শিলিগুড়িতে বাবুপাড়ায় যেখানে বাসা ভাড়া নিলাম, সেই বাড়ি থেকে বড় রাস্তার দূরত্ব একশো ফিট-ও হবে না বোধহয়। প্রায় ঘরের সামনে থেকেই টোটো পেয়ে যাওয়ার আনন্দে, প্রথমদিন সকালে বেরতে একটু দেরি হয়ে গেল। রাস্তায় নেমে হন্তদন্ত হয়ে হাঁটতে সবে শুরু করেছি, তিনটে কুকুর চিৎকার করতে-করতে আমাকে ঘিরে ধরল। কলেজে যাওয়া তো দূরের কথা, প্রাণে কীভাবে বাঁচব তাই নিয়ে যখন ভাবছি, আমার বাড়িওয়ালা রাকেশদা এসে উদ্ধার করলেন, বললেন, ‘আপনাকে তো চেনে না, তার ওপরে কাঁধে ব্যাগ নিয়ে দৌড়চ্ছেন…পাড়ার কুকুর, বোঝেনই তো!’ বলে এক গাল হাসলেন। শুধু বুঝলাম না, হাড়েহাড়ে বুঝলাম সেদিন সন্ধে থেকেই।
আরও পড়ুন: রিল কীভাবে বদলে দিচ্ছে আমাদের গান শোনার অভ্যেস? লিখছেন আদিত্য ঘোষ…
কলেজ থেকে ফেরার পথে টোটো থেকে নেমে বাসস্থানে যাওয়ার পথে সকালের তিন-মূর্তি আমার পিছু নিল আর ক্রমাগত ডেকে গেল, শুধু আর ঝাঁপিয়ে পড়ল না। পরেরদিন কলেজ যাওয়ার সময়ে আমাকে দেখে সামান্য চিৎকার করলেও, কোনও বাড়াবাড়ি করেনি, শুধু আমাকে অনুসরণ করে মোড়ের মাথা অবধি গেল, ফেরার সময়েও একই ভাবে অভ্যর্থনা জানিয়ে আমার সঙ্গে বাড়ি অবধি এল। এরপর ডাকাডাকি করা বন্ধ করল, দূর থেকেই দেখতাম, রাকেশদার প্রেসের দরজার কাছে কিংবা কোনও প্রতিবেশীর পাঁচিলে বসে আছে। মোড়ের মাথায় একটা বিরিয়ানির দোকান ছিল, তার সামনে অবধি তাদের ঘুরে বেড়াতে দেখতাম না, বরং সেই বিরিয়ানির দোকান পেরিয়ে একটা মনিহারি দোকানের সামনে ওদের দেখা যেত। রাকেশদাকে এই নিয়ে জিজ্ঞাসা করাতে বলেছিল, পাড়ার লোকই ওদের খাবার দেয়, তাই বিরিয়ানির প্রতি লোভ নেই। মনিহারি দোকানে গেলে বিস্কুট পায়, তাই সেখানে সন্ধেতে একবার ঘুরে আসে। রোজ সন্ধে সাড়েসাতটা থেকে আটটার মধ্যে বাড়ি ফিরতাম। একদিন ফিরতে সাড়ে আটটা বেজে গেল। গলিতে ঢুকে দেখি আবার কুকুরগুলোর রুদ্রমূর্তি! চেঁচাতে-চেঁচাতে আমার দিকে এগিয়ে এল। আবার সেই রাকেশদা আমার রক্ষাকর্তা হলেন। বাইরে এসে ওদের সরিয়ে দিয়ে আমাকে বাড়িতে ঢুকিয়ে নিলেন; এইবার এক গাল হেসে বললেন ‘আজকে দেরি করে ফিরলেন তো, তাই ডাকছিল!’

ইতিমধ্যে শিলিগুড়ি শহরের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়ে গিয়েছে; সেখানে বান্ধব আর বিনোদন কোনওটার অভাব নেই। দার্জিলিং মোড় থেকে ভেনাস মোড়ের মধ্যে পানের দোকান আর পানীয়ের দোকানের সংখ্যার বেশি তফাৎ নেই। কিন্তু মিশনের হোস্টেলের চেয়ে দশগুণ ভয়ের এই পাহারা আর শাসন। তাই সুখের চেয়ে স্বস্তি ভাল। বারে বা আড্ডায় না বসে, সোজা বাড়ি চলে আসা শ্রেয় মনে করলাম। দরকার হলে ব্যাগে বোতল নিয়ে। কোনও নেমন্তন্ন বা পার্টিতে যেতাম এই কড়ারে যে, বাড়ির দোরগোড়ায় আমাকে ছেড়ে আসতে হবে। পরে বারান্দায় বসে দেখতাম— এই শাসন শুধু আমার প্রতি ছিল না, পাড়ার কোনও লোকই রাত করে বাড়ি ফিরলে চেঁচিয়ে পাড়া মাত করত, আর মফস্স্বল শহরের বারান্দা থেকে মাথা উঁকি দিত সেদিন কোনও বাড়ির কর্তা রাত করে বাড়ি ঢুকেছে দেখতে। অদ্ভুত ব্যাপার, কেউ সপরিবার রাত করে বাড়ি ফিরলে অশান্তি করত না- একা কেউ ফিরলেই তাদের হাঁকডাক শুরু হয়ে যেত। এইরকম পরিবার-বান্ধব কুকুরদের খাবারের অভাব হবে না, এটাই তো স্বাভাবিক!
আমাদের পাড়ার কালু জানত যে, তাকে নিয়ে আদিখ্যেতা করার দুটো মানুষ পাড়াতেই, তার দু’জন sympathizer এর জোরে বেশ রোয়াবেই থাকত। পিঙ্কি ওর অভিভাবিকা, যে রাতে ওকে খাওয়ানোর জন্যে ডেকে-ডেকে পাড়ার লোকের ঘুম ভাঙিয়ে দেয়, আর আমার গিন্নি ওকে নিয়ে প্রভূত আদিখ্যেতা করে। ফল-স্বরূপ কালু গিন্নিকে দেখলে ওর কাঁধে দুটো পা দিয়ে দাঁড়িয়ে গিয়ে ওর মুখ চাটে আর আমি শিউরে উঠি। মধ্যবিত্ত পাড়ায় এখনও সন্ধ্যায় শাঁখ বাজানোর রীতি আছে, আর তার মধ্যে আমাদের বাড়ি একটা। শুধু আমার গিন্নি শাঁখ বাজালে পাশের পাড়া থেকে কালু শঙ্খধ্বনির মতো আওয়াজ দেয়, সেটা নিয়ে বিস্তর হাসাহাসি করে থাকি। এর মধ্যে খবর এল আশেপাশের পাড়ায় ভীষণ চুরি হচ্ছে। হঠাৎ রাতে কালুর চিৎকার বেড়ে গেল— আর সে এমন চিৎকার যে, সবার ঘুমের দফারফা। কালুর রাতের চিৎকারে যখন পাড়ার লোক তিতবিরক্ত আর পাড়ায় যখন কর্পোরেশনের হাতে ওকে তুলে দেওয়ার কথা হচ্ছে, এক সকালে কালুকে রক্তাক্ত অবস্থায় রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখা গেল, পেটে একটা লোহার শিক গোঁজা। পিঙ্কি কাঁদতে-কাঁদতে আমাদের বাড়িতে এসে অবস্থা জানায় আর কিছু টাকা জোগাড় করে বেলগাছিয়া ভেটেরনারি কলেজে দৌড়য়। সেইদিনই ঘটনাক্রমে এক চোর ধরা পড়ে খোঁজ নিয়ে, তল্লাশি করে যে খবর পাওয়া গেল, তাতে সবার আক্কেলগুড়ুম। আশেপাশের পাড়ায় যে চোরের দল চুরি করেছে, তারা নাকি আমাদের পাড়াতে কয়েকদিন ধরে রাতে আসছে আর সেটাই কালুর রাতের চিৎকারের কারণ। অনেক চেষ্টা করেও কালুর দৌলতে এই পাড়ায় দাঁত ফোটাতে না পেরে, ওরা কালুকে মেরে ফেলার জন্যে পেটে শিক গুঁজে দিয়েছে। কালু সেই অবস্থায় নিজেকে টানতে-টানতে পিঙ্কি আর আমাদের বাড়ির মধ্যবর্তী রাস্তায় অবধি চলে এসেছে যাতে এর একটা বিহিত হয়। কালুর চিকিৎসার আর অর্থাভাব থাকল না, সবাই এগিয়ে এল কালুকে বাঁচাতে। যমে-মানুষে(থুড়ি কুকুরে) টানাটানি সেরে কালু পাড়ায় ফেরত এল। কালু এখন নিজের রেলায় থাকে আর পাড়ার একজন হয়ে গিয়েছে।
যে-কুকুরদের কথা বলছি, এরা সবাই নেড়ি কুকুর। এরা রাস্তায় ঘুরে বেড়ায় আর নিজেদের মধ্যে একটা এলাকার বিভাজন করে নেয়। নিজের এলাকায় অন্য এলাকার কুকুরদের ঢোকা বারণ, ঢুকলেই যুদ্ধ। যেখানে থাকে, সেই এলাকাকে রক্ষা করার আর যাবতীয় ঝামেলা থেকে মুক্ত রাখার দায়িত্ব স্বেচ্ছায় এরা কাঁধে তুলে নেয়। রাতে বেশি চেঁচালে পাড়ার লোক বিরক্ত হয়, কিন্তু কেন চেঁচাচ্ছে সেটা নিয়ে মাথা ঘামায় না। কলকাতায় আমাদের পাড়ার কোনও গোলমাল থেকে বাঁচালে এদের নিয়ে আদিখ্যেতা করা হয় না, বড়জোর কয়েকটা বিস্কুট জোটে, কিন্তু কোনও গোলমাল হলে, সব দোষ এদের কাঁধের ওপরে বর্তায় আর তাই জন্যে বাড়ির উচ্ছিষ্ট অবধি তাকে খেতে না দিয়ে শাস্তি দেওয়া হয়। সব পাড়ায় যেমন বাবু আর খোকা নামে কেউ থাকে, তেমনই সব পাড়ায় একটা কালু, লালি থাকে। এরা যতই কেজো আর সজাগ হোক না কেন, এদের পেডিগ্রি নেই, বিদেশি রক্ত বইছে না তাদের ধমনীতে তাই তাদের নাম টমি, গোল্ডি কখনও হয় না, এদের নাম হয় লালি, কালি, ভুলো, কালু। রাশিয়ার দেশি সুরা ভদকা খেতে গেলে যেমন কাঁচের গ্লাস লাগে, অথচ বাংলা মদ ভাঁড়েও খাওয়া যায়, তেমনই জার্মানিতে রাখালদের সঙ্গে গরু চড়ানো জার্মান শেপার্ডকে আমরা এ-দেশেভক্তি করি আর বিদেশি রক্তকে ইজ্জত দিয়ে তাদের নাম টমি, গোল্ডি ইত্যাদি রাখি আর তাদের ট্রেনিং আর খাওয়ার জন্যে মুক্তহস্তে খরচ করি (আমার এক পরিচিত এক ধাপ এগিয়ে গিয়ে জুনো, ওথেলো, সিজার ইত্যাদি নামকরণ করেছিলেন, সেটা শেক্সপিয়ারের প্রতি রাগে না ভক্তিতে জানি না)। এই নেড়ি কুকুররা স্বশিক্ষিত, এদের কোনও ট্রেনিং দেওয়া হয় না। নিজেদের খাবার জুটিয়ে নিতে হয়, কোনও বাড়ি থেকে ওদের খাবার দিলেও ওদের জন্যে আলাদা করে রান্না হয় না, যা রান্না হয়েছে সেখান থেকেই এক খাবলা দেওয়া হয়। যেমন আমার দেশের বাড়িতে ঠাকুমাকে দেখাশোনা করার দায়িত্ব স্বেচ্ছায় কালি কাঁধে তুলে নিয়েছিল, আর বিনিময়ে দু’মুঠো খাবার জুটে যেত তার দু’বেলায়। বিধবার নিরামিষ খাবার সোনা-মুখ করে খেয়ে নিত রোজ। কিন্তু ঝামেলা হল যখন জয়কাকু তাঁর তালতলার চটি পড়ে ঠাকুমাকে বিজয়ার প্রণাম করতে এলেন। বেরনোর সময়ে চটি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, অনেক খুঁজে নারকোল গাছের গোড়ায় এক টুকরো চটি পাওয়া গেল। চটিতে কাঁচা চামড়ার গন্ধ পেয়ে কালির মাংসাশী মন জেগে উঠেছিল আর চটিটাকে খেয়ে নিয়েছে। এতে কি কালির কোনো দোষ ছিল? পরেরদিন সকালে ঠাকুমা যখন পাশের পাড়ায় বড়পিসিমার বাড়ি যাচ্ছিলেন, কালি তো ঠাকুমাকে ফলো করে ঠাকুমা ঠিক মতো পৌঁছেছেন কি না দেখতে কোনো কসুর করেনি! মিলেনিয়াম পার্কের কাছে পৌঁছে, চক্ররেল রোজ হুইসল দেয়, কারণ সেখানে অনেকে রেললাইন টপকে হাঁটাচলা করে। হাইকোর্ট অঞ্চলের কুকুরদের কেউ দায়িত্ব দেয়নি, কিন্তু দূর থেকে ট্রেনের হুইসিল শুনলেই তারা ছুটে এসে হুইসলের সঙ্গে গলা মেলায়, অন্যদের সজাগ করার জন্যে। মানুষ যন্ত্রের আওয়াজকে যত না ডরায়, তার চেয়ে বেশি ডরায় কুকুরের ডাককে। যেমন মুর্শিদাবাদের ঔরঙ্গাবাদে মসজিদে আজানের শব্দ শুনলে সেখানকার কুকুরদের সেই শব্দে গলা মেলানর দায়িত্ব কেউ দেয়নি, তবু তারা গলা মেলায়। কিন্তু তাদের তো ট্রেনিং দেওয়া হয়না, ডগ শো’তে গিয়ে সভ্যতা দেখিয়ে মেডেল কোনওদিন ওরা পাবে না। কিন্তু ট্রেনিং দিলে অবিশ্বাস্য সব কাণ্ড করতে পারে নেড়ি কুকুররা। আমার এক বন্ধু যেমন গঙ্গাসাগরে গিয়ে এক কুকুরকে গাঁজার ধোঁয়ায় টান দিয়ে নেশা করতে দেখেছিল। আর সংগীতজগতের প্রবাদপুরুষ আবদুল করিম খাঁ’র পোষ্য টিপু মিয়াঁ তো জলসায় গিয়ে খাঁসাহেবের সঙ্গে সরগম অবধি করত! কিন্তু এরা ব্যতিক্রম। নেড়ি কুকুরদের সভ্যতা আর ভব্যতার ট্রেনিং দেওয়া হয় না, তাই এদের ণত্ব-ষত্ব জ্ঞান নেই। অন্যায় বা বেচাল দেখলে এরা ডেকে ওঠে, মুখ লুকিয়ে সোফার তলায় ঢুকে ওম খোঁজে না। তাই এদের অন্যত্র সরিয়ে রাখাই আজকের দিনে মঙ্গলের।
যে-কুকুরদের কথা বলছি, এরা সবাই নেড়ি কুকুর। এরা রাস্তায় ঘুরে বেড়ায় আর নিজেদের মধ্যে একটা এলাকার বিভাজন করে নেয়। নিজের এলাকায় অন্য এলাকার কুকুরদের ঢোকা বারণ, ঢুকলেই যুদ্ধ। যেখানে থাকে, সেই এলাকাকে রক্ষা করার আর যাবতীয় ঝামেলা থেকে মুক্ত রাখার দায়িত্ব স্বেচ্ছায় এরা কাঁধে তুলে নেয়।
কিন্তু এখানেও একটা মুশকিল আছে, চারপাশের মানুষের ওপরে আস্থা হারিয়ে এখন গ্রহের ওপরে বিশ্বাস বেশি করা হয়। যা দিনকাল, কেতুর দৃষ্টি পড়ছে চারদিকে। আর কেতুকে সন্তুষ্ট রাখতে গেলে কালো কুকুরকে খাওয়াতে হয়। বিলিতি কুকুরের হাজার বায়নাক্কা, বরং পাড়ার কালো নেড়ি কুকুর সোনা মুখে সব খায়, আর শুধু খায় তাই-ই নয়, সঙ্গের পাটকিলে রঙের কুকুরকে ভাগও দেয়। নেড়ি কুকুর না থাকলে, কেতু কুপিত হবেন যে!
পুনশ্চ: শিলিগুড়ির পাড়ায় একটা কুকুরের নাম প্লুটো দেখে পুলকিত হয়েছিলাম এই ভেবে যে, অবশেষে নেড়ি কুকুরও জাতে উঠল! তারপরেই মনে পড়েছিল, প্লুটোর ভারতীয় নাম কেতু।