চিত্রকর জ্যোতিরিন্দ্রনাথ

Painting by Jyotirindranath Tagore

শশিভূষণ দত্ত, চপলা দত্ত, গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর, সুজাতা দেবী, লীলা মৈত্র, জনক গঙ্গোপাধ্যায়। হয়তো খাপছাড়া তালিকা মনে হবে একসঙ্গে এই নামগুলোকে। কিন্তু সূত্র একটা আছে। ছবির সূত্র। এঁদের ছবিই এঁকেছিলেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর, তাঁর জীবনশেষের বছর, ১৯২৫-এ। পঞ্চান্ন বছরের চিত্র-চর্চার শেষ ওই বছর। যার ফসল প্রায় ১৭০০ ছবি। বিখ্যাতের রাজধানী থেকে অপরিচিতের অলিগলি— অনায়াসে স্পর্শ করেছে ওই বিপুল চিত্রভাণ্ডার, মৃত্যুশতবর্ষেও যার অনেকটাই অদেখা।

অবশ্য, দেখানোর জন্য ছবি আঁকতেন না জ্যোতিরিন্দ্রনাথ। আঁকতেন আপন খেয়ালে। যে-খেয়ালে নাটক লিখেছেন, গান তৈরি করেছেন, অনুবাদ করেছেন, চর্চা করেছেন বিজ্ঞানের, নেমেছেন পাট-নীল বা স্টিমারের ব্যবসায়, সে-খেয়ালেই ছবি এঁকেছেন। আপন খেয়ালে চলেন রাজা।

দস্তুরমতো ছবি আঁকার শুরু ১৮৭০-এ। আর তাঁর আঁকা ছবির প্রথম সংকলন প্রকাশিত হচ্ছে ১৯১৪-য়, তাও বিদেশ থেকে, TWENTY-FIVE COLLOTYPES from the Original Drawings by Jyotirindra Nath Tagore। প্রকাশ করছে লন্ডনের এমেরি ওয়াকার প্রকাশন।

আরও পড়ুন: আলো-আঁধারের অতুলনীয় নির্মাণই কি গগনেন্দ্রনাথের নিজস্ব টিপছাপ? লিখছেন অভীক মজুমদার…

উদ্যোগটা ছিল উইলিয়াম রোটেনস্টাইনের। ১৯১২। রবীন্দ্রনাথ তখন লন্ডনে। তাঁর কাছে ছিল ১৩১৮ ফাল্গুন সংখ্যা ‘ভারতী’-র এক কপি। জ্যোতিরিন্দ্রনাথের আঁকা রবীন্দ্রনাথের কয়েকটা পেন্সিল-স্কেচ ছাপা হয়েছিল সে-সংখ্যায়। দেখে রোটেনস্টাইন তো উচ্ছ্বসিত। দেখতে চাইলেন আরও ছবি। রবীন্দ্রনাথ সে-খবর জ্যোতিরিন্দ্রনাথকে জানালে তিনি কয়েকটা খাতা পাঠিয়ে দিলেন। তার পরে, জ্যোতিদাদাকে লিখছেন রবীন্দ্রনাথ,

ভাই জ্যোতিদাদা,

আপনার ছবির খাতা আমি Rothensteinকে দেখিয়েছি। তিনি এখানকার একজন খুব বিখ্যাত artist; তিনি দেখে অত্যন্ত আশ্চর্য হয়ে গেছেন। তিনি আমাকে বল্লেন, আমি তোমাকে বলছি, তোমার দাদা তোমাদের দেশের সর্বশ্রেষ্ঠ চিত্রী। আমাদের দেশে প্রথমশ্রেণীর ড্রয়িং যাঁরা করেন, তাঁদের সঙ্গেই ওঁর তুলনা হতে পারে। এতদিন যে, আমাদের দেশে এ ছবির কোনো সমাদর হয় নি, এর মত এমন অদ্ভুত ঘটনা কিছু হতে পারে না। most marvellous, most magnificent-এই ত তাঁর মত। তিনি বলেছেন, এখানকার সব চেয়ে বিখ্যাত art criticকে তিনি এই ছবি দেখাবেন, এবং এর একটা ছোট সমালোচনা তিনি নিজে লিখবেন। Portfolioর আকারে একটা selection তোমাদের করা উচিত। যেটা যথার্থ আপনার নিজের জিনিস এবং যাতে আপনার শক্তি এমন আশ্চর্যরূপে প্রকাশ পেয়েছে, সেটাকে লুপ্ত হতে দেওয়া উচিত হয় না। আপনার এ ছবি এখানে যাঁরাই দেখেছেন, সকলেই খুব প্রশংসা করছেন। রোটেনস্টাইন খুব একজন গুণজ্ঞ লোক, এঁর মতে আপনার চিত্রশক্তি একেবারেই প্রথমশ্রেণীর গুণীর উপযুক্ত; এ কথাটা চাপা রাখলে চলবে না। ২৯ ভাদ্র ১৩১৯।

আপনার স্নেহের রবি

কেন এত উচ্ছ্বসিত রোটেনস্টাইন? ওই সংকলনের ভূমিকায় সে কথাটা বলছেন তিনি,

They seem to me also to be drawn with the most perfect naturalness. Here is neither pre-occupation with Western models nor a conscious attempt to follow a Mogul tradition. The drawings of Indian ladies are especially remarkable. The 17th and 18th centuries imposed so weak and characterless a vision of woman on the European artist that one has almost to go back to Durer and Holbein to find such frank and sincere portraits as these.

অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর
গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর

জ্যোতিরিন্দ্রনাথের ড্রয়িংগুলির সহজ স্বাভাবিকতার সঙ্গে মেলাতে গেলে যেতে হবে ড্যুরার এবং হলবাইনের কাছে। ড্যুরার মানে আলব্রেখট ড্যুরার, রেনেসাঁ যুগের জার্মান শিল্পী। আর হলবাইন, হান্স হলবাইনও জার্মান, ড্যুরারেরই সমসাময়িক। ড্রয়িং-এ দুজনেরই ছিল আশ্চর্য দক্ষতা এবং তার চেয়েও বেশি, স্বাভাবিকতা। ইউরোপের শিল্পের মধ্যযুগে ধর্মীয় অনুষঙ্গে যে-ধরনের প্রাণহীন তপস্যা-ক্লিষ্ট চেহারা আঁকা হত, সে-ধারায় প্রাণের সঞ্চার করেছিলেন রেনেসাঁ যুগের শিল্পীরা; ড্রয়িং-এ বিশেষ করে এই দু’জন।

এই দুজনের ছবি দেখে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন কি জ্যোতিরিন্দ্রনাথ? নিশ্চিত করে বলা যায় না। তাঁর ছবি আঁকা শেখার শুরু বোম্বাইয়ে, সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে থাকার সময়ে, গৃহশিক্ষকের কাছে। ঔপনিবেশিক ভারতের শিল্পশিক্ষার সেই আদি যুগে পাশ্চাত্যের শিক্ষাধারা নিশ্চয় প্রভাব ফেলেছে তাঁর উপর। আমেদাবাদে সত্যেন্দ্রনাথের লাইব্রেরিতে বিদেশি ছবির অ্যালবামও হয়তো দেখে থাকবেন।

প্রথম ছবি তিনি এঁকেছিলেন দশ-এগারো বছর বয়সে। ব্যারিস্টার সত্যপ্রসন্ন সিংহের (পরে লর্ড সিংহ) কাকা প্রতাপনারায়ণ সিংহ তখন মণিরামপুরে আছেন। মেজদাদার সঙ্গে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ মণিরামপুরে গিয়েছিলেন। প্রতাপনারায়ণের ছবি আঁকেন। সেই প্রথম ছবি প্রশংসা পেল। তখন একে-একে বাড়ির লোকদের ছবি আঁকতে লাগলেন।

পেন্সিলে সেই আঁকার ধারা চলতেই লাগল তার পরে, আমৃত্যু। যাঁদের ছবি তিনি এঁকেছিলেন তাঁদের মধ্যে আছেন দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাদম্বরী দেবী, মৃণালিনী দেবী, ডাবলিউ সি বোনারজি, শিল্পী ঈশ্বরীপ্রসাদ, ঐতিহাসিক অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়, আইনজীবী রানাডে, চিত্তরঞ্জন দাস, গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর, গোপালকৃষ্ণ গোখেল, মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধি, ইয়োকোয়াইমা তাইকান, যদুনাথ সরকার, সি এফ এন্ড্রুজ, অসিতকুমার হালদার। এঁকেছেন আত্মপ্রতিকৃতিও। এ-তালিকা তাঁর চিত্রাবলির অতি সামান্য অংশ। সবচেয়ে বেশি এঁকেছিলেন রবীন্দ্রনাথের ছবি। নানা রবীন্দ্রনাথ—নতনেত্রে, সহাস্য, উত্তোলিত বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ… এমন সব ক্যাপশনে। আর নামহারা যাঁরা, তাঁরাও এসেছিলেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথের রেখাপথে। যেমন জনৈক ভদ্রলোক, শ্মশ্রুধারী, মামী, মেজমাসি, একটি বালিকা, জনৈক মিস্ত্রি, জনৈকা যুবতী, জনৈক জ্যোতিষী।

মুখ বাছেন না তিনি। আপন খেয়ালে মুখ তাঁর কাছে সকলই শোভন, সকলই বিমল। তাঁর ছবির সব খাতা তিনি দিয়ে গিয়েছিলেন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে,  ‘নতুনকাকা-মশায়ের শেষদান’-এই কথাটি লিখে। সেসব খাতা উলটেপালটে দেখতে-দেখতে অবনীন্দ্রনাথের যা মনে হল লিখলেন ‘জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর’ প্রবন্ধে, ‘বঙ্গবাণী’ পত্রিকার ১৩৩২ আষাঢ় সংখ্যায়,

কই, আমরাও তো ছবি আঁকি, কিন্তু ছেলেবুড়ো আপনার-পর ইতরভদ্র সুন্দর-অসুন্দর নির্বিচারে এমন করে মানুষের মুখকে যত্নের সঙ্গে দেখা এবং আঁকা আমাদের দ্বারা তো হয় না— আমরা মুখ বাছি। কিন্তু এই একটি মানুষ তিনি কত বড় চিত্রকর হবার সাধনা করেছিলেন যে, সব মুখ তাঁর চোখে সুন্দর হয়ে উঠল, কি চোখে তিনি দেখতেন যে বিধাতার সৃষ্টি সবই তাঁর কাছে সুন্দর ঠেকল, কোনো মুখ অসুন্দর রইল না। রূপবিদ্যার সাধনা পরিপূর্ণ না করলে তো মানুষ এমন দৃষ্টি পায় না!

মৃত্যুর শতবর্ষ পরেও জ্যোতিরিন্দ্রনাথের সেই দেখার দৃষ্টি পূর্ণ প্রকাশ পেল না।