প্রাণপণে দাঁতে দাঁত চেপে, প্রায় নিশ্বাস বন্ধ করে অপেক্ষা করছি। সামনেই বাথরুম। বাথরুমের দোর যেন কোনও দুর্জয় দুর্গের দুর্ভ্যেদ্য দরওয়াজা। হাজার টোকা, ধাক্কাধাক্কিতেও খোলার নামগন্ধ নেই। ভেতরে কে অধিষ্ঠান করছেন— সে-সম্পর্কেও ধারণা স্পষ্ট নয়। সবার নাম ধরে ডেকে, আকুতি জানিয়েও কোনও লাভ হয়নি। টুঁ শব্দটিও কেউ করছে না। অগত্যা, অপেক্ষা আর দুঃসহ নিম্নচাপ সহ্য করার চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া ছাড়া গতি নেই। দরদর করে ঘাম হচ্ছে। কাপড়েচোপড়ে হওয়া থেকে বিরত থাকার জন্য, শরীরের নিম্নভাগের বেগ-নিবারণকারী পেশিগুলোর শক্তি পরীক্ষার সময় এটাই। যে-কোনও মুহূর্তে পরাজয় বরণ করে ফেলতে পারে পেশিতন্তুরাশি, পেশাদারিত্ব দেখানোর দায় তো তাদের নেই! মনে হচ্ছে, বাথরুমের আশপাশের কোনও কোনাতেই বসে পড়তে হবে। মনকে ফাঁকি দিতে অনুলোম-বিলোম প্রাণায়ামের আশ্রয়ও নিয়েছিলাম। নিম্নগামী বেগ আরও বেড়ে গেল। মনকে অন্যত্র সরিয়ে নিতে কল্পনা করার চেষ্টা করলাম দার্জিলিং পাহাড়, পুরীর সফেন সমুদ্র— কী মুশকিল, সব জায়গাতেই ভেসে উঠতে লাগল বিভিন্ন শৌচাগারের ছবি! মন ধাইল বাথরুমের অন্দরেই। বেগমুক্তির সিংহাসনের পানে।
অথচ বাথরুমের তো অভাব হওয়ার কথা ছিল না এ-বাড়িতে। একান্নবর্তী পরিবারে যে যেখানে খুশি চলে যেতে পারত। শোওয়ার ঘর নির্দিষ্ট থাকলেও, সকলেরই সব ঘরে অবাধ গতায়াত। খাওয়ার ঘরে একসঙ্গে খাওয়া। অতিথি এলে যে-কোনও আসবাবে তাকে বসিয়ে আপ্যায়ন করা। সব যৌথ পরিবারে যেমন চলত আরও যা-কিছু— আমাদের পরিবারে তার অন্যথা হতে দেখিনি কখনও।
আরও পড়ুন : পুজো মানেই প্রতিযোগিতার হারাকিরি!
লিখছেন অমিতাভ মালাকার…
তবে আমার জ্ঞানচক্ষু উন্মীলনের সঙ্গে-সঙ্গেই টের পেয়েছিলাম— ভাঙনকাল আসন্ন। ঝগড়াঝাঁটি, অশান্তি, গালমন্দ প্রায় শিল্পের পর্যায়ে পৌঁছে গেছিল এ-বাড়িতে। নিয়মিত রেওয়াজ করার মতোই কলহ-তর্কে গলাসাধা রোজনামচায় পরিণত হয়েছিল। রেষারেষি, সম্মানহানি, হুমকি, ভীতিপ্রদর্শনের ছায়া আমাদের ভাই-বোনেদের মধ্যেও পড়তে শুরু করল ক্রমে।
যেদিন সব কিছু আলাদা করার সিদ্ধান্ত রাগতস্বরে ঘোষণা করে সেজকাকা— কাকিমা বোনের হাত ধরে টেনে নিয়ে তেতলায় উঠে গেল— সেদিন কিশোরমন বুঝেছিল, ‘একান্নবর্তী’ যুগের রমরমা শেষ হল এবার এ-বাড়িতে। রান্নাঘর আলাদা হল। বাসনপত্র-আসবাব ভাগাভাগি হয়ে গেল। খাওয়ার ঘরের অস্তিত্ব বিপন্ন হল। দালান-বারান্দা— দোতলা-তিনতলা-চারতলায় অবাধ যাতায়াতে বাধা তৈরি হল অচিরেই। ছাদও বাদ গেল না এই ভাগাভাগিতে। বাড়ির যে-কোনও বাথরুমে স্বাধীন গতিবিধিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হল। ‘মিলিত’ পরিবার থেকে ‘আমাদের’ পরিবার তৈরি হল— মা, বাবা, ঠাকুমা, আমরা তিন ভাই। আরাধ্য দেবদেবী আলাদা হল না বটে— তবু একতলার ঠাকুরঘর, দেবদেবীর আরাধনা, ব্রতপালন জৌলুস হারাল।

অবস্থার ফেরে ‘কলঘর’ বিলাসিতাকে মন থেকে সরিয়ে ফেলতে হয়েছিল— চাহিদার তুলনায় বাথরুমের বরাদ্দ কমে যাওয়ায়। বাড়ির পুজোর আনন্দ-হইহই-মজা ক্রমে ম্রিয়মাণ হয়ে পড়ে নিয়মরক্ষায় পরিণত হয়েছিল— মেনে নিতে হয়েছিল উপায়ান্তর না থাকায়। তবে চেষ্টার কোনও ত্রুটি রাখেনি মা-ঠাকুমা-দাদারা কখনওই। সীমিত ক্ষমতায় আয়োজিত পুজোয়ঈশ্বর সন্তুষ্ট হতেন বলেই মনে হয়। ক্লাবের সরস্বতী পুজো আর আমাদের বনেদি পাড়ারদুর্গাপুজোর পরিবেশ, আবহ, সম্পর্ক, সংস্কৃতি— সে না পাওয়ার অতৃপ্তি কানায়-কানায় পূর্ণ করল এবং ছাপিয়ে গেল হৃদয়কে— অসীম ‘পাওয়া’রআবেশে জড়িয়ে নিয়ে।
ঘরে-ঘরে কাকা-কাকিমা, জ্যাঠা-জেঠিমা, দাদু-ঠাকুমা, মাসিমা-মেসোমশাই, ভাই-ভগিনি পেলাম। নতুন কোনও জীবনে যেন যোগ দিল আমার সত্তা। নতুন-নতুন বাড়িঘর পেলাম, যে-বাড়িঘরে খাওয়া-বসা-বাথরুম গমন এমনকী রাতে থেকে যাওয়াও খুব স্বাভাবিকতার সঙ্গে বরণ করে নেওয়া হত। ইট, কাঠ, কংক্রিট নয়— ভালবাসার বাড়ি সেসব। সম্পর্কগুলোও মিলিয়েমিশিয়ে কোনও দাদার স্ত্রীকে পিসি, কোনও কাকার স্ত্রীকে মাসিমা, কোনও মেসোমশাইয়ের স্ত্রীকে বউদি বলে সম্বোধন করেছি। নির্বিচারে। নির্ভাবনায়।
দুর্গাপুজোর আগে দুর্গানগরী হয়েছে পুজোর সর্বজনীন মাঠ। সর্বজনীন হয়ে ওঠার নির্মল আনন্দে মেতে গিয়েছি আমিও, বৃহত্তর পরিবারের সঙ্গে। মহালয়ার দিন মাইকে মহিষাসুরমর্দিনী শোনা থেকে শুরু করে— প্রতিমা উদ্বোধন, বোধন, কলাবউ স্নানে সঙ্গ দেওয়া। একসঙ্গে পুষ্পাঞ্জলি, সন্ধিপুজোর রীতিপালন, কুমারী পুজো, বীরাষ্টমী, সন্ধ্যারতি, আড্ডা, দলবেঁধে অন্য প্রতিমা দর্শন করতে যাওয়া; রাস্তার ধারের ডিমভাজা থেকে শুরু করে বিরিয়ানি, কোর্মা, মুরগি-মটন, ফিশফ্রাই, ফুচকা, আইসক্রিম ভক্ষণ, নতুন ঔজ্জ্বল্য ছড়িয়ে নায়কসুলভ হাঁটাচলায় চমক দেওয়ার চেষ্টা কিংবা সুন্দরী-সকাশে থতমত খাওয়া, পুনরায় সামলে নেওয়া— সব একসঙ্গে। একসাথে বসে পুজোর ভোগপ্রসাদ খাওয়া কিংবা গানবাজনা, প্রথম সিগারেট; অনেক অনুভূতিই পুজোর মাঠে অন্য মাত্রা নিয়ে মৃদু অথচ পেলব উত্তেজনা ছড়াত হৃদয়ে। সব কিছুই ছিল হৃদয়ের কাছাকাছি, প্রাণময় সখ্যে বেঁধে-বেঁধে থাকতাম সকলে— তথাকথিত বেদনাদীর্ণ রক্তের সম্পর্ককে পিছনে ফেলে ওই সম্পর্কগুলোর গভীরতা মনের অতলান্ত সাগরের তলদেশ ছুঁতে পেরেছিল।
ঘরে-ঘরে কাকা-কাকিমা, জ্যাঠা-জেঠিমা, দাদু-ঠাকুমা, মাসিমা-মেসোমশাই, ভাই-ভগিনি পেলাম। নতুন কোনও জীবনে যেন যোগ দিল আমার সত্তা। নতুন-নতুন বাড়িঘর পেলাম, যে-বাড়িঘরে খাওয়া-বসা-বাথরুম গমন এমনকী রাতে থেকে যাওয়াও খুব স্বাভাবিকতার সঙ্গে বরণ করে নেওয়া হত। ইট, কাঠ, কংক্রিট নয়— ভালবাসার বাড়ি সেসব। সম্পর্কগুলোও মিলিয়েমিশিয়ে কোনও দাদার স্ত্রীকে পিসি, কোনও কাকার স্ত্রীকে মাসিমা, কোনও মেসোমশাইয়ের স্ত্রীকে বউদি বলে সম্বোধন করেছি। নির্বিচারে। নির্ভাবনায়।
যে-বৃহত্তর পরিবারের অংশ হয়েছি, সে-পরিবারও কালের নিয়মে ছোট হতে শুরু করেছে বেশ কয়েক বছর আগে থেকেই। পাড়া ছেড়েছে কেউ, কেউ ছেড়েছে ভুবন-পারাবার। বাড়িঘর হাত বদল হয়েছে। বদলেছে অনেক কিছুই। ক’দিন আগে রাতে বাড়ি ফেরার সময়ে পাড়ায় ঢোকার মুখে পথ আগলে দাঁড়াল পুলিশ। ‘কোথায় যাবেন?’ শুনলাম, পুজোর কার্যকরী সমিতি গঠন করা নিয়ে নির্বাচন চলছিল। তাতে বিস্তর গোলমাল হয়েছে। বাক্বিতণ্ডা, হাতাহাতিতে পৌঁছেছে। বহিরাগত বাহুবলীরা এসে ভিড় করেছে পাড়ায়। ব্যালট বাক্স ভাঙচুরের প্রয়াস, ব্যালট পেপার ছিঁড়ে দেওয়া, বুথে গুন্ডাবাহিনীকে ঢুকিয়ে দেওয়া— বিধানসভা, পৌরসভা বা লোকসভা নির্বাচনের এমনতর গোলমালই তো হতে দেখেছি এলাকায় কিংবা নিউজ চ্যানেলে-টিভির পর্দায়। আমাদের পরিবারেও ক্ষমতা দখলের লড়াইয়ের ঝাপটা এসে পড়বে এভাবে— কল্পনায় আসেনি এখনও।
বন্ধুর সঙ্গে বন্ধুর কথা বন্ধু হল। কেমন যেন ছাড়া-ছাড়া হতে শুরু করল সব কিছু। সবই হচ্ছে, কিন্তু কোথাও যেন ঠিক সুরটা লাগছে না। পুজোর আয়োজনে, আড়ম্বরে, অর্ঘ্যমাল্যে-পুষ্পে কি মা দুর্গা তৃপ্ত হন না কি সন্তানসন্ততিদেরমিলেমিশে সুখে-শান্তিতে, আনন্দে-খুশিতে একসাথে দেখে চোখ জুড়োয় তাঁর? সর্বজনীন-পরিবার ভেঙে যাওয়ার আশঙ্কায় ছুটে যাই মায়ের কাছে পরদিন সকালেই। হাতজোড় করে বলি, ‘জুড়ে দাও মা, বেঁধে-বেঁধে রাখো একসাথে। সুখে-দুঃখে, আনন্দে-উৎসবে। মতান্তর হোক, মনান্তর যেন না হয়।’
মেঘ চিরে আকাশে তখন কালো মেঘের ঘনঘটা। দেখলাম এক ফালি রোদ এসে পড়েছে মায়ের মুখে— প্যান্ডেলের ফোকর গলে। মায়ের মুখে যেন মৃদু হাসি। নিশ্চিন্ত হলাম কিছুটা। জগন্ময়ী মা যেন বার্তা দিলেন ধৈর্য রাখতে। আশ্বাস দিলেন, ‘মেলাবেন তিনি মেলাবেন।’