এনার্জি করিডরে কবিগুরু
টেক্সাস শুনলেই কেমন মনে হয় না? বিশাল হ্যাট পরা কাউবয় আসছে ঘোড়া ছুটিয়ে, কিংবা এখুনি ঠাঁই-ঠাঁই করে গুলি চালাবে ড্রাগ মাফিয়ার দল। সেই পাঁচের দশকে এলিজাবেথ টেলর রক হাডসনের অস্কারজয়ী ‘জায়ান্ট’ থেকে হালের বহু নেটফ্লিক্স সিরিজের প্রেক্ষাপট আমেরিকার এই বিশাল আয়তনের রাজ্যটি। টেক্সাস মুভিজের এমনই কদর বিশ্বজুড়ে যে, হায়দরাবাদে রামোজী ফিল্ম সিটিতে পর্যন্ত টেক্সাসের সেট বানানো আছে যেখানে কাঠের বাড়ি, ঘোড়া, কাউবয়ের ম্যানেকিন সব আছে। ডাউন টাউন হিউস্টনে কিন্তু টেক্সাস মার্কা কিছু চোখে পড়ল না। একসময়ে রাজধানী ছিল, সে অবশ্য অনেকদিন আগের কথা। ১৮৩৯ সালেই অস্টিনে সরিয়ে নেওয়া হয় রাজধানী। তা বলে হিউস্টনের গুরুত্ব এতটুকু কমেনি, বরং বেড়েছে দিনে-দিনে। জনসংখ্যার দিক থেকে বলুন কী ব্যবসা-বাণিজ্য, হিউস্টন চিরকাল একনম্বরে। তেলকেন্দ্রিক শিল্প, অত্যাধুনিক স্বাস্থ্য পরিষেবা আর নাসার জনসন স্পেস সেন্টারের জন্য পৃথিবী জুড়ে এত খ্যাতি হিউস্টনের।
আরও পড়ুন: এমিরেটস-এর এয়ারবাসকে যে বিয়েবাড়ি বানিয়ে ফেলা যায়, সেটা করে দেখিয়েছিল কলকাত্তাইয়ারা…
জুলাইয়ের খর রোদে, হোটেলের বাইরে পা রেখে বেজায় মজা পেলাম। আমার একটা অদ্ভুত স্বভাব আছে, আমি বিদেশের বিভিন্ন শহরে ম্যানহোলের ঢাকনার ছবি তুলি। কারণ, ইউরোপের অনেক শহরে ম্যানহোলের ঢাকনায় কবিতার লাইন লেখা থাকে। লন্ডনের রাস্তায় প্রাচীন লোহার ঢাকনার কাছে কান পাতলে, আমি শুনতে পাই টেমসের জলস্রোতের শব্দ। আমেরিকার অনেক শহরে একটুকরো শিল্পকর্ম খোদাই করা থাকে ওই ঢাকনার ওপর। আর বহু জায়গায় লেখা থাকে মেড ইন ইন্ডিয়া। হিউস্টনেও ফুটপাথে নজর করে দেখলাম, ভারতে তৈরি এই লোহার ঢাকনা। পরে খোঁজ নিয়ে জেনেছি, হাওড়ার ফাউনট্রিতে তৈরি হয় কাস্ট আয়রনের ম্যানহোল লিড। অবশ্যই আমেরিকার থেকে অনেক সস্তায়। সেগুলো রপ্তানি হয় আজ না, অন্তত আটের দশক বা তারও আগে থেকে।

আর-একটা মজার ব্যাপার দেখে, ছেলেমানুষের মত খুশি হলাম আমি আর আমার সহকর্মী বৈশালী। শহরের এই কেন্দ্রস্থলে একটি বাড়ি থেকে অন্য বাড়িতে যাওয়ার জন্য আছে স্কাইওয়াক। রোদ-বৃষ্টি গায়ে না লাগিয়েই দিব্যি হেঁটে-হেঁটে পৌঁছে যান দোকানে, মলে, রেস্তরায়। এরকম নাকি এগারো কিলোমিটার পথ আছে, কোথাও আকাশে, কোথাও বা পাতালে। কোনও যানবাহনে না চড়ে, স্রেফ পায়ে হেঁটে পাড়ি দেওয়া যায় একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে। ভাবুন তো টালিগঞ্জ থেকে এসপ্ল্যানেড হেঁটেই মেরে দিলেন এবাড়ি সেবাড়ির মধ্য দিয়ে! আমরা সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনে হেঁটেই চললাম, কত কিলোমিটার সে আর হিসেব করিনি।

রবীন্দ্রনাথের মূর্তি বিদেশের বহু জায়গাতেই আছে। সেটা আশ্চর্যের কিছু নয়। কিন্তু কীভাবে আছে, সেটা ক’জন ভারতীয় বা বাঙালি পর্যটক খোঁজ নেয়? লন্ডনের কাছে স্ট্যাটফোর্ড আপন অ্যাভনে শেক্সপিয়রের বাড়ির বাগানে কবিগুরুর যে-আবক্ষ মূর্তিটি আছে, সেটির অযত্ন দেখে মনে হয়, না থাকলেই ভাল ছিল। ১৯৯৫ সালে মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু যখন এটি উপহার দিয়েছিলেন শেক্সপিয়র বার্থপ্লেস ট্রাস্টকে, তখন বাঙালি রোমাঞ্চিত হয়েছিল। কিন্তু সেটির সঠিক রক্ষণাবেক্ষণ হয় না। অন্যদিকে হিউস্টনের এনার্জি করিডরের রে মিলার পার্কে ব্রোঞ্জের লাইফ সাইজ রবীন্দ্র-মূর্তি এত ঝকঝকে যে প্রবাসী ভারতীয়দের ধন্যবাদ না জানিয়ে উপায় নেই। এর কৃতিত্ব টেগোর সোসাইটি অফ হিউস্টন, আরও বিশেষভাবে বলতে গেলে ওখানকার নামী ব্যবসায়ী অশোক দে সরকার ও তাঁর স্ত্রী রুমা দে সরকারের। দু’জনেই আইআইটি খড়গপুরের প্রাক্তনী। ওঁরা অবশ্য বারবার কৃতজ্ঞতা জানান স্থানীয় প্রশাসনকে, মূর্তি বসানোর এত গুরুত্বপূর্ণ একটি জায়গা দেওয়ার জন্য। ২০১৩ সালে বাংলার খ্যাতনামা শিক্ষাবিদ সত্যম রায়চৌধুরীর উদ্যোগে শিল্পী কমল মন্ডলের তৈরি মূর্তিটি পাঠানো হয় আমেরিকায়। টুকরো হিসেবে। তারপরে ওখানে অ্যাসেম্বল করে স্থাপন করা হয়। এটাও যথেষ্ট গর্বের ব্যাপার যে, এক বাঙালি শিল্পীর হাতে তৈরি হয়েছে এই চমৎকার মূর্তি। টেগোর গ্রোভ মেমোরিয়াল পার্ক দেখতে শুধু ভারতীয় কেন, সব দেশের মানুষ আসেন। বঙ্গ সম্মেলনে যাওয়া কলকাতার শিল্পীরা সবাই দল বেঁধে গেলেন রে মিলার পার্কে, কোরাসে ‘আগুনের পরশমণি’ ভরিয়ে তুলল কেজো দিনের দুপুর। সেই সুরের টানে কত আমেরিকান চলতি গাড়ি থামিয়ে নেমে এলেন, ভিড় করে দাঁড়ালেন রবিঠাকুরের পদতলে। সে এক গায়ে কাঁটা দেওয়া মুহূর্ত।
কেন গুরুত্বপূর্ণ হিউস্টনের এই এনার্জি করিডর? একসময়ে হিউস্টনকে বলা হত এনার্জি ক্যাপিটাল অফ দ্য ওয়ার্লড। প্রাকৃতিক গ্যাস থেকে অশোধিত তেল, হিউস্টনের আশেপাশে বিপুল সম্ভার। যে-পার্কে রবীন্দ্রনাথের মূর্তি, সেই এলাকাটাকে এনার্জি করিডর বলে কারণ এখানেই বড় বড় তেল আর গ্যাস কোম্পানির অফিস। রোজ নাকি লাখের ওপর লোক এখানে চাকরি করতে আসে। এই বিপুল কর্মকান্ড ঘিরে স্বাভাবিকভাবেই তৈরি হয়েছে অভিজাত আবাসন, তারকা হোটেল, দামী রেস্তোরাঁ, নামী স্কুল। যতই আকাশছোঁয়া বাড়ি উঠুক না কেন, গোটা এলাকাটা কিন্তু সবুজে ভরা। পথের ধারে গাছের সারি তো আছেই, আর আছে অনেক পার্ক। অশোকদাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘এই উদ্যোগ কি সরকারের?’ অশোকদা জানালেন, টেক্সাসে ম্যানেজমেন্ট ডিস্ট্রিক্ট বলে সরকারি বিভাগ আছে। তাদের কাজ হল এলাকায় বাণিজ্য কর আদায় আর তাই দিয়ে ব্যাপক হারে গাছ লাগানো, পার্ক-উদ্যান তৈরি, রাস্তা চওড়া করা, সাইকেল আর পায়ে হাঁটার রাস্তা বার করা, নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, এমনকী বিজ্ঞাপন আর প্রচারের মাধ্যমে অঞ্চলের ব্র্যান্ডিংও তাদের দায়িত্ব। এনার্জি করিডরে বিশ্বের পয়লা সারির তেল কোম্পানিগুলির অফিস হওয়ার কারণে, করের পরিমাণ বিলিয়ন-বিলিয়ন ডলার। সেটাই কাজে লাগানো হয় পরিবেশের উন্নয়নে। এর কাছেই দে সরকারদের খুব সুন্দর বাড়ি। সেখানে সকলের ডিনারের নেমন্তন্ন। আর একপ্রস্থ গানবাজনা হল। যে-ঘরটিতে গ্র্যান্ড পিয়ানো রাখা, তার ছাদ আর জানালার কাচ, চার্চের কথা মনে পড়িয়ে দেয়। হৈ-হৈ করে ভালমন্দ খেয়ে হোটেলে ফেরা, তারপর ছোট-ছোট দলে রাতভর আড্ডা। আসলে কলকাতায় এত ব্যস্ত থাকেন তারকারা, তাছাড়া নামডাক হয়ে গেলে ইচ্ছে থাকলেও প্রকাশ্যে প্রাণ খুলে আনন্দ করা যায় না। তাই লক্ষ করে দেখেছি, বিদেশে গেলে বাঁধন আলগা করে যে যার মতো নিঃশ্বাস নেন। আপনমনে রাস্তায় হাঁটলে, শপিং মলে ঘুরলে, হুটহাট রেস্তরায় ঢুকলে মবড হওয়ার ভয় নেই। প্রবাসী মধ্যবয়সিরা ছাড়া মাঝেসাঝে সেলফির আবদার করার লোকও নেই। এই দু’দণ্ডের শান্তিতে সেলিব্রিটিদের মুডই বদলে যায়।
তা এই অন্য মেজাজের একঝাঁক তারকাকে নিয়ে আমরা বেরোলাম নগরকীর্তনে। প্রথম গন্তব্যটাই অদ্ভুত ন্যাশনাল মিউজিয়াম অফ ফিউনারাল হিস্টরি। ‘জন্মিলে মরিতে হবে। অমর সে কোথা কবে’, এই আপ্তবাক্য সকলেই জানি। কোনও কোনও শেষযাত্রা হয় রাজকীয়, কোনওটা বা চরম উপেক্ষার, আর আমাদের মত হরিদাস পালেদের জন্য বরাদ্দ কাচঢাকা গাড়িতে কয়েকগোছা রজনীগন্ধা। এসবই আমাদের দেখা। তা বলে মিউজিয়ামে গিয়ে জানতে হবে অন্তিম ক্রিয়ার কিস্সা? ঢুকে বুঝলাম, জানার কোনও শেষ নেই।


ইতিহাসের পথ বেয়ে কীভাবে বদলেছে শববাহী শকট, কফিনের নক্সা, প্রেসিডেন্ট থেকে পোপ কার শেষযাত্রা ছিল কত বর্ণময় সব সাজানো। এক একটা ঘর তো রীতিমত অস্বস্তিকর। আলো-আঁধারিতে কার যেন কফিন, পাশে কালো পোশাক পরা মূর্তি বসে আছে, গা ছমছম করে। শুনলাম, হ্যালোয়িনের সময় এই মিউজিয়ামে নানা ভুতুড়ে ইভেন্ট হয়, টিকিট কেটে ভয় পেতে আসে লোকজন। শুধু শেষযাত্রার কেন, শোকপ্রকাশের ইতিহাসও দেখলাম বদলে গেছে যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে। উনিশ শতকে ব্যক্তিগত শোকের চেয়ে পাবলিক মোর্নিং-এর ওপর বেশি জোর দেওয়া হত। ভিক্টোরীয় গোঁড়ামি তখন পাশ্চাত্যের জীবনছন্দ। শোকের আবহে ঠিকঠাক পোশাক, এমনকী গয়না পরতে হবে (মৃতের চুল থেকে তৈরি গয়না রাখা আছে স্যাম্পল হিসেবে), ঘর সাজাতে হবে নিয়ম মেনে। জেনে চমৎকৃত হলাম ‘লিভিং রুম’ কথাটা কোথা থেকে এসেছে। বিংশ শতাব্দীতে আমেরিকায় তৈরি হয় ফিউনারাল হোম, মানে বাড়ি থেকে সরিয়ে নিয়ে যেখানে রাখা হত মৃতদেহ আর চলত নানা ধর্মীয় আচার। যেহেতু বাড়ির বৈঠকখানায় সেই সময় শুধুই জীবিতদের অধিকার, তাই তার নাম হল লিভিং রুম। মৃত্যু নিয়ে বাড়াবাড়ির চরম পর্যায় আমার মনে হল মিউজিয়ামের স্যুভেনির শপটি। সেখান থেকে নানারকম উপহার কিনতে পারেন প্রিয়জনের জন্য, তবে কফিনের আকারের বিজনেস কার্ড হোল্ডার বা হাড় হিম করা সফট টয় কতটা প্রশংসা পাবে নিজের দেশে, কেনার আগে ভেবে নেবেন।
২০১৩ সালে বাংলার খ্যাতনামা শিক্ষাবিদ সত্যম রায়চৌধুরীর উদ্যোগে শিল্পী কমল মন্ডলের তৈরি মূর্তিটি পাঠানো হয় আমেরিকায়। টুকরো হিসেবে। তারপরে ওখানে অ্যাসেম্বল করে স্থাপন করা হয়। এটাও যথেষ্ট গর্বের ব্যাপার যে, এক বাঙালি শিল্পীর হাতে তৈরি হয়েছে এই চমৎকার মূর্তি।
মৃত্যুকে এতখানি গুরুত্ব দিয়েছে যে-শহর, সে কিন্তু আসলে জীবনের জয়গান গায়। টেক্সাসকে বলা যায় বিশ্বের সবচেয়ে বড় মেডিক্যাল হাবগুলির একটি (মতান্তের সর্বশ্রেষ্ঠ)। টেক্সাস মেডিক্যাল সেন্টার-এর ছাতার নিচে যত সংখ্যক হাসপাতাল আর চিকিৎসা-গবেষণা সংস্থা আছে, তা সম্ভবত পৃথিবীর আর কোথাও নেই। মেডিক্যাল স্কুল, নার্সিং স্কুল, চিকিৎসার প্রায় সবকটি বিভাগের জন্য আলাদা আলাদা ট্রেনিং স্কুল, কী নেই! সেই কোন যুগে হিউস্টনে চালু হয়েছিল লাইফ ফ্লাইট এয়ার অ্যাম্বুল্যান্স। সারা পৃথিবী থেকে এখানে কঠিন রোগের চিকিৎসা করাতে আসেন মানুষ। হিউস্টনের সবচেয়ে বড় শপিং মল গ্যালারিয়াতে ঘোরার সময়ে পরপর বেশ কয়েকজন কমবয়সি কিন্তু অত্যধিক মোটা ছেলেমেয়ে নজরে পড়ল। তাদের স্থূলতা এমন পর্যায়ের যে, হাঁটতে-চলতে পারে না, হুইল চেয়ারে নিয়ে ঘুরছে বাড়ির লোক। একটি মেয়ে তো এত সুন্দর, একঢাল সোনালি চুল, সমুদ্র নীল চোখ, করুণভাবে তাকিয়ে ছিল আইসক্রিম পার্লারের দিকে, দেখে ভারি কষ্ট হল। এই শহরে এত অতিরিক্ত ওজনের মানুষ নজরে পড়ছে কেন? কৌতূহল হল। জানলাম, মার্কিন মুলুকে অল্পবয়সিদের মধ্যে ওবেসিটি মারাত্মকভাবে বাড়ছে। ছোট বয়স থেকে অতিরিক্ত জাঙ্কফুড আর ঠান্ডা পানীয় এর জন্য দায়ী।
এই হিউস্টনেই আছে নামকরা সব ওয়েট ম্যানেজমেন্ট ক্লিনিক। অবস্থা আয়ত্বের বাইরে চলে গেলে ছেলেমেয়েকে এখানে নিয়ে আসেন অভিভাবকেরা। লক্ষ করে দেখেছি, আমেরিকায় সারাদিন বাসে-ট্রেনে-সাবওয়েতে, এমনকী গাড়ি চালানো অবস্থাতেও বেশির ভাগ লোকের একটা হাত আটকা কোকের গ্লাসে। সকালে একবার কিনলে চব্বিশ ঘণ্টা যে-কোনও দোকানে রিফিল ফ্রি। লম্বা গ্লাসের অর্ধেকটা বরফ, তার ওপর কোকা কোলা। আর পথচলতি খাবার বলতে স্যান্ডউইচ-বার্গার-ব্যাগেল-ডোনাটের ছড়াছড়ি। ভাবলাম, আহা রে, ওদের তো কোনও ভাস্কর চক্রবর্তী নেই যে লিখে যাবেন ‘রক্তে বিষ মিশে আছে প্রিয়তমা।’
 
															 
							

