বছর দুই আগের কথা। এক পরিচিতর বাড়িতে নিমন্ত্রণ। আড্ডা-শেষে আমন্ত্রিত এক চিত্রপরিচালক বললেন, ‘তুমি অভিনয় করবে?’
উত্তরটা তৈরি ছিল। বললাম, ‘না।’
এমন তৎক্ষণাৎ প্রত্যাখ্যানে অবাক হলেন ভদ্রলোক। বিস্মিত চোখে বললেন, ‘কেন?’
—আসলে পারব না, কোনওদিন করিনি তো। তারপর গলা নামিয়ে বললাম, “করেছি, স্কুলে, দু’বার। একবার বটগাছ হয়েছিলাম, আরেকবার কাঠবিড়ালি। ওই অভিজ্ঞতায় আপনার কাজ হবে না।” ভদ্রলোক হো হো করে হেসে উঠলেন। বললেন, “শোনো, আজকাল হল ‘ব্লো ইয়োর ওন ট্রাম্পেট’-এর যুগ। যে যেটা জানে না, যে যেটা পারে না, সে আজকাল সেটাই তুমুল কনফিডেন্সের সঙ্গে করে। অতএব এমন সপাটে ‘না’ বললে, আজকালকার যুগে তুমি কিন্তু বেশি কিছু করতে পারবে না।”
‘আগেকার দিনে হলে করা যেত বুঝি?’

আরও পড়ুন: বিভূতিভূষণ চরিত্রের গতিপথ বুঝেই তার মৃত্যু ডেকে আনতেন! লিখছেন যশোধরা গুপ্ত
‘আলবাত যেত।’ ভদ্রলোক বললেন, ‘করুণা বন্দ্যোপাধ্যায়কে চেনো তো?’
এরপর আলোচনার গতিপথ একটু বদলাল। ‘অপরাজিত’-তে অভিনয়ের জন্য সেরা অভিনেত্রীর বাফটা নমিনেশন পাওয়া করুণা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথাই বলছিলেন সেই পরিচালক। করুণা দেবীর স্বামী ও সত্যজিৎ রায়ের বাল্যবন্ধু সুব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়ের মাধ্যমে সত্যজিৎ যখন ওঁকে সর্বজয়া চরিত্রে অভিনয়ের জন্য ডাকলেন, উনি পোস্টকার্ডে লিখে পাঠালেন— ‘পারব না, করব না। ভাবো একবার।’ অনেক অনুনয়ের পর সেই চরিত্রে অবশেষে প্রাণ দেন করুণা বন্দ্যোপাধ্যায়। সত্যজিৎ রায়ের জহুরির চোখের দরুণই ‘না’ শুনেও হাল ছাড়েননি তিনি। আর ওদিকে করুণা বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্বামী সুব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়, শাশুড়ি নলিনী বন্দ্যোপাধ্যায়, শ্বশুর সুনীতকুমার— সকলে মিলে বুঝিয়েসুঝিয়ে ওঁকে রাজি করাচ্ছেন। অথচ, করুণা বন্দ্যোপাধ্যায় কিন্তু তখন অভিনয়ে আনকোরা নন মোটেই, প্রায় আড়াই বছর ধরে ভারতীয় গণনাট্য সংঘে চুটিয়ে অভিনয় করছেন। কিন্তু তারপরেও তাঁর মনে হচ্ছে যে, ‘সত্যজিতের মতো পরিচালকের সিনেমায় অভিনয় করব না, কারণ আমি তার যোগ্য নই।’ এদিকে পরিচালক আবার তাঁকে ছাড়া আর কাউকে যোগ্য ভাবতেই পারছেন না। দুই শিল্পী, একজনের কাজের প্রতি এমন বিনয়, আরেকজনের প্রতিভার প্রতি এমন ইগো-হীন সমর্পণ, এখন কি আদৌ ভাবা সম্ভব?
সত্যিই যায় না। করুণা বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পর্কে যত জানা যায়, ততই বোঝা গেছে যে, এমন নির্মোহ যাপন সহজ নয় মোটেই। হয়ত সেইজন্যই তিনি ‘সর্বজয়া’; জীবনে অর্থ আর খ্যাতির মায়াকে জয় করেছেন যিনি, তাঁরই কেবল অমন নাম সাজে।

এক-এক সময় মনে হয়, হয়তো ওই কারণেই সর্বজয়া চরিত্রে এত অসম্ভব স্বাভাবিক লেগেছে ওঁকে, হয়তো সর্বজয়ার যাত্রার সঙ্গে তাঁর আত্মিক মিল ঘটেছিল অনেক আগেই; হয়তো চরিত্রটায় বিশেষ ‘অভিনয়’-ই করতে হয়নি ওঁকে। তাই ‘পথের পাঁচালী’-তে হরিহরকে তামাক সেজে দিতে দিতে সর্বজয়া যখন বলে, “এর চেয়ে ভাল আর কী হতে পারে? খোকাকে লেখাপড়া শেখাবে… দুগ্গার একটা ভাল পাত্তর জুটবে, আর দু’বেলা দু’মুঠো ভাত, বছরে দুটো কাপড়, এর চেয়ে বেশি আর কী দরকার?” তখন দু’মুঠো ভাতকাপড়ের আতিশয্যে সত্যজিতের সর্বজয়া জীবনের সকল আহ্লাদ খুঁজে পায়, না করুণা দেবীর নির্মোহ ব্যক্তিযাপনই উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে, বোঝা মুশকিল।
১৯১৯ সালের ঠিক আজকের দিনটিতেই খুলনা জেলার পয়োগ্রামে জন্মেছিলেন তিনি। স্কুলে যাননি, কিন্তু তা বলে পড়াশুনায় ঘাটতি পড়েনি একেবারেই। বাবা, মা আর দুই দাদা-ই ছিলেন তাঁর শিক্ষক। আর সে শিক্ষা যে তিনি অন্তরে গ্রহণ করেছিলেন, রবীন্দ্রনাথের ভাষায় সে শিক্ষা যে তিনি বহন নয়, বাহন করেছিলেন; সে পরিচয় পেয়েছি আমরা পরে ।

প্রাইভেটে ম্যাট্রিক পাশ করে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের যোগমায়া দেবী কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন করুণা। ইংরেজি সাহিত্যে এমএ পাশ করার দু-বছর পর বিয়ে করেন সহপাঠী সুব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়কে। যদিও সে-বিয়ে নিয়ে ঝামেলা কম হয়নি— করুণা দেবীর বাড়ি ছিল কংগ্রেসপন্থী, আর সুব্রতবাবুরা ছিলেন মার্কসবাদী। এই রাজনৈতিক মতাদর্শজনিত পার্থক্য দু’জনের যৌথ জীবনযাত্রার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু যে ভিন্নতা আদর্শগত, যেখানে বিচ্ছিন্নতাবাদী গোঁড়ামি, অন্ধত্ব বা একচোখামি নেই, সেখানে সাধনের পথ অধরা থাকে না দীর্ঘক্ষণ। আর এক্ষেত্রে পথ বের করেছিলেন করুণা দেবীর মা সুধা সেন আর সুব্রতবাবুর মা নলিনী বন্দ্যোপাধ্যায়। ভাবতে অবাক লাগে যে স্বাধীনতারও আগে, সেই ১৯৪৩ সালেও, সংসারে এই দুই বাঙালি মায়ের কি প্রভূত কর্তৃত্ব ছিল। হয়তো তাঁদের নির্যাসই করুণা দেবীকে এক ব্যতিক্রমী জীবনের দিকে ঠেলে দিয়েছিল।
ব্যতিক্রমীই বটে। বিয়ের বছরেই, অর্থাৎ ১৯৪৩ সালে বাংলা জুড়ে চলছে মন্বন্তর। সেই দুঃসময়েও করুণা দেবী গণনাট্যের কাজ করে যাচ্ছেন। কয়েকবছর পর স্বামীর সঙ্গে পাড়ি দিচ্ছেন মুম্বই, বা তৎকালীন বোম্বাইয়ের আন্ধেরিতে— কমিউনিস্ট পার্টির কমিউনে। সেখানে গণনাট্যের মহড়া করছেন পার্টিকর্মীদের সঙ্গে। তারপর ১৯৪৮-এ কমিউনিস্ট পার্টি বেআইনি ঘোষিত হলে সুব্রতবাবু যখন গ্রেপ্তার হয়ে নাসিক জেলে বন্দি হলেন, তখন সংসারের হাল ধরতে ইন্টারভিউ দিচ্ছেন করুণা দেবী। শর্টহ্যান্ড শিখছেন, সঙ্গে নাটকের কাজও চলছে পুরোদমে। কিন্তু এ-নাটক তো যে সে নাটক নয়, নিষিদ্ধ নাট্যগোষ্ঠীর নাটক চালাতে হত গেরিলা কায়দায়। পুলিশ আসার খবর পেলেই এদিকওদিক আলাদা হয়ে নাট্যকর্মীরা মিশে যেতেন সাধারণ মানুষের ভিড়ে। নাটকের খবর ছড়াত লোকমুখে আর রাত জেগে তার পোস্টার সাঁটাতে হত কলকাতার দেওয়ালে-দেওয়ালে। গণনাট্য সংঘের একজন সক্রিয় কর্মী ও সদস্য হিসেবে এ-সবই করেছেন করুণা দেবী।

আসলে না-করে তাঁর উপায় ছিল না। মহাকালের নিষ্ঠুরতার মাঝেও যাঁদের বুকের মধ্যেকার স্বপ্নের ধিকিধিকি আগুনটা জ্বালিয়ে না রেখে উপায় নেই, চলার পথের প্রতিটি অন্যায়ের প্রতিবাদ না-করে যাঁদের নিস্তার নেই, পরবর্তী প্রজন্মকে সাম্য আর নিরপেক্ষতার মন্ত্রে দীক্ষিত না করে মুক্তি নেই যাঁদের, তাঁদের দলেই পড়তেন করুণা বন্দ্যোপাধ্যায়।
সারারাত গণনাট্যের পোস্টার সেঁটে ভোররাতে ঘরে ফেরেন যে করুণা বন্দ্যোপাধ্যায়, মন্ডল কমিশন নিয়ে নয়ের দশকের ছাত্র আন্দোলনের বিষয়ে দিলীপ পাডগাওঙ্কারের ‘দ্য টাইমস অফ ইন্ডিয়া’-য় প্রকাশিত সম্পাদকীয়র সাপেক্ষে চিঠি লেখেন, তুখড় লেখনী প্রতিভা নিয়ে জন্মেও লেখার নেশাকে পেশা করে পয়সা রোজগার করতে নারাজ হন, আর কোনওরকম রাখঢাক না-করেই পরিচালক মৃণাল সেনের বক্স অফিস ব্যর্থতাকে আমার, আপনার, গোটা ভারতীয় সমাজের ব্যর্থতা বলে দাগিয়ে দিয়ে বলেন, ‘মৃণাল সেন এতটা সংবেদনশীল, এতটা সমাজসচেতন আর এতটা অসাম্য বিরোধী ছিলেন বলেই সারাজীবন সিনেমা নিয়ে নানান পরীক্ষানিরীক্ষা করে গেলেন; না-পেলেন দর্শক, না-পেলেন প্রোডিউসার, না-পেলেন খ্যাতি।’
১৯৪৮-এ কমিউনিস্ট পার্টি বেআইনি ঘোষিত হলে সুব্রতবাবু যখন গ্রেপ্তার হয়ে নাসিক জেলে বন্দি হলেন, তখন সংসারের হাল ধরতে ইন্টারভিউ দিচ্ছেন করুণা দেবী। শর্টহ্যান্ড শিখছেন, সঙ্গে নাটকের কাজও চলছে পুরোদমে। কিন্তু এ-নাটক তো যে সে নাটক নয়, নিষিদ্ধ নাট্যগোষ্ঠীর নাটক চালাতে হত গেরিলা কায়দায়।
১৯৬৫ সালে দিল্লি-তে আয়োজিত তৃতীয় আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের সেমিনারে একটি পেপার প্রকাশ করেন করুণা দেবী; চলচ্চিত্র— জনজীবন ও সংস্কৃতির প্রতিফলন। সেই সময় এমন কোন কাগজ বা ম্যাগাজিন ছিল না, যারা তাঁর এই লেখার আলোচনা প্রকাশ করেননি। এতে তিনি বলেছিলেন, ‘সিনেমা জনজাগরণ ঘটায়, জনআন্দোলন সূচিত করে। এদেশের মানুষ সাজগোজ, জামাকাপড় সবেতেই যখন সিনেমা দ্বারা অনুপ্রাণিত, তখন সিনেমাকে আরও ব্যাপক অর্থে এদেশে ব্যবহার করা হবে না কেন? কেন সিনেমাকে আমরা সমাজ পরিবর্তনের কারিগর করে তুলব না?’
এমন সংগ্রামী চেতনা যার, তাঁকে ঠিক কী নামে ডাকা যায়? অভিনেত্রী? বিপ্লবী? না কি এক বিপ্লবী অভিনেত্রী? যার জীবনটাও ঠিক অপু ট্রিলজির মতোই। ‘অপুর সংসার’-এর সর্বজয়ার মতোই এক নির্মোহ ব্যক্তিজীবন দিয়ে যার সূচনা, ‘অপরাজিত’-র মা ও ছেলের ক্রমবর্ধমান দূরত্বের মতোই যাঁর রাজনৈতিক জীবনের সঙ্গে সামাজিক আটপৌরেমি খাপ খেল না কোনওদিন, আর ‘অপুর সংসার’-এর মৃত সর্বজয়ার মতোই যে আজ নিজে চলে গিয়েও সন্তান অপুর মতো আমাদের মধ্যেও এক ধিকিধিকি আগুন জ্বালিয়ে রেখে গেল, সেই কি প্রকৃত সর্বজয়া নয়?



