তরমুজ আর ইদ
মোহাম্মদপুরে রাস্তাগুলো ভরে আছে বিষণ্ণ সবুজ পুলিশ আর সবুজ তরমুজের সমাবেশে।
আমার মাঝে মাঝে মনে হয়, তরমুজই হওয়া উচিত ছিল বাংলাদেশের জাতীয় ফল। সবুজের ভিতর লালের এমন প্রতীকী অবস্থান, অমন রক্তময় আবিষ্কার, ওরকম সরল, সহজ, স্বল্পমুদ্রায় প্রাপ্য, প্রান্তিক, মাতৃময় পুষ্টির মতো জীবনদাত্রী, ভারী ও বলিষ্ঠ, নিরহঙ্কার ও মৃত্তিকাসংলগ্ন, লোকজ ও অনভিজাত আর কোনও ফলবান সৃষ্টি আমার চোখে পড়ে না।
জাতীয় ফল না হলেও গত এক মাস তরমুজ বাংলাদেশের জাতীয় ঘটনা হয়ে রইল। বাংলাদেশে এটা বিক্রির নিয়ম বহুকাল ধরেই সংখ্যা হিসেবে। একটা আস্ত তরমুজ দরাদরি করে কিনতে হত। কেটে কেটে ভাগ করে বিক্রি করত খুচরো ফলবিক্রেতা। ফলে দরিদ্র রিকশাচালক, ভ্যানগাড়িচালক আর শ্রমজীবী মানুষ এক টুকরো তরমুজ দশ-পনেরো টাকায় কিনে খেতে পারতেন। উদাত্ত আকাশের অক্লান্ত রোদের নীচে দাঁড়িয়ে শ্রমজীবী দরিদ্র মানুষের তরমুজ খাওয়ার দৃশ্য তাঁদের ঘামের মতো কোমল, মেহনতের মতো সুন্দর। সেই তরমুজ বিক্রি হতে লাগল কেজিতে। তাতে যে দাম হাঁকানো হল, তরমুজের দাম বেড়ে গেল পাঁচগুণ। দরিদ্র জনগোষ্ঠী তো দূরের কথা, সাধারণ আয়ের লোক তরমুজ খাওয়া বন্ধ করে দিলেন। পুলিশ আর আদালতের সাহায্যে তরমুজের দাম ঠিকঠাক করা হল। কিন্তু ততদিনে যা হবার হয়েছে। প্রচুর ফলন হওয়ায় গোডাউনে আর ব্যবসায়ীদের দোকানে দোকানে পচে নষ্ট হল এই রক্তাক্ত ফল। ফলন রয়েছে, ফল রয়েছে, অথচ অসাধু ব্যবসায়ীর লাভের লোভে প্রাণশক্তির এই বিনষ্টি, এ তো সারা পৃথিবীরই সারকথা, যুগে যুগে।
তরমুজকে না হয় আইন দিয়ে বাঁধা গিয়েছে। কিন্তু মানুষের মড়ক ঠেকাবে কে? মহামারীকে তো আইন দিয়ে বাঁধা যায় না। হাসপাতালে হাসপাতালে পাতালের হাহাকার। হিমশিম খাওয়া চিকিৎসক আর চিকিৎসাকর্মী। মৃত্যুর মিছিল। দেখা যাচ্ছে, শেষ গাছটা কেটে, শেষ পরমাণুর শক্তি দিয়ে, দরদালান আর উঁচু উঁচু অন্ধকার তৈরি করে মানুষকে বাঁচানো যায় না। পাশের দেশ ভারতে অগণন মৃত্যুর দোলা আর ভয় গঙ্গা পার হয়ে পদ্মার পালে বাতাস দেয়। সরকার, অফিস আদালত, দোকানপাট, চলাফেরা বন্ধ করলেন। কিন্তু অন্ধ হলে তো প্রলয় বন্ধ থাকে না, বাদ সাধে অর্থনীতি। রোজার মাস বাংলাদেশের বেচাকেনার প্রধানতম মাস। অনেক খুচরো পাইকারি ব্যবসায়ীর এই এক মাসের আয়ে সারা বছরের অর্ধেক সংস্থান হয়ে যায়। সমস্ত বন্ধ থাকলে দিনমজুরের দিন চলে না। ফলে ধীরে ধীরে সীমাবদ্ধ আকারে ব্যবসা-বাণিজ্য চালু হল।
রোজায় বাজারে ভিড় এড়ানো দায়, পুঞ্জ পুঞ্জ মানুষের দল, ভয় আর সঙ্কোচকে চোখে নিয়ে বাজারে যান, মহামারীর চোখ তাদের এড়ায় না।
এবারের সমস্ত বৈশাখ গেল বৃষ্টিবিহীন। ভূমিতে অজেয় জীবাণু, আকাশে সন্তাপ। দূরে আড়িয়াল খাঁ-র তীরে মায়ের চোখ ধু-ধু করে, দাদির কবরের পাশে রাখা ডালিম শুকিয়ে ঝরে যায়। এবার আমের মুকুল বাঁচানো যায়নি। গ্রামান্তরের মুকুল-পচা বাতাস চারদিক থেকে ঢাকায় ছুটে আসে। আমরা টের পাই না, আমাদের মুখমণ্ডল কাপড়ের আস্তরণে আবৃত, আমাদের মন আলাদা করে কোনও গন্ধ শনাক্ত করতে পারে না। তবে কি জ্যৈষ্ঠ আসবে কিন্তু মধুমাস আসবে না আর?
ইফতারের পর পথে পথে অকারণ হাঁটতে থাকা উঠতি ছেলেদের আর দেখি না। মহল্লার মেয়েরা কি আর নেমে আসছে না মুদি-দোকানে? তাঁদের মাথায় রাখা ওড়নার আড়ালে চোখের ভ্রূকুটি কোথায় ফেলে এসেছে? এখন এমন এক সময় যখন পরিচিত কেউ পাশ দিয়ে হেঁটে গেলেও চিনতে পারি না। আমাদের মুখে মাস্ক, চোখ ভূমিতে নিবদ্ধ, মন স্পর্শের শঙ্কায় অস্থির। কেনাকাটায় এখন নতুন নিয়মের ঢল— অনলাইন কেনাকাটা। আমাদের সামাজিক যোগাযোগ নেই, সামাজিক যোগাযোগের যন্ত্র রয়েছে। সেখানে উবু হয়ে থেকে থেকে আমাদের চোখ ঘোলাটে, শিরদাঁড়া আনত, সারাদিন সেখানে বিদ্বেষের যান্ত্রিক উৎসব চলে। আমাদের মাথা আর ভাবে না, কেবল প্রতিক্রিয়া দেখায়। রতিক্রিয়ার চেয়েও প্রতিক্রিয়া আজ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে, উত্তেজনার অভূতপূর্ব এমন উপাদান সভ্যতায় পূর্বে ক্রিয়ারত ছিল না কখনও।
রোজা আধাআধি শেষ হয়ে আসে। প্রতিদিন খ্যাতনামা, অগ্রগণ্য কেউ না কেউ মারা যান। সেই মৃত্যুর শোকের প্রস্তুতি নিতে নিতে অন্য কারও মৃত্যুর খবর চলে আসে। আমরা শোক করি না, কেবল খবর শুনি। কোনও দিন বিখ্যাত কারও কোনও মৃত্যুর খবর না পৌঁছলে মনে হয়, আজকের দিনটা বৃথা হয়ে গেল।
ঢাকার তুল্য এমন শহর আর পৃথিবীতে আছে কি না জানা নেই। একটা উৎসবকে কেন্দ্র করে, এর নব্বইভাগ মানুষ শহর ছেড়ে চলে যায়। পেশা আর পেশি মানুষকে ঢাকায় কেন্দ্রীভূত করেছে, কিন্তু অজস্র টাকা আর ঝাড়লণ্ঠনের বিনিময়েও ঢাকা ইদকে কিনে নিতে পারেনি। সরকারি নিষেধ সত্ত্বেও ব্যতিক্রম নয় এবারও। জনমানুষের প্রয়োজনই আইন, আর প্রয়োজন কবেই বা আইন মেনেছে? যে যেভাবে পারছে ঢাকা ছাড়ছেন। বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে যেতে হলে পদ্মা পাড়ি দিতে হয়। এই পদ্মা যেন এক পুলসিরাত। ফেরিজাহাজে মানুষের ভিড়ে গাড়ি ওঠা দায়। রাষ্ট্রীয় পুলিশ, বিজিবি, প্রশাসন মোতায়েন করেও সে স্রোতে বাঁধ দেওয়ার উপায় তৈরি হল না। ফেরি চলতেই হবে, কেননা নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের চলাচল বন্ধ করা সম্ভব নয়। চিকিৎসাপ্রার্থী অসুস্থ মানুষেরা আসা-যাওয়া করবেন, তার জন্যও ফেরি, স্টিমার চালু রাখা চাই। কিন্তু চলাচল রাখা হল সীমিত। তার ফল হয়েছে অদ্ভুতুড়ে। ভিড়ের ধাক্কায় লোকে টলে পড়ে যাচ্ছে নদীতে, এমনকী মাঝারি আকারের মোটরযানও ধাক্কা খেয়ে তলিয়ে যাচ্ছে পদ্মায়। পায়ের চাপে পিষে যাচ্ছে মানুষ, এক-দুজন নয়— অনেকজন।
সন্ধ্যার পর অলিতে-গলিতে তবু পক্বকেশ বুড়োরা আসর জমান; এখনও রূপকথা বলে চলেন। পুরনো ঢাকার ইদ আর ইদের মিছিল। আজকের কথা তো নয়, সেই চারশো বছর ধরে চলে আসা ইতিহাস। যেন আজও চকবাজার, হোসেনি দালান, রমনা, আজিমপুর পার হয়ে যাচ্ছে ইদ-মিছিল। মীরপুর, ধানমণ্ডি, মোহাম্মদপুরে সারি সারি বাঁশ আর বেতের, কাঠের খেলনা, মুড়ি, সন্দেশ, জরি, রং, আতর, কাবাব, ফালুদা, ফিরনি, ঝলমলে জামা, হরেক খেলায় টইটম্বুর ইদের মেলা। উর্দুভাষী মহল্লায় গজল আর কাওয়ালির আসর। আজ বুধবার বাংলাদেশে চাঁদ দেখা যায়নি, অর্থাৎ, ইদ হচ্ছে শুক্রবার। ইতিহাস বলে ঢাকার নওয়াবেরা ইদের চাঁদ দেখতেন বুড়িগঙ্গায়। বজরায় ভেসে ভেসে তাঁরা আকাশের দিকে তাকাতেন, বাঁকানো বজরার মতো চাঁদ কি উঠেছে আকাশে? মাঝরাতে বাড়ি ফিরতে ফিরতে মনে হচ্ছে, দূরবিনের দিন শেষ হয়ে ফের আমরা বজরার ওপরে গিয়ে বসব। আকাশের লাস্যময়ী অতিথি চাঁদ বজরায় করে ফের আসবেন আমাদের বাড়ি, পৃথিবীর গ্রামে গ্রামে তিনি বিলি করবেন ঝলমলে ইদ। এখনও যারা চাঁদ দেখেন, আর যারা চাঁদ দেখতে ভুলে গেছেন, সকলকে ইদের শুভেচ্ছা।