ঘরের আমি আর বাইরের আমি, কর্মক্ষেত্রের আমি দু’টি আলাদা সত্ত্বা। ঘরের মানুষটি অনাড়ম্বর হলে চলে, কিন্তু ঘর ছেড়ে বাইরে কাজের জগতে যে-লোকটি প্রবেশ করছে, তাকে আনুষ্ঠানিক হতে হবে। ঘর আর কর্মক্ষেত্র— এই দু’টি স্থানের সামঞ্জস্য রাখার চেষ্টা করা বৃথা। দু’টি জায়গার অভিমুখ, কর্মকাণ্ড এমনকী সাজপোশাকও আলাদা হওয়া বাঞ্ছনীয়। ফ্যাশনের মূল কথা সাজপোশাক দিয়ে নিজের এক বিশিষ্ট জগৎ তৈরি করা। আমি মানুষটা কোন ঘরে থাকি, কী খাই, কেমন জামাকাপড় পরি— সবটা নিয়েই আমি। এমন যে আমরা করি না, তা নয়। কোন পোশাক আরামপ্রদ হবে তা চিন্তা করি। এমনকী, জানালার পর্দা, বিছানার চাদর, টেবিলের কাপ-প্লেট নিয়ে আমরা ভাবি তো! এগুলো আমাদের জীবনের ‘ডিজাইন’। শৈলী। ব্যক্তিত্ব অনুযায়ী সাজপোশাকের এক নিজস্ব ছক। কেউ তাঁতের শাড়ির অনুরাগী। কেউ একটু অনুষ্ঠান গোছের ব্যাপার হলেই পাঞ্জাবী-পাজামা গলিয়ে নেয়। সেটা নকলনবিশি হতে পারে, সবাই যা পরে এসেছে বা পরছে, সেই গড্ডলিকা প্রবাহে গাভাসানো হতে পারে, কিন্তু এর গভীরে যে ওই ফ্যাশন-ডিজাইন লুকিয়ে আছে, সেটা মেনে নিতে হবে।
ইতালীয় ফ্যাশন ডিজাইনার জর্জিও আরমানি (১৯৩৪-২০২৫) ঠিক এ-ব্যাপারটাকে মূল করে নিজের সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিলেন। ১৯৭৫ সালে চল্লিশ-পার বয়সে তিনি নিজের কোম্পানি যখন চালু করছেন, তখন পুরুষদের পরনে ফোলানো-ফাঁপানো সেই স্যুট-টাই, যা তাঁরা ঘরে-বাইরে একই রকম পরছেন আর মহিলারা ঝাঁকে-ঝাঁকে কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করছেন বটে, কিন্তু তাঁদের কাছে দিশা নেই যে, রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে অফিস-কাছারিতে ঢুকতে তাঁরা সাজপোশাকে কীভাবে বদল আনবেন। ইউরোপ-আমেরিকায় ঘর ছেড়ে বাইরে কাজ করতে আসা মেয়েরা সে-কারণে ফ্রকেই আটকে থাকছেন।
আরমানি গোটা ব্যাপারটার খোলনলচে বদলে দিলেন। পুরুষের পোশাক থেকে সমস্ত ‘স্টাফিং’ বাদ দিয়ে হালকা, অনায়াস চলাফেরাযোগ্য স্যুটের নকশা তৈরি করলেন। তাতে একটা তথাকথিত ‘ক্যাজুয়াল লুক’ এলো। স্যুট-টাই মানে একটা গুরুগম্ভীর ব্যাপার আর থাকল না। অন্যদিকে মেয়েদের পোশাকে বৈপ্লবিক ভাবে স্যুট এলো। কর্মক্ষেত্র যখন এক, তখন পুরুষ আর মহিলাদের পোশাক কখনওই লিঙ্গভিত্তিক ভাবে আলাদা হতে পারে না। এতে আশ্চর্য এক সমতা প্রতিষ্ঠিত হল। আরেকটি ব্যাপার লক্ষণীয়, যে-সিনেমার মাধ্যমে আরমানি এবং তাঁর ডিজাইন পরবর্তীকালে নাম করবে, পল স্র্যাডার-এর সেই ‘আমেরিকান জিগোলো’ (১৯৮০) ছবিতে প্রধান চরিত্র জুলিয়ান (রিচার্ড গেয়ার) একজন যৌনকর্মী। কোনও যৌনকর্মী তথাকথিত ন’টা-পাঁচটার চাকরি করেন না ঠিকই, কিন্তু সাজপোশাক তাঁর পেশার ক্ষেত্রে কত গুরুত্বপূর্ণ তা বোঝাতে জুলিয়ানের পোশাক ডিজাইন করেন জর্জিও আরমানি এবং সাড়া ফেলে দেন। ফ্যাশনের সঙ্গে ফিল্মের যে আগাগোড়া একটা গুরুত্বপূর্ণ মেলবন্ধন আছে, তা আরও দৃঢ় হয়েছিল ইতালীয় জর্জিও আরমানির আমেরিকান ছবির পোশাক-নির্মাণে।
আমি মানুষটা কোন ঘরে থাকি, কী খাই, কেমন জামাকাপড় পরি— সবটা নিয়েই আমি। এমন যে আমরা করি না, তা নয়। কোন পোশাক আরামপ্রদ হবে তা চিন্তা করি। এমনকী, জানালার পর্দা, বিছানার চাদর, টেবিলের কাপ-প্লেট নিয়ে আমরা ভাবি তো! এগুলো আমাদের জীবনের ‘ডিজাইন’।
প্রায় পঞ্চাশ বছরের কেরিয়ারে খুব আশ্চর্যজনক ভাবে আরমানি কাজ করেছেন প্রধানত তিনটি রং নিয়ে— সাদা, কালো আর ধূসর। কদাচিত নীল। অনেকে বলে থাকেন, তারুণ্যে সৈন্যদলে কাজ করবার জন্য আর যুদ্ধের ভয়াবহতা চোখের সামনে দেখার ফলে আরমানির জগতে উজ্জ্বল রঙের প্রবেশ ঘটেনি। কিন্তু গভীর করে ভাবলে বোঝা যায়, আরমানি আসলে বরাবর বাইরে কাজ করতে বেরোনো মানুষদের উপযোগী রঙের কথা ভেবেছেন। তিনি চেয়েছেন কাজের মানুষের পোশাকে যেন গাম্ভীর্য আসে। তবে পঞ্চাশ বছর ধরে কেবলমাত্র এই ক’টা রঙ নিয়ে ক্রমাগত কাজ করে চলা খুবই কঠিন জিনিস। যেখানে ইউরোপ-আমেরিকায় ফ্যাশন প্রতিদিন পরিবর্তন হয় এবং যেখানে আরমানির গ্রাহক সিনেমার নামকরা অভিনেতা-অভিনেত্রী, সঙ্গীতজ্ঞ ও প্রখ্যাত খেলোয়াড়েরা, সেখানে এমন কৃতিত্ব ভালরকম সাফল্যের দাবী রাখে। এক সময়ে ‘ভোগ’ ম্যাগাজিনের সম্পাদক বিখ্যাত এবং কুখ্যাত অ্যানা উইনটোর ঘোষণা করেছিলেন, আরমানি আর চলে না। এমনকী, অ্যানার উদ্যোগে গড়ে ওঠা ‘মেটগালা’-তে এখনও নিয়ম যে-কেউ যেমন-খুশি সাজো এবং তা যত রঙ-বেরঙের হয়, যত নিরীক্ষামূলক হয়, তত ভাল। এ-যেন আরমানি-নির্মিত একহারা রঙের পোশাকের সম্পূর্ণ বিপরীত! কিন্তু আরমানির উদ্ভাবনের পথ তাতে বাধাপ্রাপ্ত হয়নি। তিনি তাঁর শিল্পশৈলী থেকে বিন্দুমাত্র বেপথু হননি। হলিউডে তিনি অবিচল থেকেছেন। কাতারে কাতারে অস্কার সহ বিভিন্ন ফিল্ম পুরস্কারের মঞ্চে অভিনেতারা তাঁর বানানো পোশাক পরতেন এবং এতটাই যে, কোনও-কোনও বছরের অস্কার মঞ্চকে ‘আরমানি অ্যাওয়ার্ড’ নাম দেওয়া হত অর্থাৎ বেশিরভাগ অংশগ্রহণকারীই আরমানির পোশাক পরেছে!

বহু গবেষকের ধারণা অস্কার বাদে আরও যে গুরুত্বপূর্ণ ফিল্ম পুরস্কারের মঞ্চ যেমন কান, বার্লিন কিংবা ভেনিস ফিল্মোৎসব, সেখানে ‘রেড-কার্পেট’ বলে যে-কর্মকাণ্ড, যেখানে লাল গালিচা মাড়িয়ে অভিনেতা-অভিনেত্রীরা হেঁটে যান, সেখানে নিত্যনতুন পোশাক প্রদর্শনের ট্রেন্ড শুরু হয়েছিল মাত্র দু’জন ফ্যাশন ডিজাইনারের হাতে— কোকো শানেল এবং এই জর্জিও আরমানি। ওই রেড-কার্পেট ছিল এঁদের র্যাম্প শো। সেভাবে দেখলে আরমানি র্যাম্প খুব বেশি জায়গায় করেননি। ইতালি এবং আমেরিকায় তাঁর প্রাসাদোপম বাড়িগুলিতে বেশিরভাগ সময়ে তাঁর নতুন ডিজাইন ও পোশাকের প্রদর্শনী চলত। হবে নাই-বা কেন? ঘর আর বাহির যে জর্জিও আরমানির পোশাক-দর্শনে খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল! কেরিয়ারের রজত-জয়ন্তী বর্ষে আরমানি পোশাক ডিজাইনের পাশাপাশি গহনা, ঘর-হোটেলের আসবাব, সুগন্ধি, খাবারের বাসন— এমন অনেক কিছুর ডিজাইন শুরু করেন। খুব দ্রুত সেগুলি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। বিশ্বের তাবড় হোটেল-চেনগুলি ডিজাইনের জন্য তাঁর কাছে হত্যে দিতে আরম্ভ করে। তাঁর নিজের আরমানি-হোটেলও গড়ে ওঠে বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ কিছু শহরে। দুবাই-এর প্রখ্যাত বুর্জ খলিফার অন্দরশিল্প তাঁর হাতে তৈরি। শুধু এসব নয়, ইংল্যান্ডের জাতীয় ফুটবল দলের জার্সি বহুবার তিনি ডিজাইন করেছেন। দু’বার অলিম্পিকে ইতালি দেশের পতাকা-বাহকদের পোশাকও তাঁর নির্মাণ। বিখ্যাত শিল্পীদের অসংখ্য মিউজিক ভিডিও-এর পোশাক পরিকল্পনা ছিল জর্জিও আরমানির। তিনি গ্র্যামি এবং এমটিভি মিউজিক পুরস্কারের অনুষ্ঠানও বেশ কয়েকবার ডিজাইন করেছেন।
কিন্তু কথা হল যে-মানুষটা প্রায় দোকানে কাজ করা দিয়ে নিজের কেরিয়ার শুরু করেছিলেন, মাত্র কুড়ি-পঁচিশ বছরে বিলিয়ন ডলারের ফ্যাশন সাম্রাজ্য তৈরি করলেন কী করে? এক্ষেত্রে একজন মানুষের কথা উঠে আসে— সের্গিও গ্যালিওত্তি, জর্জিও আরমানির প্রিয়তম বন্ধু ও প্রেমিক। গ্যালিওত্তি নিজের দামি গাড়ি বেচে আরমানিকে ব্যবসার প্রথম মূলধন জুগিয়েছিলেন। ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে বরাবর ভীষণ রকম নীরব থেকেছেন আরমানি। কিন্তু নিজের প্রেমিকের কথা কখনও লোকাননি। শুধু তাই নয়, সাত-আটের দশকে এই জর্জিও আরমানি, জিয়ান্নি ভারস্যাচে, ঈভ স্যঁ ল্যঁর, রয় হ্যালস্টন ফ্রোইক, জাঁ পল গল্টিয়ার, অ্যালেকজান্ডার ম্যাকুইন, কেলভিন ক্লেনদের মত ডিজাইনাররা নিজেদের যৌনপরিচয় নিয়ে রাখঢাক করেননি বলে বিশ্বজোড়া যৌনসংখ্যালঘু সমকামী মানুষদের সাম্যের আন্দোলন গতি পেয়েছিল। বহু নামকরা অভিনেতা-অভিনেত্রীরা যে-সময়ে নিজেদের জনপ্রিয়তা রক্ষার জন্য এবং একঘরে না হয়ে পড়ার ভয় থেকে ‘স্ট্রেট’ (বিসমকামী) সেজে থাকতে বাধ্য হয়েছেন, সে-সময়ে এই অকুতোভয় ডিজাইনাররা নিজেদের যৌন-আকাঙ্ক্ষার কথা উজাড় করেছেন। তবে এও ঠিক, ফ্যাশন ডিজাইনার হলে সমকামী হবার প্রবণতা থাকে, এইরকম বিচ্ছিরি সব মিথ তৈরি হয়েছিল জর্জিও আরমানিরা যৌন-আকাঙ্ক্ষা ও যৌনপরিচয়ের ক্ষেত্রে খোলামেলা থেকেছিলেন বলেই। আবার অন্য দিকে বহু সাধারণ যৌনসংখ্যালঘু মানুষ নিজেদের নিয়ে লজ্জিত হননি এঁদেরই জন্য। কিন্তু জর্জিও আরমানি বহু বার এলজিবিটিকিউএ+ মানুষদের জীবন ও যাপনের বৈচিত্র্য উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হয়েছেন। তিনি অনেক সময়ে সমকামী পুরুষরা কেন আরও পুরুষালি হবে না, এই মর্মে বক্তব্য রেখে নানা বিভ্রান্তির সৃষ্টি করেছেন! তবে সের্গিওর পর তিনি কখনও কোনও ঘোষিত সম্পর্কে যাননি। বরং, সের্গিওকে এডস রোগ থেকে বাঁচাতে না পারা তাঁর কাছে সারা জীবনের এক ব্যর্থতা হিসেবে অভিহিত ছিল।
গত ৪ সেপ্টেম্বর, জর্জিও আরমানি নিজের বাসগৃহে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। এ-বছর আরমানি ফ্যাশনের পঞ্চাশ বছর পূর্তি। সব প্রস্তুতি সারা হয়ে গিয়েছিল সেই বিরাট অনুষ্ঠানের। কিন্তু তিনি আর রইলেন না। ঘর আর বাহিরকে মিলিয়ে দিয়েছিলেন যিনি, বিশ্ব-ফ্যাশনে যিনি এনে দিয়েছিলেন গাম্ভীর্য আর যাঁর ডিজাইন ছিল সাফল্যের প্রতীক, সেই জর্জিও আরমানি চিরঘুমে শায়িত হলেন। রেখে গেলেন বিশিষ্ট ফ্যাশনের এক বিশাল সাম্রাজ্য আর উত্তরাধিকার।