নাগাড়ে চারপাশের সব জীব আর জড়কে খোঁচানো মানুষের স্বভাব। ঢিপি দেখলেই কাঠি ফোটায়, গুহা দেখলেই উঁকি মারে। এমনকী জলের তলায় নিঃশব্দ অন্ধকারেও সাবমেরিন সেঁধিয়ে দেয়। বহু লোক মনে করে, প্রকৃতিকে সম্মান করে, ন্যূনতম নাক গলিয়ে এই গ্রহে বাস করাই ভদ্র প্রজাতির কাজ। এবং মানুষ অতি ত্যাঁদড়, বেয়াদব, ডানপিটে। এখন গবেষকদের ফের রব উঠেছে, চিনের কোনও ল্যাবে বৈজ্ঞানিক নাড়াঘাঁটা ও কেরামতি ফলাতে গিয়েই ঘাতক করোনাভাইরাসের সৃষ্টি। আবার জুহি চাওলা মামলা করেছেন, ফাইভ-জি নেটওয়ার্ক সারা দেশ জুড়ে স্থাপন করা হলে, প্রাণীরা এখন যে রেডিয়েশনের শিকার হয়, তখন তার চেয়ে দশ থেকে একশো গুণ রেডিয়েশনের শিকার হবে। কোনও মানুষ, জন্তু, পাখি, পোকা, গাছ তা থেকে বাঁচবে না। সত্যিই হাত-পা ছুড়ে কেউ বলতেই পারে, মানবজাতের অ্যাদ্দূর পেছনপাকামির কি আদৌ দরকার ছিল?
পৃথিবীতে অনেকেই যুগে যুগে বাণী বিলিয়েছেন এই মর্মে: একটা বাঘ পুরোপুরি ঈশ্বরের ইচ্ছানুযায়ী বাঘ, একটা পিঁপড়ে তার শুঁড়ের আগা থেকে ফোলা-নিতম্বের ডগা অবধি টইটম্বুর ঈশ্বরের ইচ্ছানুযায়ী পিঁপড়ে, কারণ তাদের অস্তিত্বের একটি কণাও ঈশ্বরপ্রদত্ত প্রবণতাগুলোকে অতিক্রম করে না বা বিকৃত করে না। কিন্তু মানুষ যত পেরেছে কর্ডলাইন আবিষ্কার করেছে, ঈশ্বরের গড়া ছাঁচগুলো নিয়ে তাতে বাড়তি নাটবল্টু ঝালাই করেছে, কিছু ইস্ক্রুপ বেমালুম কেড়ে নিয়েছে, কখনও সহজ-চাকা গাঁতিয়ে উল্টোদিকে ঘুরিয়েও পরখ করেছে। তাই তার নিয়তিই হল একদিন না একদিন নিজের সামূহিক সর্বনাশ ডেকে আনা। যে লোক নিত্যি সকালে উঠে বলে, ‘দেখি তো সাপের ছানার গায়ে শিক গেঁথে দিলে কী হয়’, সে এক সুন্দর প্রাতে ছোবল খেয়ে দাঁত ছরকুটে পড়ে থাকবে, আশ্চর্য কী?
প্রথম আপত্তি হল, ঈশ্বর যদি সর্বজ্ঞ ও সর্বশক্তিমান হন, তাহলে তো তাঁর ইচ্ছানুযায়ীই মানুষ এমন বেধড়ক নিয়মভাঙা জানোয়ার হয়ে উঠতে পেরেছে, উনি তার মানে চেয়েইছিলেন এই সন্তানটা দস্যি হোক, তার হুড়ুদ্দুম কার্যকলাপ দেখে চক্ষু জুড়োই। অর্থাৎ, মানুষ ঈশ্বরের ইচ্ছানুযায়ী চলবে না, নিজের ইচ্ছেকে নাগাড়ে ঈশ্বরের ইচ্ছের ঘাড়ে ফিট করে দেবে— এই ছিল ঈশ্বরের ইচ্ছে। তা যদি না-ও হয়, যদি ধরে নিই তিনি সব জন্তুকেই একই রকম এদিক-ওদিক দু’দাগ স্বাধীনতা দিয়ে পাঠিয়েছিলেন, অন্যরা হৃদয়ে উত্থিত বদ-ভাবনাগুলোকে আমল দেয়নি, বা তা আমল দেওয়ার মতো মস্তিষ্ক আয়ত্ত করে উঠতে পারেনি, তাই স্রেফ বিশ্বপ্রভুর আকাঙ্ক্ষাকেই ধ্রুবতান ধরে ড্র্যাঁওড্র্যাঁও বাগাচ্ছে, আর মঞ্চের অন্যদিকে দাঁড়িয়ে মানুষ জন্তুটি বাঁধা-লাইনে প্যারেডের ধার না-ধেরে, প্রদত্ত স্বাধীনতার আঁটি বেবাক চুষে একেবারে ছিবড়ে করে ফেলেছে— তাহলে বলতে হয়, মানুষ যা কিছু ফলিয়ে-ফুলিয়ে মানবিকও হয়ে উঠেছে সবই নিষিদ্ধ দরজাটা চাড় মেরে খুলে ফেলারই ফল। বাঘ তো অসুস্থ বাঘকে ফেলে চলে যায়, মানুষ হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করে। হরিণ বিনা আপত্তিতে ধরেই নেয় তার বিধিলিপি নতমুখে খাদকের পেটে প্রবেশ করা, মানুষজাতির দুর্বলেরা সবলের অত্যাচারকে প্রশ্ন করে, মিছিল হাঁটে, স্ট্যাচু উপড়ে ফেলে দেয়।
কাজেকম্মে ও উদ্যমে মানুষ যে ঈশ্বরকে বেধড়ক ধাঁ করে দিয়েছে, সন্দেহ নেই। যেখানে কুকুর-বেড়ালেরা লাখ লাখ বছর ধরে এমন কিচ্ছু বাগিয়ে উঠতে পারল না যা ‘কুকুর-প্লাস’ বা ‘বেড়াল ৩.০’, সেখানে এই গ্রহের একটা জন্তু নিয়মিত মহাকাশে ঘুরে আসছে এবং যানের জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে সেই দৃশ্য দেখছে, যা তার রেটিনায় প্রতিফলিত হওয়ার জন্য নির্মিতই নয়। একটা জানোয়ার, যে শুরু করেছিল অন্য সব্বার মতো স্রেফ খাদ্য অন্বেষণে দৈনিক হাওয়া-শোঁকাশুঁকি দিয়ে, সে গ্রহতারকার পাশ দিয়ে শাঁ করে বেরিয়ে যায়, আবার ঝামেলা হলে মহাকাশযানের ধারে পা রেখে মেরামত অবধি করে! যে নিজের তৈরি কাঁড়ি কাঁড়ি কৃত্রিম উপগ্রহকে মহাবিশ্বে জুতে দিয়েছে, তারা তাকে ছবিটবি পাঠিয়ে, বার্তা সরবরাহ করে গর্বিত পিওনের মতো দাঁড়িয়ে আছে চন্দ্রসূর্যের গ্রুপ-ফোটোর ধার ঘেঁষে! এ প্রায় সুপার-একলব্যের মতো মার্কশিট, যা দেখে গুরু-জনের মাল্টি-মুচ্ছো যাওয়ার দশা।
হ্যাঁ, কোনও সন্দেহই নেই, মানুষ সংঘবদ্ধ ভাবে ঝাঁকে ঝাঁকে সহ-মানুষকে কোতল করেছে ধর্ম নামে একটা বানানো ধারণার খাতিরে, বা রাজনৈতিক আনুগত্য নামে একটা বানানো ধারণার বশে। কোন পর্যায় অবধি একটা জাত বানাতে বানাতে গেলে, ভেবেচিন্তে কিনা এমন উদ্ভট বন্দোবস্ত রচতে পারে, যেখানে একটা লোকের হাজারটা মুরগি থাকলেও তার পাশের লোকটা তা হাত বাড়িয়ে নিতে পারবে না বরং না খেয়ে মরবে, এবং অনেক সময় মৃত্যুর পূর্বমুহূর্তেও এই পরিস্থিতির উদ্ভটতাটা (ওর নশোনিরানব্বইটা বাড়তি আছে তবু আমি একটামাত্তর নিতে পারব না কেন) অবধি তার মাথায় ঢুকবে না (মুরগিওলার মাথায় তো নয়ই)। কিন্তু এও ঠিক, মানুষ যাতে এই গ্যাঁড়াকল থেকে বেরিয়ে আসতে পারে, তার জন্যেও বহু মানুষ রেগুলার প্রাণ দেয়। অনাগত একটা সমাজের কিছু কল্পিত মানুষের স্বচ্ছন্দ জীবনের তাত্ত্বিক সম্ভাবনার কথা ভেবে যদি একটা বিশ-বাইশ বছরের মানুষ তার বুক গুলির সামনে পেতে দেয়, তাহলে বানাতে বানাতে বহুদূর যাওয়ার কতমাত্রিক চোখ-ঠিকরোনো মাইল ও ক্রোশ আছে!
মানুষ আগুন আবিষ্কার করে তাতে শিকারটাকে ঝলসে নিয়েছে যেদিন থেকে, সেদিন থেকেই তার আর ঈশ্বরের বিরোধ, বা ঠিক বিরোধ না হলেও, পথের বেঁকে যাওয়া শুরু। নগরপত্তনে সে কোটিখানেক অন্যপ্রাণীকে নিকেশ করেছে। হাবভাব দেখে মনে হয়, এই বিশ্বের অ-মানুষ যত প্রাণী ও সম্পদ, সব তার ক্রীতদাস বা সম্পত্তি। পাশাপাশি, ঈশ্বর সম্পর্কিত ভাবনা, এমনকী মানুষ ঈশ্বর-সমঞ্জস না হয়ে চূড়ান্ত বখেড়া পাকাচ্ছে এই ভাবনাও— লিপিবদ্ধ করার প্রতিভা মানুষই দেখিয়েছে। নিপুণ নিখুঁত মিথ্যে বানানোরও। যদি একটা ঘোড়াকে বলা হয়, ‘এক দেশে এক ঘোড়া ছিল…’, সে বলবে, ‘আরে মশায়, আমি অন্য ঘোড়ার কথা শুনে সময় নষ্ট করব কেন?’ যদি তাকে বলা হয়, ‘একটা মানুষ ছিল, যে উড়তে পারত…’, সে হেসে বলবে, ‘যা স্পষ্টতই ভুল, তা নিয়ে আমি ভাবিত হব কেন?’ আর মানুষ কিনা, যে-লোকটা অসামান্য মিথ্যে বানাতে পারছে, চিরকাল তাকে ঘিরে গোল হয়ে তার কথা শুনেছে, পরে তার বই পড়েছে, এখন তার ওয়েব-সিরিজ দেখছে, এবং তাকে প্রশস্তি-পুরস্কার-পয়সায় ভূষিত করছে। মিথ্যাকে, কল্পনাকে, বা সোজা কথায় অ-স্বাভাবিক চিন্তাতরঙ্গকে, এমন শ্রদ্ধার আসনে (আসলে বিকল্প সত্যের আসনে, এমনকী শ্রেয়তর সত্যের আসনে) বসাবার শিক্ষা নিজেকে দিয়েছে যে-জাত, তাকে দেখে হৃদয় চড়কগাছ না-হওয়া সম্ভব? প্রতিনিয়ত চারিদিকের ধরাছোঁয়া-গত জিনিসপত্রের চেয়ে স্পর্শাতীত আইডিয়াকে অধিক মাইডিয়ার জপছে যে-জাত, তার এলেম বিপুল।
বিশ্বের সব পরোয়াহীন স্বাধীনতার, প্রতিভার, উড়ানের একটা খিড়কির উঠোন আছে, খুব নোংরা। বাড়িতে ভোজ হচ্ছে, ঝাড়লণ্ঠন ধুয়ে-পাখলে রেডি, আর সেই জঞ্জাল-প্রাঙ্গণে পড়ে আছে এঁটো কলাপাত, চিংড়ির খোসা, পাঁঠার কাটামুন্ডু, খুর, হয়তো ফাঁকিমারা পাচকের কর্তিত আঙুলও (ফিউডাল কর্তা-দত্ত শাস্তি)। তাই ফাইভ-জি কেন, আঠেরো-জি আসবে, কেউ আটকাতে পারবে না, যে-গবেষণা মারণ-রোগের ওষুধ আবিষ্কার করে (বা যুদ্ধে জেতার মারণ-জৈব-অস্ত্র), তা ফস করে হাত পিছলে ঘুলঘুলির বাইরে বের করে দেবে চার-খোঁচওলা কৃতান্ত জীবাণু। সংক্ষেপে, মানুষ মরবে। কিন্তু যা-ই করবে, সে করবে: শান সে। প্রস্থান, যদি ঘটে, হবে লীলাময় ও এক-চোখ-মেরে, ঠোঁটে উইট মচকে। তার প্রতিভা, তার পেরে-ওঠা, তার নিজেকে বারেবারে বাড়িয়ে নিয়ে আছড়ে ফেলার এমন একটা বেগবত্তা আছে, এমন ক্ষিপ্র তোড়, কীর্তির এমন টইটম্বুর তুষ্টি, যা বিনাশকে তুচ্ছ করতে শেখায়। নিউটন নিজের চোখে ছুঁচ বিঁধিয়ে দেখছিলেন, রংটং-এর বোধগুলো বদলায় কি না। মানুষও নিজের ফুসফুসে কালি ভরবে, হঠকারিতা আর অভিনবত্বের উদ্দীপনা যুগপত গরগরিয়ে ভোগ করবে, কোভিডের ভয়ে জিভ ঢুকিয়ে চুম্বন ছেড়ে দেওয়ার পাত্র সে নয়। ওই জিভ আত্মা অবধি চেটে নিচ্ছে, যা ঈশ্বরকেও পুনর্জন্মের লোভে নীত করে।