আপনারা যে-সব শিল্পী এই গানটার সঙ্গে জড়িয়ে আছেন, তাঁরা প্রত্যেকেই অভিনেতা। কিন্তু তা হলে নাটক, সিনেমা বা টিভি শো, এসবের মধ্যে না গিয়ে গান বাঁধলেন কেন? প্রতিবাদের গানের একটা ধারা আছে বলে? না কি গানই জনপ্রিয় হয় বলে?
এটা ঠিকই আমরা প্রায় প্রত্যেকেই অভিনেতা, কিন্তু আমাদের প্রত্যেকেরই সঙ্গীতের সঙ্গে একটা গভীর যোগাযোগ রয়েছে। অনির্বাণ নাটকের সূত্রে গানের মধ্যে থাকে, আমি তো আগে একটা ব্যান্ডে গান গাইতাম, ঋদ্ধি, ঋতব্রত, এরাও খুব ভাল গান করে। ওদেরও নাটকের সঙ্গে গানের, মিউজিকের একটা যোগাযোগ আছে। তবে আমার মনে হয়, মানুষ যখন ভেতরে ভেতরে ছটফট করে, তখন তার কাছে অনায়াসে যে-ব্যাপারটা আসে, তার ওপর ভর করেই সে প্রতিবাদের মাধ্যমটা বেছে নেয়। আমাদের মনে হয়েছিল গান সেই মাধ্যমটা হতে পারে। যা আমাদের এবং লোকের মনে সহজেই দাগ কাটতে পারে। হ্যাঁ, এটা ঠিকই, আমাদের বাংলা গানের মধ্যে একটা প্রতিবাদের গানের ঐতিহ্য আছে। সে রবীন্দ্রনাথ হোক বা নজরুল, আইপিটিএ হোক বা ইয়ুথ কয়্যার। মৃণাল সেনের ‘আকালের সন্ধানে’ সিনেমায় গাড়ি করে সবাই একসঙ্গে যাওয়ার সময় ‘হেই সামালো ধান হো, কাস্তেটা দাও শান হো’ গাইছেন। ওই সিনেমায় সবাই কিন্তু অভিনেতার ভূমিকায় অভিনয় করছিলেন।
আর নাটক তো হচ্ছে, অনেকেই করছেন, ছাত্র আন্দোলন হচ্ছে, এবং তা মাথাচাড়া দিয়ে উঠলেই তাকে চেপে দেওয়ার বেদম চেষ্টা হচ্ছে। তার সঙ্গে কিন্তু ‘হম দেখেঙ্গে’ গানও গাওয়া হচ্ছে, ‘সব ইয়াদ রখা জায়েগা’, সে কবিতাও ছড়িয়ে যাচ্ছে। সত্যি কথা বলতে কী, আমরা অত ভেবে করিনি। আপনা-আপনিই গানটা এসেছে। এবং আমরা অভিভূত যে, এই গানটা সারা ভারতের বহু মানুষের চিন্তাকে ছুঁতে পেরেছে।
তা হলে তো এবার জিজ্ঞেস করতেই হয়, গানটা তৈরি হল কী করে?
গত বছর, মানে ২০২০-র জানুয়ারি মাসে যখন এনআরসি-সিএএ নিয়ে দেশ উত্তাল, শাহিনবাগে প্রতিবাদ হচ্ছে, আমাদের পার্ক সার্কাস ময়দানে দিন-রাত জেগে প্রতিবাদ চলছে, তখন একদিন অনির্বাণ ফোন করে জানাল যে, এইসব পরিস্থিতি ওকে এমন অস্থির করে তুলেছে যে, ও একটা গান লিখেছে। সেটা নিয়ে কিছু করা যায় কি না। আমি বললাম নিশ্চয়ই করা যায়। কথাও হল দু’চারবার। কী করা যেতে পারে, কীভাবে করা যেতে পারে, এসব আলোচনা নিয়ে এগোতে এগোতেই দুম করে দেশে লকডাউন শুরু হয়ে গেল। আচমকা একটা এমন পরিস্থিতি, যে আমরা কেউই কিছু বুঝে উঠতে পারছিলাম না কী করব, কী করা উচিত। লকডাউনের সঙ্গে কিছুটা ধাতস্থ হয়ে, তার পর আবার ঠিক করলাম গানটা তৈরি করব। লকডাউন উঠলেও প্রথম দিকে খুবই কড়াকড়ি ছিল। আমরাও সেসব নিয়ম ভাঙতে চাইনি। তারপর গানটার শুটিং শুরু করি এ বছরের গোড়ার দিকে। সেটাও অনেক নিয়ম মেনে। এবং তারপর গানটা ফেসবুকে আর ইউটিউবে প্রকাশ করা হয়।
এই গানের যে মূল লাইনটা ফিরে ফিরে আসে, সেই লাইনটা শুনে মনে হচ্ছে, একটি নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের প্রতি অন্যায় এই প্রতিবাদের গানটায় বেশি প্রাধান্য পেয়েছে। তা-ই কি?
দু’তিনটে দিক দিয়ে এই প্রশ্নটার উত্তর দিতে চেষ্টা করব। এক, এনআরসি এবং সিএএ এখনও খুব প্রাসঙ্গিক। এবং এই নির্বাচনেও সেটাকে হাতিয়ার করা হচ্ছে। নির্বাচনী প্রচারের মধ্যে যেখানে সিএএ-র কথা বললে মনে হচ্ছে ভাল হয়, সেখানে বলা হচ্ছে— আমরা জিতে এলে সিএএ করবই। আবার যেখানে মনে হচ্ছে এনআইএ বা সিএএ নিয়ে বলাটা ততটা হয়তো কার্যকর হবে না, সেখানে বলা হচ্ছে, এসব নিয়ে আমরা এখনও কিছু সিদ্ধান্ত নিইনি, এটা ভাবনার স্তরে। ব্যাপারটাকে খুব ধোঁয়াশার মধ্যে রাখা হচ্ছে, কিন্তু কোনও সময়ই ভাবনাটাকে বাতিল করে দেওয়া হচ্ছে না। কেবল নানা জায়গায়, নানাভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে।
দ্বিতীয়ত, অন্য কোথাও পাঠিয়ে দেওয়ার যে বন্দোবস্ত, সেটা যে কেবল সংখ্যালঘুদের ক্ষেত্রে সীমিত, তা কিন্তু নয়। এনআরসি হলে বিপদে পড়বে বা পড়েছে অসম-এর একটি বিরাট উদ্বাস্তু হিন্দু গোষ্ঠীও। ফলে, ব্যাপারটা যদিও করা সংখ্যালঘুদের বিপাকে ফেলার জন্য, কিন্তু এই নিয়ম কার্যকর হলে অনেকেই বিপদে পড়বেন। যাঁরা পঞ্চাশ-ষাটের দশকে ভারতে এসেছেন, তাঁরা উদ্বেগে রয়েছেন, কবে তাঁদের কাছ থেকে কাগজপত্র দেখতে চাওয়া হবে। ফলে, অন্য কোথাও যাব না, আমি এই দেশেতেই থাকব— এটা কিন্তু কেবল সংখ্যালঘুদের কথা ভেবে লেখা নয়।
আর তিন নম্বর, আমাদের দেশের এখন যা অবস্থা, সচেতন কোনও মন্তব্য করলেই বলা হয়— এদেশে থাকতে হবে না, গো টু পাকিস্তান। কিন্তু আমি অন্য দেশে কেন যাব? যে পাকিস্তান যাওয়ার নিদান দিচ্ছে সে আমার সরকার। মনে রাখতে হবে, আমার সরকার কিন্তু আমার দেশ নয়। আমার দেশ আমার বাড়ি, পরিবেশ, আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশী, আমার স্কুল, বন্ধুবান্ধব, আমার এসি সারানোর মিস্ত্রি, চায়ের দোকানওয়ালা, যে মুসলমান বন্ধুটার সঙ্গে স্কুল-কলেজে এক সঙ্গে পড়েছি— সে, বাড়িতে যে ঠাকুরমশাই পুজো করতে আসেন তিনি, পাড়ার মোড়ের অশ্বত্থ গাছটা। এই সমস্তটা মিলিয়ে আমার দেশ। এবং আরও অনেক কিছু। আমার দেশটা একমাত্র আমার সরকার নয়। সে যে পার্টির সরকারই হোক। সে আমার দেশ পরিচালনা করে মাত্র। সুতরাং আমার সরকার নিয়ে সমালোচনা করলে আমায় দেশ ছেড়ে চলে যেতে হবে কেন? আর সরকারই বা বলবে কেন দেশ ছেড়ে যেতে? আমি এদেশের নাগরিক, আমার রেশন কার্ড, আধার কার্ড, ভোটার কার্ড যা যা কাগজ দরকার সব আছে, আমি ভোট দিই, ট্যাক্স দিই। সব নিয়মমতো করি, কিন্তু সে সরকারের সমালোচনা করতে পারব না, কেন? তা হলেই শুনতে হবে, অন্য দেশে যাও?
সুতরাং, গানের কথাগুলো কিন্তু সংখ্যালঘু সম্প্রদায় বা এনআরসি-সিসিএ’র আওতায় আসা মানুষজনদের নিয়ে নয়। যাঁরা সাধারণ নাগরিক, যাঁরা সরকারের মতবিরোধ করেন, যাঁরা প্রাপ্য না পেলে আন্দোলন করেন— এ গান তাঁদের জন্যও। মোদ্দা কথা, আমরা যারা— মানুষ দিয়ে তৈরি দেশের ভাবনায় বিশ্বাসী, তাঁদের সব্বার জন্য এই গান।