ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2025

 
 
  • সংবাদ মূলত কাব্য : পর্ব ১০

    মৃদুল দাশগুপ্ত (May 18, 2025)
     

    মদিরাশাস্ত্র

    ‘সুরা একটি বিশ্ববিদ্যালয়’— আমাকে কে বলেছিলেন কথাটা? বলেছিলেন, সুনীল মিত্র। আমার জীবনে দেখা সবচেয়ে রঙিন মানুষটি। শুধু এইটুকুই নয়, দু’এক সেকেন্ড থেমেই সুনীল মিত্র বলেছিলেন, ‘বুঝলে কিনা, শক্তি, শক্তি ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের সিঁড়িতে বসে আছে। ‘শুনে আমি থ! — শক্তি চট্টোপাধ্যায়! যিনি কিনা হরবখত বলেন, মদ্যই তাঁকে পদ্যের কাছে নিয়ে আসে; —সেই কবি সুরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারেনি। প্রায় হুঙ্কার দিয়ে সুনীল মিত্র বলেছেন, ‘নাহ শুধু ঋত্বিক ঘটক ওই ইউনিভার্সিটির ভেতরে ঢুকতে পেরেছে।’ আমি সুনীলদাকে সকৌতূহলে শুধিয়েছি ‘আর আপনি, সুনীলদা? ভাবলেশহীন মুখে সুনীলদা বলেছেন, ‘আমি ইউনিভার্সিটির মাঠে ঘোরাঘুরি করছি।’ 

    জরুরি অবস্থা জারি হওয়ার আগের বছর, ১৯৭৪ সালে শ্রীরামপুর ইএসআই হাসপাতালে চাকরিসূত্রে এসেছিলেন সুনীলদা, তাঁর স্ত্রীও ছিলেন এই হাসপাতালে কর্মরতা। ইএসআই হাসপাতালটি আমাদের ডাক্তারবাগানের বাড়ির লাগোয়া। বলা হয়নি, ১৯৬২ সালে আমাদের নিজেদের বাড়িটি তৈরি হয়। গঙ্গাতীরের বেনেপাড়া থেকে আমরা শ্রীরামপুরের পশ্চিম এলাকায় চলে আসি। তখন পশ্চিমে শ্রীরামপুর শহরটি বিকশিত হচ্ছে। এ-প্রসঙ্গে দু’-একটি কথা বলতে ইচ্ছে করছে, আমি যখন টু-থ্রিতে পড়ি এই নতুন বাড়িতে চলে আসা নিয়ে। (১) আমাদের বাড়ি যখন তৈরি হচ্ছে, গৃহনির্মাণের কাজ দেখতে বাবার সঙ্গে বালক আমি চলে আসতাম। এই অঞ্চলে তখন ধানখেত, ফসল চাষের ক্ষেত্র, এসব ছিল; টমেটো যে গোড়ায় সবুজ রঙের হয়, পরে হয় লাল, তা আমি ওই জানলাম। (২) আমরা নতুন বাড়িতে আসার কয়েকমাস পর আমাদের বাড়িতে বিদ্যুৎ আসে। তা ছিল এক উল্লাসের বিষয়। বেনেপাড়ার বাড়িতে ইলেকট্রিক ছিল না। তখনকার দিনে বেশ কিছু বাড়িতে বা অঞ্চলে বিদ্যুৎ ছিল না। শুধু শ্রীরামপুরে নয়, তৎকালে যাদবপুর, দমদম (মামাবাড়ি) বহু এলাকা দেখেছি রাত্তিরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। (৩) অফিস থেকে ফেরার পথে একদিন বাবা একটি রেডিও নিয়ে আসে। উল্লাস। (৪) আমার বাবার বাগান করা ছিল সখ। দু’টি আমগাছ, একটা কাঠাল গাছ ছিল আমাদের বাড়িতে। এ ছাড়াও ফুলের বাগান। বাবা শীতে, বাঁধাকপি, ফুলকপি, শালগম এসবও ফলাত। বেগুন, পেপে, ঝিঙে, ঢ্যাড়শ—এসবও। আমরা ভাইবোনেরা খেতে বসে মাকে শুধোতাম, এই বেগুনভাজা কি আমাদের বাড়ির বেগুন? যেন তার আলাদা স্বাদ!

    আরও পড়ুন : ইস্টবেঙ্গল গ্যালারিতে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে হাসি বিনিময় হয়েছিল! মৃদুল দাশগুপ্তর কলমে ‘সংবাদ মূলত কাব্য’ পর্ব ৯…

    ১৯৬২-’৬৩ সাল থেকে এবার লাফ দিয়ে আসা যাক ১৯৭৪-এ, রঙিন মানুষ সুনীল মিত্রর কথায়, ১৯৭৪-এ শ্রীরামপুরে চাকরিসূত্রে এসে আমাদের শহরটিকে রঙিন করে দিয়েছিলেন সুনীলদা। তাঁদের বাড়ি হাওড়ার শিবপুরে। সুনীলদাদের বাড়িতে কেউ চাকরি করতেন না। উত্তরবঙ্গে চা বাগান ছিল তাঁদের। সুনীলদার বৃদ্ধ বাবা মা-কে দেখেছি আমি। হাওড়া ব্রিজ থেকে উড়াল সেতু ব্রেবোর্ন রোডে বাঁক নিচ্ছে যেখানে, ডানদিকেই তাঁদের হিমালয়ান টি হাউস, এখনও আছে কিনা, জানিনা। শিবপুরে থাকার সময়ই সুনীলদা বের করতেন ‘বিভিন্ন কোরাস’ নামে একটি লিটিল ম্যাগাজিন। শ্রীরামপুরে এসে তিনি ওই পত্রিকাটিই ফের বের করতে লাগলেন। সুরারসিক মানুষ ছিলেন সুনীলদা, মদিরাসক্তও হয়ে পড়েছিলেন তিনি; কিন্তু কখনও তাঁকে তাল হারাতে দেখিনি। কোন মদিরা কখন পান করতে হয়, মদ্যপানের উপযুক্ত পরিবেশ রচনা ইত্যাদি বিষয়ে বিবিধ নিয়মনীতি মানতেন সুনীলদা‌। মদ ও মদ্যপান বিষয়ে বিদেশি বিবিধ বইপত্রও তাঁকে ওলটাতে দেখেছি। ওই নিয়মনীতি মেনে, পরিবেশ রচনা করে সুনীলদার মদ্যপানে মাঝে-মাঝে ঘটে যেত অনেক নাটকীয় কাণ্ড।

    আমাদের স্টেশনের কাছে বাজারে বড়-বড় কয়েকটি মাছের আড়ত আছে, সেখানে মাছ সংরক্ষণে ওই সব বরফের চাঙড় আসে। এমনিতে স্কোয়ার ফুট হিসেবে বরফের দাম সস্তাই। সুনীলদা তাঁর সাকরেদ রিকশ-চালককে দিয়ে ওই বরফ আনিয়েছেন। সুনীলদা ওই বরফের চাঙড়ে আঙুর ঘসে-ঘসে মুখে তুলে গেলাসে চুমুক দিচ্ছেন। বাংলা মদ।

    একদিন বিকেলে ইএসআই-এ সুনীলদার ফ্ল্যাটে গিয়েছি, দরজা খুলে পুষ্পবৌদি সুনীলদার ঘরের বন্ধ দরজার দিকে আঙুল তুলে বললেন, দেখো গিয়ে তোমার দাদার কাণ্ড! সে-ঘরের দিকে এগোতেই দেখলাম, বন্ধ দরজার তলার ফাঁক দিয়ে বের হচ্ছে জলের ধারা। এগোতেই পায়ে লাগল কনকনে হিমশীতল জল! দরজায় টোকা দিতেই সুনীলদা বললেন, ঠিকসময়ে এসেছ, বলেই ফের দরজা বন্ধ করে দিলেন। দেখলাম সব লাইট নিভিয়ে এপ্রান্ত-ওপ্রান্ত দড়ি টাঙিয়ে সুনীলদা একটা হ্যারিকেন ঝুলিয়েছেন। তার আলোয় দেখলাম, মেঝেয় মস্ত বড় একটি বরফের চাঙড় কাঠের গুঁড়োসহ পলিথিন পেতে রাখা। তার পাশে ঠোঙায়-ঠোঙায় আঙুর আর আখরোট। আমাদের স্টেশনের কাছে বাজারে বড়-বড় কয়েকটি মাছের আড়ত আছে, সেখানে মাছ সংরক্ষণে ওই সব বরফের চাঙড় আসে। এমনিতে স্কোয়ার ফুট হিসেবে বরফের দাম সস্তাই। সুনীলদা তাঁর সাকরেদ রিকশ-চালককে দিয়ে ওই বরফ আনিয়েছেন। সুনীলদা ওই বরফের চাঙড়ে আঙুর ঘসে-ঘসে মুখে তুলে গেলাসে চুমুক দিচ্ছেন। বাংলা মদ। আমাকে গেলাস ধরিয়ে সুনীলদা বললেন, ‘কাবুলে কান্দাহারে তোরাবোরার গুহায় আফগানরা এইভাবে দিশি মদ খায়। এই দেখো, এই দেখো, হাত বাড়িয়ে সুনীলদা দেখালেন, ‘ন্যাশশনাল জিওগ্রাফিক’-এ কভার স্টোরি— আফগানিস্তান।

    আর-একবার বিকেলে রাস্তায় সুনীলদার সঙ্গে দেখা হতেই বললেন, চল তোমাকে একটা দারুণ জায়গায় নিয়ে যাই, পুরো আবুধাবি। ট্রেনে চড়ে দু’জনে গেলাম চুঁচুড়া। চুঁচুড়া স্টেশনে নেমে সুনীলদা মস্ত বড় আকারের চেক চেক স্টাইলের দুটো রুমাল কিনলেন; খুঁজে পছন্দ করে। তখন তরুণদের গলায় ওইরকম রুমাল বাঁধার চল হয়েছিল, মেয়েরাও মাথা ঢেকে থুতনিতে গিঁট মারত। চুঁচুড়া স্টেশন থেকে রিকশয় পশ্চিমে দিল্লিরোডের কোলে গিয়ে আমি সত্যিই তাজ্জব! ঢেউ খেলানো জমিতে এদিক-ওদিকে বেশ কয়েকটি খেজুর গাছ। মাঝে একটি পানশালা। বড় রুমাল একটি মাথায় বেঁধে দু’পাশে ঝুলিয়ে সুনীলদা আমারও রুমালটি ওইভাবে বাঁধলেন, গেলাসে চুমুক দিতে-দিতে সুনীলদা বললেন, মরুদ্যানে ধাবায় হাইওয়ের ধারে বেদুইনরা এভাবেই মদ খায়। তারপরই তাঁর আক্ষেপ, শুধু উট নেই। তবে ওই দেখো ওই দেখো—তেলের ট্যাঙ্কার! সত্যিই দিল্লি রোড দিয়ে সূর্যাস্তবেলায় একটা ট্যাঙ্কার যাচ্ছিল।

    এবার আর-এক রঙিন মানুষের কথা বলি; তিনি শম্ভু রক্ষিত‌। সত্তর দশকের শুরু থেকেই অপরূপ এই কবির নানাবিধ কাণ্ডকারখানার দু’চারটিতে আমি জড়িত, যা আমার স্মৃতিসম্পদ। শ্রীরামপুরে প্রায়ই আসত শম্ভুদা, শৈলেনদা(দত্ত), সোমনাথদা (মুখোপাধধ্যায়), রমাদির বাড়িতে। আমার সঙ্গে পরিচয় হয় ১৯৭১-এ কফিহাউসে। শ্রীরামপুরে সবার সঙ্গে তার সদ্ভাব। ওই সময়ই এমন একটা কাণ্ড ঘটিয়ে দিল শম্ভুদা, শ্রীরামপুরে আমরা সকলেই খেপে লাল! শ্রীরামপুরে এক কবিকে, যিনি শিক্ষিকা, চিঠি লিখেছিল শম্ভুদা, যে চিঠি কহতব্য নয়, যাকে বলে শালীনতার সীমা ছাড়ানো। শ্রীরামপুরে শৈলেনদা, সোমনাথদাদের মিটিংই বসে গেল, যে মিটিংয়ে শম্ভুদার শাস্তির কথা উঠল। আমি তখন কলেজ ছাত্র, শম্ভুদা যেখানে থাকেন হাওড়ার কদমতলায় কুচিল ঘোষাল লেনে আমার মামারবাড়ি, মা-র কাকা, খুড়তুতো ভাইয়েরা থাকে—এসব সোমনাথদা জানতেন।  সোমনাথদা আমাকেই বললেন, তুই-ই তাহলে শম্ভুর বাডি গিয়ে হৈ-হৈ করে আয়। শৈলেনদা বললেন, ছেলেপিলে নিয়ে বেশি মারধোপর করো না যেন, জাস্ট একটু কড়কে দেবে। তখন তো আর মোবাইল ছিল না। কিন্তু কদমতলায় বিচারপতি দাদুর বাড়িতে ল্যান্ডফোন ছিল। গোপালমামা আমার সমবয়সী, তদুপরি কমরেড। পোস্টাফিস থেকে গোপালমামাকে ফোন করলাম। 

    শম্ভু রক্ষিত

    মামাবাড়ির অদূরে কুচিল ঘোষাল লেনে তখন শম্ভুদা তার মাসির বাড়িতে থাকত। শম্ভুদার নাম ধরে কড়া খটখটাতে শম্ভুদাই দরজা খুলে দিল। ভেতরে উঠোনে হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পড়ল গোপাল(মামা) ও তার তিন-চার কমরেড। তারা কিল, চড়, ঘুষোঘুষি করার আগেই শম্ভুদা জড়িয়ে ধরল আমাকে, ওরে মৃদুল, কী দারুণ কবিতা লিখেছিস ‘শীর্ষবিন্দু’-তে… আয়…আয়…

    ভ্যাবাচাকা খেয়ে গোপাল(মামা) আমাকে বলল, আমরা তাহলে চলে যাই….

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     



 

Rate us on Google Rate us on FaceBook