নতুন মহাকাব্যের ঘ্রাণ

Author Ngũgĩ wa Thiong’o’

গুগি ওয়া থিয়ং’ও এবং তাঁর বিঔপনিবেশিকায়ন থেকে আমি একটু অবচেতন দূরত্ব বজায় রাখতাম। এই  অবচেতন দূরত্বের প্রধান কারণ ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে ঔপনিবেশিকায়তের লড়াই হোক, ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে দলিত প্রতিরোধ হোক কি ধনতন্ত্রের বিরুদ্ধে সর্বহারাদের লড়াই হোক— প্রতিটি লড়াই ও প্রতিরোধে কেমন করে যেন একটা অন্তঃ-ক্ষমতাতন্ত্র ঠিক গড়ে যায়।

নারী হিসেবে আবিষ্কার করি, নারীদের প্রান্তে ঠেলে দেওয়া হয়েছে প্রতিটি প্রতিরোধের শেষে। তাই প্রতিটি প্রতিরোধের শেষে নারীকে আবার প্রতিরোধে নামতে হয়। এই কারণেই বোধহয় গুগি-র থেকেও একটা দূরত্ব বজায় ছিল আমার অনেকদিন অব্ধি।

আরও পড়ুন: শুধুমাত্র গৌরদা বলেছিলেন বলে, ষোলো বছরের অধ্যাপনা ছেড়ে দিয়ে ‘আজকাল’-এ চলে গেলাম, যে কাগজ তখনও বেরয়নি। লিখছেন রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়।

গুগিকে আমি প্রথম পড়তে শুরু করি দু’হাজার বাইশ সালের মাঝামাঝি সময়ে। আমার জরায়ুতে একটি একশো চব্বিশ মিমি ফাইব্রয়েড সার্জারি হয়েছিল গুগিকে পড়তে শুরু করার কিছুদিন আগে। এক বছর ধরে চলা চিকিৎসা-পর্বে খেয়াল করছিলাম, অসম্ভব দক্ষ ও পেশাদার ডাক্তারবাবু জরায়ু-সহ নারীশরীরকে সম্পূর্ণতার প্রতীক হিসেবে দেখছেন এবং দেখাতে চাইছেন। আমার এক বন্ধুও সেই সময়ে জরায়ু ক্যানসারে আক্রান্ত ছিল। তার ডাক্তার এবং চারপাশও মধ্য তিরিশের নারীশরীর এবং অস্তিত্বকে জরায়ু ছাড়া ভাবতে পারছিল না। আপ্রাণ চেষ্টা চলছিল জরায়ুটা রেখে যদি ক্যানসারকে বাগে আনা যায়। মোটের উপর আমি বুঝতে পারছিলাম, চারপাশ একটি অঙ্গকে আমার পুরো অস্তিত্বের অবিচ্ছেদ্য অংশ ভাবে অনায়াসে। খুবই দমবন্ধ লাগত। এর কিছুদিন পরেই আমি পড়তে শুরু করি গুগি-র ‘দ্য পারফেক্ট নাইন: দ্য এপিক অফ গিকুয়ু অ্যান্ড মুম্বি’। এটিই সম্ভবত ইংরেজিতে প্রকাশিত গুগি-র শেষ আখ্যান।

মোটামুটি আড়াইশো পাতার মহাকাব্য ধাঁচার উপন্যাস। ভাষা, যতি, বাক্যগঠন গদ্য নয়; পদ্য অনুসারী। জোরে-জোরে, দুলে-দুলে পড়ার ঠাকুমা-দিদিমার কৃত্তিবাসী যে-ধরণ, গুগি-র এই উপন্যাসের (যদি বলা যায়) গড়নও তাই। গুগি বইটি লিখেছিলেন তাঁর জনজাতির ভাষা গিকুয়ুতে। গুগি-র নিজেরই করা ইংরেজি অনুবাদে হয়তো কাব্য হারিয়েছে খানিক, হারায়নি বইটির জোরালো রাজনীতি।

গুগি নিজে গিকুয়ু জনজাতির মানুষ। তাঁর দেশ কেনিয়া। কেনিয়ার গিকুয়ুরা কীভাবে এই দুনিয়ায় এল, সেটা বলতেই এই বই। গুগি বলছেন গিকুয়ু, মুম্বি আর তাদের দশ মেয়ের কথা। বলা শুরু হয়, সর্বশক্তিমানকে শ্রদ্ধা জানিয়ে। গিকুয়ুদের আদি পিতা-মাতা গিকুয়ু ও মুম্বি সর্বশক্তিমানের কৃপায় মাউন্ট কেনিয়ার কাছে খুঁজে পায় তাদের জন্য বরাদ্দ বাসভূমি ও প্রকৃতি। তাদের ঘর আলো করে আসে দশ সন্তান। এবং দশজনই কন্যারত্ন। দশজনের মধ্যে ন’জনকে একত্রে ডাকা হয় ‘নিঁখুত নয়’ (পার্ফেক্ট নাইন) বলে। ন’জনই গুণে সর্বান্বিতা। দশম কন্যারত্ন ওয়ারিজিয়া তার নয় বোনের চেয়ে পৃথক। সে হাঁটতে পারে না। তার মতো সাহসী আর বড় ধনুর্ধর কেউ নেই ব্রহ্মান্ডে। এইখান থেকেই গুগির বলায়, আমি নতুন ঘরানার মহাকাব্যের ঘ্রাণ পেতে শুরু করি।

গুগি ওয়া থিয়ং’ও

মহাকাব্যের মূল চরিত্র নারীকে করে, তার প্রেক্ষিত থেকে ক্লাসিকগুলোকে নতুনভাবে দেখার চল ইউরো-আমেরিকান নারীবাদী লেখকরা বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় ভাগ থেকে শুরু করেছেন। কিন্তু সেখানে প্রতিটি নারীই তাদের পুরো অস্তিত্ব নিয়ে দৃঢ়। একটি মহাকাব্যের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য বজায় রাখা প্রধান চরিত্রটি পা না-থাকা একজন নারী— এটাই যথেষ্ট গুগির বিকল্প দুনিয়ার মূল সুর বোঝানোর জন্য। 

একে-একে গুগি বলতে থাকেন ওয়ারিজিয়ারা বাকি বোনেরা কী অনুপম সুন্দর! ভারতীয় ও ইউরোপীয় ট্র্যাডিশনের মহাকাব্যে আমি মেয়েদের সৌন্দর্যকে প্রাথমিকভাবে সুন্দর দৈহিক গঠন দিয়েই বর্ণিত হতে দেখেছি। সেই দৈহিক গঠনের বর্ণনা দিতে গিয়ে স্থূলমতি পিতৃতান্ত্রিকরা ঠোঁট, স্তন ও নিতম্বের বর্ণনা করেছেন; সূক্ষ্মমতি পিতৃতান্ত্রিকরা হাতের আঙুলের পেলবতা, চুল কত দীঘল,  চোখ কত গভীর, তা নিয়ে অসাধারণ কাব্যময়তা তৈরি করেছেন। কিন্তু ঠোঁট-স্তন-নিতম্ব, হাতের আঙুল-চুল-চোখ— সব কিছু দিয়ে বর্ণনাই যে শেষ অব্ধি নারীকে দেহ দিয়েই দেখার চেষ্টা, সেইটা তো আর তাত্ত্বিকভাবে অস্বীকার করা যায় না!

গুগি বললেন, ওয়ানজিরু নেতৃত্বে সুন্দর, ওয়ানজিকু সুন্দর মানুষের উপশমে, ওয়ামবুইয়ের সৌন্দর্য যুক্তিবোধে, ওয়াংউই সুন্দর ঔদার্যে, ওয়াসিরার সৌন্দর্য কঠোর পরিশ্রমে, ওয়ানজেরি সুন্দর তার গানে, ওয়াইথিরা শ্রদ্ধাবোধে সুন্দর, ওয়াংআরির সৌন্দর্য সহভাগীদারিত্বে, ওয়াইরিমু সত্যকথনে সুন্দর, আর কনিষ্ঠা ওয়ারিজিয়া সুন্দর সাহসে ও বুদ্ধিতে। গুগি যখন দশ বোনের রূপের (উপরোক্ত গুণগুলিকে গুগি রূপ হিসাবেই চিহ্নিত করেছেন) বর্ণনা দিতে থাকেন, আমি দেখতে পাই নাইরোবির কোনও কৃষক ফুটিফাটা মাটিতে ট্রাক্ট্রর চালাচ্ছেন, মুম্বইয়ে কোনও ডাক্তার গুরুত্বপূর্ণ সার্জারি সেরে কফিতে চুমুক দিলেন, ঢাকার কোনও বস্ত্র শ্রমিক মিলে ঘাম ঝরাচ্ছেন, ডেঙ্গুয়াঝাড় চা-বাগানে চা-পাতা তোলার বিরতিতে টিফিনবক্স খুললেন প্রায় পনেরো কেজি পাতা আঙুল দিয়ে তুলে ফেলা শ্রমিক, গরমে তেতে ওঠা, টিনের চালের নীচে ছেলেমেয়েদের কম্পিউটার শেখাচ্ছেন কোনও শিক্ষক। হ্যাঁ, এরা প্রত্যেকে নারী এবং প্রত্যেকে সুন্দর। পুরুষ হওয়ার পরেও গুগি নারীকে দেখতে জানেন, তাই গুগি অনায়াসে বলে চলেন নারীকে।  

দশ বোনের গল্পে প্রথা মেনে নিরানব্বইজন পাণিপ্রার্থী এসে হাজির হয়। এই পাণিপ্রার্থীরা যখন বর্ণনা করে দশ বোনকে আমরা দেখি দশ বোন যেন কুটোটি নাড়তে না পারা রূপসী পরি কেবল। অবস্থা বেগতিক দেখে গিকুয়ু আর মুম্বি মেয়েদের বলে তোমরা নিজেরাই পছন্দ করে নাও। শুধু পছন্দের সময় নিজেদের যুক্তি-বুদ্ধিকেই গুরুত্ব দিও। মেয়েরা মা-বাপকে বলে এমন কোনও কাজ দাও, যাতে আমরা যুক্তি-বুদ্ধির প্রয়োগ করে বুঝতে পারি, কাদের সঙ্গে ঘর বাঁধতে চাই। মা-বাবা বলেন, তবে তাই হোক। চাঁদের পাহাড় (‘মাউন্টেন অফ মুন’) থেকে সিংহ আর ড্রাগনের মিশেল এক জীবের কেশর আনতে হবে মেয়েদের, তাদের পাণিপ্রার্থীদের সঙ্গে নিয়ে গিয়ে। সেই কেশর ওয়ারিজিয়ার পায়ে ছোঁয়ালেই ওয়ারিজিয়া সেরে উঠবে। একশো ন’জন মিলে শুরু হল যাত্রা। গুগি বলতে থাকেন, সে এক যাত্রা বটে! মেয়েরা ঘাস কাটছে, ছেলেরা ঝাঁট দিচ্ছে, মেয়েরা ঘর ছাইছে, ছেলেরা ঘরের মেঝে নিকোচ্ছে, ছেলেরা পরিশ্রান্ত হয়ে পড়ছে, মেয়েরা শিকার করছে, ছেলেরা রান্নার আয়োজন করছে, মেয়েরা পরিশ্রান্ত হয়ে পড়ছে, ছেলেরা শিকার করছে, মেয়েরা রান্নার আয়োজন করছে। গুগি বলে ওঠেন, দুনিয়ার নিয়ম সব কাজ সবাই করবে, কাজের কোনও নারী/পুরুষ হয় না— এটাই আদি এবং এটাই অন্ত। চলতে-চলতে, একে-একে ঝরতে থাকে পাণিপ্রার্থীরা। কেউ এতটা পথ হাঁটতে রাজি হয় না, তো কেউ একটা বিকলাঙ্গ মেয়ের জন্য এত কিছু করার মধ্যে যুক্তি খুঁজে পায় না। পথে আসা সমস্ত বিপদ-আপদ দশ বোন একত্রে মোকাবিলা করে এবং শেষ অব্ধি চাঁদের পাহাড়ে পোঁছায়। সেখানে পৌঁছে, ওয়ানজেরি গান ধরে সেই সিংহ আর ড্রাগন মিশেল প্রাণীকে অন্যমনস্ক করতে থাকে, আর ওয়ারিজিয়া তীর মেরে তাকে আহত করে। এই সুযোগে ওয়ারিজিয়ার পাণিপ্রার্থী পুরুষটি প্রাণীটির ঘাড় থেকে কেশর সংগ্রহ করে আনে। এবার সেই কেশর পায়ে বুলিয়ে দিলেই ওয়ারিজিয়া সেরে যাবে। গল্প ফুরোবে, নটে গাছটি মুড়োবে। না, গিগু এখান থেকেই আবার গল্প শুরু করেন। 

গুগি আমাকে বোঝান বাড়িই হোক, কাজের জায়গাই হোক, রাষ্ট্রই হোক শোষণ বজায় রাখার জন্যই আমাকে সে নির্দিষ্ট ধাঁচায় দেখতে চাইবে। আমার সাফল্য কেমন হবে, আমার পরাজয় কীসে হবে, তা ঠিক করে দিতে চাইবে।

ওয়ারিজিয়া তার বোনদের সামনে সদর্পে ঘোষণা করে, সে এই কেশর পায়ে বুলাবে না কারণ সে নিজেকে স্বয়ংসম্পূর্ণ মনে করে; কোনও অসম্পূর্ণতার বোধই নেই তার ভিতর। সে এই কেশর নিজের স্বয়ংসম্পূর্ণতার স্মারক হিসেবে নিজের জন্য সংগ্রহ করতে এসেছিল শুধু। আর সে তার বাকি ‘নিঁখুত নয়’ বোনের মতো মা-বাবার কাছেও ফিরে যাবে না বিয়ের অনুমতি নিতে কারণ বিয়েটা তার। গুগি এক ধাক্কায় আমার ভিতরে ঢুকিয়ে দেওয়া ইউরোপীয় দুনিয়ার চিন্তনের সীমাবদ্ধতা দেখিয়ে দেন। দেখিয়ে দেন সম্পূর্ণতা, পরিপূর্ণতা ইত্যাদি বোধগুলির মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে, ঔপনিবেশিক পিতৃতান্ত্রিকতা। আমি বুঝতে পারি নারী হিসেবে, ব্যক্তি হিসাবে, দলিত নারী হিসাবে নিজেকে বুঝতে গেলে আমাকে বিঔপনিবেশিকায়নের কাছে আসতে হবেই। বিঔপনিবেশিকায়নের জোরেই লিঙ্গ বৈপরীত্যের নির্দিষ্ট ছাঁচ ভেঙে গুগি আমার দিদি হয়ে ওঠেন। আমি গুগির কাছে নিজের খোঁজে আসতে শুরু করি। গুগি আমাকে বোঝান বাড়িই হোক, কাজের জায়গাই হোক, রাষ্ট্রই হোক শোষণ বজায় রাখার জন্যই আমাকে সে নির্দিষ্ট ধাঁচায় দেখতে চাইবে। আমার সাফল্য কেমন হবে, আমার পরাজয় কীসে হবে, তা ঠিক করে দিতে চাইবে। ওয়ারিজিয়ার আত্মপ্রত্যয় না থাকলে বুঝিয়ে দেবে, এই পথে গেলেই তোমার সম্পূর্ণতা। ওয়ারিজিয়ার মতোই সম্পূর্ণতার লোভ এবং টোপ প্রত্যাখান করতে পারলে, তৃতীয় বিশ্বের নারীবাদী হয়ে ওঠা যায়।