চাঁদের পাহাড়

Representative Image

‘প্রথম যেদিন চাঁদের পাহাড় পড়েছিলাম, তখন গরমের দুপুর। আমি মামারবাড়িতে। তখন কোন ক্লাস পড়ি ঠিক মনে পড়ছে না। নেহাত-ই একজন স্কুল পড়ুয়া। মধ্যবিত্ত বাড়ির গরমের দুপুরগুলো যেমন হয়, আমারও তেমন-ই ছিল। গল্পের বই হাতে দুপুরগুলো বেশ কেটে যেত। সেই প্রথম আমি চাঁদের পাহাড় পড়লাম। কথাগুলো শেষ করে জ্যোতিষ্ক থামলেন। তারপরে বললেন, ‘সেই যে চাঁদের পাহাড়ের নেশা আমাকে পেয়ে বসল, ব্যস! সে-থেকেই চাঁদের পাহাড় অভিযানে যেতে হবে এই লক্ষ্য আমি স্থির করে ফেলি।’

যখন জ্যোতিষ্কর সঙ্গে কথা হচ্ছে, তিনি তখন সাইকেল চালাচ্ছেন। হাঁপাচ্ছেন। তবুও তিনি যে চাঁদের পাহাড়ের অভিযান সফল করেছেন, সেই উচ্ছ্বাস বারবার তাঁর গলায় ধরা দিচ্ছে। তবে তিনি জানালেন, ‘আমার শরীর ভেঙেছে। অনেকদিন তো হল। সাইকেলটাও খারাপ হয়েছে বেশ কয়েকবার। আর কতদূর যেতে পারব ঠিক জানি না।’ কথাগুলো বলে আবার একটু শ্বাস নিলেন। তবুও জ্যোতিষ্কর অজানাকে জানার নেশা আরও, আরও বেশি। তিনি লড়ে যাওয়ার ছেলে। নয়তো একটি উপন্যাস পড়ে ছুটে গেলেন চাঁদের পাহাড়ে! প্রথম বাঙালি নন, তাঁর আগেও এক বাঙালি পৌঁছেছেন সেখানে। তবে জ্যোতিষ্ক সবচেয়ে উঁচু শৃঙ্গে পৌঁছেছেন। পৌঁছেছেন বিভূতিভূষণের কল্পনার চাঁদের পাহাড়ের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ মার্গারিটা পিক, যা রুয়েনজোরি পর্বতমালায় অবস্থিত।

আরও পড়ুন: ‘সাইকেলকে ভালবেসেই দু-চাকায় ভর করে কালকা থেকে পাড়ি জমিয়েছিলেন লাদাখ।’ কথোপকথনে রিন্টু অধিকারী…

চাঁদের পাহাড়, যার আসল নাম রুয়েনজোরি পর্বতমালা। এই পর্বতমালা পূর্ব আফ্রিকার উগান্ডা ও কঙ্গো গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের সীমান্তে অবস্থিত। এর উচ্চতা ৫,১০৯ মিটার (১৬,৭৬৩ ফুট)। খাতায় কলমে ১১ বছরের প্ল্যানিং হলেও এর পেছনে রয়েছে দীর্ঘ ইতিহাস। এক-একটা মুহূর্তের পরিকল্পনা। তবে নাইরোবির টিকিট কাটার ঘটনা খুব আকস্মিক। জ্যোতিষ্ক অন্নপূর্ণা বেস ক্যাম্পে তখন। জুন মাসের ঘটনা। হঠাৎ তাঁর কী মনে হল, অনেক দিনের স্বপ্নকে এবার বাস্তবের রূপ দেওয়া যাক। ঝট করে কেটে ফেললেন টিকিট। তখনও তিনি ভিসার জন্য আবেদন করেননি। কিন্তু তাঁর চাঁদের পাহাড় যাওয়ার অদম্য জেদ কি কেউ আটকাতে পারে? বাড়ি ফিরলেন। ব্যাগ গোছালেন। সাইকেলটা প্যাক করেলেন। মাত্র একটা জামা নিয়ে চলে এলেন মুম্বই। সেখান থেকে নাইরোবি। সেখান থেকে ট্রেনে মোম্বাসা। তারপর তাঁর শুরু সাইকেল যাত্রা। রেললাইনের ধার বেয়ে এগিয়ে গিয়েছেন। ঠিক আমাদের দেখা সিনেমার মতো। শঙ্কর যে রেল স্টেশনে কাজ করত, জ্যোতিষ্ক গিয়েছিলেন সেখানে। নিজে হাতে পরখ করে এসেছেন সেই সৌন্দর্যের উদাসীনতাকে। তিনি জানিয়েছেন, ‘সিনেমার দেখানো প্লট থেকে একদম আলাদা আমার অভিযান। সিনেমার চেয়েও বেশি রোমাঞ্চকর এই প্রকৃতি।’ তিনি আরও জানিয়েছেন যে, ‘বিভূতিবাবু কী করে এত সঠিক ভাবে প্রতিটা বর্ণনা তুলে ধরেছেন? এ যেন এক আশ্চর্য।’

লোকের বাড়ির পেছনের অংশে দিন কাটিয়েছেন। কখনও ছাদে, আবার কখনও বাগানে। ফল খেয়েছেন। অনেক সময়েই শুকনো খাবার খেয়ে কাটিয়েছেন। কখনও ঘণ্টার পর ঘণ্টা জল পাননি। আবার স্থানীয় লোকেদের সাহায্য পেয়েছেন। এগিয়ে গিয়েছেন বিভূতিভূষণের স্বপ্নকে পূরণ করার জন্য। ছোট থেকেই ডানপিটে জ্যোতিষ্ক। পাহাড় আর অজানাকে জানার ইচ্ছে ছোট থেকেই। বাবা প্রথম জীবনে ছিলেন আর্মি অফিসার। পরে স্কুলে যোগদান করেন। সেই সুবাদে ঘুরেছেন গোটা ভারতের বিভিন্ন জায়গা। সাইকেল নিয়ে তার আগেও বেশ কিছু অভিযানে গিয়েছেন তিনি। তবে এইবারের অভিযানটা তাঁর কাছে বড্ড স্পেশাল। কারণ তিনি ছোটবেলার স্বপ্ন পূরণ করতে গিয়েছেন।

খরচের প্রসঙ্গে তিনি জানিয়েছেন, ‘আমি কারুর থেকে একটা টাকা নিইনি। কোনও স্পন্সর খুঁজিনি। বাবা দিতে চেয়েছিলেন, তাও নিইনি। বাঙালিদের মেরুদণ্ড নেই, এই কথাটা আমি মানি না। বাঙালিরা চাইলে বিশ্বজয় করতে পারে। গোটা অভিযান আমি নিজের টাকায় এসেছি। এখনও দৌড়ে যাচ্ছি নিজের টাকার উপর ভিত্তি করে।’

সাইকেল নিয়ে তিনি পাড়ি দিয়েছেন দেড়হাজার কিলোমিটার। পার করেছেন এক-একটি দেশের বর্ডার। সময় লেগেছে ১০দিনের বেশি। কেনিয়া থেকে উগান্ডা গিয়েছেন। সেখানে থেকে চাঁদের পাহাড়ে যাওয়ার বেস ক্যাম্পে পৌঁছেছেন। বেস ক্যাম্পে তাঁর গোটা ট্রেক প্ল্যান করেছেন হানউইক্স। কিলিম্বে বেস ক্যাম্পে মাত্র একদিন বিশ্রাম নিয়েই ঝাঁপিয়ে পড়েছেন চাঁদের পাহাড় অভিযানে। তিনি আর সঙ্গে আটজন নিয়ে ১৪দিনে সম্পূর্ণ করেছেন চাঁদের পাহাড়ের অভিযান। তিনি জানিয়েছেন, ‘এই অভিযান প্রচন্ড কঠিন ছিল। এক কিলোমিটার যেতেই দুই ঘণ্টা লেগে যাচ্ছিল। কাদা জল, গ্লেসিয়ার, তুষার ঝড় এবং সেই সঙ্গে বৃষ্টি। বন্য জন্তুর ভয়ে আমরা সবসময়ে সতর্ক ছিলাম।’ জ্যোতিষ্কর কথায়, ‘আমাদের সঙ্গে দুটো একে ফরটিসেভেন ছিল। এখানে বুনো শুয়রের ভয় বেশি। তবে আমাদের সেগুলো ব্যবহার করতে হয়নি।’

চাঁদের পাহাড় নিয়ে নানা মুনির নানা মত। অনেক বিশেষজ্ঞের মতে চাঁদের পাহাড়ে এমন কিছু আছে, যা বিশ্বের অষ্টম আশ্চর্যের সমান। আবার অনেকে বলেন ওখানে নাকি সোনা অথবা হীরের খনি আছে। তবে জ্যোতিষ্কের কথায়, ‘আমি তো বিশারদ নই, তবে এমন কিছু থাকাটা অস্বাভাবিক নয়।’ রহস্য আছে আরও। স্থানীয় মানুষরা মাউন্টেন অফ মুন নিয়ে কথা বলতে আগ্রহী নয়। ট্রেক করে ওঠা এবং ফিরে আসা পর্যন্ত ঠিক আছে। রুয়েনজোরি পর্বতমালা বা ‘চাঁদের পাহাড়’ স্থানীয় বাকনজো জনগোষ্ঠীর কাছে দেবতার আবাসস্থল হিসেবে পরিচিত। লোককথায় বলা হয়, বরফে ঢাকা মার্গারিটা শৃঙ্গর গুহায় অদৃশ্য আত্মা ও পাহাড়ের রক্ষক আত্মারা বাস করে। ‘অদৃশ্য গুহা ন্যামওয়ামবা’ নামে এক রহস্যময় গুহার কথা শোনা যায়, যা শুধু নির্বাচিত কিছু মানুষের কাছেই প্রকাশ পায়। প্রাচীন কাহিনিতে রয়েছে হারিয়ে যাওয়া নগরী ও লুকনো ধন-সম্পদের গল্প, যেগুলোকে পাহাড়ের দেবতারা রক্ষা করে বলে বিশ্বাস করা হয়। বরফের চাঁদের মতো আভা, অদ্ভুত আবহাওয়া, আর অধরা গন্তব্য এই পর্বতকে ঘিরে রেখেছে এক চিরন্তন রহস্য। জিজ্ঞেস করলাম, ‘বুনিপ আছে নাকি?’ ,তিনি হাসলেন, একটু থেমে বললেন , ‘না। এইসব গুজব। তবে ওকাপি দেখা গিয়েছিল বহু বছর আগেই, আমি যে পথে ট্রেক করে গিয়েছি সেই পথেই দেখা গিয়েছিল।’

জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনার অভিযান তো শেষ, এবার কি দেশে ফেরার পালা,?’ তিনি বললেন, ‘এই অভিযান সবে শুরু। আমি প্রতিটা জায়গা ঘুরে দেখব যেখানে শঙ্কর আর আলভারেজ গিয়েছিল।’

‘গোটা ট্রেকে ডাল, ভাত, সোয়াবিন খেয়ে কাটিয়েছেন জ্যোতিষ্ক। জ্যোতিষ্ক মনে করেন বিভূতিভূষণ বাস্তবে সকলকে শঙ্করের মতো স্বাবলম্বী হতে শিখিয়েছেন। জীবনের প্রতিটা মুহূর্তে বাঙালিকে উদ্বুদ্ধ করে গিয়েছেন চাঁদের পাহাড়ের মাধ্যমে। এই গোটা অভিযানে জ্যোতিষ্কর মনে হয়েছে হয়তো তিনি পারবেন না। আবার পরমুহুর্তে তিনি ঘুরে দাঁড়িয়েছেন। কল্পনার শঙ্করের কথা মনে করেছেন। বিভূতিভূষণের সঙ্গে মনে-মনে কথা বলেছেন। তিনি যেন বলেছেন, ‘রান জ্যোতিষ্ক রান!’ ঠিক যেভাবে ফরেস্ট গাম্প পেছন থেকে শুনেছিলেন, ‘রান ফরেস্ট রান!’ জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনার অভিযান তো শেষ, এবার কি দেশে ফেরার পালা,?’ তিনি বললেন, ‘এই অভিযান সবে শুরু। আমি প্রতিটা জায়গা ঘুরে দেখব যেখানে শঙ্কর আর আলভারেজ গিয়েছিল।’ প্রসঙ্গত তাঁর এই অভিযানে আলভারেজ ছিল স্থানীয় ছেলে বেনাড। জ্যোতিষ্কের কথায়, ‘বেনাডই আমার অভিযানের আলভারেজ। প্রতিটা মুহূর্তে আমাকে আগলে রেখেছে সে।’ জ্যোতিষ্ক বর্তমানে রয়েছেন তানজানিয়াতে। বিভূতিভূষণ রূপকথা এঁকেছেন আর জ্যোতিষ্ক সেই রূপকথাকে বাস্তবের রূপ দিয়েছেন। অজানা পথ, অজানা গাছের স্তম্ভ। অজস্র পাখির ডাক। মহাশূন্যের মতোকুয়াশা ঢাকা গুহা। ভোরের প্রথম আলো ছিটকে এসে পড়েছে অভিযানের তাঁবুতে। এখানে প্রতিধ্বনিরা বারবার ফিরে-ফিরে এসেছে। জীবনের ঝুঁকি থেকেছে। গোপন রয়ে গিয়েছে কথোপকথন। বাঙালির নামে জয়ধ্বনি পড়েছে আবার। জীবনের জয় হয়েছে।