দোচু লা পেরিয়ে দেবলোকে
দোচু লা। আমরা কথায় বলি দোচু লা পাস। যেহেতু জংখা অর্থাৎ ভুটানের ভাষায় ‘লা’ মানে পাস, তাই আলাদা করে বলার দরকার নেই। ভুটানে বড়-বড় পাস বা গিরিখাত আছে গোটা পাঁচেক। তার মধ্যে মনে হয় সবচেয়ে সুন্দর এই দোচু লা। থিম্পু আর পুনাখার মধ্যে এই কুয়াশামাখা ছায়াপথ ভারি রোম্যান্টিক। মে মাসে হাল্কা ঠান্ডার আমেজে দুর্দান্ত এক যাত্রা। শীতে অবশ্য রাজকীয় হিমালয় তার অপার্থিব শৃঙ্গ নিয়ে হাজির হয় চোখের সামনে। বরফে মোড়া বেশ কয়েকটি চূড়া দেখা যায় এই পাসে দাঁড়িয়ে। বসন্তদিনের পাওনাও কম নয়, রডোডেনড্রনের রঙিন শুভেচ্ছা। যাঁরা নিসর্গের চেয়ে স্বর্গ নিয়ে বেশি চিন্তিত, তাঁদের কাছে বড় আকর্ষণ এই গিরিখাতের আধ্যাত্মিক মহিমা। দোচু লা নাকি পার্থিব জগতের সঙ্গে দৈবলোকের সংযোগ পথ। রাস্তায় ইয়াকের দল দেখে মনে হল, তবে কি গরুর লেজ ধরে বৈতরণী পার হওয়ার মতো এখানে ইয়াকের লেজ ধরে গিরিখাত পার হলেই পৌঁছনো যায় সুরলোকে? সে যাই হোক, বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে বহুদূর। তাছাড়া, পথেই যদি পান স্বর্গের স্বাদ, পথের শেষে পৌঁছনোটা কি আর জরুরি মনে হবে?
খুব কম গাড়ি চোখে পড়ল পথে। শুনেছিলাম মে মাসের ভরা মরশুমে নাকি এক একসময় গাড়ির ভিড়ে জ্যাম হয়ে যায় দোচু লা পাস। আমাদের ভাগ্য ভাল, ঘণ্টা তিনেক নির্জন পথে মনের সুখে ক্যামেরা চালিয়ে যেতে পারলাম। বরং ইয়াকের দল এমন দুলকি চালে চলছিল যে, মাঝরাস্তা বরাবর গাড়ির গতি বাধ্য হয়ে কম রাখতে হচ্ছিল। বলে রাখা ভাল, প্রকৃতি আর আধ্যাত্মিক ব্যাপার ছাড়াও দোচু লা-র আরও একটা মাহাত্ম্য আছে। ১০৮টা স্মারক চোরতেন। মানে ছোট-ছোট মন্দির বলা যায়। শহীদ সেনাদের স্মরণে। হিন্দুদের মতন বৌদ্ধরা, বিশেষ করে যাঁরা তিব্বতি বজ্রযান বৌদ্ধধর্মে দীক্ষিত, তাঁরা ১০৮ সংখ্যাটার পবিত্রতায় বিশ্বাসী। এগুলো আবার তিনধাপে সাজানো, সেনাবাহিনীর র্যাঙ্ক অনুযায়ী। একটা জায়গায় পাহাড়ের কিছুটা ওপরে একলা কুঁড়েঘর দেখে থমকে গেলাম। যেন জলরঙে আঁকা ছবি। মেঘলা আকাশের চালচিত্রে, একটু হেলে থাকা পাইনের পাশে কাঠের তৈরি নড়বড়ে একচালা বাড়ি।

টিপটিপ বৃষ্টি পড়েই চলেছে। ফার্ন আর শ্যাওলা মাখা সরু পায়ে চলা পথ উঠে গেছে ঐ ঘরের দিকে। অল্প ধোঁয়া নাকি মেঘের টুকরো লেগে আছে তার মাথায়। কেমন যেন টানতে লাগল আমাকে। ‘আকাশে ছড়ানো মেঘের কাছাকাছি/দেখা যায় তোমাদের বাড়ি’। ওখানে আমাকে যেতেই হবে। পা বাড়াতেই সাবধান করল ক্যামেরাম্যান, ‘দিদি, খুব পিছল কিন্তু, পারবে উঠতে?’ আমার তখন যেন ঘোর লেগে গেছে। ঘাড় নেড়ে পা টিপে-টিপে উঠতে লাগলাম। পেছনে সে আর চালকও আসতে লাগল অগত্যা। এমন কিছু কঠিন মনে হল না। ঐ কুঁড়েতে থাকেন এক মহিলা, গরিব পাহাড়িদের মুখে এমন বলিরেখা পড়ে যে, বয়স বোঝা মুশকিল। পঞ্চাশ হতে পারে, আবার সত্তরও হতে পারে। রীতিমতো উল্লসিত হলাম দেখে, বাকু পরা সেই মোটাসোটা মহিলা চায়ের জল চাপিয়েছেন। কার জন্য বুঝলাম না। আমরা আসব সে তো জানা ছিল না। এই রাস্তায় তো আর গাড়িও চোখে পড়েনি অনেকক্ষণ যে খদ্দেরের আশা আছে। পরে বুঝলাম, অভ্যেসবশেই চা বানাচ্ছেন কারণ এই বিকেল-বিকেল সময়ে দু-চারটি জানাশোনা চা-খোর হয়তো আসে অন্যদিন। আশেপাশে তো আর দোকান নেই। আজ অবশ্য খারাপ আবহাওয়ার কারণে বেঞ্চ ফাঁকা। আমরাই আলো করলাম বসে। খুব ইচ্ছে করছিল আড্ডা জমাই, জেনে নিই এই একলার জীবনের গল্প। কিন্তু ভাষা সমস্যায় সেটা সম্ভব হল না। শুধু এটুকু জানা গেল, ওঁর কেউ নেই। চা আর ম্যাগি বিক্রি করে যা পান, সেটাই সম্বল। ‘এই একলা ঘর আমার দেশ/ আমার একলা থাকার অভ্যেস’ উনি তো শোনেননি রূপম ইসলামের গান!
চা যে দুর্ধর্ষ খেলাম তা বলব না। নেহাত সস্তা পাতা দিয়ে অপটু হাতে বানানো। তবে ভেজা বিকেলে গরম তরল গলা দিয়ে নামতে বেশ আরামই লাগল। একলা মানুষটির জন্য মনকেমন আমরা ধরে রাখলাম লেন্সে। ট্রাভেল শোয়ের দোচু লা এপিসোডে থেকে যাবে এই বিজন চায়ের দোকান। আমরা ভাবি, জীবনের পথে ওঠাটাই সমস্যা, নামাটা সহজ। পাহাড়ের পথে কিন্তু ঠিক উলটো। সেটা এর আগেও টের পেয়েছি, কিন্তু ভুলে যাই বারবার। কে বলে নেড়া একবারই বেলতলায় যায়!
অতএব সপাটে আছাড় খেলাম মাঝপথে। কিন্তু কী আশ্চর্য, আটকে গেলাম অল্পতেই। গড়িয়ে একেবারে নীচে পড়ে গেলে কী হত, ভেবে আমাদের তিনজনের হাড় হিম হয়ে গেল। এবং বোধহয় এই বেঁচে যাওয়ার বিস্ময়েই আমি তুরন্ত গা ঝাড়া দিয়ে উঠলাম সঙ্গীদের সাহায্য আসার আগেই। ব্যথা তো লেগেছে বটেই, জিন্সের ওপর দিয়ে ছড়েও গেছে হাঁটু, কিন্তু তার থেকেও বড় অস্বস্তি শ্যাওলা মাখামাখি হয়ে গেছে একদিকটা। ভেজা জামায় ঠান্ডা লাগছে রীতিমতো। কী আর করা যাবে! ওভাবেই গাড়িতে উঠলাম। বেশি পথ বাকি নেই আর!
এমন কিছু রাত হয়নি। সন্ধে সাতটা-সাড়েসাতটা হবে। কিন্তু মনে হল পুনাখা যেন ঘুমিয়ে পড়েছে। কিন্তু একসময়ের রাজধানী, ব্যস্ত ট্যুরিস্ট স্পট, দেশের সবচেয়ে সুন্দর জং— এতকিছু নিয়ে ভরসন্ধেয় ঘুমিয়ে পড়ল পুনাখা? আর এ তো শীতের জায়গাও নয় যে লোক জড়োসড়ো হয়ে ঘরে ঢুকে পড়বে সন্ধে হতেই। দশ হাজার ফুট উচ্চতার দোচু লায় যে ঠান্ডার আমেজ ছিল, পুনাখায় তা একদম উধাও। কারণ পুনাখা অনেক নীচে, প্রায় সমতল। এদিকে খিদেয় পেটে ছুঁচো ডন মারছে। পারোর অভিজ্ঞতা মনে পড়ায় আমরা ঠিক করলাম, হোটেলে পৌঁছে খাবার পাব কি না পাব, সেই ঝুঁকিতে না গিয়ে খেয়ে ঢোকাই ভাল। কিন্তু সেরকম রেস্তরাঁ চোখে পড়ল না। রাস্তাঘাটে আলোও মিটমিটে। একটা ছোটখাটো দোকান দেখে ঢুকলাম। চা, কফি, বিস্কুট, চিপস ছাড়া সেই ম্যাগি আর ওমলেট। তাই-ই সই। পেঁয়াজ লঙ্কা দেওয়া ডাবল ম্যাগি তিন প্লেট অর্ডার করে কফি নিয়ে বসলাম। বাঙালির যা স্বভাব। আমি আর ক্যামেরাম্যান প্রবল বিরক্তির সঙ্গে এই সূর্যাস্ত হলেই খাবার না পাওয়া নিয়ে গরমাগরম কথাবার্তা বলতে লাগলাম। ভয় নেই, কেউ তো আর বাংলা বুঝবে না এখানে! আর বেড়াতে আসা লোকজনও দেখছি না চারপাশে। হঠাৎ দৈববাণীর মত অন্ধকার ফুঁড়ে ভেসে এল, ‘বাঙালি মনে হচ্ছে!’ চমকে তাকিয়ে দেখি দোকানের বাইরে দাঁড়িয়ে এক যুগল। কলকাত্তাইয়া পাঞ্জাবি আর শাড়ি-ই বলে দেয়, এঁরা বাঙালি। আমরা যেন হাতে চাঁদ পেলাম। ‘হ্যাঁ দাদা’ বলে উঠে যাওয়ার আগেই ওঁরা হাজির টেবিলে। আলাপ জমল। রায় দম্পতি বেশ কয়েক বছর পুনাখার বাসিন্দা। মনে পড়ছে না কী চাকরি করতেন রায়দা, যতদূর সম্ভব কোনও ভারতীয় জলবিদ্যুৎ প্রকল্পে। ম্যাগির প্লেট টেবিলে আসতেই হাহাকার করে উঠলেন রায় বৌদি। ‘এই ছেলেমেয়ে দুটো ম্যাগি খেয়ে থাকবে রাতে?’ বড়জোর কুড়ি মিনিটের আলাপ, যেন সাতজন্মের চেনা। চোখে জল এসে গেল। ভাগ্যিস, দোকানের আলোটাও বাইরের মতই টিমটিমে!

তারে চোখে দেখিনি, শুধু বাঁশি শুনেছি। রাতে তার কুলুকুলু শুনেই মন আকুল হয়েছিল। ভাবুন, হোটেলের ঘরে শুয়ে আছেন, আপনার কানে অবিরাম বেজে চলেছে পাহাড়ি নদীর বয়ে যাওয়ার শব্দ, এর থেকে ভাল রাগিণী আর কিছু হতে পারে? সকালে উঠেই লাগোয়া ব্যালকনিতে গিয়ে মন ভাল হয়ে গেল। পুনাখার আদরের দুই বোন ফো চু আর মো চুর মধ্যে একজন স্রোতস্বিনী আমার সামনে। এই দুই নদী ঘিরে পুনাখার অনেক গর্ব। এদের সঙ্গমেই জ্যাকারান্ডার বেগুনি সমারোহে আসাধারণ স্থাপত্যের পুনাখা জং। স্থানীয় ভাষায় এর একটা খটোমটো নাম আছে, যেটা উচ্চারণে আমাদের খুব অসুবিধে হলেও মানেটা ভারি সুন্দর প্যালেস অফ গ্রেট হ্যাপিনেস, অপার আনন্দের প্রাসাদ। মনে পড়ে গেল, ভুটানকে বলা হয় কিংডম অফ হ্যাপিনেস। এই দেশে জিডিপির মত জিএনএইচ বলে একটা ব্যাপার বেশ সিরিয়াসভাবে দেখা হয়। গ্রস ন্যাশনাল হ্যাপিনেস, যাতে অর্থনৈতিক উন্নতির থেকেও বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয় মানুষের ভাল থাকাকে। তাই ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস রিপোর্টে র্যাঙ্ক-এ কতটা নীচে, তা নিয়ে আদৌ চিন্তিত নয় ভুটানের সরকার বা আমজনতা। তারা জিএনএইচ নিয়েই খুশি। সত্যি বলতে কী, সুখ ব্যাপারটাই তো নিজস্ব অনুভবের। পাশের বাড়ির লোক কী ভাবল, তাতে আমার বয়েই গেল!

দুই কল্লোলিনীর সঙ্গমে পুনাখা জং তৈরি শুরু হয়েছিল ১৬৩৭ সালে। দু-বছর লেগেছিল শেষ হতে। শুধু ভুটানি কেন, সব বৌদ্ধদের কাছেই পরম পবিত্রতার নিদর্শন। আর সবচেয়ে সুন্দর জং কেন বলা হয় একে, বুঝতে পারলাম নদীর এপারে দাঁড়িয়েই। চেরি ব্লসমের দিনগুলোতে জাপানের ছবি যেমন দেখায়, ঠিক তেমন বর্ণালি এখানে। বড়-বড় জ্যাকারান্ডা গাছ বেগুনি ফুলে ভরে আছে, আর তার ফাঁক দিয়ে উঁকি দিচ্ছে পুনাখা জং-এর ব্রোঞ্জের চূড়া। ব্যাকড্রপে নীল আকাশ, ধূসর পাহাড়। আর কী চাই চোখের ভুরিভোজে? সেতু পেরোতে গিয়ে মাঝপথে থমকে দাঁড়ালাম। দাঁড়াতেই হবে। কিশোরীর চপলতা দুই বোনের শরীরে, পায়ের নীচে তাদের বয়ে চলার উচ্ছ্বসিত ছন্দকে উপেক্ষা করবেন, সাধ্য আছে? ওপারে পৌঁছতে তাই সময় লাগল।
মনে পড়ে গেল, ভুটানকে বলা হয় কিংডম অফ হ্যাপিনেস। এই দেশে জিডিপির মত জিএনএইচ বলে একটা ব্যাপার বেশ সিরিয়াসভাবে দেখা হয়। গ্রস ন্যাশনাল হ্যাপিনেস, যাতে অর্থনৈতিক উন্নতির থেকেও বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয় মানুষের ভাল থাকাকে।
জং-এর ভেতরে গিয়ে এক শ্রমণের কাছে আমি জানতে পারলাম মাথার ওপরে সাজানো সার-সার তেকোনা রঙিন কাপড়ের অর্থ। অথচ দার্জিলিং থেকে গ্যাংটক, এর আগে কতবার দেখেছি পথের ধারে, পাহাড়ের ঢালে, গুম্ফার উঠোনে, এমনকী বাড়ির দরজাতে পর্যন্ত সুতোয় গাঁথা তেকোনা কাপড়ের মালা, উঁচু-উঁচু খুঁটির মাথায় পতপত করে উড়ছে মন্ত্র লেখা নানা রঙের পতাকা। কখনও কৌতূহল জাগেনি কেন কে জানে! জানলাম, পাঁচটা রঙের হয় নীল, সাদা, লাল, সবুজ আর হলুদ। প্রতিটি রঙের আলাদা ব্যঞ্জনা। ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ, ব্যোম। লক্ষ্য করে দেখবেন, যত ছোটই পতাকা হোক, প্রার্থনার মন্ত্র লেখা থাকবেই। দেশকে, মানুষকে ভাল রাখার প্রার্থনা। আগেই বলেছি জং শুধু ধর্মকর্মের জায়গা নয়, প্রতিরক্ষা থেকে প্রশাসন সবকিছুই নিয়ন্ত্রিত হয় এই ক্ষমতার অলিন্দে। পুনাখা জং-এ রাখা রয়েছে প্রাচীন তিব্বতি গুরুদের স্মারক যার দখল নিয়ে একসময় তিব্বতের সঙ্গে বহুবার যুদ্ধ বেধেছে ভুটানের। এই জায়গাতেই নাকি তিব্বতিদের গো-হারান হারিয়ে তাদের সব অস্ত্রশস্ত্র কেড়ে নিয়েছিল ভুটানিরা। সেসব সাজানো আছে পুনাখা জং-এ। আর-একটা আশ্চর্য ব্যাপার— ভুটানের সব বড় জং-ই শুনছি কখনও না কখনও আগুনে বা ভূমিকম্পে ধ্বংস হয়ে গেছিল। কিন্তু আবার ফিরে এসেছে ফিনিক্স পাখির মতো স্বমহিমায়। বাঙালি যতই কবিতা আওড়াক ‘মন্বন্তরে মরিনি আমরা, মারী নিয়ে ঘর করি’, ভুটানিরাও দেখলাম কিছু কম যায় না!