২০০১ সালের ১৪ মার্চ, পুল্লেলা গোপীচাঁদ অল ইংল্যান্ড ওপেন-এ পুরুষদের সিঙ্গলস ট্রফি ছিনিয়ে নিয়েছিলেন। ১৯৮০ সালে প্রকাশ পাড়ুকোনের বিজয়ের কুড়ি বছর পর গোপীচাঁদ দ্বিতীয় ভারতীয় হিসেবে এই খেতাব জিতেছিলেন। কিন্তু গোপীচাঁদের এই জয়ের সঙ্গে এমন একটা ঘটনা জড়িয়ে আছে, তার তুলনা মেলা ভার। ১৯৯৪ সালে, গোপীচাঁদের যখন মাত্র ২০ বছর বয়স, তাঁর হাঁটুর সামনের দিকের অ্যান্টিরিয়র ক্রুশিয়েট লিগামেন্ট ছিঁড়ে যায়। যে কারণে দু’বছরে তাঁকে তিনবার অস্ত্রোপচার করাতে হয়, যা প্রায় তাঁর ব্যাডমিন্টন জীবন শেষ করে দিতে বসেছিল। ১৯৯৭ সালে তিনি আবার কোর্টে ফেরেন, এবং ২০০২ সাল অবধি টানা পাঁচ বছর তিনি পুরুষদের সিঙ্গলস-এ ভারতীয় চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন। এবং কেবল জাতীয় স্তরে নয়, এই সময়ে তিনি আন্তর্জাতিক অনেক খেতাব অর্জন করেছিলেন, তার মধ্যে একটা ছিল এই অল ইংল্যান্ড ওপেন ব্যাডমিন্টন চ্যাম্পিয়নশিপ। ২০০১ সালের এই খেতাব জয়ের লড়াইয়ের পথে তিনি তাঁর চরমতম প্রতিদ্বন্দ্বী, ড্যানিশ তারকা পিটার গাডে-কে (তখন বিশ্বের এক নম্বর) হারান। এবং এই পুরো সময়টায় (১৯৯৭-২০০২) তিনি একটি গেমও হারেননি— না জাতীয় স্তরে, না আন্তর্জাতিক স্তরে।
তাঁর কোর্টে ফেরা এবং পুরুষদের ব্যাডমিন্টনে দেশে ও বিদেশে এই সর্বময় কর্তৃত্ব— এমন একটা অতিমানবিক জেদ, স্পর্ধিত জেতার খিদে, চরম প্যাশন আর সর্বোচ্চ আত্মনিয়োগের আখ্যান বলে, যা একজন সত্যিকারের চ্যাম্পিয়নকে চিনিয়ে দেয়। ভারতীয় ব্যাডমিন্টন দল যখন এই সপ্তাহে (মার্চ ১৭-২৪) ২০২১-এর অল ইংল্যান্ড ওপেন চ্যাম্পিয়নশিপ খেলছে, তখন টিমের ‘গোপী স্যার’, ভারতীয় টিমের কোচ, তাঁর ২০ বছর আগে এই চ্যাম্পিয়নশিপ জেতা নিয়ে কথা বললেন ডাকবাংলা.কম-এর সঙ্গে।
২০০১ সালে আপনার অল ইংল্যান্ড ওপেন জয়টা ভারতের ব্যাডমিন্টনের ধারাকে এক ঝটকায় বদলে দিয়েছিল। সেই প্রসঙ্গে যখন কেউ কথা বলে, আপনার মাথায় প্রথম কী আসে?
আমি সে রকম মানুষই নই, যে কিনা সর্বক্ষণ নিজেকে মনে করিয়ে দিতে দিতে চলে যে সে অতীতে কী করেছিল। যদি পিছন ফিরে তাকাই, তা হলে এই বিষয়ে দুটো কথা বলব— এক, এই জয়টা আমায় এমন একটা জায়গায় পৌঁছে দিয়েছিল, যে ভিতটার ওপর দাঁড়িয়ে আমি নিজের কোচিং সেন্টার খুলতে পারি। আর দুই, ওটা এমন একটা জয় ছিল, যার জন্য আমায় সবাই একজন খেলোয়াড় হিসেবে বহুদিন মনে রাখবে। এই প্রাপ্তির জন্য আমি সত্যিই গর্ব বোধ করি।
সেই জয়ের মুহূর্তটায় আপনার কেমন লাগছিল?
সত্যি কথা বলতে কী, আনন্দের চেয়েও, স্বস্তি হচ্ছিল অনেক বেশি। কারণ এই টুর্নামেন্টটা খেলার সময় আমার সারা শরীরে অসহ্য ব্যথা ছিল। সেই ব্যথা অতিক্রম করে প্রতিটি ম্যাচ খেলতে হচ্ছিল, তাই ম্যাচ শেষ হলে বিরাট স্বস্তি পেতাম, ফাইনালেও তা-ই পেয়েছিলাম। মনে হচ্ছিল, যাক বাবা, টুর্নামেন্টটা শেষ হয়েছে। আর তা ছাড়া, জয়ের মুহূর্তটাকে উপভোগ করার চেয়ে আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিল, এরপর কী কী জিতব, তা ভাবা, তার পরিকল্পনা করা এবং সে বিষয়ে আশা করা। অল ইংল্যান্ড জিতে আমি আত্মতুষ্ট হইনি, আরও টুর্নামেন্ট জিততে চেয়েছিলাম।
আপনি যখন অল ইংল্যান্ড খেলতে নামলেন ২০০১-এ, ততদিনে আপনার হাঁটুতে তিন-তিনটে অস্ত্রোপচার হয়ে গেছে…
হ্যাঁ, সেসব সমস্যা তো ছিলই। ২০ বছর আগে, আমাদের ফিজিওথেরাপিস্ট-ও ছিল না, খেলার ছিল নির্দিষ্ট ধরনের পুষ্টি কীভাবে পাওয়া যাবে তার বন্দোবস্তও ছিল না। চোট থেকে সেরে ওঠার প্রক্রিয়া এখনকার মতো এত উন্নত ছিল না। ২২ থেকে ২৪ বছরের মধ্যে আমার যে ধরনের অস্ত্রোপচার হয়েছে, সে-সবের ধকল আমার শরীর থেকে অনেক কিছু নিংড়ে নিয়েছে। আর, আমাদের সময়কার ১৫ পয়েন্টের গেম (যা এখন ২১ পয়েন্টের গেম হয়েছে) খেলোয়াড়দের বেশিদিন ধরে খেলার সুযোগ দিত না, তাই কেরিয়ার খুব লম্বা হত না। তখনকার সময় ২৫-২৬-২৭ বছর বয়স থেকেই খেলোয়াড়রা ভাবত, তাদের কেরিয়ার শেষের দিকে। যখন আমি অল ইংল্যান্ড আমার বয়স ছিল ২৭ বছর। সবাই মনে করত যে আমি একটু বেশি বয়সেই এই খেতাব জিতেছি। আমি চেষ্টা করছিলাম, কীভাবে আমার কেরিয়ারকে একটু প্রলম্বিত করা যায়।
আপনি নিজে কেমন করে উদযাপন করেছিলেন এই জয়?
ওই যে বললাম, আমার কাছে সেলিব্রেশন ছিল এক ধরনের স্বস্তি, যে, যাক, এবার অন্তত একটা গোটা দিন বিশ্রাম নিতে পারব, সারা শরীরের ব্যথা নিয়ে দুশ্চিন্তাটা কমবে, আগামী দু-তিনদিন ব্যথাটা সারার সময়ও পাবে। আমি কোনও ছুটি নিইনি। আমার জীবনটা খেলাকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হত, তাই কোথাও ছুটি কাটাতে যাওয়া বা খেলাটা থেকে কিছুদিন দূরে থাকার কোনও প্রশ্নই ওঠেনি। আর আমার চোটের জন্য তো অনেকটা সময় আমি কোর্টের বাইরে এমনিতেই কাটাতে বাধ্য হয়েছিলাম। তাই ওই স্বস্তিটাই আমার সেলিব্রেশন।
গত ২০ বছরে সবটা বদলে গেছে, খেলার ফর্ম্যাট, খেলার সারফেস, খেলার গতি। প্রকাশ পাড়ুকোন-এর ১৯৮০ সালের অল ইংল্যান্ড জয়ের পর, একজন ভারতীয খেলোয়াড়ের হাতে ওই ট্রফি উঠতে সময় লেগে গেল ২১ বছর। তারপরেও আরও ২০ বছর কেটে গেছে। কবে আমরা আবার অল ইংল্যান্ড চ্যাম্পিয়ন পাব?
আমাদের দলে অনেকেই সম্ভাবনাময়, আশা করি এ বছরেই কেউ চ্যাম্পিয়ন হবেন। পুরুষদের বা নারীদের সিঙ্গলস— দুই ক্ষেত্রেই, কয়েকজন চ্যাম্পিয়ন হওয়ার ক্ষমতা রাখেন, অবশ্যই পি ভি সিন্ধু, হয়তো শ্রীকান্ত কিদাম্বি। এঁরা সকলেই বড় টুর্নামেন্ট জেতার যোগ্য।
কিন্তু অন্য টুর্নামেন্টের সঙ্গে অল ইংল্যান্ডের তফাত হল, যে স্টেডিয়ামটায় খেলা হয় (বার্মিংহ্যামের ‘এরিনা বার্মিংহ্যাম’), সেটা এত বড়, সেখানে সাফল্য পেতে গেলে শারীরিক সক্ষমতা থাকতে হয় একেবারে তুঙ্গে। সেইটা খুব, খুব গুরুত্বপূর্ণ। এই টুর্নামেন্টটা এই জন্যই এত কঠিন। আমাদের খেলোয়াড়দের এ বছরে একটা সম্ভাবনা আছে জেতার, দেখা যাক, আমরা উৎসব করতে পারি কি না।
অল ইংল্যান্ডে আপনি সব ম্যাচ জিতেছিলেন স্ট্রেট সেট-এ। ইংল্যান্ডের কলিন হটন-এর বিরুদ্ধে ১৫-৭, ১৫-৪ (রাউন্ড অফ ৩২ ম্যাচ), চিনের জি জিনপেং-এর বিরুদ্ধে ১৫-৩, ১৫-৯ (রাউন্ড অফ ১৬ ম্যাচ), ডেনমার্কের অ্যান্ডার্স বোয়েসেন-এর বিরুদ্ধে ১৫-১১, ১৫-৭ (কোয়ার্টার ফাইনাল), ডেনমার্কের পিটার গাডে-এর বিরুদ্ধে ১৭-১৪, ১৭-১৫ (সেমিফাইনাল), এবং শেষে ফাইনালে চিনের চেন হং-এর বিরুদ্ধে ১৫-১২, ১৫-৬। যেন, একটাও গেম হারা বারণ! আপনি ১৯৯৭ থেকে ২০০২ অবধি, এমনকী ঘরোয়া টুর্নামেন্টে একটাও গেম হারেননি! কী করে সম্ভব হল?
এ যে খুব সচেতন ভাবে করেছি তা নয়। পৃথিবীতে কেউই নিশ্চয়ই সাধ করে একটা গেমও হারতে চায় না। আমি ভাগ্যক্রমে খেলাগুলো সব ওইভাবে জিতে গিয়েছিলাম, এই যা। অল ইংল্যান্ডের ওই কংক্রিটের কোর্টে যত সময় কাটাচ্ছিলাম, আমার শরীরে ততই ব্যথা বাড়ছিল, শরীর টাটিয়ে ছিল। তাই যত তাড়াতাড়ি ম্যাচ শেষ করে দিতে পারতাম, তত ভাল। দুটো গেমেই ম্যাচটা জিতে গেলে, পরের দিনগুলোর জন্য শক্তি আর এনার্জি বাঁচিয়ে রাখতে পারতাম।
স্কোর দেখলে মনে হয়, গাডে-এর সঙ্গে সেমিফাইনালটাই টুর্নামেন্টের সবচেয়ে কঠিন ম্যাচ ছিল। তা-ই কি?
হ্যাঁ, তা-ই। ওটা একটা বড় ম্যাচ ছিল। এর আগে ওঁর কাছে আমি প্রত্যেকবার হেরেছি। অল ইংল্যান্ডের সেমিফাইনালে, এত বড় জায়গায়, ওঁকে হারানো— একটা বিরাট ব্যাপার। খুব শারীরিক পরিশ্রমও করতে হয়েছিল ওই ম্যাচে। মানসিক ভাবেও খুব ধকল গিয়েছিল। উনি বিশ্বের এক নম্বর ছিলেন, ওঁর বিরুদ্ধে জেতা খুব শক্ত ছিল।
জি সেই মুহূর্তে পুরুষদের সিঙ্গলসে অলিম্পিকে সোনাজয়ী। আপনি তাঁকে ৪০ মিনিটে হারিয়ে দিলেন। কীভাবে প্রস্তুতি নিয়েছিলেন?
আমার তো মনে হয় অন্যান্য খেলোয়াড়দের তুলনায় ওঁকে হারানোটা সহজ ছিল। আমি আগেও ওঁকে হারিয়েছি বেশ সহজেই। সত্যি বলতে, চার-পাঁচবার ওঁর সঙ্গে খেলেছি, প্রতিবারই হারিয়েছি। তাই, যদিও তিনি অলিম্পিক চ্যাম্পিয়ন, ওঁর খেলার ধরনটা জানতাম, এবং নিজের খেলার ধরন নিয়ে আত্মবিশ্বাসীও ছিলাম।
২০০০-২০০১-এর সিজনে, চেন হং তাঁর ফর্মের তুঙ্গে ছিলেন। আপনিও তা-ই ছিলেন, স্কটিশ ও তুলুজ ওপেন টাইটেল জিতেছিলেন। ফাইনালে আপনি ওঁকে হারালেন। ওঁর মুখোমুখি হওয়ার জন্য কীভাবে প্রস্তুতি নিয়েছিলেন?
আমার মনে হয় ওই স্তরের টুর্নামেন্টের ফাইনালে, মানে একটা অল ইংল্যান্ড ফাইনালে, প্রতিদ্বন্দ্বীর মুখোমুখি হওয়ার সময় র্যাঙ্কিং-ট্যাংকিং’এর কথা মাথায় থাকে না। আমি ওই টুর্নামেন্টে গোড়া থেকেই ভাল খেলছিলাম, ফিট ছিলাম, আর আত্মবিশ্বাসীও ছিলাম। আমি ও চেন দুজনেই সেমিফাইনালে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই করে জিতেছিলাম, তবে ওর লড়াইটা আরও কঠিন ছিল। তাই ওর শারীরিক ধকল গিয়েছিল বেশি। তাই আমার কাজটা ছিল শুধু ওকে অনেকগুলো শটে ধোঁকা দেওয়া, র্যালিগুলোকে লম্বা রাখা, যাতে ও আরও ক্লান্ত হয়ে পড়ে। যাতে একটা সময়, ওর খেলাটা কিছুটা ভেঙে পড়ে, আর আমি সেই মুহূর্তের ফায়দাটা তুলতে পারি।
আপনি বিশ্বের চার নম্বর খেলোয়াড় ছিলেন, এটাই আপনার কেরিয়ারের শ্রেষ্ঠ র্যাঙ্কিং। আপনার কি মনে হয় হাঁটুর চোট আপনাকে না ভোগালে এবং আরও ভাল কোচিং পেলে, আপনি এক নম্বরে পৌঁছতে পারতেন ও সেই র্যাঙ্কিং ধরে রাখতে পারতেন?
অনেকবার এটা নিয়ে ভেবেছি। এখন ভেবে দেখেছি, যদি চোট না পেতাম, বুঝতেই পারতাম না ব্যাডমিন্টনকে আমি কতটা ভালবাসি, খেলার এতটা খিদে হয়তো থাকত না। তাই আমার বেলায়, একেবারে উল্টো ব্যাপার হযেছে, চোটগুলোই আমার শক্তি হয়ে দাঁড়িয়েছে। খেলোয়াড় হিসেবে এবং কোচ হিসেবে, আমার কঠিন সময়গুলোই আমার আসল ভিত।
আপনার গোটা কেরিয়ারে, সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী কে?
আমি যখন খেলতাম, তখন বহু খেলোয়াড়ই খুব শক্তিশালী ছিলেন, তৌফিক হিদায়াত (ইন্দোনেশিয়া), জিয়া জুয়ানজে (চিন), পিটার গাডে (ডেনমার্ক), হেনড্রাওয়ান (ইন্দোনেশিয়া)। বড় বড় টুর্নামেন্টে ভারত থেকে প্রায় সবসময়ই আমিই থাকতাম একমাত্র প্রতিযোগী, তাই আমার নিজের কিছু সমস্যা থাকত, প্র্যাকটিস করার ভাল পার্টনার বা সতীর্থ পেতাম না। কিন্তু সব মিলিয়ে যা পেয়েছি, তাতে আমি খুশি। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে যতদিন ধরে খেললে এক বা দুজনের সঙ্গে খুব বড় টক্করের একটা ইতিহাস গড়ে ওঠে, ততদিন আমি খেলিনি বটে, কিন্তু শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বীর মুখোমুখি হয়েছি বইকি। এও মনে রাখতে হবে, তখন আমরা খুব বেশি টুর্নামেন্ট খেলতাম না, এখনকার মতো বিশ্ব জুড়ে টুর্নামেন্টে অংশ নিতাম না।
এখনকার কোনও পুরুষ সিঙ্গলস খেলোয়াড়ের নাম বলুন, যাঁর সঙ্গে খেললে আপনি বেশ ব্যাপারটা উপভোগ করতেন?
কেনটো মোমোতা (জাপানের খেলোয়াড়, এখন পুরুষদের সিঙ্গলসে বিশ্বে এক নম্বর), আর ভিক্টর অ্যাক্সেলসেন (ডেনমার্কের খেলোয়াড়, এখন বিশ্বে দু’নম্বর), এঁরা দুজন এখন বিশ্বের সেরা প্লেয়ার। এঁরা দুজনেই কোর্টে যে পরিমাণ শারীরিক ও মানসিক শক্তির পরিচয় দেন আর যে পরিমাণ আগ্রাসন এঁদের খেলায় থাকে, তা স্তম্ভিত করে দেওয়ার মতো। এঁদের মোকাবিলা করতে পারলে দারুণ লাগত। এঁদের আমি সমীহ করি। আর অবশ্যই এই প্রসঙ্গে আগের প্রজন্মের বিরাট বিরাট খেলোয়াড়দের নাম আর একবার বলতে হবে: পিটার গাডে, তৌফিক হিদায়াত, এবং লি চং ওয়েই— এঁরা তো কিংবদন্তি। ব্যাডমিন্টন খেলাটার বেশ সৌভাগ্য বলতে হবে, এক প্রজন্মের বিরাট খেলোয়াড়রা সরে যেতেই, পরের প্রজন্মে মোমোতা ও অ্যাক্সেলসেনের মতো খেলোয়াড় এসে গেছেন ও ধারাটা বজায় রাখছেন।
হায়দরাবাদে আপনার অ্যাকাডেমির কথায় আসি, গত দশক জুড়ে বিশ্বের বহু সেরা খেলোয়াড় এখান থেকে বেরিয়েছেন। এখন কি ভারতীয় খেলোয়াড়দের খেলার কোনও নির্দিষ্ট ধরন তৈরি হয়েছে, মানে স্বতন্ত্র স্টাইল, যা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বা ইউরোপীয় খেলোয়াড়দের চেয়ে, বিশেষত ডেনমার্কের খেলোয়াড়দের চেয়ে আলাদা?
ভারতীয়রা সবাই একটা নির্দিষ্ট স্টাইলে খেলছেন, এটা হওয়া খুব শক্ত। কারণ অন্যান্য বহু দেশে, মানুষের একটা জাতির সাদৃশ্য আছে, মানে, তাঁরা একই রকম শারীরিক ও সাংস্কৃতিক ছাঁচের লোক। কিন্তু ভারতে, তুমি যদি কেরালা, পঞ্জাব, বাংলা বা মিজোরামের খেলোয়াড়দের দিকে তাকাও, দেখবে, সবাই আলাদা। তাঁদের শরীরের গঠন, মনের ধরন, শারীরিক সক্ষমতা, খেলার ভঙ্গি, সব আলাদা। তাই ভারতীয়দের ব্যাপারটা অন্যদের মতো নয়। আমি খেলোয়াড়ের ‘বডি টাইপ’ দেখে, তাঁর উপযোগী স্টাইলটা ঠিক করি। আমি চিরকাল বিশ্বাস করে এসেছি, ভারত এই রকমই, এবং এখানে খেলোয়াড়ের শারীরিক গঠন, মনোভঙ্গি, মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা, এগুলো মিলিয়ে হিসেব করে ঠিক করতে হবে, তাঁর স্টাইল কী হবে। তাই শ্রীকান্ত (কিদাম্বি) বা সমীর (ভার্মা) বা সাই (প্রনিথ), বা সৌরভ, কাশ্যপ, প্রণয়— এঁরা সবাই পুরুষদের সিঙ্গলস খেলছেন, কিন্তু প্রত্যেকের স্টাইল আলাদা। এবং সেটাই ভারতের সবচেয়ে বড় শক্তি। এই বৈচিত্রটাই ভারতের শক্তি ও সম্পদ।
তাহলে বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য দিয়েই ব্যাডমিন্টনেও আমরা সফল হতে চাইছি?
হ্যাঁ, এবং আমাদের সেইটাকে স্বীকৃতি দিতে হবে। আমরা যদি ভাবি, ভারতে খেলাধুলোর নীতি নির্ধারণ করতে বসে আমরা একটাই পরিকল্পনার খোপে সবকিছু সেঁধিয়ে দিতে পারব, তাহলে আমরা কিছুতেই সফল হব না। আমাদের সেই উদারতা শিখতে হবে, যাতে আমরা খেলোয়াড়দের স্বাধীনতা দিই, নিজের মতো স্টাইল তৈরি করার। সেটাই গুরুত্বপূর্ণ।
পুরুষদের ডাবলসে সাত্ত্বিকসাইরাজ রানকিরেড্ডি আর চিরাগ শেট্টি জুটি এসে যাওয়ার ফলে কি ভারত শিগগিরই অল ইংল্যান্ড ওপেন খেতাব জিততে পারে? এই মুহূর্তে পৃথিবীর সেরা জুটিদের হারাতে গেলে তাঁদের আর কতটা প্রস্তুত হতে হবে?
খুব বেশিদিন লাগবে না এঁদের বড় খেতাব পেতে, হয়তো আর এক-দু’বছর। এবছরও হয়ে যেতে পারে, কিচ্ছু বলা যায় না।
নতুন যারা উঠে আসছে, তাদের কী বলবেন?
খেলাটার প্রতি ভালবাসা আর প্যাশন থাকাটাই সবচেয়ে জরুরি। শুধু বহু বছর ধরে শৃঙ্খলা আর পরিশ্রম আর অধ্যবসায় প্রয়োগ করেই সফল হবেন, এ কথা ভাবলে মুশকিল। যা করছেন সেটাকে ভালবাসুন, সেটা নিয়ে সবসময় উত্তেজিত থাকুন, এটাই হচ্ছে আসল এবং একেবারে প্রাথমিক কথা। খেলাটাকে ভালবাসুন, বাকিটা আপনিই হবে। আর প্রতি পদক্ষেপে, নিজের প্রতি বিশ্বাস রাখুন, সবটা উজাড় করে দিন। আমি তাঁদেরই সফল হতে দেখেছি, যাঁদের মধ্যে সফল হওয়ার একটা গনগনে খিদে ছিল।