চোখ-কান খোলা: পর্ব ৭

Poster of The Bengal Files

বিবেক দংশন

‘দ্য মেশিনিস্ট’ ছবির জন্য তিনমাস ধরে ওজন কমিয়েছিলেন ক্রিশ্চিয়ান বেল। মেথড অ্যাক্টিংয়ের ক্লাসরুম ধরে নেওয়া হয় সেই প্রস্তুতিকে। এই শারীরিক কসরতের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর একটি মনস্তাত্ত্বিক যাত্রাপথ ছিল। অমন একটি আঁধারঢাকা চরিত্র তাঁকে ভেতরে লালন করতে হয়েছে। তার মানে কি, অভিনেতা আসলে ওই চরিত্রের সবক’টি কাজের সমর্থক হয়ে উঠছে? ভেতরে ভেতরে সেও হয়ে উঠছে সেই চরিত্র? স্তানিস্লাভস্কির বিখ্যাত তত্ত্ব ‘ম্যাজিক ইফ’ বলেছিল, অভিনেতাকে তার চরিত্র হজম করতে গেলে কল্পনাশক্তির ডানা মেলতে হবে সেই চরিত্রকে নিয়ে। কীভাবে সে যা নয়, তা হয়ে উঠবে সে? সে যদি চরিত্রের আধারে, চরিত্রের রোজনামচায় নিজেকে নিয়ে গিয়ে ফেলে। বের্টোল্ট ব্রেখট যখন তাঁর এলিয়েনেশন তত্ত্বর অবতারণা করলেন, তখন অন্য একটি প্রতর্ক সামনে এল। দর্শককে পারফরমেন্সের আবেগি অন্দরমহল থেকে দূরে সরিয়ে নেওয়ার জন্য অভিনেতা কী করতে পারেন, তার একটা রূপরেখা তৈরি হল।

কিন্তু এইসব বিতর্কই অভিনেতার সঙ্গে চরিত্রের বোঝাপড়ার। কিন্তু কেবলই চরিত্র কি অভিনেতার ভাবনার উপজীব্য? চরিত্র তো পরিপ্রেক্ষিতের জমিতেই দাঁড়িয়ে। একটি ছবির যদি উদ্দেশ্য হয়, গোপনে নয়, সরাসরিই যদি এমন হিংসার কথা প্রচার করা, যা সংবেদনশীল, যা সুবিধের নয়, তাহলে অভিনেতা কী করবে? শুধুই অভিনয়ের চ্যালেঞ্জের জন্য মেনে নেবে সেই চরিত্রের প্রস্তাবনা? অভিনেতা বলবেন, আমার কী দায়! আমি কেবলই আমার চরিত্রটুকু ঠিক করে ফুটিয়ে তুলব। কিন্তু এই দায় কি শিল্পী না নিয়ে থাকতে পারেন? বিশেষ করে, সময় যদি ততটা সুখের না হয়, ততটা আনন্দের না হয়, যদি রাজনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যে লেগে থাকে সন্দিহান প্রোপাগান্ডার ধুনো-গন্ধ, তাহলেও কি চরিত্র সত্য, জগৎ মিথ্যা ভেবে নিয়ে অভিনেতা নির্লিপ্ত থাকতে পারেন?

আরও পড়ুন: নাম ছিনতাই করলেই কি ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি সম্ভব?
পড়ুন ‘চোখ-কান খোলা’ পর্ব ৬…

সম্প্রতি বিবেক অগ্নিহোত্রীর ‘দ্য বেঙ্গল ফাইলস’, যার নাম নাকি আদতে ছিল ‘দ্য দিল্লি ফাইলস’, সেই ছবির দুই বাঙালি অভিনেতা নেটিজেনদের জ্বলন্ত প্রশ্নের মুখে পড়ে দু’রকম উত্তর দিয়েছেন। এক অভিনেতা জানিয়েছেন, ইতিহাসের বিকৃতি নিয়ে তাঁর মাথা ঘামিয়ে লাভ নেই, কারণ তিনি ইতিহাসবিদ নন। অভিনেতা। চরিত্রই তাঁর কাছে একমাত্র মাথাব্যথার কারণ। অন্য এক অভিনেতা বলেছেন, হিটলারের চরিত্র করলে কি তিনি নাৎসি সমর্থক হয়ে উঠবেন? মোদ্দায়, দুই অভিনেতাই এই ছবিতে তাঁদের চরিত্রদু’টি পছন্দ করেছেন, ‘অভিনেতা’ হিসেবেই। এই ছবির রাজনৈতিক, তার চেয়েও সাংঘাতিক, সাম্প্রদায়িক অভিঘাত নিয়ে তাঁরা ভাবিত নন। আরও বড় কথা, এই ছবি আদৌ সত্যের প্রতি কতটা নিবেদিত, তা নিয়েও তাঁদের কোনও অবস্থানই নেই। আরও উদ্বেগের, একজন খ্যাতনামা, প্রতিষ্ঠিত অভিনেতা, যাঁকে নিয়ে সবচেয়ে বেশি প্রশ্ন উঠছে, তিনি বলেছেন, এখনকার ‘ট্রেন্ড’ মেনে নাকি তাঁকে চিত্রনাট্যে তাঁর চরিত্রের অংশটুকুই কেবল পড়ানো হয়েছে। কেন একজন বরিষ্ঠ অভিনেতা, এই ছবির পরিচালকের অবস্থান জেনেও, এমন একটি ব্যবস্থায় রাজি হবেন, এবং কেন তিনি কোনও দায়ই নিতে চাইবেন না, এই প্রশ্ন কি এড়িয়ে যাওয়া যাবে?

এবার কথা হচ্ছে, এই ছবির পরিচালক তাঁর রাজনীতি নিয়ে স্পষ্টবাদী। তাঁর এই ছবিতে দু’জন এমন অভিনেতা অভিনয় করছেন, যাঁদের রাজনৈতিক পরিচিতি নিয়ে কোনও সংশয় থাকার কথা নয়। সর্বোপরি, এই পরিচালকের আগের ছবি, ‘দ্য কাশ্মীর ফাইলস’, ‘দ্য তাসখন্দ ফাইলস’ বা ‘বুদ্ধা ইন আ ট্রাফিক জ্যাম’— কোথাও তাঁর রাজনীতি অস্পষ্ট নয়।

কিন্তু অভিনেতা কী করবে? যে অভিনেতার কোনও প্রকাশ্য রাজনৈতিক অবস্থান নেই, তাঁকে সরিয়ে রেখে, একটু দেখা যাক, নির্দিষ্ট রাজনীতি, নির্দিষ্ট আদর্শবাদে বিশ্বাসী অভিনেতারাই বা এক্ষেত্রে কতটা নিশ্ছিদ্র। ‘দ্য তাসখন্দ ফাইলস’ লালবাহাদুর শাস্ত্রীর মৃত্যু নিয়ে জলঘোলা করেছিল। সেই ছবিতে অভিনয় করেছিলেন নাসিরুদ্দিন শাহ। জানা ইতিহাসের বিপ্রতীপে দাঁড়িয়ে, যে নতুন ইতিহাস গড়ার খেলাটা এই ছবির মূল উদ্দেশ্য, তা নিয়ে নাসিরুদ্দিন শাহ-র বিরুদ্ধতা আজও সোচ্চার। মাথায় রাখার, এই ছবির জন্য রাজি হতে, অধুনা-বিজেপি সমর্থক মিঠুন চক্রবর্তীও দু’বার ভেবেছিলেন, নাসিরুদ্দিন এককথায় রাজি হয়েছিলেন।

সম্প্রতি বিবেক অগ্নিহোত্রীর ‘দ্য বেঙ্গল ফাইলস’, যার নাম নাকি আদতে ছিল ‘দ্য দিল্লি ফাইলস’, সেই ছবির দুই বাঙালি অভিনেতা নেটিজেনদের জ্বলন্ত প্রশ্নের মুখে পড়ে দু’রকম উত্তর দিয়েছেন। এক অভিনেতা জানিয়েছেন, ইতিহাসের বিকৃতি নিয়ে তাঁর মাথা ঘামিয়ে লাভ নেই, কারণ তিনি ইতিহাসবিদ নন। অভিনেতা। চরিত্রই তাঁর কাছে একমাত্র মাথাব্যথার কারণ। অন্য এক অভিনেতা বলেছেন, হিটলারের চরিত্র করলে কি তিনি নাৎসি সমর্থক হয়ে উঠবেন? মোদ্দায়, দুই অভিনেতাই এই ছবিতে তাঁদের চরিত্রদু’টি পছন্দ করেছেন, ‘অভিনেতা’ হিসেবেই।

এইখানে বিবেক অগ্নিহোত্রীর থেকে প্রসঙ্গটাকে ঘুরিয়ে যদি একটু সন্দীপ রেড্ডি ভাঙ্গার ছবির ওপর আলো ফেলা যায়, তাহলে এই সমীকরণ আরও ঘাঁটবে। কারণ, বিবেকের ছবির তবু একটি রাজনৈতিক অভিমুখ আছে। ভাঙ্গার ছবি সামাজিকভাবে যে ধরনের আদর্শকে তোল্লাই দেয়, এবং ভাঙ্গা সরাসরি যে ধরনের ভাবনা খোলসা করেন তাঁর সাক্ষাৎকারগুলিতে, তা জেনেশুনে যে অভিনেতারা বিষ পান করবেন, তাঁরা কি তবে ভাঙ্গার মতের সমর্থক হবেন? আদিল হোসেনের মতো অভিনেতা ‘কবীর সিং’ করার পর উপলব্ধি করেন, তাঁর এই ছবি করা উচিত হয়নি। এটুকু দ্বিধাও কি শিল্পী হিসেবে অভিনেতার কাছে প্রয়োজনীয় নয়? বাংলার এক প্রতিষ্ঠিত অভিনেতার যেমন মত, ওই নির্দিষ্ট চলচ্চিত্রটি যে রাজনৈতিক মতবাদেরই পতাকা-বাহক হোক না কেন, সত্যের প্রতি সেই চলচ্চিত্র কতটা ঝুঁকে, সচেতন অভিনেতা হিসেবে সেটুকু অন্তত ভাবার প্রয়োজন আছে।

আমরা সকলেই জানি, এই সময় দাঁড়িয়ে পেশাদারিত্বর দায় এড়ানো সহজ নয়। অভিনেতাও পেশাদার হতেই পারেন। কিন্তু একজন চিকিৎসক যেভাবে ঠিক করতে পারেন না কোন রোগীর চিকিৎসা তিনি করবেন, তেমন পেশাদারিত্ব কি অভিনেতারও? আইনজীবীরাও তো বহু ক্ষেত্রে আইনি মেরিট ছাপিয়েই সিদ্ধান্ত নেন, কার হয়ে তিনি মামলা লড়বেন, কার হয়ে লড়বেন না। আইনের প্রতিমূর্তির চোখ তো কালো কাপড়ে বাঁধা। কাজেই এই দায় তাঁর না নিলেও চলে। কিন্তু একজন ক্রিমিনাল লইয়ারও, তার পরেও, বহু ক্ষেত্রে নিজের অবস্থান নির্ধারণ করেন। সাংবাদিককে নিরপেক্ষ হতে হবে, এটাই চালু তত্ত্ব। তারপরেও, কিছু সাংবাদিক পক্ষ বেছে নেন, কেন? একজন চিকিৎসকও পেশাদার মানসিকতাকে কি সরিয়ে রাখবেন না, কোনও না কোনও মানবিক দায় থেকেই? বিবেকের কাছে, সত্যের কাছে এটুকু দায়, এমনকী, একজন ভাড়াটে অপরাধীরও থাকতে পারে।

শিল্পী দিনের শেষে আদতে রাজনৈতিক-ই, তিনি চান বা না-চান। তাই অভিনেতাকেও জানতে হবে, বিভেদ-চারিয়ে দেওয়া কোনও কাজের অংশীদার যখন তিনি হবেন, তখন তাঁর অবস্থান আদতে কী হওয়া উচিত। তিনি যদি ছবিটির বক্তব্য নিয়ে ভাবিতই না হন, তাহলে চরিত্রটিকে পছন্দ করছেনই বা কী করে? রাজনীতি এড়িয়ে গিয়েও, চরিত্রের দাঁড়িয়ে থাকার জমিটুকু তো তাঁকে অন্তত বুঝতে হবে। ভিলেন কেন ভিলেন, নায়ক কেন নায়ক, এইটুকু প্রশ্ন তাঁর নিজের মনেও জাগবে না? এমনিতেই কৃত্রিম মেধা কিছুদিনের মধ্যেই অভিনেতাদের প্রতিস্থাপন করবে, এমন জল্পনা হাওয়ায় ভাসছে। তাই অভিনেতাকে তাঁর রক্তমাংস ও মনের সঙ্গে সংলাপে যেতেই হবে। কোনও চরিত্রই কোনও নিরালম্ব বায়ুভূত নয়। চরিত্র ও চলচ্চিত্রের মূল সারে বিশ্বাস তিনি না করুন, অন্তত অবিশ্বাসটুকুও তো তাঁর থাকবে। সেটুকু না থাকলে, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা অভিনেতার একটি হলোগ্রামের সঙ্গে তাঁর তফাত কোথায় রইল?