যে-কথা হারিয়ে যায়

Representative Image

স্বপ্না দেব আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। হঠাৎ খবরটা পেয়ে বুকের ভেতরটা কেমন যেন ফাঁকা হয়ে গেল। কেমন এক গভীর শূন্যতার সৃষ্টি হল সেখানে। এই শূন্যতা কীভাবে ভরানো যাবে জানি না। বস্তু দিয়ে বস্তুর শূন্যতা ভরানো যায় কিন্তু এ-শূন্যতা ভরবে কীসে! মানুষের সঙ্গে মানুষের পারস্পরিক সম্পর্কে, হৃদয়তন্ত্রীতে দুঃখ-সুখ-আনন্দ-বিষাদের যে-গভীর রাগিণী বেজে ওঠে, তাতে সহসা যদি ছেদ পড়ে যায়, তাহলে সে-সুর ফিরিয়ে আনার উপায় আমাদের জানা নেই। শুধু স্মৃতিতে যেটুকু থাকার, সেটুকু থাকে।

স্বপ্না দেবের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় ‘প্রতিক্ষণ’-এর মাধ্যমেই। আমার ছবি আঁকার পেশাগত জীবনের একেবারে প্রথম ভাগ থেকেই। তখনকার বামপন্থী সাহিত্য-সংস্কৃতি এবং তার সঙ্গে যুক্ত লেখক-কবিদের সঙ্গেই প্রধানত আমার যোগাযোগ গড়ে উঠেছিল। তার ফলে স্বাভাবিকভাবেই মার্কসীয় ভাবধারার পত্র-পত্রিকার সঙ্গেই আমার মানসিক সম্পর্কের বন্ধন অনেক দৃঢ় ছিল। সেটা বলতে গেলে কখনওই রুজি-রোজগারের জায়গা ছিল না।

আরও পড়ুন: স্বপ্না দেব-এর প্রয়াণে বিকল্প সাংবাদিকতার একটা যুগের অবসান হল! লিখছেন মৃণাল ঘোষ…

শশিভূষণ দে স্ট্রিট থেকে প্রতি সপ্তাহে এরকমই একটি পত্রিকা বেরোত— ‘সপ্তাহ’। আমার ভাই সাহিত্যিক অভিজিৎ সেনগুপ্তের ‘সুন্দরবনের ডায়েরি’ বেরোত এই পত্রিকায়। আমি তার ছবি আঁকতাম। ওখান থেকেই পরিচিতি পেয়ে ‘পরিচয়’ পত্রিকার সঙ্গে যোগাযোগ। দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় তখন সম্পাদক। ওখানেই অরুণ সেনের সঙ্গে আলাপ। তিনিই আমাকে ‘প্রতিক্ষণ’ পত্রিকার সঙ্গে যোগাযোগ করতে বললেন। ‘প্রতিক্ষণ’ সদ্য তখন বেরিয়েছে। নাম শুনিনি তার। একদিন দেখা করতে গেলাম। অরুণবাবু যাঁর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলেন, তাঁকে প্রথম দৃষ্টিতে দেখেই মুগ্ধ হয়ে গেলাম। শুভ্র, নিষ্কলঙ্ক, পাটভাঙা ধুতি-পাঞ্জাবিতে এমন পরিচ্ছন্ন-মার্জিত বাঙালিয়ানা আগে যেন কখনও দেখিনি। তাঁরা নাম জানলাম, প্রিয়ব্রত দেব। ‘প্রতিক্ষণ’-এর প্রতিষ্ঠাতা, প্রাণপুরুষ। তাঁর পাশেই নিঃশব্দে, সুমিষ্ট হাসিতে যিনি আমাকে অভিবাদন জানালেন, তিনি ছিলেন এঁরই সহধর্মিণী— স্বপ্না দেব। তাঁরও বেশভূষা ও শরীরী ভাষায় সেই বিনম্র সাবেকি বাঙালিয়ানা।

স্বপ্না দেব

প্রতিক্ষণের সঙ্গে সেই যে আমার সম্পর্কের শুরু, তারপর কেটে গেল কতবছর। জীবিকার তাগিদে বিভিন্ন প্রকাশকদের বইতে গল্পের ছবির আঁকার কাজ, মলাটের কাজ কতই তো করতাম, কিন্তু প্রতিক্ষণে কাজ করে যে তৃপ্তি, সেরকম আনন্দ কোথাও পাইনি। কখনওই মনে হত না যে— প্রতিক্ষণ একটা ব্যাবসায়িক প্রতিষ্ঠান। কত আড্ডা-আনন্দ-হাসি-কৌতুকে মাতা এ যেন এক বৃহৎ সংসার। এর যেন উচ্ছল প্রাণ আছে। আর সেই প্রাণ জাগানোর সোনার কাঠি যাঁর হাতে, তিনি আর কেউ নন, স্বপ্না দেব। সদাপ্রশান্ত, প্রাণোচ্ছল এই মানুষটি অফিসের মধ্যে ঘুরছেন-ফিরছেন সকলের কুশল জিজ্ঞাসা করছেন, কোনও সমস্যা এলে, শান্তভাবে তার সমাধান করার চেষ্টা করছেন।   

স্বপ্না দেবের কথা বলতে গেলে প্রতিক্ষণের কথাই এসে যায় বারবার। সঙ্গে প্রিয়ব্রত বাবুর কথাও। কারণ প্রতিক্ষণ তো ছিল এঁদের প্রাণপ্রতিমা।

প্রতিক্ষণ আমার কাছে ছিল একটা সৃষ্টিশালা। অফুরন্ত প্রাণের উৎস। প্রায় প্রতিদিনই আমার অফিসের পর চলে আসতাম প্রতিক্ষণে। কখনও-কখনও সঙ্গে থাকত প্রতিক্ষণের পরবর্তী সংখ্যায় ছাপার জন্য কোনও অলংকরণ বা প্রচ্ছদ। দেখতাম আড্ডা বসে গেছে অন্যতম সম্পাদক দেবেশ রায়ের ঘরে। চলছে সাহিত্য, রাজনীতি অথবা শিল্প নিয়ে কোনও আলাপ-আলোচনা। কখনও  হয়তো জোরালো তর্ক-বিতর্ক। সংস্কৃতি জগতের কত লোকই যে আসতেন সেখানে, তার হিসেব নেই। আমার যে কত গুণী লোকের সঙ্গে পরিচয় ঘটেছে এই সূত্রে, তারও শেষ নেই।

পূর্ণেন্দুদা হয়তো নিজের ঘরে বসে ছবি আঁকছেন, তাঁর সঙ্গে ছবি নিয়ে কথাবার্তা হত। তারপর হয়তো কিছু একটা আঁকতে বলতেন। বসে যেতাম আঁকতে। কাপের পর কাপ আসত লেবু চা। স্বপ্না দেব আসতেন সবার কাছে, কিছু কথা বলতেন, চা পেয়েছি কিনা জিজ্ঞেস করতেন। এই বৃহৎ মহোৎসবের গৃহকর্ত্রী ছিলেন তিনি।

প্রিয়ব্রত বাবু এবং স্বপ্না দেব সর্বময় কর্তা-কর্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও, একটা দুর্লভগুণের অধিকারী ছিলেন। যাঁর যা কাজ, সেখানে কখনও হস্তক্ষেপ করতেন না। লেখক কিংবা শিল্পীর কাজের ব্যাপারে নীরবই থাকতেন। বলা ভাল, শিল্পীকে স্বাধীনতা দিতেন। কিন্তু তাঁদের উৎসাহিত করার ব্যাপারেও একটা নীরব ভূমিকা থাকত।

একটা ব্যাপার বেশ লোভনীয় ছিল আমার কাছে। সন্ধ্যা গড়িয়ে গেলে, এই দু’জনের উদ্যোগে নীচের থেকে চলে আসত গরম-গরম শিঙাড়া অথবা লঙ্কার আচার-সহ কচুরি। এ-কথা আমি নির্দ্বিধায়, নিঃসংশয়ে বলতে পারি যে, প্রকাশনা জগতে সৃষ্টিশীল কাজ করার যা কিছু আনন্দ-উৎসাহ-স্বপ্ন দানা বেঁধেছিল, তা এই প্রতিক্ষণকে ঘিরেই। এবং সবটার মূলে ছিলেন স্বপ্না দেব আর প্রিয়ব্রত বাবু। স্বপ্না দেবের কথা ভাবতে গেলে একঝলকেই আমার মনে হয় সরল, অহমিকাবর্জিত একজন সাধাসিধে মাধুর্যমাখা মানুষ, যাঁকে ভাবতে হয় প্রতিক্ষণের মতো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রথম শ্রেণির কাগজ চালানোর কথা।

কতবার তাঁর বাড়ি গেছি, মুগ্ধ হয়েছি তাঁর আতিথেয়তায়। নেহাৎ ব্যক্তিগত ব্যাপারেও তিনি মতামত দিয়ে তা সমাধান করার চেষ্টা করেছেন। এই মানুষকে কী আর ভোলা যায়!

একটি কথা বিশেষভাবে বলা দরকার। তাঁর এই শান্ত, মাধুর্যময় চরিত্রের সমান্তরালে ছিল আর-একটি সত্তা, যা অত্যন্ত দৃঢ় এবং সাহসী। একটা উদাহরণ দিলে বিষয়টা আরও স্পষ্ট হবে। সে-সময়ে ভারতের উত্তরভাগে চলছে ভয়ঙ্কর খালিস্তানি আন্দোলন। উগ্র শিখরা যার নেতৃত্ব দিচ্ছিল, যাঁদের হাতে খুন হয়ে গেলেন স্বয়ং ইন্দিরা গান্ধী। এই আন্দোলনের একজন প্রধান নেতা  ভিন্দ্রেনওয়ালা, যিনি ছিলেন পঞ্জাবের তৎকালীন সরকারের কাছে ত্রাস। স্বপ্না দেব গেলেন বাঘের ডেরায়, তাঁর সাক্ষাৎকার নিতেও বিন্দুমাত্র দ্বিধাগ্রস্ত হননি। তাঁর দিকে প্রশ্নবান ছুঁড়ে দেয়ার মতো হিম্মৎ ছিল তাঁর! অবিচল থেকে নিজের কাজটুকু করে নেওয়ার অসাধারণ আত্মবিশ্বাস ছিল স্বপ্না দেবের। সেই সাক্ষাৎকার ছাপাও হয়েছিল প্রতিক্ষণে।

আর-একটা জিনিস মনে পড়ে। প্রতিক্ষণের জন্য আমাকে মাঝে-মাঝে লিখতেও বলতেন। আমি ট্রেনে রোজ ডেলি-প্যাসেঞ্জারি করি জেনে আমাকে এই বিষয়েই একটা লেখা লিখতে বললেন। আমি লিখেছিলাম হকারদের নিয়ে একটা লেখা। মনে আছে, লেখাটা সবার ভালও লেগেছিল বেশ।পূর্ণেন্দু পত্রী প্রয়াত হওয়ার পর একটা স্মরণলেখ লিখতে বলেছিলেন। সেই লেখাটা পড়ে তিনি একটু বিচলিতও হয়েছিলেন মনে আছে।

যুধাজিৎ সেনগুপ্ত ও স্বপ্না দেব

স্বপ্না দেবের প্রয়াণে এতটাই বেদনাহত হয়েছি যে— আজ যখন এই লেখাটা লিখতে বসলাম, আমার মন সায় দিচ্ছিল না। মনে হচ্ছিল ধরাছোঁয়ার বাইরে যে, তাঁকে নিয়ে লিখে কী আর হবে! কিন্তু তখন রবীন্দ্রনাথ মনে পড়ল। ‘মানুষের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই।’ মানুষের ছোট-ছোট বাঁচা নিয়েই তো বৃহৎ বাঁচা। ভিন্ন-ভিন্ন মানুষের মধ্যে তাঁর ভিন্ন-ভিন্ন রূপ। সব মিলিয়েই গড়ে ওঠে একজন সামগ্রিক মানুষের ব্যক্তিত্ব। আমার মধ্যে স্বপ্না দেব যেভাবে বেঁচে ছিলেন, তাই-বা মানুষ কীভাবে জানবেন। কালের নিয়মে তা তো হারিয়ে যাবেই! তাই যদি কালি-কলমে খানিকটা ধরে রাখা যায়।

স্বপ্না দেব গেলেন বাঘের ডেরায়, তাঁর সাক্ষাৎকার নিতেও বিন্দুমাত্র দ্বিধাগ্রস্ত হননি। তাঁর দিকে প্রশ্নবান ছুঁড়ে দেয়ার মতো হিম্মৎ ছিল তাঁর! অবিচল থেকে নিজের কাজটুকু করে নেওয়ার অসাধারণ আত্মবিশ্বাস ছিল স্বপ্না দেবের। সেই সাক্ষাৎকার ছাপাও হয়েছিল প্রতিক্ষণে।

যেমন একটা সাধারণ ছবি আমার মনে চিরদিনের জন্য আঁকা হয়ে থাকবে। যদিও প্রকৃতপক্ষে সেটা সাধারণ নয়। প্রত্যেক বছরই সেটা ঘটত। কলকাতা বইমেলা। প্রতিক্ষণের স্টল। স্টলের একপাশে সোফা দিয়ে সাজিয়ে একটা সুন্দর ঘরের মতো করা হয়েছে। ঘননীল পর্দার ওপর সাদা লেখা জ্বলজ্বল করছে— ‘প্রতিক্ষণের আড্ডা’ কলকাতার সাংস্কৃতিক জগতের তাবৎ সাহিত্যিক-কবি-গায়ক-নাট্যকার-চিত্রশিল্পীরা আসছেন, যাচ্ছেন বসে গল্পগুজব করছেন। হাসি-ঠাট্টা-রসিকতায় উচ্ছল হয়ে উঠছে সবকিছু। আর তার মধ্যে দেখা যাচ্ছে— স্বপ্না দেব মুখে হাসি, হাতে মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে সবাইকে মিষ্টি বিলি করছেন। মনে আছে, প্রতিক্ষণ থেকে বারাসাতের আমডাঙায় একবার যখন বনভোজন হয়, আমার পরিবারের সঙ্গে কীভাবে সহজ আনন্দে মেতে উঠেছিলেন। কোমরে আঁচল বেঁধে তদারকি করছিলেন সব কিছু। তাঁর সমগ্র অস্তিত্বে ছিল দয়াময়-কোমল আভিজাত্য। অত্যন্ত মুক্ত মনের মানুষ, কিন্তু তথাকথিত আধুনিকতার উগ্রতায় তিনি কখনওই বিশ্বাসী ছিলেন না। আন্তর্জাতিক মননের মানুষ ছিলেন তিনি, কিন্তু মনের গহীনে ছিলেন খাঁটি বাঙালি। এভাবেই তিনি আমার মনে বেঁচে থাকবেন নিজের অপরূপ ব্যক্তিত্বে।