সাতের দশকে শুরু হওয়া ভারতীয় নাট্যক্ষেত্রে ‘থিয়েটার অফ রুটস’ আন্দোলনের অন্যতম প্রধান পুরোধা ব্যক্তিত্ব ছিলেন রতন থিয়াম। একজন প্রাক্তন চিত্রশিল্পী এবং নির্দেশনা-নকশা-চিত্রনাট্য এবং সংগীতে দক্ষ রতন থিয়ামকে প্রায়শই সমসাময়িক ভারতীয় নাট্যগুরুদের একজন শ্রেষ্ঠ রূপকার হিসেবে বিবেচনা করা হত।
তাঁর নাট্যকর্ম খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দীতে ভরত কর্তৃক প্রবর্তিত ভারতীয় নাট্যশৈলী নাট্যশাস্ত্র, প্রাচীন গ্রিক নাটক এবং জাপানের নোহ থিয়েটার দ্বারা দৃঢ়ভাবে প্রভাবিত। অথচ এই প্রতিটি রূপকর্ম আধুনিকতার ও বাস্তবতার বেদিতে শিকড়সমেত প্রোথিত। কারণ, রতন থিয়াম তাঁর নিজস্ব নাট্যতত্ত্বর সঙ্গে প্রয়োগকে মিলিয়ে দেখতে পছন্দ করতেন। জন ডিউয়ি যাকে বলেছিলেন ‘প্র্যাগম্যাটিক থিওরি অফ ট্রুথ’, তার মূল কথা হল, যদি কোনও বিষয়ে সত্যে উপনীত হতে হয়, তাহলে পুঁথি বা তাত্ত্বিক কচকচি নয়, একটা ফলিত এবং চূড়ান্ত পরীক্ষানিরীক্ষার মধ্য দিয়ে সেই সত্যে উপনীত হওয়া উচিত। অর্থাৎ, থিয়েটারের যে অবরোহী পদ্ধতি, তাতে রতন বিশেষভাবে বিশ্বাস করতেন। অন্বেষা বা অন্বেষণের শেষে যা পড়ে থাকে, তাকে তাঁর এপিস্টেমিক প্র্যাকটিসের সঙ্গে মিলিয়ে, তবে তাকে তিনি থিয়েটারে নিয়ে এসেছেন।

আরও পড়ুন: নবদ্বীপের বৈষ্ণব শিকড় থেকে মণিপুরের লোকশিল্প, অন্য এক রতন থিয়াম! লিখছেন সুদেব সিংহ…
ঐতিহ্যবাহী মণিপুরী মেইতেই অভিনয়শিল্পের বেশ কয়েকজন প্রধান প্রবক্তাদের তত্ত্বাবধানে বছরের পর বছর ধরে অধ্যয়নের মাধ্যমে থিয়েটারের প্রতি তাঁর এক আশ্চর্য অব্যর্থ রসসন্ধানী নন্দনতাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে উঠেছিল। থিয়াম তাঁর থিয়েটারে ঐতিহ্যবাহী মার্শাল আর্ট, থাং-তা ব্যবহারের জন্যও প্রবলভাবে পরিচিত ছিলেন। যেমন ‘ঊরুভঙ্গম’, সংস্কৃত নাটককার ভাস-রচনা অবলম্বনে নিজেই নির্মাণ করেছিলেন নিজস্ব নাট্যমহাকাব্য। মহাভারতের একটি পর্বের উপর ভিত্তি করে তৈরি, এই ‘চক্রব্যূহ’-সহ (সেনা গঠন) তাঁর সেরা নাট্যকর্মগুলির মধ্যে একটি বলে বিবেচিত হয়।
যখন রতন থিয়াম ‘ম্যাকবেথ’ প্রযোজনা করছেন, তখন কিন্তু তিনি ম্যাকবেথকে ইউরোপীয় আঙ্গিক থেকে দেখতে চাননি। ম্যাকবেথকে তিনি তাঁর আঞ্চলিকতার ভাষায় রূপায়িত করতে চেয়েছেন। তাঁর বাস্তবতার সঙ্গে ম্যাকবেথকে মিলিয়ে দেখতে চেয়েছিলেন রতন। যে মণিপুর এখন এত অশান্ত, সেই মণিপুরের প্রেক্ষিতেই তিনি দেখেন ম্যাকবেথকে। মণিপুরি কবি থিম্বলের কবিতায় যে আঞ্চলিক রাজনৈতিক ভাষ্য উঠে আসে, বা শর্মিলা ইরম চানু টানা ১৬ বছর অনশনের মাধ্যমে যে প্রতিরোধ তুলে ধরেন, বা মণিপুরের মেয়েরা ভারতীয় সেনার ধর্ষণের বিরুদ্ধে যে নগ্ন মিছিল করেন— সেই রাষ্ট্রদ্রোহর সঙ্গে ম্যাকবেথকে মিলিয়ে দেখতে চেয়েছিলেন রতন থিয়াম। ম্যাকবেথের যে উচ্চাশা বা লেডি ম্যাকবেথের যে রিরংসা, সেই প্রবণতাগুলোকে এই বাস্তবের সঙ্গে মেলান রতন। আকিরা কুরোসাওয়া যেমন তাঁর ‘থ্রোন অফ ব্লাড’-এ একটি আঞ্চলিক স্পিরিটকেই মূল সত্য করে তুলেছিলেন, সেখান থেকে বেরিয়ে এসে রতন তাঁর ‘ম্যাকবেথ’-এর প্রতিটি অ্যাকশন দৃশ্যে ভারতীয় রাষ্ট্রের উত্তর-পূর্বকে দেখার তির্যক দৃষ্টিকোণকে আক্রমণ করেন। তাঁর সেই সময়ের বেশ কিছু সাক্ষাৎকারে সেই কথা ধরা পড়েছিল।

অর্থাৎ, তাঁর ‘প্র্যাগম্যাটিক থিওরি’-তেই কেবল সন্তুষ্ট ছিলেন না রতন থিয়াম। তাঁর রাজনৈতিক বোধ ও বীক্ষা দিয়ে সেই তত্ত্বের ফলিত প্রয়োগ ঘটাতেন রতন। এর সঙ্গে একমাত্র তুলনীয় বাদল সরকারের থিয়েটার-চর্যা। তবে, যে প্রসেনিয়াম-বিরোধিতা ও নিরাভরণ থিয়েটারের মধ্যে বাদল তাঁর নিজস্ব রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ বুনে দিতে চেয়েছিলেন, রতন তার বিপ্রতীপে দাঁড়িয়ে থিয়েটারের গ্র্যাঞ্জারে বিশ্বাস করতেন, থিয়েটার ‘লার্জার দ্যান লাইফ’ হবে, এই তত্ত্বে বিশ্বাস করতেন, অনেক মানুষ নিয়ে কাজ করতেন এবং তাঁর অভিনেতাদের তিনি প্রায় একটি সেনাবাহিনী বা ‘প্লাটুন’ হিসেবে দেখতেন, যাঁরা প্রচণ্ড ডিসিপ্লিন ও প্রকাশে আচ্ছন্ন হয়ে থাকবে।
ম্যাকবেথের যে উচ্চাশা বা লেডি ম্যাকবেথের যে রিরংসা, সেই প্রবণতাগুলোকে এই বাস্তবের সঙ্গে মেলান রতন। আকিরা কুরোসাওয়া যেমন তাঁর ‘থ্রোন অফ ব্লাড’-এ একটি আঞ্চলিক স্পিরিটকেই মূল সত্য করে তুলেছিলেন, সেখান থেকে বেরিয়ে এসে রতন তাঁর ‘ম্যাকবেথ’-এর প্রতিটি অ্যাকশন দৃশ্যে ভারতীয় রাষ্ট্রের উত্তর-পূর্বকে দেখার তির্যক দৃষ্টিকোণকে আক্রমণ করেন।
আমার একটি ঘটনা মনে পড়ছে। অ্যাকাডেমিতে আমি যখন রতন থিয়ামের প্রযোজনা প্রথম দেখতে গিয়েছিলাম, সেখানে কোরাসের একটি মেয়ে, যে কিনা মাস্ক পরে অভিনয় করছিল, অ্যাকাডেমির মঞ্চের মানচিত্র বুঝতে না পেরে পড়ে যায়। তাকে সবাই ধরাধরি করে হাসপাতালে নিয়ে যায়। রতন নিজে মেয়েটিকে পৌঁছে দিয়ে আসেন। কিন্তু, এক মুহূর্তের জন্যও প্রযোজনা বন্ধ হয়নি। পরে সেই অভিনেত্রী সুস্থও হয়ে ওঠে। কিন্তু এখানে যা লক্ষণীয়, তা হল, এতটাই শৃঙ্খলাবদ্ধ ছিল ওঁর থিয়েটার. যে একটা দুর্ঘটনার পরেও থিয়েটার কিন্তু থেমে যায়নি। এমনই শৃঙ্খলা, প্রয়োগ ও পরীক্ষার মধ্য দিয়ে রতনের থিয়েটার গড়ে উঠেছিল।

‘কালিন্দী ব্রাত্যজন’-এর ফেস্টিভ্যালে এসে রতন থিয়েটার করে গিয়েছেন। আমি যখন মিনার্ভা-র দায়িত্বে ছিলাম, তখনও রতন এসেছিলেন তাঁর থিয়েটার নিয়ে। রতন যখন ন্যাশনাল স্কুল অফ ড্রামা-র চেয়ারম্যান ছিলেন, তখন বোলপুরের দারোন্দায় একটি অনুষ্ঠান উদ্বোধন করাতে নিয়ে গিয়েছিলেন। তখন অনেক কথা হয়েছিল। রতন থিয়ামের একটি জীবনী আমি লেখাতে চেয়েছিলাম, দু’জন থিয়েটারের মানুষকে পাঠিয়েছিলাম এখান থেকে মণিপুরের ইম্ফলে, তাঁরা গিয়েওছিলেন। রতন হেসে বলেছিলেন, আমার জীবনী লিখতে গেলে এখানে থাকতে হবে। যথারীতি তাঁরা পারেননি।
মুম্বইয়ের চলচ্চিত্রদুনিয়ায় কাজ করতে গিয়েছিলেন রতন। সেই অভিজ্ঞতা যে ওঁর ভাল লাগেনি, সেকথা আমাকে বলেছিলেন। থিয়েটার এবং থিয়েটারের ভাবনা নিয়েই ওঁর সঙ্গে কথা হয়েছে মূলত। তাঁর সঙ্গে প্রতিটি রুদ্ধশ্বাস আশ্চর্য কথোপকথনের মাঝে খুলে যেত নাট্যভুবনের এক অজানিত এবং অকল্পনীয় দিগন্তরেখা। ব্যক্তিগত জীবনে যদিও তিনি ছিলেন লাজুক, অন্তর্মুখী ও নিভৃতচারী। একইসঙ্গে প্রবল রসবোধে টইটম্বুর।
রতন আমাদের খুবই পছন্দের, ভালবাসার, শ্রদ্ধার লোক। অসম্ভব ক্যারিশম্যাটিক লোক ছিলেন।