ভারতে কারও বিষাদ-অবসাদ ঘটলে, সে গাঁজা খায়, বা লাগাতার পর্নোগ্রাফি দ্যাখে, কিংবা মেট্রোর লাইনে ঝাঁপ দেয়, কিন্তু আমেরিকায় কারও অসহ একা লাগলে সে প্রাইভেট বন্দুক কোঁচড়ে বেরিয়ে পড়ে ও এলোপাথাড়ি গুলি চালিয়ে নিরীহ সাত-দশজনকে মার্ডার করে। কথাটা নিষ্ঠুর ও শিথিল, রসিকতার মতো, কিন্তু প্রায় সত্যি। আমাদের কাছে (এবং সম্ভবত মার্কিনদের কাছেও) আমেরিকার মাস-শুটিং’এর (‘একজন আততায়ী কেন কে জানে আচমকা স্কুলে বা জিমে বা মন্দিরে বা ফুটপাথে অনেককে খুন করল’) সংবাদ আর নূতন ও শকিং নয়, এবং তৎপরবর্তী বিতর্ক ও যুক্তি-চালাচালিও বাসি বোরিং বহুবিবৃত। ১৬ মার্চ আটলান্টায় আটজনকে খুন করল একজন, ২৩ মার্চ কলোরাডোতে দশজনকে খুন করল আর একজন। আটলান্টায় মাসাজ পার্লারের কাছে যে গুলি চালিয়েছিল, ধরার পর সে জানিয়েছে, ফ্লোরিডাতেও আর একটা গুলি-উৎসবের বাসনা ছিল। ২৩ তারিখ শপিং মল-এ যে গুলি চালিয়েছে, তার সংলাপ এখনও জানা যয়নি। কেউ বলছে তার সিরিয়ায় জন্ম, তাই সে উগ্রপন্থী, কেউ বলছে তার গার্লফ্রেন্ড ছিল না, তাই সে যৌন-হতাশায় ভাজা-ভাজা। আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে শুকনো পরিসংখ্যান (উইকিপিডিয়ায় ‘লিস্ট অফ মাস শুটিংস ইন দ্য ইউনাইটেড স্টেটস ইন ২০২১’ অনুযায়ী), এ বছরের জানুয়ারিতে আমেরিকায় মাস-শুটিং (অন্তত চারজন গুলিবিদ্ধ হয়েছেন এমন সহিংস আক্রমণ) ঘটেছে ৩৫টা, ফেব্রুয়ারিতে ৪১টা। মারা গেছেন ৭৮জন, আহত ২৫২জন। আর মার্চে যে-যে তারিখে গুলি করে গণহত্যা হয়েছে তার লিস্টি— ৩, ৪, ৫, ৬ (এই দিন দুটো ঘটনা), ৭, ৮, ১০ (দুটো ঘটনা), ১১ (তিনটে ঘটনা), ১২, ১৩ (চারটে ঘটনা), ১৪ (তিনটে ঘটনা), ১৫, ১৬ (দুটো ঘটনা), ১৭, ১৮ (দুটো ঘটনা), ২০ (তিনটে ঘটনা), ২২ (তিনটে ঘটনা), ২৩ (দুটো ঘটনা), ২৬ (তিনটে ঘটনা), ২৭ (চারটে ঘটনা), ২৮ (চারটে ঘটনা), ৩১ (দুটো ঘটনা)। মারা গেছেন ৬৫জন, আহত ১৮৩জন। খুব সোজা কথা, আমেরিকায় হরদম, গড়ে প্রায় প্রতিদিন, এমন ঘটনা ঘটে, কয়েকটা খবর বড় ছবিছাবা হইহই আলোড়ন ঝলকায়, তখন রাষ্ট্রপতি গভীর সমবেদনা জানান, পতাকাও মাঝেসাঝে অর্ধনমিত থাকে, কখনও এক বা দুজন বন্দুক-প্রতিবাদী সরোষ ও সঙ্গত বক্তৃতান্তে সাময়িক মিডিয়া-আলো পান, পরে পুরো বস্তুটা ঝিমিয়ে যায়।
মসৃণ ক্যারমবোর্ডে স্ট্রাইকারের মতো, তত্ত্ব, আধা-তত্ত্ব, তথ্য, আধা-তথ্য শাঁইশাঁই এদিক-ওদিক ধাইছে ও ফিরতি-পটাং আসছে। একদল লোক বলছেন, আমেরিকায় বন্দুকের জোগান কমাও, বেশি বিপজ্জনক বন্দুকের ব্যক্তিগত ব্যবহার নিষিদ্ধ করো, যে লোকটা বন্দুক কিনছে তার ব্যাপারে জোরদার খোঁজখবর নিয়ে তবেই বন্দুক বিক্রি করো। খুব সহজ যুক্তি: হাতের কাছে বন্দুক থাকলে একটা রাগী (বা সব-হারানো অসহায় ও পরোয়াহীন) লোক সেটা ধাঁ করে চালিয়ে দেবে, এ সম্ভাবনা বেশি। বন্দুক না থাকলে, তার হয়তো মনে হবে উড়িয়ে গুঁড়িয়ে পুড়িয়ে দিই, কিন্তু গুলি তো আর করতে পাবে না। এমনকী যে লোকটা নিজেকে মারতে চায়, তার ড্রয়ারে বন্দুক না থাকলে, আত্মহত্যার অন্য উপায় খুঁজে পেতে-পেতে তাৎক্ষণিক অশ্রু-ঝাপট কেটে যেতে পারে। উল্টো-শিবিরের লোক হেসে বলছেন, ভাই, বন্দুক মানুষকে মারে না। মানুষ মানুষকে মারে। যদি কেউ মনে করে, তার জীবন ছারখার হয়ে গেলে সে অন্যের জীবন তছনছ করবে, তাহলে নাগালে বন্দুক না থাকলে সে পেঁয়াজ কাটার ছুরি নিয়েও ভিড়ে ঝাঁপিয়ে পড়বে। আত্মহত্যাকামী লোক উঁচু ব্রিজ থেকে ঝাঁপ দেবে। তাই মানুষের সংশোধন দরকার, বন্দুক-নীতির নয়। তখুনি কোরাস ভেসে আসছে, আরে, এই আততায়ীরা সব্বাই মানসিক ঝঞ্ঝাটিয়া, একরকম পাগল। পাগলকে বন্দুক বেচো না, তাইলেই হবে। সঙ্গে সঙ্গে আর এক দল ঝাঁপিয়ে দেখাচ্ছেন, এই খুনিদের মাত্তর চার বা পাঁচ পার্সেন্ট মানসিক ব্যাধিগ্রস্ত। মানসিক রোগের প্রতি এমনিতেই লোকের অস্বস্তি ভয় অপরিচয় তুমুল, তার ওপর মিথ্যে ধারণা ছড়ানোর মানে কী? বরং মদ বা মাদক-আসক্ত লোকের এই বেগোছালো খুন করার সম্ভাবনা বেশি। অমনি মদ-বিলাসী (বা ড্রাগ-আবেশী) খেপে চিল্লাচ্ছেন, আমরা লাট খাই ও প্রলাপ আওড়াই, হয়তো রেগেমেগে তিন ঘা বসিয়েও দিই বউ-বাচ্চাকে, তা বলে গণ-গুলির দায়ও নেব? এবার কি এই অজুহাতে গোটা আমেরিকা ড্রাই স্টেট?
মঞ্চে আর এক বাবু ঢুকে বলছেন, ওসব ছাড়ো, শৈশব-নথি ঘাঁটো, দেখবে এরা প্রহার-ঘেরা পরিবারের সদস্য, অনেকেরই শিশুকালে (যৌন বা অন্য) নিগ্রহের ইতিহাস রয়েছে। পরের লোক ভুরু কুঁচকে: উঁহু, ভাবনার গতিধারাটাই ভুল, এই ধরনের যে-কোনও খুনকে শুধু ‘আর একটা খুন’ হিসেবে দেখে ওপর-ওপর রায় দিয়ে দিলে হবে না। যে গুলিচালনায় এশীয়-আমেরিকানরাই মূলত মারা যাচ্ছেন, তার শেকড়ে দ্যাখো গিয়ে জাতিগত ঘৃণা রয়েছে, অন্য একটা হত্যা খুঁড়লেই হয়তো ধর্মীয় মৌলবাদ স্পষ্ট। পরের তত্ত্ববিদ ঘোরানো সিঁড়ি দিয়ে বর্ণবৈষম্যের করিডোরে ঢুকে বলছেন, এই গোছের খুনি সম্পর্কে মানুষের ধারণার নেপথ্যে আছে: ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যকামী শ্বেতাঙ্গ আর সম্প্রদায়গত ভাবেই হিংস্র কৃষ্ণাঙ্গের স্টিরিওটাইপ নির্মাণের চেষ্টা। যখন শ্বেতাঙ্গ খুন করে, বলা হয় লোকটা ছিল একাচোরা কোণঠাসা প্রান্তিক (অর্থাৎ, হায় সমাজ তাহারে খেলায় নিল না) (এই মোচড়ানো মার্জিনালকে নিয়ে মরমি চলচ্চিত্রও রচিত হয়), আর কৃষ্ণাঙ্গ আততায়ী হলে বলা হয়, ওঃ, এ তো হবেই, ওরা গামবাট ভায়োলেন্ট টাইপ (সমাজে এই অবমানবগুলোকে নিয়েও চলতে হবে, প্রগতিশীল শ্বেতাঙ্গের এ এক বিষম দায়)। আর ভারতীয় সমাজের পাইকারি লেবড়েজুবড়ে থাকার রীতিকে নিয়ে যাঁরা পেল্লায় গর্বিত, তাঁরা জপছেন, যে-সমাজে সম্পদ উপচে পড়ছে কিন্তু একটা লোক জীবনে বুড়ো মা-বাপের অবধি খোঁজ নেয় না, আর মা-বাপ জানে না জোয়ান ছেলে মোলো না বাইবাড়ি পড়ে রইল, সেটা তো অসুস্থ, একলষেঁড়ে, মরকুটে সোসাইটি। ওখানে গুলি চলবে না তো কী চলবে, ডাংগুলি? নেক্সট কুঠুরিতে বলা হচ্ছে, রাষ্ট্র যদি হিংসাকে উদযাপন করে, তবে নাগরিকও ভেবে নেয় তার হিংসার প্রতি সমাজের (বা অন্তত অথরিটির) প্রশ্রয় আছে। আমেরিকার রাজনীতি ও সংস্কৃতি জুড়ে হিংস্রতাকে বাঘা বীরত্ব বলে ধুপধুনো চড়ানো হয়, অন্য দেশের ঘাড়ে বোম ফেলে এলে উদ্দাম নেত্য করা হয়, নায়ক বিভিন্ন ভিলেনের পাঁজরায় গুড়ুমগাড়ুম বারুদ ঠুসে নির্বিকার ফুঁ দিয়ে নলের ধোঁয়া ওড়ায়। তবে সেখানকার লোকেরা জীবনের তুঙ্গ-সমাধান হিসেবে আগ্নেয়াস্ত্র বেছে নেবে, আশ্চর্য কী?
কিন্তু প্রধান কথা হল, মার্কিন সমাজ অন্যরকম, সেখানে বন্দুক পোষা একটা প্রথা, বন্দুক রাখা সাংবিধানিক অধিকার, বাড়িতে একটা বন্দুক থাকলে অনেকেই নিরাপদ বোধ করেন, বন্দুক সেখানে বহু লোকের কাছেই আক্রমণের প্রতীক নয়, আত্মরক্ষার প্রহরী। তাই মাঝে মাঝেই আপত্তিটা উঠেছে ওঠে উঠবে: কিছু লোক একটা অধিকারের অপব্যবহার করছে বলে আমার মৌলিক অধিকারটা হরণ করে নেওয়া হবে কেন? যুক্তিটা প্রায় বাক্স্বাধীনতার তর্কেরই সমীপবর্তী। ধরা যাক, একটা দেশে প্রতি বছর কয়েকটা লোক সাম্প্রদায়িক সিনেমা বানায়। তাতে অশান্তি বাড়ে, খুচখাচ দাঙ্গাও বাধে। বিরক্ত হয়ে সরকার কি সিনেমা করার অধিকারটাই কেড়ে নিতে পারে? বা, এই অজুহাতে সেন্সর এমন বজ্র-আঁট করে দিতে পারে যে, পানসে নিরপেক্ষ ঝুঁকিহীন চিত্র ছাড়া প্রায় সব কিছুই ক্যাঁক ও কটাস অবধারিত বাতিল? ফেসবুক হোয়াটসঅ্যাপ ইউটিউব রাজনীতিমঞ্চ মিলিয়ে যে অবর্ণনীয় ইতরতার ঘোটালা রচিত হচ্ছে, যে অতিজাগতিক জঞ্জাল উপচে পরিচ্ছন্ন ও শীলিত ভাবনার জমি তরতরিয়ে গ্রাস করছে, তা দেখেশুনে কোনও নিখাদ নন্দনসম্মত শাসকগোষ্ঠীও কি বলতে পারেন, অনেক হয়েছে, এবার এই চিন্তানিক্ষেপ ও কলহবিক্ষেপের পরিসরটাকে একটু ছেঁটে ফেলা হোক? যদি কিছু লোকের (বা গোষ্ঠীর) মস্তানি ও অশিক্ষা দেখে আমরা বিড়বিড়িয়ে মাথা নাড়ি, এদের জিহ্বা দৈব ঝাপড়ায় বিকল হলে মন্দ হত না— তবু আদর্শগত ভাবে কক্ষনও নিষেধ-ফতোয়া মানতে পারি কি? তাই মার্কিন বন্দুক-উকিল বলতে পারেন, প্রায় প্রতিদিন আমার সহ-নাগরিক বন্দুকের গুলিতে মারা যাচ্ছে জেনেও, আমার নিজ দেরাজের বন্দুক আমি বিসর্জন দেব কেন? সরকার বরং বন্দুক বাজেয়াপ্ত না করে, সচেতনতা-জাগানিয়া প্রকল্প চালু করুক, যাতে লোকে দায়িত্বশীল ভাবে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করে। বা, লোকে যাতে একাকিত্বে না ভোগে, পরিবারে নিগৃহীত না হয়, মাদকাসক্ত না হয়ে পড়ে, অন্য সম্প্রদায়ের প্রতি বিদ্বেষ থেকে বিরত হয়। যদি মানব-মনের ২৯ অন্ধকার থেকে ‘মরার আগে যত পারব লোককে খুন করে মরব’ নিঃসৃত হয়, তবে অস্ত্রটার দিকে নজর নিবদ্ধ না করে, সেই থমথমে আঁধার তৈরির প্রক্রিয়াটা, তোলপাড়ের ইতিহাসটার প্রতি দৃষ্টি প্রয়োগ করতে হবে। লোকটা যাতে অনাদৃত না বোধ করে, সমষ্টির মধ্যে সেই সমানুভূতি গড়ে তোলো। রাষ্ট্র যাতে বোঝে, ‘হতভাগ্য সেই দেশ, যার বীরের প্রয়োজন হয়’, সে মন-নিসর্গ নির্মাণ করো। বদলে যাঁরা বলছেন, আরে ভাই, যত নষ্টের গোড়া বন্দুকগুলো তুলে নিয়ে পাতকোয় ফেলে দাও, তাঁরা মূল সমস্যাটাকেই এড়িয়ে, একটা উপসংহারের বিস্ফোরণের দিকে হেলে পড়ছেন মাত্র।
মুশকিল হল, আচম্বিতে কিছু নিরীহ লোক যখন গায়ে সিসের টুকরো নিয়ে থুবড়ে মরে, সেই পরিণতিটা এত মর্মান্তিক, সেই অপচয় এমন অপূরণীয়, এই প্ররোচনাহীন নিধন এমন অন্যায্য অনুচিত— তার কাছে শৌখিন তর্ক ফ্যালফেলিয়ে হার মেনে যায়। শতাব্দীর সাধনায় ড্যাঙায় স্বর্গ নামিয়ে আনো, সমুদয় সমীচীন-কাণ্ড আপসেই ঘটবে, অধুনা তাই খরখরে ডিটেলে মন দিতে হবে না— কথাটা ম্যাক্রো-দর্শনগন্ধী হলেও, তদ্দিন অপেক্ষা করতে গেলে কতগুলো নিরপরাধ প্রাণ সম্পূর্ণ অহেতুক বিনষ্ট হবে, সে হিসেবও তো কষতে হবে। তা করতে গিয়ে, ওই উপদেশকে বাস্তবজ্ঞানহীন, এমনকী চক্রান্ত-চটচটেও মনে হতে পারে। কোনও রাষ্ট্রই কি এমত সমীচীন ইউটোপিয়া প্রতিষ্ঠিতে পারে, যে, কোনও নাগরিক কক্ষনও একা বোধ করবে না আর বারোয়ারি হারে সবাই সৌহার্দ্যে দয়ায় চুবে থাকবে? নিশ্চয় একটা সমাজকে ক্রমাগত প্রণয়ন করতে হবে প্রতিটি ব্যক্তির প্রতি মনোযোগী হয়ে ওঠার প্রক্রিয়া, কিন্তু স্বল্পমেয়াদি প্রায়োগিক বন্দোবস্ত পরিহার করে, শুধু বিমূর্ত বিচার ও আমূল পরিবর্তনের পানে চক্ষু ফেড়ে তাকিয়ে থাকলে, আজকে সকালে কালকে সন্ধেয় প্রশাসন চলবে কী করে? কেউ রাজপথে পেটো ছুড়তে গেলে আগে তার হাত থেকে তড়িঘড়ি বোমটা কাড়তে হবে তো, না কি তার সমাজবিরোধী হয়ে ওঠার ইতিহাস তখন উন্মোচন করতে হবে ২১১ এপিসোড ধরে? বাক্স্বাধীনতার অপব্যবহার করলে বেশ কিছু অন্তর দুঃখী বা তেতো হয়ে পড়ে, চিড়বিড়োয়, তা সহন সহজ; কিন্তু বন্দুক-স্বাধীনতার অপব্যবহার করলে দোকান করতে গিয়ে পুরুষটি, পথ হাঁটতে গিয়ে শিশুটি, অফিস গোছাতে গিয়ে নারীটি মুহূর্তে ফুরিয়ে যায়। ওই প্রাণগুলো আর কোনওদিন এই গ্রহে ফিরবে না। তাই এখানে বাক্স্বাধীনতার সমীকরণ মেনে চললে, এক পৃথিবীর ভুলচুক ঘটে যাবে। মৃত্যুর সামনে থিয়োরিকে থমকাতে হয়। হত্যা থামাতে গেলে কিছু দুরমুশ-সিদ্ধান্ত নিতে হয় (তাতে অসুবিধে ঘটতে পারে, এবং তা নিয়েও নিশ্চয়ই ভাবা দরকার, কিন্তু সেগুলো অগ্রাধিকার পাবে না)। আজ যে-কোনও কারণে পীড়িত বা বিধ্বস্ত বা প্রভাবিত এক মানুষ যদি একটা স্কুলে গিয়ে গুলি চালায় ও ফিজিক্স ল্যাবে যাওয়ার সময় কয়েকজন ছাত্রছাত্রী লুটিয়ে পড়ে, তবে বন্দুক ব্যান করে আগে নাগরিকের প্রাণ রক্ষা করতে হবে, তা রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ কর্তব্য, কারণ প্রাণের চেয়ে মূল্যবান আর কিছু নেই, কিচ্ছু না। নিশ্চয়ই আমেরিকার গড়ে-ওঠার মধ্যে বন্দুক-রাখার অধিকার উপ্ত আছে, কিন্তু কেন নতুন করে ভাবা হবে না, একটা দেশে যত লোক তার চেয়ে বেশি বন্দুক থাকার কী দরকার? এও তো গ্রাফ-টাফ এঁকে বুঝিয়ে দেওয়া আছে, আমেরিকার যে-রাজ্যে বন্দুক কম, সে-রাজ্যে বন্দুক-গত মৃত্যুর সংখ্যাও কম, যে-রাজ্যে বন্দুক বেশি, বন্দুক-গত মৃত্যুর সংখ্যাও বেশি। যে-রাজ্যে বন্দুক-আইন কড়া, সে-রাজ্যে মৃত্যুর সংখ্যা অপেক্ষাকৃত কম। সরল গণিত। এমনকী, বন্দুক ব্যবহার করে যাঁরা আত্মহত্যা করতে যান, তাঁদের মৃত্যু হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি, যাঁরা বিষ খেয়ে বা কব্জির শিরা কেটে আত্মহত্যা করতে যান, তাঁদের তুলনায়। তাহলে, বন্দুকটা সরিয়ে নিলে, কারও কারও বিপন্ন লাগতে পারে, আর এক-আধজন হয়তো আত্মরক্ষার সময় হাতের কাছে কিছু না পেতেও পারেন, কিন্তু হরেদরে অনেক বেশি প্রাণ কি বাঁচছে না? অবশ্য পাল্টা-প্রশ্ন তোলা যায়, সুষ্ঠু ও নিশ্চিত আত্মহত্যা সম্পন্ন করার অধিকার রাষ্ট্র দেবে না কেন, বা, যে-লোকটা ডাকাতের হাত থেকে বাঁচতে পারল না নিজস্ব বন্দুকের অভাবে, তার প্রাণের মূল্য কেন তিন লক্ষ প্রাণের চেয়ে কম? স্রেফ সংখ্যা দিয়ে প্রাণের মূল্য মাপা যায় কি? কিন্তু যাঁদের প্রতিটি দিন কাজ-চালানি নীতির উপর ভর করে একটা দেশের ইঞ্জিনে তেল দিতে হয়, একটা সমাজের চাকাগুলোকে যথাসম্ভব মসৃণ গড়গড়াতে হয়, আর অন্তত এই বোধের উপর নির্ভর করতে হয় যে মৃত্যুর চেয়ে জীবন বেশি কাঙ্ক্ষিত, এবং বেশি মৃত্যুর তুলনায় কম মৃত্যু মেনে নেওয়া ভাল, তাঁদের অনুশাসন-রচনাকালে আমেরিকার লোকের হাত থেকে বন্দুক ছিনিয়ে নেওয়া ছাড়া উপায় আছে বলে মনে হয় না। বাকিটা ‘গান-লবি’র চেনা ধুয়ো, আর পরবর্তী গুড়ুম-শব্দের উপর নির্ভরশীল।