শিউলি প্রচুর উপহার পাঠিয়েছে তিলকের হাত দিয়ে। সুচেতনার জন্য কার্ডিগান, ব্যাগ, প্রভাতের জন্য দামি হাতঘড়ি, মিঠির জন্য পারফিউম, চিকুর জন্য চকোলেট, কিছুই পাঠাতে ভুল হয়নি ওর। সুটকেস থেকে তিলক জিনিসগুলো বের করে সুচেতনার বসার ঘরের ডিভানটার উপর রাখছিল।
সুচেতনা ডিভানে বসে— অদূরে রকিং চেয়ারে প্রভাত তারিয়ে তারিয়ে দেখছিলেন।
— এত সব জিনিসপত্র আনার কোনও প্রয়োজন ছিল না তিলক। তুমি তো জানো আমি এ-ব্যাপারে ডায়োজিনিসের আদর্শে বিশ্বাসী— হোয়াট আর দ্য থিংস আই ক্যান ডু উইদাউট। একটা ঘড়িই তো এ-জন্মের পক্ষে যথেষ্ট— আবার এই দামি ঘড়িটা নিয়ে এ-বয়সে আমি কী করব বল দেখি? প্রভাত সস্নেহে বললেন।
— এসব আপনার শ্যালিকার ডিপার্টমেন্ট প্রভাতদা। আমি মালবাহক মাত্র, তার বেশি কিছু নয়।
— বেশ তা হলে শিউলিকেই অনুযোগ-অভিযোগ যা জানাবার জানাতে হবে, কী বলো? প্রভাত মৃদু মৃদু হাসছেন। তিলক আসার পর থেকে তাঁর মেজাজ বিশেষ রকম সুপ্রসন্ন হয়ে আছে। বিশেষ করে তিলক যে এবার তাঁর ফ্ল্যাটেই উঠেছে, সে জন্য প্রভাত খুব খুশি। আগে যেবার সুদর্শনার সঙ্গে এসেছিল, সেবার ওরা বিজয়গড়ে জুঁই-শিউলির বাবা-মার কাছেই উঠেছি। তখনও অবশ্য যাদবপুরের এই ফ্ল্যাটটা হয়নি। তালতলার দু’খোপের বাসায় জার্মানিতে থাকা শালি-ভায়রাভাইকে কোথায় থাকতে দিতেন প্রভাত? তিলক অবশ্য খুবই অ্যাকোমোডেটিভ। কিন্তু সেবার ওদের সঙ্গে সদ্যোজাত শিশুও ছিল। বাচ্চাকে দেখাতেই সেবার এসেছিল ওরা। এখন সেই শিশুরও সাত পেরোল। ভাবতে ভাবতেই জুঁইয়ের গলা কানে এল— রোদ্দুর কেমন আছে? নতুন জায়গায় অ্যাডজাস্ট করে গেছে নিশ্চয়ই।
কিছুকাল হল জার্মানি থেকে ইংল্যান্ডে চলে এসেছে ওরা। লন্ডনে বিবিসি বাংলা সার্ভিসে কাজ করে তিলক।
— হ্যাঁ, প্রথমদিকে ভাষাটা একটু প্রবলেম ছিল। শুধু জার্মান আর বাংলা ছাড়া কিছুই বলত না রোদ্দুর। এখন আবার ইংরেজিটা বলতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে।
— শিউলি কোনও চাকরি-বাকরির কথা ভাবছে না? সুচেতনা জিজ্ঞেস করলেন।
— নাঃ। তিলকের মুখে একটু ছায়া ঘনিয়েছে। ‘আমি ওকে অনেকবার বলেছি, এখন রোদ্দুর যথেষ্ট বড় হয়ে গেছে, স্কুলে যাচ্ছে। তুমি এবার চাকরি করলে তোমার নিজেরও একটা চেঞ্জ হবে। কিন্তু ও এই সংসার আর বাচ্চা মানুষ করাকেই জীবনের ব্রত করেছে। তোমার বোন তো কোনওদিক থেকেই তোমার মতো নয়।’ তিলকের গলার স্বরে একটু শ্লেষ মিশে আছে যেন।
সুচেতনা একটু অপ্রস্তুত বোধ করছেন। এটা বোধহয় তিলকের স্পর্শকাতর জায়গা। নিজে থেকে শিউলির চাকরির প্রসঙ্গ তোলা তাঁর উচিত হয়নি। প্রভাতই সামলে নিলেন। হেসে বললেন— ‘অবশ্য চাকরি-বাকরি না করে শিউলি যে খুব দোষের কিছু করেছে, তা তো নয়। সংসার, বাচ্চা এগুলোকে ও প্রাওরিটি হিসেবে নিয়েছে। তোমার তো তাতে গৌরববোধই করা উচিত। তোমার তো আর কষ্ট করে সংসার চালাতে হয় না যে, শিউলির চাকরির খুব দরকার। ও যদি ঘরে ওর নিজস্ব জগৎ তৈরি করে খুশি থাকে তো থাকতে দাও না?’
এবার তিলকও হাসছে। ‘না, আসলে শিউলি যে চাকরি করছে না তাতে আমার কোনও সমস্যা নেই। আমি শুধু ভয় পাই ভবিষ্যতে যদি কখনও ওর নিজেরই মনে হয় জীবনে ঠিক কিছুই করা হল না?’ মাথার অবিন্যস্ত চুলে আঙুল চালাতে চালাতে বলছে তিলক। চল্লিশ বছরে পৌঁছে তিলকের চুলে বেশ পাক ধরেছে। উঠেও গেছে কিছু চুল। প্রভাত তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিলেন। বিদেশবাসে তিলকের চেহারা আরও মসৃণ হয়েছে। বেড়েছে ত্বকের উজ্জ্বলতাও। ছাত্রজীবনেই হাই পাওয়ারের চশমা ছিল তিলকের। পুরু কাচের ভিতর দিয়ে উজ্জ্বল ঝকঝকে দুটি চোখ ঠিক আজও তেমনই রয়ে গেছে তিলকের। তিলক কি তার জীবনে পরিতৃপ্ত? সুখী? ঠিক বুঝতে পারেন না প্রভাত। বারান্দা দিয়ে সকালের রোদ লুটোচ্ছে বসার ঘরের মেঝেতে। ব্রেকফাস্ট খাওয়া সেরে তিনজন বসার ঘরে এসে বসেছেন। সকালের আলোয় তিলক খুব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে লক্ষ করছিল গৃহসজ্জা। শিউলিরই মতো জুঁইও খুব পরিপাটি। কিন্তু দুজনেই অধ্যাপনার সঙ্গে যুক্ত বলেই কি ঘরের সাজসজ্জায় এতটুকু বাহুল্য নেই কোথাও? একদিকে কয়েকটা গদি আর কুশন দেওয়া চারটে বেতের চেয়ার আর তার সঙ্গে মানানসই বেতের টেবিল। উপরে কাচ দেওয়া। তার উপর দু’একটা শৌখিন জিনিস। অন্যপাশে নিচু ডিভান— বাহারি কুশন এদিক-ওদিক ছড়িয়ে রয়েছে কিছু। বারান্দার দরজার পাশে বেতের একটা রকিং চেয়ার। সেটা মোটামুটি প্রভাতেরই দখলে থাকে।
সুচেতনা উঠে দাঁড়িয়েছেন। ‘কফি করি? তিলক, তোমার কি ব্ল্যাক কফি?’ ছুটির দিনে ব্রেকফাস্ট সেরে কফি খাওয়া এ-বাড়ির বহুদিনের রেওয়াজ। আজ শনিবার। সুচেতনার ডে অফ। প্রভাতেরও আজ ক্লাস থাকে না। তবু বাড়ির প্রায় উল্টোদিকেই ইউনিভার্সিটি বলে প্রভাত শনিবারও একবার ইউনিভার্সিটি চত্বরে ঢুঁ মারেন।
মিলনের দোকানে চা খেতে খেতে গল্প করেন। ডিপার্টমেন্টে নিজের ঘরে গিয়ে পড়াশুনোও করেন। কম্পিউটারেও ইদানীং কাজ করেন একটু-আধটু। আজ একটু দোনামোনার মধ্যে ছিলেন। তিলক সবে গতকাল রাতে এসেছে, আজ প্রভাত ইউনিভার্সিটি গেলে ও কিছু মনে করবে না তো? সুচেতনা ঠিক সেই মুহূর্তেই জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি কি আজ ডিপার্টমেন্টে যাবে?’
প্রভাত একটু ভাবলেন। আজ যে ওই চত্বরে না গেলে তাঁর সমূহ ক্ষতি হয়ে যাবে, এমন নয়। আসলে যাওয়াটা একটা অভ্যাসমাত্র। প্রভাতের ইতস্তত করা দেখে তিলক নিজেই বলল, ‘যাওয়ার থাকলে প্রভাতদা নিশ্চয়ই যাবেন। আমি দিনের বেলা একটা তোফা ঘুম দেব।’ প্রভাত ঘাড় নাড়লেন।
— না, আমার কোনও তাড়া নেই। দৈনন্দিন জীবনযাপন একটা অভ্যাসের মতো। আসলে, জানো তিলক, ওই যে তুমি বলছিলে না শিউলির কথা? যদি ওর কখনও পশ্চাত্তাপ হয়— মনে হয় ঠিক কিছুই করা হল না, মানুষের ওটা স্বাভাবিক মানসিকতা। এই যে আমি— ধর না কেন— জীবনে অনেক ঝড় উঠেছে, সে সব সামলে-সুমলে আমি এখন প্রতিষ্ঠিত লোক।
প্রভাত ধীরভঙ্গিতে কথা বলছেন। ‘জীবন হয়তো তেমন উজাড় করে দেয়নি আমাকে, কিন্তু বিমুখও তো করেনি। একটা নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার চাকরি, স্ত্রী, সন্তান, বাড়ি এমনকী গাড়ি অবধি এখন রয়েছে একটা— এর বেশি আমি আর কী চাইতে পারতাম? কিন্তু তবু, এসবের শেষেও দিনান্তে পৌঁছে আমারও মাঝেমধ্যে মনে হয়—’ প্রভাত একটু সময় নিচ্ছেন কীভাবে বলবেন ভাবনাটা— ‘ঠিক যেভাবে বাঁচতে চেয়েছিলাম সেভাবে কি বাঁচা হল জীবনটা? ওই যে দার্শনিক থোরো বলেছিলেন না? ‘উই লিভ বাট আ ফ্র্যাকশন অফ আওয়ার লাইফ’— কথাটা কিন্তু খুব খাঁটি। আমার মাঝে মাঝে মনে হয়, জীবনের একটা ভগ্নাংশও কি তেমনভাবে বাঁচলাম! সেভাবে জ্বলে উঠতে পারলাম কি কখনও? পারিনি। একটা মুহূর্তও বোধহয় জীবনে তেমন প্রবলভাবে বাঁচতে পারিনি। সে আমারই অক্ষমতা।’ স্বগতোক্তির ভঙ্গিতে কথা শেষ করে প্রভাত তিলকের দিকে তাকালেন। মুগ্ধভাবে বসে তিলক প্রভাতের কথা শুনছে।
— সত্যি কী সুন্দর করে কথা বলেন প্রভাতদা! সেই পুরনো ছাত্রজীবনে শুধু ক্লাসরুম-লেকচারে না, কতবার যে ক্যান্টিনে, আড্ডায় এরকম বুঁদ হয়ে শুনতাম, সেই স্মৃতিটাই প্রভাতদা ফিরিয়ে দিলেন আবার। তিলক সপ্রশংস ভাবে বলল।
সুচেতনা নিঃশব্দে কফি রেখে গেছেন। তাঁর মনেও তোলপাড় করছে পুরনো সময়ের কথা। কত বছরই বা? সতেরো-আঠারো বছর আগে। তবু মনে হয় অন্য এক যুগ। প্রভাতের এই অমোঘ সম্মোহনীর ডাকেই সাড়া দিয়েছিলেন সুচেতনা। না দিয়ে পারেননি। তিলকও ছিল প্রভাতের অতি প্রিয় ছাত্র আর গুণমুগ্ধদের একজন। মফস্সল থেকে পড়তে এসেছিল তিলক। হোস্টেলে থাকত। পড়াশুনোয় ভাল করার, জীবনে সফল হবার এক অদম্য জেদ ছিল তিলকের মধ্যে। অভাবী পরিবারের বাপ-মা হারানো ছেলে বলেই কি? দাদাদের অন্নে প্রতিপালিত তিলক মুখচোরা হলেও ওর ভিতরের জেদই ওকে চালিয়ে নিয়ে যেত। তিলক ছিল সুচেতনার ঘনিষ্ঠতম বন্ধুদের একজন। সেই সময় থেকেই অন্যদের থেকে নিজেকে কিছুটা আলাদা করে নিয়েছিল ও। তাঁদের সময়ও বন্ধুদের পরস্পরকে ‘তুই’ বলাটা চালু ছিল। তিলক কিন্তু কিছুতেই ‘তুই’ বলতে পারত না মেয়েদের। মেয়েদের সম্পর্কে ওর অকারণ আড়ষ্টতা ছিল একটু। সুচেতনার সম্পর্কে সেটা আরই বেশি। তিলকের মনে কবে যে সুচেতনা সম্পর্কে বিশেষ আকর্ষণ জন্ম নিয়েছিল, তা মনে নেই সুচেতনার। তবে তিলক তা মুখ ফুটে স্পষ্ট করেছিল অনেক পরে।
— সুচেতনা, আজ ছুটির পরে আমার জন্য একটু সময় দিতে পারবে? কতগুলো কথা আলোচনা করার ছিল।
‘আজ?’ সুচেতনা প্রমাদ গুনেছিল। তিলক যে ওকে প্রেম নিবেদন করার জন্য ঝিলের দিকে নিয়ে যেতে চাইছে, তা মাথাতেই আসেনি ওর। সুচেতনার তখন প্রভাতের সঙ্গে সম্পর্ক সবে শুরু হয়েছে। সেই প্রেমের গোপনীয়তা রক্ষার জন্য ও এমনিতেই দিশেহারা। সেই সম্পর্কের খবর কোনওভাবে তিলকের কানে উঠেছে, হয়তো তিলক সেজন্যই ওকে সাবধান করে দিতে চায়, এরকম অনুমান করেছিল সুচেতনা।
‘হ্যাঁ, ব্যাপারটা খোলাখুলি বললেই ভাল হত।’ তিলকের মুখে একটু লালের ছোঁয়া। নিজের দুশ্চিন্তায় মশগুল সুচেতনা আলাদা করে খেয়াল করতে পারেনি তা। তৎক্ষণাৎ সম্মত হয়েছিল ঝিলের পাড়ে নিরিবিলিতে যেতে।
‘কী ব্যাপার বলো তো?’ দুশ্চিন্তায় নিজের গলা নিজের কাছেই ভারী মনে হয়েছিল সুচেতনার। কী বলতে চায় তিলক? ও মনে মনে ঠিক করেই এসেছিল তিলক যদি প্রভাতের সঙ্গে প্রেম সম্পর্কে কিছু আঁচ করে বারণ করতে আসে, তবে ও স্পষ্টই বলবে এ-বিষয়ে কথা বলা তিলকের পক্ষে অনধিকারচর্চা, তা সে তিলক যতই বন্ধু হোক না কেন। কিন্তু তিলক ও প্রসঙ্গে যায়ইনি। বরং যা বলেছিল— তার জন্য একেবারেই প্রস্তুত ছিল না সুচেতনা।
‘তুমি কি সত্যিই বোঝো না সুচেতনা! এতদিনেও বোঝোনি?’
‘কী বুঝব তিলক?’ সুচেতনা অবাক ভাবে বলেছিল।
‘আমি তোমাকে কীরকম ভালবাসি! তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচব না সুচেতনা।’ আবেগে গলা বুজে আসছিল তিলকের।
সুচেতনা তড়িৎস্পৃষ্ট হয়েছিল। অনেকক্ষণ কিছু বলতে পারেনি। তিলক ততদিনে ওর নিজেরও খুব প্রিয় বন্ধু। কখনওই তিলককে ও অপছন্দ করত না। কিন্তু প্রভাতকে আগেই ভালবেসে ফেলেছে ও। বয়সে অনেক বড় অধ্যাপকের জন্য সেই প্রেমে বড় জায়গা নিয়েছিল শ্রদ্ধা। কী জবাব দেবে তিলককে সেদিন বুঝতে পারেনি সুচেতনা। শেষে বলেছিল, ‘এ হয় না তিলক। হতে পারে না।’
‘কেন? কেন নয় সুচেতনা? তোমার মনে কি আমার জন্য একটুও জায়গা নেই?’ তিলকের আকুলতা দেখে মায়া হচ্ছিল সুচেতনার। ও বলেছিল, ‘তুমি আমার খুব বড় বন্ধু তিলক। খুব কাছের। কিন্তু আমি আরেকজনকে ভালবাসি। আমার উপায় নেই।’
‘কে? আমাদের ক্লাসের কেউ? আমি চিনি?’ সুচেতনা ঘাড় নেড়েছিল। ও এ বিষয়ে আর কিছু বলবে না। পরে কখনও তিলক নিশ্চয়ই জানতে পারবে সব। আর জোর করেনি তিলক। কোনও অতিনাটকীয়তা দেখায়নি। আর দু’চারটে কথার পর ওরা যে যার পথে চলে গিয়েছিল।
কয়েক মাস পরে যখন চত্বরে কানাঘুষো শুরু হল, তখন সুচেতনাকে সবচেয়ে বেশি সাপোর্ট দিয়েছিল তিলক। ‘যে যা বলে গায়ে মেখো না, এটা তোমার নিজস্ব ডিসিশন’ বলত ও। সুচেতনার সঙ্গে বন্ধুত্বে ছেদ পড়তে দেয়নি ও। সুচেতনাই আড়ষ্ট হয়ে গেছিল। বহুদিন পর্যন্ত তিলকের সঙ্গে সহজভাবে কথা বলতে পারত না ও।
আস্তে আস্তে সহজ হয়েছিল সব। তিলক যখন জার্মনিতে চাকরি পেল, তার আগেই সুচেতনা ওকে আলাপ করিয়ে দিয়েছে সুদর্শনার সঙ্গে।
‘আমার বোন, কিন্তু কোনও দিক থেকে আমার চেয়ে একচুলও কম নয়।’
‘কথাটার মধ্যে কি কোনও সাজেশন আছে?’ তিলক জানতে চেয়েছিল।
‘অ্যাজ ইউ ইন্টারপ্রেট। তবে আমার পরামর্শ ভেবে দেখতে পারো।’ বেশ হালকা মেজাজেই বলেছিল সুচেতনা।
‘তুমি খুশি হবে?’ তিলক জানতে চেয়েছিল।
‘অফ কোর্স! আমার বোনের সঙ্গে আমার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধুর কিছু হলে, আমি তো খুশি হবই।’ সুচেতনা একটু প্রগলভ ভাবে বলেছিল। তার কয়েকদিন আগে ও এক রাতের জন্য ডায়মন্ডহারবার ঘুরে এসেছে প্রভাতের সঙ্গে। তখন নিষিদ্ধ আগুনের হলকা ছুটছে ওর সারা শরীরে।
খুব সতর্কভাবে এগিয়েছিল তিলক। শিউলি-র সঙ্গে প্রেম থেকে বিয়ের পর্বে সময় নিয়েছিল কিছুটা। শিউলির মা-বাবা তিলককে গোড়া থেকেই পছন্দ করেছিলেন। শিক্ষিত, মেধাবী ছেলে। বিদেশে চাকরির বন্দোবস্ত প্রায় পাকা। এমন ছেলেকে হাতছাড়া করতে কে চায়? গোটা ব্যাপারটায় সুচেতনার এক ধরনের নীরব সম্মতি ছিল। ওর আর তিলকের মধ্যে গোপন আন্টারস্ট্যান্ডিং ছিল আগাগোড়া। আজ বহু বছর পর যখন তিলক বলল— ‘তোমার বোন তো কোনও দিক থেকেই তোমার মতো নয়’, তখন ও যেন হঠাৎ সেই গোপন চুক্তির কথাই মনে করিয়ে দিতে চাইল সুচেতনাকে। যেন বলতে চাইল, ‘তুমি চুক্তি ভঙ্গ করেছ। তোমাকেই দায় নিতে হবে।’
সারাদিন ঘুরেফিরে এসব কথাই ভাবছেন সুচেতনা। কেন জানি না গভীর একটা অপরাধবোধ কাজ করছে মাথার ভিতর।
সারাদিন তিলক লম্বা ঘুম দিচ্ছে। কফি খেয়ে প্রভাত বেরিয়ে গেছেন অনেকক্ষণ। বিকেলের আগে ফিরবেন না। মিঠি চিকুকে নিয়ে এক বন্ধুর বাড়ি নিমন্ত্রণ গেছে। সন্ধের আগে ফিরবে না। গড়িয়াহাটে কয়েকটা জিনিস কেনার রয়েছে। দুপুরে একবার চট করে বেরিয়ে কিনে আনলে হয়। ভাবামাত্র চট করে তৈরি হয়ে নিলেন সুচেতনা।
***
বাড়ি ফিরে অভিমন্যু দেখল দাদু আর দিদান পিছনের ব্যালকনিতে চায়ের সরঞ্জাম সাজিয়ে বসে আছে।
‘দাদুভাই, একদম চানটা সেরে এসো। ফ্রেশ হয়ে এলে শরীরের ক্লান্তি যাবে।’ দিদান হেঁকে বলছেন।
‘না না, এই অবেলায় চান করবার দরকার নেই। অভি বরং হাতমুখ ধুয়ে আসুক।’ দাদুর মৃদু প্রতিবাদ। ঝঙ্কার দিয়ে থামিয়ে দিচ্ছেন অদিতি— ‘থামো তো। কোলেপিঠে করে মানুষ করেছি— ওর ধাত তুমি আমাকে বোঝাবে? দিনের শেষে চান না করলে ওর জুত হয় না, সে-কথা ভুলে গেছ?’
‘আহা, সে সব আগে ছিল— এখন বিদেশে ওর হ্যাবিট্স বদলেছে কিনা— তারপর এখানে ওয়েদারের সঙ্গে অ্যাকাস্টমড হবারও একটা ব্যাপার আছে—’ শুভঙ্কর হাল ছাড়েন না। নিজের ঘরের থেকে টুকরো টুকরো কথাগুলো কানে ভেসে আসছে অভিমন্যুর। আজ দিদানের গলায় বিশেষ খুশির সুর। মনমেজাজ খুব প্রসন্ন থাকলে দিদান ‘অভি’ না বলে ‘দাদুভাই’ বলে ডাকে। অভিমন্যু অনেক ভেবে দেখেছে, দিদানের মনে তার জন্য একটা বিশেষ অধিকারবোধের জায়গা আছে। বাস্তবিকই দিদান তাকে কোলেপিঠে করে মানুষ করেছেন সেই ছোটবেলা থেকে। মা ছিল না বলে মায়ের বাড়া করেছে। তার থেকেই ধীরে ধীরে তৈরি হয়েছে অধিকারবোধের জায়গাটা। অদিতি যখন গর্ব করে লোকজনকে বলেন, ‘এটা আমার অভির ঘর’, কিংবা ‘আমি রান্না না করলে পছন্দ করে না অভি, ওইজন্য রান্নার লোক রাখি না’ তখন সেই সব কথার মধ্য দিয়েও একমাত্র নাতির সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের বিশিষ্ট জায়গাটা পরিষ্কার হয়ে যায়। দাদুর ব্যাপারটা বরং অনেক বেশি সূক্ষ্ম, জটিল। দাদু আজ পর্যন্ত কখনও অভি-কে ‘টেকেন ফর গ্রান্টেড’ বলে ধরে নেননি। বরং তার নিজস্ব মতামত, ইচ্ছে— সবকিছুকে বরাবর মূল্য দিয়েছেন। ঠিক যেমন এখনও বিদেশ বসবাসের ফলে যে অভি-র প্রাত্যহিক অভ্যাস, জীবনযাপনে কিছু পরিবর্তন আসতে পারে, এ-কথাটা দাদুরই মাথায় এসেছে, দিদানের নয়। যে কারণেই হোক অভিমন্যুর দাদুর প্রতি এক গভীর মমত্ববোধ আছে। একমাত্র সন্তানবিয়োগ থেকে শুরু করে নাতিকে পালন-পোষণ করে বড় করে তোলা— সবকিছুই শর্তহীন মেনে নিয়েছেন শুভঙ্কর। স্ত্রী হিসেবে অদিতির তুলনা নেই সত্যি, সারা জীবন দশ হাতে সংসারের হাল ধরেছিলেন বলেই শুভঙ্করের কোনও অর্থকষ্ট নেই। শুভঙ্কর খারাপ চাকরি করতেন না, তবু সরকারি চাকরির বাঁধা মাস-মাইনেতে সংসার চালিয়ে অভিমন্যুর পড়ার খরচ চালিয়েছেন। রিটায়ারমেন্টের আগেই রিজেন্ট এস্টেটে দোতলা বাড়ি করতে পেরেছেন। অদিতি না থাকলে এসব সম্ভব হত না। এমনকী অভিমন্যুর মা-বাবার মৃত্যুর পরে যখন লাইফ ইনশিওরেন্স থেকে মোটা টাকা পাওয়া গিয়েছিল, তখনও সেই টাকা বা মেয়ে-জামাইয়ের ডাক্তার হিসেবে রোজগারের সঞ্চিত টাকায় হাত পড়তে দেননি শুভঙ্কর। পুরোটা ফিক্সড ডিপোজিট করে রেখেছিলেন অভিমন্যুর নামে। সেই টাকা বাড়তে বাড়তে নেহাত কম হয়নি। বড় হবার পর এইসব গল্পের ছলে বলেছিলেন দিদান। ও বিদেশে পড়তে যাবার আগে বুঝিয়ে দিয়েছিল সব কাগজপত্র। আগেরবার আমেরিকা থেকে ফিরে অভিমন্যু একবার দাদুনকে বলি বলি করে বলেই ফেলেছিল, ‘দাদু আমি এখন রোজগার করছি। ডলারে আর্নিং এখানকার টাকার তুলনায় অনেক বেশি। আমার নামে বাবা-মা’র যা টাকা রয়েছে, আমার ইচ্ছে সেটা তোমরা নাও— অন্তত একটা অংশ— সারাজীবন তো কষ্ট করলে।’
পুরো কথা শেষ করার আগেই থমকে গেছিল ও। দাদু হাই পাওয়ারের চশমার ফাঁক দিয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন ওর দিকে। ‘ঋণ শোধ করতে চাইছ?’ সামান্য প্রশ্ন, তবু তার মধ্যে যেন বিদ্যুতের কশাঘাত লুকিয়ে।
ওর মুখে বেদনার ছাপ লক্ষ করেই দিদান বাধা দিয়েছিলেন তৎক্ষণাৎ। ‘সব কথাকে বেঁকিয়ে নাও কেন? ও কি বলেছে ঋণশোধের কথা? বড় হয়েছে, রোজগার করছে তাই আমাদের দিতে ওর মন চাইছে’ পরিস্থিতি সহজ করার চেষ্টা করেছিলেন দিদান।
দাদু চুপ করেছিল একটু। তার পর বলেছিলেন, ‘নিজের মৃত সন্তানের জীবনের দাম হিসেবে যে-টাকা এসেছে— তা দিয়ে ফুর্তি করার আগে আমার যেন মৃত্যু হয়।’ কথাগুলো বলে চেয়ার ছেড়ে উঠে চলে গিয়েছিলেন শুভঙ্কর। থমথমে হয়ে গেছিল পরিবেশ। সেই ঘটনার পরদিন শুভঙ্করের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিয়েছিল অভিমন্যু।
শুভঙ্করের আত্মমর্যাদাবোধের সামনে পড়তে চায় না অভিমন্যু। এবার ক্রমে দিদানের মাধ্যমে প্রস্তাব পেড়েছিল বিয়ের খরচ কিছুটা হলেও ও নিজে দেবে। শুভঙ্কর রাজি হননি। ‘আমেরিকায় টাকা গাছে ফলছে নাকি এখন? তোমার রোজগার করা অর্থ রেখে দাও ভবিষ্যতের কাজে। বউকে নিয়ে বছরে একবার আসতে গেলেই তো কত খরচ’, বলেছেন শুভঙ্কর। তারপরে একটু থেমে বলেছেন, ‘তাছাড়া আমার কথাও ভাব। লোকের তিনটি দায় থাকে। পিতৃদায়, মাতৃদায়, কন্যাদায়। সেগুলি ছাড়া আমি কন্যার পারলৌকিক ক্রিয়া অবধি করেছি। খুকু তোমাকে আমার কাছে দিয়ে গেছে। তোমাকে বিয়ে দিয়ে সংসারে থিতু করে দেওয়া আমার কন্যার সঙ্গে সম্পর্কিত। কন্যাদায়েরই এক্সটেশন বলতে পারো।’
খুব সহজ-স্বাভাবিক ভঙ্গিতে কথাগুলো বলছিলেন শুভঙ্কর। মুখের একটি রেখাও কাঁপছিল না। অদিতি তাঁর মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলেছিলেন, ‘তোর দাদু এবার বাড়িটাও তোর নামে মিউটেশন করিয়ে দেবেন ঠিক করেছেন। না করলেও ক্ষতি নেই। উইলে যাবতীয় বিষয়-আশয়ের তুই-ই নমিনি। তোর বিয়ের জন্য কত শখ করে বাড়ি সাজাচ্ছি, বাজার করছি— এসব নিয়েই তো বেঁচে থাকা। আমাদের আর কে আছে বল?’ অভিমন্যুর চোখে জল এসেছিল। জীবনের প্রান্তে এসে তাকে ঘিরেই স্বপ্ন দেখছে বৃদ্ধ দম্পতি।
‘তাহলে তোমরাও আমাকে কথা দাও— এবার পাকাপাকি ভাবে এখানকার বাস তুলে আমার কাছে গিয়ে থাকবে তোমরা। গ্রিন কার্ড পেলেই তোমাদের নিয়ে যাব আমি।’
শুভঙ্করের মুখে একটা প্রসন্নতা খেলা করছিল। অদিতি হাসছেন। ‘আচ্ছা পাগল তুই দাদুভাই। এবার বিয়ে করতে এসেছিস, কোথায় বউকে নিয়ে যাবার কথা ভাববি, তা নয়— বুড়ো-বুড়িকে নিয়ে যাবার তাল করছিস।’
‘দাদু, আমি ওসব জানি না, তোমরা যাবে কি না বলো।’ জেদি ভাবে বলেছিল অভিমন্যু।
এবার শুভঙ্করও হাসছেন মিটিমিটি।
‘আগে স্ত্রীকে নিয়ে সংসারী হও। থিতু হও। তারপরে গ্রিন কার্ড পেয়ে যাবার পর— তখনও যদি তোমার মনে হয় দাদু-দিদানকে এ দেশটা দেখানো দরকার— তাহলে নিশ্চয়ই যাব তোমার কাছে বেড়াতে।’
‘বেড়াতে’ শব্দটা ব্যবহার করলেন শুভঙ্কর। অভিমন্যুর কান এড়াল না। ‘বেড়াতে না, থাকতে যাবে আমার কাছে।’ কাটা কাটা ভাবে বলল ও।
শুভঙ্কর হাসলেন। ‘আসলে কী জানো? তোমার এখন উঠতি বয়স। সামনে গোটা জীবনটা পড়ে আছে। কত স্বপ্ন, কত আকাঙ্ক্ষা। আমাদের তো জীবনের বেশির ভাগটাই পার হয়ে গেছে। এখন আর নতুন করে নতুন জায়গায় বসবাস মন চায় না। মনে হয় এই চেনা গণ্ডিটুকুই আপন। এটাই আমার নিজের জায়গা। আমার দেশ। এই মাটিতেই শেষ নিঃশ্বাসটা ফেলতে চাই আমি।’
অভিমন্যুর হঠাৎ বহুদিন বাদে মনে পড়ল, দাদু একজন স্বাধীনতা সংগ্রামী। বিয়াল্লিশের আন্দোলনে জেলখাটা মানুষ। গান্ধীর ডাকে সাড়া দিয়ে দেশের মানুষ কীভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল ‘কুইট ইন্ডিয়া’ মুভমেন্টে, অভিমন্যুর শৈশবে সেই গল্প অনেকবার করেছেন দাদু। সরকার স্বাধীনতা সংগ্রামীদের তাম্রফলক দিচ্ছে, সম্বর্ধনা দিচ্ছে দেখে দিদান একবার অনুযোগ করেছিলেন, ‘এত লোককে গভর্নমেন্ট সম্মান জানাচ্ছে, তুমি তো একবার লিখতে পারো যে তুমি ফ্রিডম ফাইটার ছিলে।’
শুভঙ্কর জিভ কেটে বলেছিলেন, ‘কী যে বলো! আমাকে ফ্রিডম ফাইটার বললে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের অপমান করা হয়। আমি তো চুনোপুঁটি। ওই সময় যারা ছাত্র ছিল— তারা দলে দলে মিটিং-মিছিল করেছিল, কতজন গান্ধীর ডাকে ঘর ছেড়ে প্রাণ বিপন্ন করে লড়াই করেছিল। আমি তো কিছুই না।’
‘তুমিও তো জেল খেটেছিলে? খাটোনি?’ অদিতি তাও হাল ছাড়েননি।
‘ওটাকে জেলখাটা বলে না। আমাদের এলাকায় বন্ধুরা সবাই যাচ্ছিল। কানু, হারু ওদের সঙ্গে আমিও গেছিলাম দল ভারী করতে। পরদিনই বাবা জামিনে ছাড়িয়ে এনেছিলেন। এক দিনের হাজতবাসকে জেলখাটা বলে না। ছিঁচকে চোরের সঙ্গে দাগি আসামির যা তফাত, আমার সঙ্গে স্বাধীনতার আসল যোদ্ধাদের তফাত ততটা। মূল্যবোধটা শুধু একরকম ছিল। ওইখানে কোনও খামতি ছিল না। কোনও কম্প্রোমাইজ ছিল না— শুভঙ্কর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলেছিলেন।
ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র