তখন আমার একুশ বছর বয়স। বাইশও হতে পারে। বয়সে আর কী বা আসে যায়। আশির দশকের প্রথম ভাগে, ‘যৌবনমদে মত্তা’ তখন, আমি ও বন্ধুরা। গান করছি, আধুনিক ড্যান্স থিয়েটার গ্রুপের সঙ্গে জড়িত। অঞ্জন দত্তর নাট্যদলেও আছি। বিভিন্ন জার্মান নাটক করছি। এরই মধ্যে বেশ কিছু গুণমুগ্ধ মানুষও চারপাশে জুটে গেল। বন্ধুদের সঙ্গে বাঁধভাঙা আনন্দের জোয়ারে ভাসতে ভাসতে আলাপ হল কিছু বয়োজ্যেষ্ঠ, গুণী অথচ লাগামহীন মানুষের সঙ্গে। তাঁদের কর্মস্থানে তাঁরা সুপ্রতিষ্ঠিত। কিন্তু তাঁদের এক ছন্নছাড়া মুক্ত জীবনও রয়েছে। তাঁরা পুলিশ, আমলা, বা উকিল হলেও, কবিতা, সিনেমা, থিয়েটার তাঁদের টানে। এমনই একজন ছিলেন আয়ান রশীদ খান। পুলিশের বড় পোস্টে চাকরি করেন, কিন্তু কবিতা, সাহিত্য, সিনেমা তাঁর প্রাণ। তাঁর খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়। রবীন্দ্রনাথ, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, বিষ্ণু দে— এঁদের সঙ্গে আমার পরিচয় পাঠ্যপুস্তক মারফৎ। কিন্তু সামনাসামনি কোনও কবির সঙ্গে আলাপ হয়নি। কলেজে এক ছেলেবন্ধু অবশ্য কবিতা লিখত, কিন্তু তাকে তেমন আমল দিইনি কোনওদিন।
শক্তিদার কবিতা সংকলন থেকে রশীদ পাঠ করতেন প্রায়ই। বিশেষত যখন মুডে থাকতেন। গমগমে গলায় সেই কবিতা দারুণ লাগত। আর পড়তেন উর্দুতে গালিবের কবিতা ও বঙ্গানুবাদ শক্তিদার। কবিতা শুনতে শুনতে সময় কেটে যেত। একদিন হঠাৎ কবি স্বয়ং চলে এলেন এই আসরে। অবশ্যই মদ্যপানের আয়োজন হয়েছিল। কবির সঙ্গে আলাপ হতেই উনি বললেন, ‘আমার কবিতা শুনেছ না পড়েছ?’
‘প্রথমে শুনেছি, পড়ে পড়েছি!’
‘কে শোনাল? ওই মদ্যপটা? ও কবিতার কী বোঝে, আমি শোনাচ্ছি…’
রশীদের অবশ্যই আঁতে ঘা লাগল। উনি মনে করতেন উনি কলকাতার রিচার্ড বার্টন, আর শক্তিদার কবিতার আবৃত্তিও দারুণ করেন। শুরু হল দুই বন্ধুর মধ্যে প্রতিযোগিতা। কে কত ভাল আবৃত্তি করতে পারেন। শক্তিদা তুলনাহীন, ‘অবনী, বাড়ি আছ’ থেকে শুরু করে ‘আসলে কেউ বড়ো হয় না’, ‘ছেলেটা’ বা ‘আমি দেখি’—একের পর এক কবিতা বলছেন। মদ্যপান করলেও কবিতা থেকে বিচ্যুত হননি। মাঝেমধ্যে রশীদও এক-দু’লাইন বলতে চেষ্টা করেন, কিন্তু শক্তিদা বলে ওঠেন, ‘অ্যাই অর্বাচীন, চুপ! আমার কবিতা আমার থেকে ভাল তুই আবৃত্তি করবি? হবে না! পারবি না!’ আমি তখন মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনছি, দেখছি, সবটা নিজের মধ্যে জমিয়ে রাখছি। হঠাৎ প্রশ্ন, ‘অ্যাই মেয়েটা, বল, আমি ভাল কবিতা পাঠ করি, না এই তোর বন্ধু? সত্যি করে বল, কোনও পক্ষপাতিত্ব নয়।’ আমি আমতা-আমতা করে কিছু বলতে গিয়ে, হঠাৎ মাথায় বুদ্ধি খেলে গেল, বললাম, ‘আপনারা দুজনেই দারুণ, একসঙ্গে গালিবের কবিতা উর্দুতে রশিদ বলুক, আর আপনি তার বঙ্গানুবাদ আবৃত্তি করুন না।’ সুরার পাত্রটা এক-ঢোকে শেষ করে বসলেন কবি। রশীদ নিয়ে এলেন বই। ভরা হল পাত্র। শুরু হল উর্দু কবিতা ও তার বাংলা তর্জমা পড়া। দুজনের উদাত্ত কণ্ঠ ধীরে ধীরে যেন অবশ করে দিতে থাকে মনমেজাজ।
কবিতা পাঠের সঙ্গে চলছে সুরাপানও। আমি চেষ্টা করছি দুজনকে বেশি মদ্যপান থেকে নিরস্ত করতে। বয়স অল্প, তাই আত্মবিশ্বাস ও অহংকার ছিল যে, আমি পারব এঁদের নিরস্ত করতে। পারব এঁদের শৃঙ্খলাবদ্ধ পথে ফিরিয়ে আনতে। কিন্তু পারিনি। কবিতা এবং মদই একমাত্র এঁদের নিরস্ত করতে পারে। শক্তিদার গলায় গালিবের এই লাইনগুলো এখনও যেন শুনতে পাই!
‘এই পৃথিবীর যত্তো
খুনখারাবির দায় এসে পড়ে মদের ঘাড়ে।
মদের ঢেউ কাঁপছে তোমার গতি দেখে।’
শক্তিদার সঙ্গে প্রথম আলাপের পর প্রায়ই নানা জায়গায় দেখা হত। আমি একসময় হয়ে উঠি ওঁর সহকর্মীও। আনন্দবাজারে শক্তিদাও কাজ করতেন, আমিও। ওই বড় বাড়ির অলিন্দে দেখা হলেই প্রায় বন্ধু হিসেবে জড়িয়ে ধরতেন। সুনীলদা, মানে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ঘরে একদিন লেখা আনতে গিয়ে দেখি, শক্তিদা। ‘এই তো, চল, সুনীল যাচ্ছে না, তুই আর আমি যাই এম্ব্যাসিতে।’ আমার তখন পাতা ছাড়ার দিন, তা-ই বললাম। ‘আরে রিনাকে (অপর্ণা সেন) বলে দে, ও দেখে দেবে। তুই না পারলে আমি বলছি…’ অনেক কষ্টে ওঁকে বোঝালাম, রিনাদি যা করার করেছেন, পাতা প্রেস-এ পাঠানো আমার দায়িত্ব। আর কাজ ফেলে মদ্যপান সম্ভব নয়। সেদিন শক্তিদা যা বলেছিলেন, আজও মনে আছে। ‘ঠিক আছে, যাস না। শক্তির চেয়ে কাজটা তোর কাছে বড় হল? একদিন বুঝবি।’ সত্যিই, কাজের নামে কত সুযোগ হারিয়েছি এমন জ্ঞানীগুণী প্রবাদপ্রতিম মানুষের সঙ্গে সময় কাটানোর। আবার পেয়েছিও সুযোগ কাজের জন্যই।
শক্তিদা প্রায়ই আসতেন আমাদের পত্রিকার দফতরে আমাদের সঙ্গে দেখা করতে। রিনাদি থাকলে তো কথাই নেই। দরজা থেকে বলতেন, ‘রিনা আছে?’ হ্যাঁ বললেই ঢুকে আসতেন এবং রিনাদির খুপরিটার দিকে এগোতে এগোতে বলতেন, ‘দুটো চা পাঠিয়ে দে।’ আমি আমাদের পত্রিকার নিজস্ব পিওন ‘শক্তি’কে চেঁচিয়ে ডাকতেই, শক্তিদা থমকে যেতেন। বলতেন, ‘চা চেয়েছি তো, অন্য কিছু নয়, তাতেই এই হুঙ্কার!’
আমি তখন ইংরেজি পত্রিকা ‘দ্য টেলিগ্রাফ’-এ কাজ করি। শক্তিদা আনন্দবাজারে। আমি সদ্য চাকরিতে বহাল হয়েছি। শক্তিদার সঙ্গে আগে থেকে আলাপ থাকায় অন্যান্য অনেকের সঙ্গে পরিচয় সহজ হয় যায়। এই সূত্রে আমি একটা মৌলিক লেখার সুযোগ পাই। মেট্রো রেল সবে চালু হবে। সবার জন্য চালু হওয়ার আগে, কলকাতার কিছু বিশিষ্ট মানুষকে পাতাল রেলে ঘোরানো হবে। ধর্মতলা থেকে কালীঘাট । আমাকে সেই প্রথম নিজস্ব কাজ দেওয়া হল। গুণীজনের পাতাল রেল অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখা। ছিলেন সুনীল গাঙ্গুলি, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, শক্তি চট্টোপাধ্যায়। এঁরা আমার হাউসের। আরও অনেকেই ছিলেন, অন্যান্য সংস্থারও। এদের মধ্যে ছিলেন সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ও। উনি তখন আর একটি পত্রিকার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। কিন্তু শক্তিদা ও সুনীলদার বহুদিনের বন্ধু। ওঁকে পেয়ে শক্তিদা যেন তাঁর যৌবনের দিন ফিরে পেলেন। সারাটা পথ চলল কবিতা, খুনসুটি, মজা । এঁরা প্রত্যেকেই তখন প্রবীণ, কিন্তু মনটা তখনও নবীন, একজোট হয়ে এঁরা যেভাবে পাতালে প্রবেশ করেছিলেন গল্প আর কবিতার আবহে, তা আজও স্মৃতিতে জ্বলজ্বল করছে। আমার লেখাটা ওই মানুষগুলির দৌলতে হয় ওঠে প্রশংসিত। এতটাই, যে শক্তিদাও বলেন, ‘তুই ইংরেজিতে ভালই লিখিস, কিন্তু বাংলাটা চেষ্টা করিস না-ভুলতে।’