হুড়মুড় করে প্রথম হাম্পের ওপর চাকা তুলে দিল বিচিত্রবীর্য। খুব জোরে যে আসছিল তা নয়। ঝকঝকে হাইওয়েতে সর্বাঙ্গ থরথর করে কাঁপাতে কাঁপাতে পৌঁছল সে। জানোয়ারের মতো গুঙিয়ে কিছুটা শক্তি সঞ্চয় করে নিল। প্রথম চাকা তো উঠেছে, ইঞ্জিন থেকে দ্বিতীয় ঘড়ঘড় শব্দটা উঠল এবার। এরপর চাকা নামবে। নামল। যেন খাদে পড়ল কেউ, আর্তনাদ করে। ধড়াম শব্দটা তিন টুকরো হয়ে গেল। রাস্তার পাশ থেকে হল্লা উঠল, ওই পড়েছে রে, আবার পড়েছে! তার মানে ব্যাপারটা প্রায়ই ঘটে। এখানেই। লাল ধুলো-গোলা চা খাচ্ছিলাম দোকানে। ঘুরে বসলাম। দু’একজন লোক, এদিক-ওদিক কীসব করছিল না, তারা, মায় একটা প্রেগন্যান্ট ছাগলও উদগ্রীব হয়ে দেখতে লাগল এরপর কী হয়।
সবার সম্মিলিত দুর্ভাবনাকে নস্যাৎ করে এবারে সামনের চাকা-জোড়া উঠে পড়ল দ্বিতীয় হাম্পে। এমনকী কেউ কিছু ভাবার আগে অকল্পনীয় জীবনীশক্তি নিয়ে খাদ পেরিয়ে তৃতীয় হাম্পেও। আর একটা আছে। সবাই চুপ। ছাগলটা ডাকতে ডাকতে নড়বড় করে রাস্তা পেরিয়ে চলে গেল ওপারে। বোধহয় টেনশন নিতে পারেনি বেচারা। অনিবার্য মার্ডার সিনেও এত উত্তেজনা হয় না। এবারে বিচিত্রবীর্যের সর্বাঙ্গ দিয়ে বেরোনো শব্দে একটু পরিহাস টের পেলাম যেন। কর্কশ হাসির সঙ্গে সে পেরিয়ে গেল শেষ হাম্পটা, যাবতীয় অপমানের জবাব দিয়ে। তারপর তাচ্ছিল্য ভরে এগোল একটু। থামল। চারখানা পরাজিত হাম্প এখন সামনের আর পিছনের চাকার মাঝখানে। এই অবধি দেখার পরেও দর্শক উদগ্রীব হয়ে রইল। এখনও তো পিছনের চাকা বাকি। নজর পড়ল জানলার ভেতরের ভাবলেশহীন যাত্রীদের দিকে। যাকে নিয়ে এত কথা, সে কিন্তু দাঁড়িয়ে আছে। কোনও লোক উঠছে বা নামছে না যদিও। বাঁকের মুখে একটা স্পিডব্রেকার স্টপেজ হতে পারে না। বাইরে থেকেই শুনতে পাচ্ছিলাম ড্রাইভার-কন্ডাক্টর গুরুত্বপূর্ণ স্ট্র্যাটেজি ঠিক করছে। যাত্রীদের মধ্যেও কিঞ্চিৎ অসন্তোষ টের পেলাম। ছাদে কিছু লোক উঠেছিল। তারা রাস্তায় নেমে এসে এমনি তাকিয়ে রইল। কন্ডাক্টর দরজা খুলে বেরিয়ে বিচিত্রবীর্যের শরীরের তলায় ঢুকে কী যেন পরীক্ষা করে বেরিয়ে এসে টিনের শরীর চাপড়ে দিতেই ড্রাইভার চাপ দিল অ্যাক্সিলারেটরে। জেগে উঠল টিরানোসরাস। আমাদের উত্তেজনাও ফিরে এসেছে। সমস্ত শব্দকে উপেক্ষা করে একটা নির্ভীক মুরগি বাসের তলা দিয়ে রাস্তা পেরিয়ে চলে এল আমাদের দিকে। আবার গুটিগুটি এগোচ্ছে বিচিত্রবীর্য।
পিছনের চাকা হাম্পে উঠল কিন্তু পেরোতে পারল না। নেমে এল। দ্বিতীয় চেষ্টায় উঠে থমকে রইল। নামতে ভয় পাচ্ছে কি? এদিকে কিছু ছেলেছোকরা বাস থেকে নেমে পড়েছে, পাশের কাঠের গোলায় কীসব দেখছে। বাস দাঁড়িয়েই আছে। এরই মধ্যে আলখাল্লার মতো অজস্র তাপ্পি মারা পেছনের চাকা হাম্পের দুই পাশবালিশের মধ্যে দিব্যি ঘুমিয়ে পড়ল। পিছনে লরি জমছে একটু একটু করে। কেউ প্যাঁ-পোঁ করছে না। গাড়ি, বাইক, ভ্যান বেরিয়ে যাচ্ছে অমায়িক ভাবে। উল্টো দিক থেকে যারা আসছে তারা ধীরেসুস্থে প্রত্যয়ের সঙ্গে হাম্প পেরোতে পেরোতে জানলার ভেতরে যাত্রীদের চেটে নিচ্ছে আহ্লাদী চোখে। রাস্তার কয়েকজন নির্বিকার ভাবে বাসে উঠেও পড়ল। দেখে, আমিও। বিচিত্রবীর্য বাস এই মুহূর্তে একটি লাইভ ইনস্টলেশন। ফ্রি। চারপাশ ঘুরে, ভেতরে (সম্ভবত) ফেঁসে যাওয়া লোকজনদের জরিপ করে, ঢাকনা খোলা, মরচে পড়া, জ্বলেপুড়ে বাঁচতে চাওয়া ইঞ্জিনের গা থেকে চুঁইয়ে বেরোনো কালো রক্ত দেখে, ফ্রন্ট সিটের সামনে মালা ঝোলানো ঠাকুরের ছবিতে প্রণাম করে, এমনকী চেনা দালাল দেখে জমির দরটা আর একবার ঝালিয়ে নিল অনেকে। আমারও চেনা বেরোল। কোথায় যেন কী একটা কেনার পর কম পয়সা ফেরত দিয়েছিল, নোংরা কথা বিনিময় হয়েছিল। একগাল হেসে বললাম, আরে কাকা যে, বৌদি ভাল? বাসের যাত্রীদের মধ্যে নানা রকম স্বগতোক্তি, কটূক্তি, নেতিবাচক মন্তব্য উড়ে বেড়াচ্ছে। মূল বিষয়, টিকিটের পুরো পয়সা নিয়ে ঘাটের মড়াকে রাস্তায় নামানো হল কেন। বাসের লোভী মালিকের ব্যর্থ ফুলশয্যার সংক্ষিপ্ত বর্ণনা কানে এল। কেউ যে খুব রেগে গেছে তা নয়। কারও তাড়া আছে বলে মনে হল না। কেউ পয়সা ফেরত চাইছে না। এমনকী, জোয়ান যারা, তারা কেউ নামছেও না। একটু ঠেলে দিলে ল্যাঠা চুকে যায়। না, তা হবে না। গ্যাঁট হয়ে বসে আছে সবাই।
নেমে যাওয়া একজন ফিরে এসে খুব চেঁচাতে লাগল। রড ধরে দাঁড়ানো একজন তার সিট দখল করে নিয়েছে। সেও উঠবে না। যুক্তি হল, লোক উঠলে অন্য লোক বসবে। পাল্টা যুক্তি হল, সিটের দখল ছাড়া হল কোথায়? চেহারা দেখে আদিবাসী বলে মনে হল। ভাষা বুঝতে পারছিলাম না। অঙ্গভঙ্গি, গলার স্বরের ওঠা-নামাতে কথোপকথন অনুবাদ হয়ে যাচ্ছিল মনে মনে। আরও অনেক কিছু দেখা হল মুফতে। সব জানলার কাচের ওপর লেখা— দুরন্ত। কয়েকটা সিট, লেডিস হতেও পারে, এদিকে যদিও ওসব চলে না, তার ওপরে একটা ছবি আঁকা আছে। গরাদ ধরে হনুমানের মতো কে যেন। সবাই সবার চেনা হয়ে গেছে। বেশ একজোট হয়ে ড্রাইভার-কন্ডাক্টরকে আচ্ছাসে অপদস্থ করার প্ল্যান করছে হাসতে হাসতে। ড্রাইভার নিজের সিটে বসে তার যাবতীয় অস্ত্র টেনে, ঠেলে, লাথিয়ে ইঞ্জিন স্টার্ট করার চেষ্টা করছে। চিৎকার করে নানা রকম নির্দেশ দিচ্ছে কন্ডাক্টরকে। সে সম্ভবত ইঞ্জিনের তলায়। বালতি করে জল এল। ইঞ্জিনের শরীরের বিভিন্ন জায়গায় কালিমাখা ভেজা ন্যাকড়া থুপকোনো চলল কিছুক্ষণ। প্রত্যেকবার স্টার্ট দেওয়ার শব্দটা ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে এল। আগের সেই গর্জনটা এখন কান্নার মতো। যাত্রীদের মধ্যে ঘোমটার তলা থেকে মায়াভরা কথা শুনলাম, আহা, ওর জ্বর হইচে গো।
খারাপ লাগাটা ঝেড়ে ফেলে হুঙ্কার দিলাম, চলেন, চলেন ঠেলে দিই। বলে, নেমে, বাসের পিছনে চলে গেলাম। এক বুড়ো নামল, আর কেউ নয়। সাইকেল চালিয়ে কয়েকটা ছেলে আসছিল, তাদেরও ডাকলাম। একজন বলল, আমরা ঠেলতে পারি না। জুটল কয়েকজন, জরদ্গব বাসকে চাঙ্গা করতে। এক ইঞ্চিও নড়ানো গেল না বিচিত্রবীর্যকে। আরে তোমার গিয়ারটা নাড়ো এবার, কথাটা নিশ্চয়ই ড্রাইভারের কানে পৌঁছল। তিনবার ঠেলার পর নড়ল সে। হইহই করে তৃতীয় হাম্পের ওপর চাকা তোলা হল ঠিকই, কিন্তু আবার নেমে গেল পিছনে। বিভ্রান্ত কন্ডাক্টর বাসের তলায় এলোপাথাড়ি হামাগুড়ি দিতে লাগল। চাকা ও হাম্পের কুসম্পর্কের রহস্য খুঁজছিল নিশ্চয়ই। আমিও ঢুকলাম ওখানে। তলা থেকে বাসের আপাত গোপন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দেখলাম প্রথমবার। পিছন দিকে বাস ঠেলতে রাজি হওয়া মানুষদের কয়েক জোড়া পায়ের মধ্যে দিয়ে ফেলে আসা রাস্তা, গাছ, আকাশ দেখা হয়ে গেল। পিছনের চাকার মাঝখানে খুবই পরাক্রমশালী কারও বৃহৎ অণ্ডকোষের মতো ডিফারেন্সিয়ালের হাঁড়ির পাশ থেকে মুখ বাড়িয়ে একগাল হেসে কন্ডাক্টর বলল, এইবারে যাবে। শুনে আশ্বস্ত হয়ে আমি বেরিয়ে এলাম রোদে।
স্টার্ট হয়নি, ফের ঠেলা হবে, হলে চলবে, আমরা সবাই বিশ্বাস করলাম। এক বাস লোককে ঠেলে হাম্প পার করা কি চাট্টিখানি কথা? দু’ইঞ্চি ওঠে। দু’ইঞ্চি নেমে যায়। প্রত্যেক ব্যর্থ চেষ্টার শেষে বাসের ভেতর থেকে টিটকিরি ভেসে আসে জোয়ারের মতো। সেটা যে কার উদ্দেশে, বোঝা শক্ত। চাকা ঠিক কতটা গড়ালে ইঞ্জিন ডিজেল আগুনের ফাঁদে পা দেবে বোঝা সহজ নয়। আরও কিছু লোক জুটে গেল এদিক-ওদিক থেকে। তারা একসঙ্গে ড্রাইভার এবং আমাদের, যারা ঠেলব, তাদের ধাক্কা দেওয়ার একাধিক পন্থা বাতলাতে লাগল। মোক্ষম হেঁইও মুহূর্তের পরেই আওয়াজ শুনে মনে হল কোমা কেটেছে ইঞ্জিনের। তারপরেই আবার মৃত্যুর স্তব্ধতায় গড়িয়ে ফিরে গেল। আমার মন বলছিল, হবে না। তুমুল শোরগোলের মধ্যে সবাই ঝাঁপিয়ে পড়লাম আর একবার, ইঞ্জিনের শব্দও শুনলাম, তারপরেই জলে ডুবে যাওয়ার সময় বুড়বুড়ির মতো আওয়াজ।
ঠিক এই সময়েই উল্টোদিক থেকে খলবল করে এসে পড়ল আর একটা বাস, নাচতে নাচতে সে যখন বিচিত্রবীর্যের গা ঘেঁষে হাম্পগুলো পেরিয়ে যাচ্ছে, তখনই দিগন্ত জুড়ে বেজে উঠল ইঞ্জিনের কাড়া-নাকাড়া। একরাশ কালো ধোঁওয়ায় রাস্তার ধুলো সাফ হয়ে গেল নিমেষে। তার মধ্যে দিয়ে আমি দেখতে পেলাম সেই বাসের নাম। অম্বালিকা।