অসুখ আর মৃত্যুর মধ্যে বেঁচে আছি, এই দুঃস্বপ্নের বাস্তবের একটা গোটা বছর ঘুরে গেল। আমার এই বিষয়ে কথা বলতে বা লিখতে একদম ভালো লাগে না, কিন্তু সবসময় যে নিজের একটা স্বপ্নের জগতে পালিয়ে-পালিয়ে বেড়াবো, তা-ও পারি না। এই বাস্তব যেন ঘোর রাশিয়ান শীতকালে একটা জমে যাওয়া পুকুরের মধ্যে ডুব দেওয়ার মতো। খুব দম আটকানো। কোথাও কোনও আশার আলো নেই, নিস্তার নেই।
কোভিডের এই দ্বিতীয় ঢেউ বহুগুণ ভয়ংকর, বিশেষত যেখানে প্রশাসনিক স্তরে কেন্দ্রীয় সরকারের সাহায্যে ব্যাপক ঘাটতি রয়ে গেছে। আবার একটা সম্পূর্ণ লকডাউনের মাঝে দাঁড়িয়ে একটা দেজা ভু-কে আটকানো যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে, আমরা যেন ঘুরে-ফিরে সেই একই জায়গায় ফিরে এসেছি। ঠিক যেখান থেকে শুরু করেছিলাম, সেই প্রথম বিন্দুতে আবার দাঁড়িয়ে রয়েছি আমরা; পার্থক্য এই যে এবার যেন সবকিছুতেই একটা বিচ্ছেদের দুর্গন্ধ রয়েছে।
জানি, যে ছবিটা তুলে ধরলাম তা যথেষ্ট বিষণ্ণ, তবে এটাই বাস্তব। কিন্তু এটা সম্পূর্ণ চিত্রটা নয়। একটা গোটা বছর ধরে আমাদের অসহায়তা, আমাদের আতঙ্ক নিয়ে আমরা কাজ করতে পেরেছি। এবং মানসিকভাবে অনেক বেশি স্থিতিশীল হয়ে উঠেছি।
একটা বছর আগে, আমাদের এমন এক ভয়ানক সংকটের মুখোমুখি হতে হয়েছিল যা ছিল আমাদের কাছে সম্পূর্ণ অপরিচিত, যার সম্বন্ধে আমাদের কোনও ধারণা ছিল না। যদিও অতিমারীর প্রকোপ এখনও একই রকম নৃশংস রয়ে গেছে, আজকে আমরা একটু-একটু করে এর মোকাবিলা করতে শিখেছি। এই বিশ্বময় অতিমারী আমাদের বাধ্য করেছে এটা বুঝতে যে একে অপরকে সাহায্য না করলে মানুষ বাঁচবে না। যাঁদের সাহায্য প্রয়োজন, তাঁদের জন্য এই অসহায়তাটাকে একটা গঠনমূলক কর্মকান্ডে রুপান্তরিত হতে দেখাটা একটা অনুপ্রেরণার অনুভূতি।
পশ্চিমবঙ্গে আট দফার বিধানসভা নির্বাচন শেষ হওয়ার কাছাকাছি সময়ে রাজ্যে কোভিড পরিস্থিতি বেশ সঙ্গীন হয়ে উঠেছিল। সবচেয়ে বড় সঙ্কট ছিল অক্সিজেন সরবরাহ এবং এর সঙ্গে হাসপাতালে বেডের। শুধুমাত্র সময়মতো অক্সিজেনের অভাবে তরুণ-প্রবীণ নির্বিশেষে বহু, বহু মানুষের মৃত্যু ঘটতে থাকে।
এই সময়, আমার কিছু অন্তরঙ্গ বন্ধু এবং সহকর্মীদের সঙ্গে আমি ‘সিটিজেনস রেসপন্স’ নামে একটি উদ্যোগে সামিল হই, যাঁদের মধ্যে আছেন পিয়া চক্রবর্তী, পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়, অনুপম রায়, ঋতব্রত মুখার্জি, রিদ্ধি সেন, সুরাঙ্গনা বন্দ্যোপাধ্যায়, রাজর্ষি নাগ প্রমুখ। HEDS- Health and Ecodefence Society নামের এনজিও, যার দায়িত্বে আছেন পিয়া চক্রবর্তী এবং বাংলা সংস্কৃতি মঞ্চের কর্ণধার তন্ময় ঘোষ, তাঁরা একটা অন্তর্বর্তী সময়ের কোভিড-১৯ রিলিফ সেন্টারের জন্য কিছু তহবিল জমা করতে পারেন।
এই সেন্টারটা কন্দর্পপুর ওয়েলফেয়ার সোসাইটি, পাটুলিতে গড়ে ওঠে। অক্সিজেন প্রয়োজন, এদিকে হাসপাতালে বেডের অপেক্ষায় রয়েছেন, এমন কোভিড রোগীদের নিয়ে শুরু হয় কাজ। ২৪ ঘন্টা ডাক্তার এবং নার্সদের পরিষেবার ব্যবস্থা করা হয়। এবং আজকে দাঁড়িয়ে, কেন্দ্রের একটা অংশ আমরা কোভিড পেশেন্টদের জন্য ‘সেফ হোম’, ‘নিরাপদ আশ্রয়’ তৈরি করতে পেরেছি। আমাদের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য হেল্পলাইন নম্বর ২৪ ঘন্টা খোলা রয়েছে।
বলা বাহুল্য, মানুষকে প্রয়োজনে সেবা করতে পারা, তাঁদের পরিবারবর্গের মুখে হাসি এবং স্বস্তি ফুটে উঠতে দেখার অনুভূতিটা অসাধারণ সুন্দর।
সাহায্যের বিনিময়ে, প্রাণ বাঁচানোর বিনিময়ে যে আনন্দ আমরা সবাই পেয়েছি, তা যেমন রয়ে গেছে, আমাদের বহু প্রচেষ্টা সত্ত্বেও যাদের হয়ত সাহায্য করে উঠতে পারিনি, সে সম্বন্ধে একটা স্থির অসহায়তা রয়েই গেছে। নানাবিধ পরিভাষা, অনুমতি, স্বাস্থ্যবিধিসম্মত ব্যবস্থা, ওষুধের যোগান, অক্সিজেন সিলিন্ডারের রিফিলিং, এই সব ব্যবস্থার খুঁটিনাটির ক্ষেত্রেই প্রয়োজন অসম্ভব মনোযোগ এবং ধৈর্য, এবং প্রত্যেকটা বিষয় খুবই যত্নসহকারে দেখা দরকার।
এই গোটা অভিজ্ঞতায় আমার নিজেকে খুবই নগণ্য মনে হয়েছে। চিকিৎসকদের প্রতি আমার সম্মান পৌঁছে গিয়েছে এক অন্য মাত্রায়। যে সাহসের সঙ্গে তাঁরা শুধু রোগ নয়, রোগীর পরিবারের হতাশাকেও দিনের পর দিন যুঝতে থাকেন, তা লক্ষণীয়।
আমি তরুণদের এবং যে কোনও ইচ্ছুক ব্যক্তিকে বলব কোভিড-১৯ রিলিফের কাজে নেমে পড়ার জন্য, তাঁদের সময় এবং উদ্যম এই যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যয় করার জন্য, অবশ্যই নিজেকে যথাযথ ভাবে সুরক্ষিত রেখে। এই কাজে নেমে পড়ার আগে প্রয়োজনীয় গবেষণা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যাতে আমরা সাহায্যের সৎ উদ্দেশ্য সত্ত্বেও ক্ষতি না করে বসি।
আমার অন্য কিছু বন্ধুরাও খুবই প্রয়োজনীয় রিলিফ কাজে ব্যস্ত থেকেছেন, যেমন কোভিড পেশেন্টদের জন্য খাবার এবং ওষুধের হোম ডেলিভারি করেছেন, এবং আমি তাঁদের নিয়ে ভীষণ গর্বিত।
আশা করি আমরা সবাই যেন এই যুদ্ধে সফল হই। এই যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী, এবং কিছু লড়াই যদি বা আমরা হেরেও যাই, তবুও আমাদের সবার এই বিশ্বাস দরকার যে, এই অতিমারীর বিরুদ্ধে আমাদের ভিতরের যুদ্ধ যেন আমরা চালিয়ে যেতে পারি।