ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • কানাগলির অতিমারী


    সাগুফতা শারমীন তানিয়া (May 21, 2021)
     

    এ শহরে রাত্রি আসে টিপটিপে পায়ে, রাতের শিরশিরে বাতাস থেকে শীতটা যেতেই চায় না, বাড়ির চৌহদ্দিতে নিঝুম কুয়াশার মতো টাঙানোই থাকে। লন্ডন শহর বড় বেশি শহুরে, রেলওয়ের জমি কিংবা খালপাড়গুলো ছাড়া বাকি প্রকৃতি এখানে ছিমছাম— যত্নে কামানো— সুশাসনে বাঁধা। টেমস নদীর দু’ধারে যতদূর চোখ যায়, পোস্তা বাঁধানো। সিকামোর গাছের পোকাধরা ডাল কেটে নিয়ে যায় সিটি কাউন্সিলের লোকে, যেন দুর্ঘটনা না ঘটে। বন্যপ্রাণীরাও এখানে সীমিত আসনে প্রার্থী, কিছু ছোট ছোট পাখি, ক’টা রাতচরা শেয়াল, গাছে গাছে হুটোপুটি খাওয়া কয়েকটা কাঠবেড়ালি। আদি বা মধ্যযুগের সেইসব দেওয়াল-ঘেরা পুর-পরিখা-দেওয়া শহর তো নয়, যেসব শহর গ্রামেরই আরেক রূপ। বহিঃশত্রুর আক্রমণে কিংবা মারীতে ছারখার হয়ে যাবে এমন তো নয়, এ শহরের বুনিয়াদ শক্ত। কিন্তু এই আত্মবিশ্বাসী, আত্মকেন্দ্রিক, অজেয় আধুনিক শহর যে এমন করে জনশূন্য হয়ে যেতে পারে, ভয়ার্ত মানুষ ঘরে বসে অদৃশ্য শত্রুর অপেক্ষা করতে পারে, এমন করে খালি হয়ে যেতে পারে শহরের অফুরন্ত ভাঁড়ার (মানে সুপারশপ), তা জীবদ্দশায় দেখব কখনও ভাবিনি। এমনকী, স্কুল-বিতর্ক করবার সময় আগামীর ‘তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ’ নিয়ে গলা খেলিয়ে বক্তৃতা দেবার সময়ও নয়। কোভিড আমাদের সেই অসম্ভবের চিত্র দেখিয়েছে, একদিন-দু’দিন নয়, বছরের অধিককাল ধরে। এ শহর তিনটি দীর্ঘ লকডাউনে একের পর এক ঢুকে গেছে মানুষের অবিরাম মৃত্যু ঠেকাতে, যেভাবে ঝমঝমিয়ে টানেলে ঢুকে যায় ট্রেন। 

    মাঝে মাঝে মনে হয় ভোপাল ট্রাজেডি কিংবা চেরনোবিল দুর্ঘটনা যেভাবে আমাদের শৈশবে জড়িয়ে আছে—গুঁড়ো দুধে বাজার ছেয়ে যাওয়া সেইসব বছর, সেভাবেই আমার সন্তানের শৈশবে জড়িয়ে যাবে এই কোভিডকাল। বাংলাদেশে একনায়ক এরশাদের আমলে প্রায়ই স্কুল-কলেজ অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ হয়ে যেত, এর নাম ছিল ‘এরশাদ ভ্যাকেশন’, আমাদের স্কুলজীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল এই ছুটি। আর এখনকার বাচ্চারা দেখল, একনায়কত্বকে ফুঁ দিয়ে শুইয়ে দিতে পারা জীবাণুর তৎপরতা, ‘কোভিড ভ্যাকেশন’। নাৎসি জেনোসাইডে কত লোক মরেছিল, কত মেরেছিলেন স্তালিন? চেঙ্গিস খাঁ? নাদির শাহ? কনস্ট্যান্টিনোপলের অটোমানরা? এক শতাব্দী আগে স্প্যানিশ ফ্লু-তে মারা গেছেন দুই বিশ্বযুদ্ধ মিলিয়ে যত মানুষ মরেছে তার চেয়ে বেশি। কোভিডে আজ অব্দি বিশ্বময় মারা গেলেন ৩.৩৮ মিলিয়ন মানুষ। মানুষ যখন ‘কাতারে কাতার’ মরতে থাকে, তখন সে কী আজব উপায়ে কেবল সংখ্যা হয়ে যায়! প্রতিদিন আসতো/আসছে পরিচিত মানুষের মৃত্যুসংবাদ। যদিও আমি সেই জলচরের মতো জীবন কাটাতে চেয়েছি— যে সাঁতরাবে কাদাজলে, তবু নাক তুলে রাখবে নির্মল উজ্জ্বল আকাশের দিকে; নিরাবেগ-নিরুদ্বেগ হয়ে বাঁচবার জন্য নয়, অজস্র মৃত্যু পেরিয়ে যেতে যেতে টানেলের শেষে আলোর নিশানাটুকুতে চোখ না রাখলে লিখবার মন জীবিত থাকে না বলে। তবু নানান পরিসংখ্যানের দিকে চোখ চলেই যেত। 

    আজ মে মাসের সতেরো তারিখ, ইংল্যান্ড আজ ‘স্টেপ থ্রি’তে প্রবেশ করছে। আজ থেকে দুই পরিবারের মানুষ ঘরোয়া আড্ডায় মিশতে পারবে, আউটডোরে পারবে জনা তিরিশেক লোক। আজ থেকে রেস্তোরাঁয় বসে খাওয়া চলবে, জিম চলবে, জাদুঘর আর সিনেমা খুলে দেওয়া হবে। কোভিডের ইন্ডিয়া ভ্যারিয়েন্ট এখানে এসে গেছে, এ নিয়ে একটা ভয় আছে যদিও। গত এক সপ্তাহে কোভিড টেস্টে পজিটিভ ধরা পড়ার ২৮ দিন পর মারা গেছেন এমন মানুষের সংখ্যা চুয়াত্তর। প্রায় ৭০% মানুষ ভ্যাক্সিন নিয়েছে এদেশে। এই প্রথম এমন কোনও কোনও দিন আমরা পেয়েছি, যেদিন কোভিডে কোনও মানুষ মারা যাননি।

    আমার কোভিড-পরিক্রমা, লন্ডনের এই কানাগলিটায় যে সদাহাস্য বুড়ো লোকটা থাকত, তাকে কেন্দ্র করে। প্রথম লকডাউনে সে হাসিমুখে স্টেশন থেকে খবরের কাগজ আর কর্নারশপ থেকে পাউরুটি কিনে ফিরত, তাজা খবর আর টাটকা রুটি… এই দুই-ই তার শয্যাশায়ী বউ ভালবাসে। সেবার বাপের বাড়িতে আসা মেয়ের মতন সতেজ হয়ে উঠেছে প্রকৃতি, গরমকাল এসেছে চোখ ধাঁধিয়ে। আমরা আলাপ করছিলাম, তবে কি আমাদের এই বারমাস্যা শীতকাল আর স্মগ-ফগ ইত্যাদিতে ঢাকা সাদা আকাশ আসলে নগরসভ্যতার দূষণের কীর্তি ছিল? টম অত ভাবত না, ধৈর্য ধরে হলদে রং করত তার দরজায়, প্রতিদিন ঘরের সামনেটা আর উল্টোদিকের পথ ঝাড়ু দিয়ে সাফ করে রাখত। দেখা হলেই এক গাল হেসে বলত— ‘তোমার বাড়িতে চল্লিশের দশকে এক স্কুলশিক্ষিকা থাকত জানো, তার আগে বাসড্রাইভার… এই গলিতে গাড়ি চলাচল বন্ধ করে দিয়ে আমরা কত মেলা করতাম বিশ্বযুদ্ধের সময়।’ বিশ্বযুদ্ধের চেয়ে কঠিন ছিল এই লকডাউন, অশান্তির পটে প্রিয়জনের আলিঙ্গন আর সান্নিধ্য— যা বিশ্বযুদ্ধে মানুষকে বাঁচিয়ে রেখেছিল, তা তো নেই। 

    আজ মে মাসের সতেরো তারিখ, ইংল্যান্ড আজ ‘স্টেপ থ্রি’তে প্রবেশ করছে। আজ থেকে দুই পরিবারের মানুষ ঘরোয়া আড্ডায় মিশতে পারবে, আউটডোরে পারবে জনা তিরিশেক লোক। আজ থেকে রেস্তোরাঁয় বসে খাওয়া চলবে, জিম চলবে, জাদুঘর আর সিনেমা খুলে দেওয়া হবে। কোভিডের ইন্ডিয়া ভ্যারিয়েন্ট এখানে এসে গেছে, এ নিয়ে একটা ভয় আছে যদিও। গত এক সপ্তাহে কোভিড টেস্টে পজিটিভ ধরা পড়ার ২৮ দিন পর মারা গেছেন এমন মানুষের সংখ্যা চুয়াত্তর। প্রায় ৭০% মানুষ ভ্যাক্সিন নিয়েছে এদেশে। এই প্রথম এমন কোনও কোনও দিন আমরা পেয়েছি, যেদিন কোভিডে কোনও মানুষ মারা যাননি। 

    দ্বিতীয় লকডাউনে টমের আদরিণী বউ মরে গেল এক সকালে, ভুগছিল অনেকদিন ধরে। কালো কোট পরে টম গেল বউকে কবর দিতে, আর বাড়ি ফিরল না। আমি কয়েকদিন ওঁর বাড়ির দরজায় টোকা দিয়ে এলাম, কোনও সাড়া নেই। পোড়ো বাড়ির মতো দেখাত ওর বাড়ি। তৃতীয় লকডাউন আসতে আসতে একদিন দেখলাম দুজন পোলিশ বিল্ডার টমের ঘর ভাঙছে, জঞ্জাল পোড়াচ্ছে। টম নাকি বাড়ি বিক্রি করে দিয়ে চলে গেছে। নাৎসি ঘেটোতে যেমন করে অশক্ত মানুষ ঝরে পড়ত, ঠিক সেইভাবে আমার গলি থেকে ঝরে গেল একে একে কতগুলো লোক, তাদের আর দেখব না। ওই তো টমের আপন হাতে রং করা হলুদ দরজা পড়ে আছে স্কিপে, চলে যাবে ল্যান্ডফিলে। একদিন সেই ল্যান্ডফিলের ওপর দাঁড়িয়ে যাবে বসতি, তারপর আরও জঞ্জাল, আরও বসতি। আরও মানুষ। 

    কোভিড এ শহরে বহু মানুষের মনে কিছু চিন্তা জাগিয়েছে যে, এ সসীম গ্রহে অসীম উন্নয়ন চলতে পারে না। প্রকৃতি আর উন্নয়নকে আলাদা দুই খোপে পুরে আমরা বেশিদূর যেতে পারব না। না চাইতেই এই যে খাদ্য আর বিলাসী পণ্যের বিস্তার, এইসব ইন্ডাস্ট্রিয়াল প্রোডাকশন আমাদের স্বাস্থ্য, আমাদের মন, আমাদের চাহিদা— সবকিছুকে এমন মাত্রায় নিয়ে গেছে, যেখানে প্রকৃতি আর প্রাণীকে অন্তহীন দহন করে চলেছি আমরা, গ্রহের ক্ষমতাকে বারবার চ্যালেঞ্জ করছি। বাংলায় চলতি কথায় এর জবাব আছে ‘যায় দিন ভাল, আসে দিন খারাপ’। আমাদের সাপ্লাই চেন যে এত ঠুনকো কে জানত, সুয়েজ খাল আড়াআড়ি আটকে দিয়ে যদি না স্থবির হয়ে যেত জাহাজ! কে জানত, অবিরল অবকাশেও মানুষের মানুষকেই চাই!

    টমের কথা বলছিলাম। আরেকজন বুড়ো মানুষ আমার কোভিডযাত্রায় চিরস্থায়ী উল্কি কেটে রেখেছেন। ওঁর নাম টনি উইলিয়ামস, গতবছর সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি এই লোকটির খবর পত্রিকায় এসেছিল। টমের মতোই বিপত্নীক, বউ মরে গেছে গত মে মাসে— প্যানক্রিয়াটিক ক্যান্সার ধরা পড়ার নয় দিনের দিন। প্রতিদিন টনি অপেক্ষা করতেন, কেউ না কেউ তো ফোন করবেই। টেলিফোন বাজেনি। নিঃসন্তান মানুষটি একাকিত্ব সইতে না পেরে অবশেষে বাড়ির জানালায় মর্মস্পর্শী একটি পোস্টার টাঙিয়ে রেখেছিলেন— ‘আমি আমার প্রিয়তমা স্ত্রী জো-কে হারিয়েছি। আমার কেউ নেই, কারো সাথে কথা বলবার নেই। দিনের চব্বিশ ঘণ্টা এই নিরবিচ্ছিন্ন নৈঃশব্দ্য সহ্য করা যে কী যন্ত্রণার! কেউ কি আমাকে সাহায্য করতে পারে না?’ দুঃখ-দুর্দশার কথা বলে কান্নাকাটি করার মানুষ নয়, টেলিফোনের ওইপ্রান্তে থাকা যে কোনও মানুষ, যার সাথে একটু কথা বলা যায়। একই লেখা সম্বল করে টনি বিজনেস কার্ড ছাপিয়ে সুপারমার্কেটে নিজহাতে বিলি করে এসেছিলেন, কেউ ফোন দেয়নি। 

    কোভিড এ শহরে বহু মানুষের মনে কিছু চিন্তা জাগিয়েছে যে, এ সসীম গ্রহে অসীম উন্নয়ন চলতে পারে না। প্রকৃতি আর উন্নয়নকে আলাদা দুই খোপে পুরে আমরা বেশিদূর যেতে পারব না। না চাইতেই এই যে খাদ্য আর বিলাসী পণ্যের বিস্তার, এইসব ইন্ডাস্ট্রিয়াল প্রোডাকশন আমাদের স্বাস্থ্য, আমাদের মন, আমাদের চাহিদা— সবকিছুকে এমন মাত্রায় নিয়ে গেছে, যেখানে প্রকৃতি আর প্রাণীকে অন্তহীন দহন করে চলেছি আমরা, গ্রহের ক্ষমতাকে বারবার চ্যালেঞ্জ করছি। বাংলায় চলতি কথায় এর জবাব আছে ‘যায় দিন ভাল, আসে দিন খারাপ’। আমাদের সাপ্লাই চেন যে এত ঠুনকো কে জানত, সুয়েজ খাল আড়াআড়ি আটকে দিয়ে যদি না স্থবির হয়ে যেত জাহাজ! কে জানত, অবিরল অবকাশেও মানুষের মানুষকেই চাই!

    দুঃসময় যেমন হঠাৎ হামলা করে, আশাও তেমন হঠাৎ এসে সব ভাসিয়ে নিয়ে যায়। ইংরেজ কবি শেলীর আংটিতে খোদাই করা ছিল— ‘শুভদিন আসবেই’। এই ভয়াল সময় কেটে যাবে এমন আশাই তো করি। মায়ের রেডিওতে যেমন হঠাৎ বেজে উঠত— ‘আজি বর্ষারাতের শেষে, সজল মেঘের কোমল কালোয় অরুণ আলো মেশে’, সেইভাবে একদিন রক্তে পুলকের ঢেউ লাগিয়ে দেওয়া সকাল হবে। এবারের গ্রীষ্মে আবার মিউজিয়ামের চত্বরে কিংবা টেট মডার্নের সামনে বসে এন্তার আড্ডা দেব ভাবি, ফ্রস্ট কেটে গেলে কুমড়োচারাগুলো বাইরে এনে পুঁতব। ল্যান্ডফিলের জমিতে গড়ে ওঠা এ বাগান আমাকে পুরো কোভিডকাল বাঁচিয়ে রেখেছে। অসমান জমিতে গজিয়ে উঠছে আলুগাছের লকলকে সবুজ পাতা, জার্মান টারনিপের ফলসারঙা চারা। অবিমৃষ্যকারী মানুষের সভ্যতার এখনও একান্ত আশ্রয়, প্রকৃতি। 

    ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook