বুদ্ধদেব দাশগুপ্তকে প্রথম সরাসরি দেখেছিলাম একটা প্রেস কনফারেন্সে, ওঁর কোনও একটা ছবির পরে। ঠিক প্রেস কনফারেন্স নয়, সেখানে দর্শকরা ওঁর সঙ্গে কথাবার্তা বলতে পারবেন। বুদ্ধদেব বারবার বলছিলেন তাঁর সিনেমার সঙ্গে কবিতার সামীপ্যের কথা, আর বলছিলেন, তিনি ছবি করার সময়ও নিজেকে মূলত কবিই মনে করেন। আমার শুনে খুব অবাক লেগেছিল, কারণ আমার ধারণা ছিল এই শিল্পমাধ্যম দুটো খুব খানিক আলাদা, একটার ছাপ অন্যটায় এসে পড়লেও, তা নিয়ন্ত্রক বা নির্ধারক হতে পারে না। একটু পরে এক ভদ্রলোক উঠে মাইকের কাছে গিয়ে রসিয়ে রসিয়ে বুদ্ধদেবকে বললেন, এতদিন ধরে এত ছবি করলেন, কই, মানুষ তো আপনার ছবি নিল না! আমরা সবাই হাততালি দিয়ে উঠলাম, হো-হো হাসির রোল উঠল। বুদ্ধদা খুব রেগে মুখ লাল করে যে উত্তরটা দিলেন তা মোটামুটি এরকম, এমনকী সত্যজিৎ রায়েরও বেশিরভাগ ছবি বাণিজ্যিক সাফল্য পায়নি, তাতে কি তাঁর নৈপুণ্য খর্ব হয়ে গেছে? বেশ কয়েকদিন পরে, রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে যখন ভেবেছি, ওই প্রশ্নকর্তা কী বলতে চেয়েছিলেন (যদি অধিকাংশ মানুষ গ্রহণ না করে তাহলে শিল্প নিরর্থক ও অসার্থক) আর বুদ্ধদেব কী বলতে চেয়েছিলেন (জনপ্রিয়তা কখনও শিল্পের উৎকর্ষের সূচক হতে পারে না), আর আমি নিজে শিল্পকে কীভাবে দেখতে চাই— তখন ওই হাসি আমিও হেসেছিলাম বলে খুব লজ্জা হয়েছে। আসলে, বিখ্যাত ব্যক্তিকে অপদস্থ হতে দেখলে খুব আমোদ পাওয়া আমাদের মধ্যে বোনা আছে, ওটাকে আমরা সাধারণত বিপ্লব বলে চালিয়ে থাকি। আজ যখন দেখি, মোটামুটিভাবে ওই প্রশ্নকর্তার মতো (ও সে-মত প্রকাশের ভঙ্গি) সর্বজনীন ও সর্বজনমান্য হয়ে উঠছে, তখন ওই সভার কথা মনে পড়ে, আর খুব জোরে মনে হয়, হাততালি জোগাড় করার জন্যে যেন কখনও ওই শিবিরে যোগ না দিই।
এরপর বুদ্ধদেবকে মুখোমুখি দেখলাম সত্যজিৎ রায় ফিল্ম ইনস্টিটিউটের প্রবেশিকা-পরীক্ষার ইন্টারভিউ দিতে গিয়ে। বুদ্ধদেব সেই বোর্ডের মধ্যমণি হয়ে বসে ছিলেন, আরও মানীগুণী ব্যক্তি ছিলেন কয়েকজন। সাধ্যমতো উত্তর-টুত্তর দিলাম। এক সময় মনে হল, উতরে গেছি। বুদ্ধদেব আমায় প্রশ্ন করলেন, সবচেয়ে প্রিয় ভারতীয় ছবি কী? আমি ‘পথের পাঁচালী’ বলতে একটু অবাক হলেন মনে হল। কারণ এর চেয়ে ক্লিশে-উত্তর কিছু হয় না। কে একজন জিজ্ঞেস করলেন, সিনেমার সঙ্গে স্বপ্নের সম্পর্ক বলো। কোনওমতে বুনুয়েল-টুনুয়েল আউড়ে ম্যানেজ করলাম। উঠে আসব-আসব, এমন সময় বুদ্ধদেব আমাকে ইকনমিক্স-এর একটা বেয়াড়া প্রশ্ন হেনে বসলেন। আমি একেবারে ক্লিন বোল্ড হওয়ার মতো হাঁ করে তাকিয়ে আছি দেখে বললেন, ‘আমি ইকনমিক্স পড়েছি। তোমার রেজিউমে-তে লেখা, তুমিও ইকনমিক্স পড়েছ। তা, ইকনমিক্সের স্টুডেন্ট হয়ে এই সহজ মডেলটা বুঝিয়ে দিতে পারছ না?’ মুশকিল হচ্ছে, বুদ্ধদেব তো ওই শাস্ত্রটা পড়েছেন মন দিয়ে। আর আমি বেহদ্দ ফাঁকি মেরেছি। পারব কী করে? অনেকটা ইংরেজি আর অনেকটা কৌতুকবোধ জড়ো করে উত্তর দিলাম, আমি নিজের মন থেকে অর্থনীতি সম্পূর্ণ ধুয়ে ফেলে গ্লানিমুক্ত হয়েছি ও চিত্তশুদ্ধির জন্য সিনেমায় ঝাঁপ দিয়েছি। সবাই খুব হেসে উঠলেন, সে-যাত্রা মুক্তি পেলাম।
ইনস্টিটিউটে কিছুদিন পড়ার পর, একদিন বুদ্ধদেব তাঁর পরিচালিত ‘লাল দরজা’ ছবিটা দেখাবার জন্যে ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে গেলেন গোর্কি সদন-এ। আমি বসেছি ঠিক তাঁর সামনে। সে যে কী অস্বস্তি, এক পরিচালকের এতখানি কাছে বসে তাঁর ছবি দেখা। শুধু মনে হচ্ছে, একবার গা-মোড়ামুড়ি দিলে যদি উনি ভেবে বসেন আমার একঘেয়ে লাগছে! একবার হাই তুললে যদি উনি ক্ষুণ্ণ হন! একবার পাশের ছেলেটার সঙ্গে ইয়ার্কি দিলে যদি উনি রাগ করেন! আমি না-হয় সিনেমা দেখছি, উনি নির্ঘাত আমাদের দেখছেন, প্রতিক্রিয়া আন্দাজ করছেন! ছবি শেষ হতে একটুও না-দাঁড়িয়ে রাস্তায় বেরিয়ে এলাম। ‘কেমন লেগেছে’ জিজ্ঞেস করলে উত্তর দেব কী? অমন কাঁটা হয়ে বসে, এগজামিন-মোডে ছবি উপভোগ করা যায়?
তারপর ইনস্টিটিউটে গণ্ডগোল লাগল। আমরা ছাত্রদের তরফ থেকে ক্লাস বয়কট করলাম। কর্তৃপক্ষের অনেক কিছু আমাদের পছন্দ ছিল না। কর্তৃপক্ষের মূল প্রতিভূ বুদ্ধদেব। আমরা ওঁর ইস্তফা দাবি করলাম। বহুদিন ধরে হুলুস্থুলু চলল। আমিও একজন নেতা গোছের ছিলাম। ক্লাসে বা করিডোরে বুদ্ধদেবের বিরুদ্ধে স্লোগান বেশ চেঁচামেচি করে দিলেও, তাঁর ঘরে ওঁর সামনে গিয়ে, খুব চিৎকার করে ওঁর নাকের সামনে আঙুল নেড়ে কথা বলতে পারতাম না। এজন্য আমার বেশ নিন্দে হত। কিন্তু বুদ্ধদেব এমন যুক্তি দিয়ে তাঁর অবস্থানটা বোঝাবার চেষ্টা করতেন, তাঁর সঙ্গে তর্ক করার সময় কর্কশতা প্রয়োজন হত না। মুশকিল হচ্ছে, অনেকের ধারণা ছিল (এখন ছাত্র আন্দোলনের রকম দেখে মনে হয়, অধিকাংশের ধারণা তা-ই) রূঢ়তাই দৃঢ়তার একমাত্র অভিজ্ঞান। তাই বুদ্ধদেবের ঘরে টাঙানো তারকভস্কির কোটেশন (যেখানে তারকভস্কি মিডিওক্রিটির বিরুদ্ধে কথা বলছেন) বেঁকিয়ে-বেঁকিয়ে ভেঙিয়ে-ভেঙিয়ে কোরাসে পড়া হত। সঙ্গত আন্দোলনের ভঙ্গিও যে সভ্য ও শালীন হওয়া প্রয়োজন, তা ভেতরে কতকটা বুঝতে পারতাম, কিন্তু স্পষ্ট করে ভাবনাটাকে রূপ দিতে পারতাম না, প্রকাশ করার সাহস তো ছিলই না।
বহুদিন পরে, যখন আনন্দবাজারে রবিবারের ক্রোড়পত্রটা দেখাশোনা করার কিছুটা দায়িত্ব পেয়েছি, ঠিক হল, বুদ্ধদেবকে একটা কলাম লেখার কথা বলা হবে। রাজি হলেন, কলামের নাম দিলেন ‘কাগের ছা বগের ছা’। লেখা পড়ে একদম মুগ্ধ হয়ে গেলাম। উনি যে একজন সাহিত্যিকও, এ কথাটা সত্যিই একেবারেই মনে ছিল না। একদিন বাড়িতে ডাকলেন। অফিসের এক সহকর্মীই নিয়ে গেলেন সেখানে। গিয়ে ঝাল ফিশফ্রাই খেলাম, আর বুদ্ধদেব অনেক গল্প করলেন সিনেমা নিয়ে। আমি সিনেমা করছি না কেন, উনি কোনও সাহায্য করতে পারেন কি না, জিজ্ঞেস করলেন। দেখলাম, আগের কাণ্ডাকাণ্ডের রেশ ধরে এতটুকু তিক্ততা তো পুষে রাখেনইনি, উল্টে একজন ফিল্ম ইনস্টিটিউটের ছাত্র কেন তার প্রথম প্রেমকে ছেড়ে কাগজের অফিসে ব্যস্ত থাকবে, তা নিয়ে একদম দাদার মতোই বকছেন। স্নেহ ও নীতি মিশ্রিত এই তিরস্কারের উদারতা অনেকক্ষণ মথিত রেখেছিল। আমি কথা ঘোরাবার জন্য কবিতার প্রসঙ্গ পাড়লাম। বললাম, কেউ আর কবিতা পড়ে না। উনি বললেন, ‘কোনওদিনই খুব বেশি লোক কবিতা পড়ত না, এখনও পড়ে না। আগে যতজন কবিতা পড়ত, এখনও তত লোক কবিতার প্রতি উৎসাহী। অত হতাশ হওয়ার তো কিছু নেই।’ সিনেমা এবং কবিতাকে এতদিন ধরে এভাবে সমান ভালবেসে যেতে কম লোককেই দেখেছি। ওঁর কলাম-টা অবশ্য হুট করে বন্ধ হয়ে গেল, কারণ ক্রোড়পত্রের ধরনটাই বদলে গেল। আমার বেশ দুঃখ হল ওঁর লেখাটার কথা ভেবে, এই জন্য নয় যে ওঁর স্মৃতিচারণায় বিশ্বের বহু বড় পরিচালকের বা কবির সান্নিধ্যের কথা উঠে আসছিল, বা এমন একটা যুগ আমাদের সামনে উন্মোচিত হচ্ছিল যার উত্তেজনা পোয়াতে আমাদের এখনও ভাল লাগে, সবচেয়ে বেশি এইজন্যে যে এমন ঝরঝরে গদ্যে এমন শিক্ষিত একটা লেখার সিরিজ সম্পূর্ণ হলে বাংলা সাহিত্য উপকৃত হত।
যখন আমরা এই বছর অনেকে মিলে ‘ডাকবাংলা’ চালু করলাম, সঙ্গে সঙ্গে ওঁকে একটা কলামের কথা বললাম। রাজি হলেন। নাম দিলেন ‘এলেবেলে’। যথারীতি তরতর করছে লেখা, সঙ্গে প্রখর পর্যবেক্ষণ, স্নিগ্ধ কৌতুক। আমরা অপেক্ষা করে থাকতাম লেখাটার জন্য। অসুস্থতার কারণে খুব একটা নিয়মিত লিখতে পারবেন না বললেন, তাই মাসে একটা লেখা যাবে, ঠিক হল। এই গত মাসে বললেন, এখন থেকে পনেরো দিন অন্তর লিখতে পারবেন। আমরা ভাবলাম, এ তো দারুণ হল, ক’দিন পর নতুন ফ্রিকোয়েন্সির কথা ঘোষণা করব। শঙ্খবাবু মারা যাওয়ার পর যেচে একটা লেখা লিখতে চাইলেন। মেসেজ করলেন, ‘একটা লেখা মনে মনে তৈরি হয়ে আছে। অবিচুয়ারি নয় একেবারেই…’ আমরা বললাম এক্ষুনি লিখুন, আর পড়ে এত ভাল লাগল, সমীহ আর ভালবাসা ভর্তি একটা লেখা, কিন্তু এতটুকু অবান্তর ফেনা নেই, মোক্ষম শব্দসন্ধান আছে, এক জায়গায় বলছেন, ‘শঙ্খ ঘোষ বাংলা কবিতার রাজ্যে সবচেয়ে বর্মহীন কবি।’ ভাবছিলাম, উনি যখন নিজেই বলছেন আরও দ্রুত লিখতে পারবেন, এতটা উৎসুক যখন লেখার জন্য, নিশ্চয়ই অনেকগুলো লেখা খুব তাড়াতাড়ি পেয়ে যাব। নির্ঘাত আমার মনে মনে একটা ক্ষতিপূরণের আকাঙ্ক্ষাও ছিল, এইবার তো আর কলামটা বন্ধ হবে না, একটা ভাল বই হবেই। কিন্তু এই কলাম-টাও হল না, হয়তো কিছু জিনিস অসম্পূর্ণ থাকার নিয়তি নিয়েই শুরু হয়।
এখন মনে হচ্ছে, যেমন কেউ চলে গেলে প্রথমেই মনে হয়, সঙ্গ পাওয়ার সুযোগ থাকলেও, যাইনি কেন, কথা বলিনি কেন। বাড়িতে যেতে ডেকেছেন, যাইনি, ফোনে কাজ সেরে নিয়েছি। সঙ্কোচও হত, আর হাবিজাবি কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখার শিল্প তো আমরা সকলেই আয়ত্ত করেছি। একটা ছোট ছবি করেছিলাম বছরখানেক আগে, শুটিং-এর সময় বলেছিলেন, ‘ছবি হয়ে গেলে খবর দিও, আমি ওই সাইটে গিয়ে দেখব।’ তৈরির পর মনে হল সেটা এমন কিছু ভাল হয়নি, আর খবর দিলাম না। এমনকী এই কলাম-টা নিয়ে কথাবার্তাও, অনেকবার ওঁর সঙ্গে না বলে সোহিনীর সঙ্গেই বলে নিয়েছি, বা মেসেজ করে দিয়েছি, থাক, অসুস্থ মানুষটাকে শুধু শুধু বিরক্ত করব না। এখন মনে হচ্ছে, গায়ে পড়ে একটু কথা বলে নিলে মন্দ হত না। সিনেমা-গত প্রাণ একজন শিল্পী, যিনি সারাজীবন কক্ষনও জনরুচির সঙ্গে এতটুকু আপোস করেননি, আর কবিতাকে নিঃশেষে প্রবেশাধিকার দিয়েছেন দৃশ্যের পর দৃশ্যে, তিনি যদি তাঁর অভিজ্ঞতা ও ধারণার কথা বলতেন অনেকটা, আর আমি আহরণ করতে পারতাম, অনেকটা ভাবনা-রসদ থাকত। কিন্তু কিছু জিনিস শেষ হয় না, শেষ না-হওয়ার জন্যেই শুরু হয়, তার ফাঁকটা আন্দাজ দিয়ে পূরণ করতে হয়, বুদ্ধদেব হয়তো বলবেন, সেইটাই কবিতা। বা হেসে বলবেন, এলেবেলে ও কাগের ছা বগের ছা না-ভেবে, নিজের কাজে মন দাও। অথবা বলবেন এসব আফশোসও মিডিওক্রিটির লক্ষণ, কারণ, একজন শিল্পীর সান্নিধ্য তো তাঁর শিল্প-সঙ্গ করলেই পাওয়া যায়।