আগে পুজোর সময়ে কলকাতার ব্যাবসায়িক রঙ্গমঞ্চগুলোতে থিয়েটার হত না। সারা বছর তাঁরা কাজ করতেন এবং ওই সময়ে ছুটি দিতেন। আমার মনে হল, বেশি লোকের কাছে পৌঁছনোর জন্য এই সময়টা বড় একটা সুযোগ। এমনিতে তো সবসময়ে হল পাওয়া যায় তেমন নয়, এই সময়ে পাওয়া যাবে, তাছাড়া প্রচুর লোকও এ-সময়ে ঘুরে বেড়ান সপরিবারে, পাশাপাশি গ্রামগঞ্জ, মফস্সল প্রবাস থেকেও লোকজন আসেন। সর্বোপরি একটা বড় অংশ, যাঁরা থিয়েটারমোদী কিন্তু সারা বছর ব্যস্ততার কারণে সময় পান না, তাঁদের কাছে পৌঁছনোর জন্য একটা বড় সুযোগ পুজোর সময়ে থিয়েটার করা।
তখন আমরা উত্তর কলকাতার ‘রঙ্গনা’-য় থিয়েটার করতাম। রোববার-সহ অন্য ছুটির দিন— সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী থেকে একাদশী দুটো করে শো করতাম। শুধু বিজয়ার দিন আমরা কোনও শো রাখতাম না।
বিষয়টা বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠল অচিরেই। তখন আমরা ওই যাকে বলে ‘বার খেয়ে’, আরও উৎসাহী হয়ে অ্যাকাডেমি-র জন্য আবেদন করলাম এবং পেলামও। পরে আমাদের দেখাদেখি অন্য দলের লোকেরাও আবেদন করা শুরু করল। এভাবেই শুরু। আমাদের একটা স্লোগান ছিল— ‘ভাল নাটক বেশি করে’ অর্থাৎ নাটক শুধু ভাল হলেই হবে না, তাকে আরও বেশি করে মঞ্চস্থ করে মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে হবে। পরে বিষয়টা আরও বিস্তৃত হল, বিশেষত এখান থেকে ব্রেন-ড্রেন হওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে মফস্সলে, অন্য নানা রাজ্যে, বিদেশেও পুজোর সময়ে আমন্ত্রণ আসা শুরু করল। তবে বিদেশের ব্যাপারটা খানিক গোলমেলে। ধরা যাক পুজোর একদিন মাংস-ভাত হচ্ছে এবারে সেদিন আবার থিয়েটার হচ্ছে, মানে এটা শুধুই আমোদ-আহ্লাদের অংশ। ব্যাপারটা খানিক এরম— কেউ একজনকে বলছে চল, থিয়েটার দেখে আসি। এবারে সে কিংবা তারা শুধুই সময় কাটানোর জন্য থিয়েটার দেখতে এল, সে না এলে অন্যরা খারাপ বলবে এই শুধু কারণে। এদিকে তার ‘রসিক’ হয়ে ওঠার কোনও প্রস্তুতিই ছিল না। দেখা যাবে, যে থিয়েটার দেখতে এল, সে জীবনে ওই প্রথমবার থিয়েটার দেখছে। তার ফলে ওদের অনেকেই মেলা আর থিয়েটার গুলিয়ে ফেলে।

আরও পড়ুন : পুজোর সময় নতুন জামা পড়ব না, পণ করেছিলাম এক আশ্চর্য কারণে!
লিখছেন রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত…
পুজোর সময়ে কলকাতাতেও যে-সমস্ত শো হত, সেখানে মূলত বাইরের দর্শকই বেশি আসতেন। কলকাতার বা স্থানীয় দর্শক যে আসতেন না তেমন নয়, তবে তারা সংখ্যায় তুলনামূলক কম।


এখন ‘থিয়েটার’-এর বোধ— এই ব্যাপারটা গুলিয়ে গেছে। এর পেছনে অনেক সমাজ-অর্থনৈতিক কারণ আছে। অনেকে যেমন ‘থিয়েটার’ শব্দটা বলে না। বলে গ্রুপ থিয়েটার। এর মতো বোকা-বোকা কথা আর হয় না। আরে ‘গ্রুপ’ না হলে, থিয়েটার হবে কী করে? থিয়েটার নিজেই তো একটা কালেকটিভ আর্ট ফর্ম। সেখানে আলাদা করে আবার গ্রুপ বলার দরকার কী! ঠিক যেমন শম্ভুদা (শম্ভু মিত্র) শুরু করলেন অন্য থিয়েটার। সে-নামও বদল হল। কখনও ‘ভাল থিয়েটার’, কখনও ‘ঠিক থিয়েটার’ আমার যদিও ব্যক্তিগত ভাবে ‘অন্য থিয়েটার’ নামটাই বেশি পছন্দের। আবার অভিনয়ের ক্ষেত্রে ধরা যাক আমাদের দেবশঙ্কর হালদার-এর কথা। সে বারো চোদ্দটা দলে থিয়েটার করে। ধরা যাক দলে ২৩ জন সদস্য আছে, সেখানে দু’একজনের বেশ নামডাক হল। এরপর দুটো ক্রাইসিস তৈরি হয়। এক, একটা দলেই বেশি করে থিয়েটার করে গেলে, সে খাবে কী? দুই, অন্য আরও দলে কাজ করলে, একসঙ্গে অনেক কাজ সহ বেশি অর্থনৈতিক লাভ হওয়ার সুযোগ হয়। এবং এখান থেকেই আরও অনেক দলে থিয়েটার করে প্রফেশনাল হওয়ার তাগিদটা তৈরি হয়। এখন এই তাগিদটা এতই জেনুইন, অভিনেতাকে আটকানো যায় না। চাকরির ক্ষেত্রে তো এই সমস্যাটা হয় না কারণ চাকরি একটা গেলে আরেকটা সঙ্গে-সঙ্গে পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ তাই সেখানে এই বাঁধনটা আছে। কিন্তু থিয়েটারে তা নেই।