মুখে যতই বোলচাল থাক, অপরাধীকে ধরতে গিয়ে ব্যোমকেশ যাকে বলে, নাস্তানাবুদ। এদিকে মেয়েদের বুদ্ধি নিয়ে তার ব্যঙ্গবিদ্রুপ সময়ে সময়ে ঝরে পড়লেও, কার্যক্ষেত্রে অপরাধীকে পাকড়াও করে তাকে টেক্কা দিল এক মেয়েই!
বুদ্ধির দৌড়ে এক মেয়ের কাছে ব্যোমকেশের পরাজয়ের এই আখ্যান যখন লেখা হচ্ছে, বিশ শতক ততদিনে প্রায় অর্ধেক পথ পাড়ি দিয়েছে। তার সঙ্গেই অনেকখানি পথ পাড়ি দিয়েছে ‘গোয়েন্দাকাহিনি’ নামের সেই জঁরটিও, উনিশ শতকের শেষভাগে যাকে চিনতে শুরু করেছিল বাংলা সাহিত্য। দারোগাদের লেখা পুলিশি বিবরণ পেরিয়ে নাগরিক সাহিত্যের দরজায় এবার কড়া নাড়ছে সে। যদিও এই দীর্ঘ যাত্রাপথে অপরাধিনী কিংবা অপরাধের মুখে বিপন্ন হওয়া ছাড়া মেয়েদের অন্য ভূমিকা চোখে পড়েনি, কাহিনির কেন্দ্রে, অর্থাৎ বিপদতারণ গোয়েন্দার চরিত্রে অবতীর্ণ হওয়ার তো প্রশ্নই ওঠেনি।
কিন্তু যে কাহিনির কথায় কথা শুরু হল, তা এই গড্ডল প্রবাহের একটা ফিরতি বাঁক। অর্থাৎ, এই কাহিনিতে গোয়েন্দার চরিত্রটি পুরুষ নয়, মহিলা। উপরন্তু, সেই মেয়ে গোয়েন্দার কথা লিখছেন যিনি, তিনি নিজেও লিঙ্গপরিচয়ে নারী। প্রভাবতী দেবী সরস্বতী। সে-সময়ের অসম্ভব জনপ্রিয় লেখিকা তিনি, এতটাই যে, তাঁর নাম নকল করে উপন্যাস প্রকাশ বন্ধ করতে তাঁকে বিজ্ঞপ্তি দিতে হয়। সেই জনপ্রিয়তার দৌলতেই হয়তো, সিরিজ সাহিত্যে গোয়েন্দাকাহিনি লেখার সুযোগ মিলেছিল তাঁর।
আরও পড়ুন : রেলওয়ের একেবারে অন্য ইতিহাস ধরা পড়ে এই বইয়ে! গৌতমকুমার দে-র কলমে ‘পাঠপুরাণ’-এর তৃতীয় পর্ব…
মনে রাখা যাক, হাতে-গরম পুলিশি তদন্ত আর রগরগে জনতোষ গোয়েন্দা গল্প ঠেলে ১৯৩২ সালে শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের কলমে আবির্ভাব ঘটেছে ব্যোমকেশ বক্সীর, যে গোয়েন্দাকে প্রথম বাঙালি পাঠক নিজের মতো বলে ভাবতে পেরেছে। এদিকে সেই ১৯৩২ সালেই কেবল গোয়েন্দাকাহিনি ও অপরাধমূলক গল্পের জন্য বরাদ্দ হয়েছে একটি গোটা পত্রিকা, যার নাম ‘রোমাঞ্চ’। গোয়েন্দাকাহিনির এই রমরমা বাজারে, ব্যবসায়িক প্রতিযোগিতা সামলাতেই রহস্যকাহিনি-ভিত্তিক সিরিজ প্রকাশের সিদ্ধান্ত নেয় ‘দেব সাহিত্য কুটীর’। যে প্রকাশনা সংস্থার নিয়মিত লেখিকা ছিলেন প্রভাবতী দেবী। সুতরাং, সমকালীন বিখ্যাত লেখকদের কলমে লেখা গোয়েন্দাকাহিনি নিয়ে সিরিজ-সাহিত্যের পরিকল্পনায় তাঁর নাম থাকাই স্বাভাবিক। সেই সুবাদেই ১৯৫২ সালে ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’ সিরিজে প্রকাশিত হল প্রভাবতী দেবী সরস্বতীর লেখা প্রথম গোয়েন্দাকাহিনি ‘গুপ্তঘাতক’। আর বাংলা সাহিত্যের এ-যাবৎ চেনা গোয়েন্দাসাহিত্যের ট্রোপ ভেঙে দিয়ে প্রভাবতী দেবী সেখানে হাজির করালেন এক মেয়ে গোয়েন্দাকে। সেই কৃষ্ণার কথা দিয়েই এই লেখার শুরু, যদিও ব্যোমকেশ এখানে বক্সী নন, চক্রবর্তী। গতানুগতিক এক পুলিশ অফিসার-মাত্র।
তবে কৃষ্ণা কিন্তু গতের একেবারে বিপরীতে দাঁড়িয়ে। মেয়েদের সঙ্গে বুদ্ধিহীনতার যে অভিযোগ দীর্ঘদিন ধরে লগ্ন হয়ে আছে, সেই জগদ্দল মিথ ভেঙে বাংলা গোয়েন্দাসাহিত্য তখনও পর্যন্ত কোনও মেয়ে গোয়েন্দার সাফল্যের বয়ান লিখে উঠতে পারেনি। সেখানে ‘প্রহেলিকা’ আর ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’ সিরিজের চারটি কাহিনিতে বাঙালি পাঠক এমন এক সাহসিনীর দেখা পেল, পিতৃহত্যার প্রতিশোধ নিতে যে বর্মার ভয়ংকর দস্যু ইউ-উইনের মোকাবিলা করতে প্রস্তুত। আরও একবার, জনপ্রিয়তা প্রকাশককে প্ররোচিত করল মেয়ে গোয়েন্দাকে নিয়েই আস্ত একটা সিরিজের ছক কষতে। আর ১৩৫৯ বঙ্গাব্দে, একই প্রকাশনার মাসিক পত্রিকা ‘শুকতারা’-র বৈশাখ সংখ্যায় দেখা গেল ‘এদেশে মেয়েদের ‘আডভেঞ্চার’-বইয়ের প্রথম পথপ্রদর্শিকা’ প্রভাবতী দেবী সরস্বতীর কৃষ্ণা সিরিজের পাতা-জোড়া বিজ্ঞাপন। গোয়েন্দাসুলভ বুদ্ধি ও বল কেবল পুরুষেরই আয়ত্তে, এই চলতি বিশ্বাসে সজোরে ঘা দিয়ে সিরিজ প্রবর্তনের বিজ্ঞাপনটি জানিয়ে দিল, ‘আকস্মিক বিপদে পড়ে শুধু উপস্থিত বুদ্ধির জোরে কেমন করে উদ্ধার পেতে পারেন’ মেয়েরা, এ বইয়ে থাকবে তার ইঙ্গিত।
গতের বিরুদ্ধে হাঁটা যে ভুল হয়নি, তা বোঝা গেল যখন অব্যবহিত পরেই ‘কুমারিকা’ নামে আরও একটি নতুন সিরিজে প্রভাবতী দেবী পরিচয় করালেন মেয়ে গোয়েন্দা অগ্নিশিখা রায়কে। এই বইগুলির শুরুতেও পাঠিকাদের উদ্দেশে জানালেন—
শুধু ছেলেদের ছাড়া মেয়েদের ‘অ্যাডভেঞ্চারে’র বই এ পর্য্যন্ত কেউ লেখেন নি। এই কারণেই ‘কুমারিকা সিরিজের’ আবির্ভাব। কোন আকস্মিক বিপদ এলে কলেজের মেয়েদের যা করা প্রয়োজন, ‘কুমারিকা সিরিজ’ পড়লেই তার ইঙ্গিত পেয়ে যাবে।
লেখিকার বয়ান এবং বিজ্ঞাপনের ভাষা দুই থেকেই আন্দাজ করা চলে, শিক্ষা-বুদ্ধি-সাহসে মেয়েদের বাইরের জগতে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর একরকম স্বপ্ন দেখাতে চাইছে এই দুই মেয়ে গোয়েন্দা।
নিজের জীবনে অবশ্য স্কুলের গণ্ডিও পেরোনো হয়নি লেখিকার। মাত্র ৯ বছর বয়সে যেতে হয়েছিল শ্বশুরবাড়িতে। তবে আত্মসম্মানের পাঠ শিখতে ভুল হয়নি তাতেও। তাই ফেলে-আসা বাড়ির জন্য মনখারাপ করে বাঁকা কথা শুনতে হয়েছিল যেই, নতুন বাড়ি আর সম্পর্ক দুই-ই ছেড়ে পুরনো ঠিকানায় ঠাঁইবদল করে নিয়েছিলেন প্রভাবতী। ব্যক্তিজীবনে পাওয়া অপমান আর না-পাওয়া ইচ্ছে মিলিয়েই বুঝি এমন দুই কন্যাকে তিনি গড়ে তুলছিলেন, যারা উচ্চশিক্ষিত, আত্মনির্ভর, স্বয়ংসম্পূর্ণ। সেই গড়ে তোলার প্রয়োজনও জানাচ্ছেন তিনি—
তারাও যে শিক্ষা পেলে ছেলেদের মতোই কাজ করতে পারে, আমি শুধু সেইটাই দেখাতে চাই। চিরদিন মেয়েরা অন্ধকারে অনেক পিছিয়ে পড়ে আছে, আমি তাদের জানাতে চাই, পিছিয়ে নয়— সামনে এগিয়ে চলার দিন এসেছে, কাজ করার সময় এসেছে,— মেয়েরা এগিয়ে চলুক, তাদের শক্তি ও সাহসের পরিচয় দিক।
বুদ্ধি আর মেধার জগতে মেয়েরা অনধিকারী, সমাজ-নির্ধারিত এই ধারণাকে নাকচ করার প্রয়োজনেই সমকালীন বাঙালি মেয়েদের তুলনায় তাদের পৃথক করে নির্মাণ করা জরুরি ছিল। তাই স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে কৃষ্ণার ফার্স্ট ডিভিশনে আইএ পাশ, তারপর বিএ পরীক্ষার খবরও পাওয়া যাচ্ছে। শুধু প্রথাগত পড়াশোনাই নয়,
এই বয়সে কৃষ্ণা মাতৃভাষা ছাড়া আরও পাঁচ-সাতটি ভাষা শিখিয়াছে। কেবল শিখিয়াছে বলিলেই হইবে না, যে কোনো ভাষায় সে অনর্গল কথা বলিতে পারে, পড়িতে পারে। পিতা তাহাকে অশ্বারোহণে পারদর্শী করিয়াছে, মোটর সে নিজেই চালায়, পিতার সহিত বর্মার জঙ্গলে সে বহু শিকার করিয়াছে। উপযুক্ত ব্যায়ামের ফলে তাহার দেহ সুগঠিত, শক্তিশালিনী; দেহে যেমন তার অটুট শক্তি, অন্তরে তার তেমনই অকুতো সাহস।
শিখার কথা আলাদা করে না বললেও চলে, কেননা সমান্তরালে চলা ‘কৃষ্ণা’ ও ‘শিখা’ সিরিজ দু’টি বস্তুত এ ওর উল্টোপিঠ। শিখাকে কৃষ্ণার প্রায় প্রতিরূপ বললে ভুল হয় না। বিপদের মুখে তারা দু’জনেই বিচক্ষণ, প্রত্যুৎপন্নমতি। আবার অপরের বিপদে সহমর্মী হওয়ার মতো মানবিক গুণও পুরোমাত্রায় রয়েছে তাদের। দুর্ভাগ্যের সঙ্গে পাঞ্জা লড়তে, দেশি-বিদেশি আততায়ীর মোকাবিলা করতে যাদের সংকোচ নেই। দেশের স্বাধীনতার প্রাক্কালে বা সদ্য-স্বাধীন দেশে দাঁড়িয়ে প্রভাবতী দেবী এমন দুই নারীকে গড়ে তুলছিলেন, যারা নারী যা আছে তা নয়, যা হতে পারে, হয়ে উঠতে পারে, সেই আগামীর আগমনির ঘোষক।
যদিও গোয়েন্দাগিরিকে বেছে নিয়ে ‘নারীধর্ম গৃহধর্ম’ পালন না করার দরুন কৃষ্ণা বা শিখাকে কম নিন্দা শুনতে হয়নি। ১৯৪৯ সালে প্রকাশিত ‘সেকেন্ড সেক্স’-এর খোঁজ প্রভাবতী পেয়েছিলেন কি না কে জানে, তবে স্বামী-সন্তান-সংসারের দায়িত্বে জড়িয়ে পড়ার সঙ্গে গোয়েন্দার ছকভাঙা যাপনকে মেলানোর কোনও সূত্র অন্তত তাঁর কাছে ছিল না, আর সেই কারণেই বৈবাহিক সম্পর্ক নিয়ে কৃষ্ণা-শিখার অবস্থান এমন ব্যতিক্রমী।
মেয়েদের নিজের জোরেই বেঁচে থাকবার রূপকথা লিখতে চেয়েছিলেন প্রভাবতী দেবী। নিজের জীবন-অভিজ্ঞতায় মেয়েদের প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গিকে যেভাবে চিনেছিলেন তিনি, তা-ই অবচেতনে তাঁকে সাহস জুগিয়েছিল হয়তো এমন দুই আত্মপ্রত্যয়ী নারীচরিত্র সৃষ্টি করতে। তাঁর দুই গোয়েন্দানী-ই শিক্ষা-বুদ্ধি-সাহস-সক্ষমতায় অনন্যা। মনুর বিধান মেনে যৌবনে স্বামী আর বার্ধক্যে পুত্রের অধীন হওয়ার নিয়মকেও তারা অস্বীকার করেছে। যদিও ‘কৃষ্ণা’ সিরিজে সদ্য-স্বাধীন দেশের চাহিদা প্রকাশ পায়— ‘বাংলার সকল মেয়ের বুকেই যেন এইরকম শক্তি ও সাহস জাগে, বাংলা যেন আবার বীর জননীতে ভরে ওঠে’, তবুও মাসতুতো বোন শুভ্রার মুখে জানা গিয়েছে কৃষ্ণার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা—
ও বলে বিয়ে করবে না… শয়তানির ব্যূহ ভেদ করে শয়তানদের ও বার করবে! ও করবে দুঃশাসনদের মুখোস খুলে তাদের স্বরূপ জানিয়ে তাদের খর্ব্ব করে, সমাজের কল্যাণ!
যদিও গোয়েন্দাগিরিকে বেছে নিয়ে ‘নারীধর্ম গৃহধর্ম’ পালন না করার দরুন কৃষ্ণা বা শিখাকে কম নিন্দা শুনতে হয়নি। ১৯৪৯ সালে প্রকাশিত ‘সেকেন্ড সেক্স’-এর খোঁজ প্রভাবতী পেয়েছিলেন কি না কে জানে, তবে স্বামী-সন্তান-সংসারের দায়িত্বে জড়িয়ে পড়ার সঙ্গে গোয়েন্দার ছকভাঙা যাপনকে মেলানোর কোনও সূত্র অন্তত তাঁর কাছে ছিল না, আর সেই কারণেই বৈবাহিক সম্পর্ক নিয়ে কৃষ্ণা-শিখার অবস্থান এমন ব্যতিক্রমী।
কিন্তু সেই ব্যতিক্রমকে কি আদ্যন্ত ধারণ করা সম্ভব ছিল প্রভাবতী দেবীর পক্ষে? কৃষ্ণা সিরিজের বিজ্ঞাপনে সদ্য-স্বাধীন দেশের ‘মা-বোন’-দের পরমুখাপেক্ষিতা থেকে মুক্ত হওয়ার ডাক দিয়েছিলেন লেখিকা। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, পুলিশের চাকরির প্রস্তাব পেয়েও কৃষ্ণা বা শিখা দু’জনেই সে প্রস্তাব ফিরিয়ে দেয়। আমাদের মনে পড়তে পারে মিস মার্পলের কথা, যিনি রহস্যের সমাধানের বিনিময়ে আর্থিক সম্মানদক্ষিণা নিতে নারাজ, কেন-না সে আচরণ তো ‘লেডি’-কে মানায় না। কৃষ্ণা-শিখার স্বনির্ভরতার ধারণাও ভদ্রবিত্ত নারীর সেই বেড়া পেরতে পারেনি। সেই কারণেই, প্রায় প্রতি কাহিনিতেই অপহৃতা হয়েও ‘স্বৈরাচারী দুর্বৃত্ত নরপশুদের কবল থেকে’ তার ‘নারীধর্ম্ম’ বজায় রাখার পবিত্র কর্তব্যটি গোয়েন্দানীকে বরাবর পালন করে যেতে হয়। আর, কেবল ‘স্বৈরাচারীদের অত্যাচার’ থেকে একলা আত্মরক্ষা করতে পারাতেই প্রভাবতী দেবীর স্বনির্ভরতার ধারণা থমকে যায়।
আসলে সমাজের ছক মেনেই বাংলা গোয়েন্দাসাহিত্য প্রথম থেকে যে ভাল-খারাপের বাইনারি তৈরি করেছিল, সেখানে চরিত্রে দাগ লাগানোর অধিকার খলনায়িকাদের একচেটিয়া। তারও আগে বাংলায় প্রথম অপরাধ-বিষয়ক কাহিনি লেখেন সৌদামিনী দেবী, তাঁর ‘মাতঙ্গিনী’ বইটিতে এক ব্যভিচারিণী নারীকে উচিত শিক্ষা দিয়ে নারীর সতীত্বের গুণগান করেন। তবে তার পরেও ‘বামাবোধিনী’ পত্রিকার সূত্রে সমাজের তরফ থেকে সৌদামিনী দেবীর যে ভর্ৎসনা প্রাপ্য হয়, সেখান থেকে এ-কথা স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, নারীর সমাজবিধি-বহির্ভূত কার্যকলাপকে লোকচক্ষুর আড়ালে কুঠুরিবন্ধ করে রাখতে পারলেই সমাজের স্বস্তি। লক্ষ্মণরেখা ভাঙার চেষ্টা যে সমাজের না-পসন্দ, সে-কথা তো জানিই আমরা। উনিশ শতকের চলতি ধারা পেরিয়ে গোয়েন্দাকাহিনির নাগরিক সাহিত্যে প্রবেশের জন্য এ তো আবশ্যিক শর্ত, ‘ভাল’ মেয়েদের ‘চরিত্ররক্ষা’। মেয়েদের অ্যাডভেঞ্চারের ‘পথপ্রদর্শিকা’ প্রভাবতী দেবীও সেই শর্তকে অস্বীকার করতে পারেননি।
আসলে গোয়েন্দাসাহিত্যের ‘নাগরিকত্ব’ লাভের পাশাপাশি যে আমজনতা ছিল তার টার্গেট অডিয়েন্স, তারও তো রূপান্তর ঘটে গেছে। কলকাতার তলায় থাকা লোকেদের জায়গা নিয়েছে মধ্যবিত্ত ঘরোয়া পাঠক, মূলত বাঙালি মধ্যবিত্তের অন্দরমহল। শিখা যখন গোয়েন্দাগিরিতে হাত-মকশো করছে, তখন সেই অন্দরমহল থেকে আপত্তিই উঠছিল। তার কাকা বলেছেন ‘বংশের নাম ডোবাবে নাকি’, কাকিমার বিদ্রুপ, ‘মেয়েছেলে নাকি ডিটেকটিভের কাজ করবে— যত সব গাঁজাখুরী কথা। বলে— যার যা কাজ তারেই সাজে। পুরুষের যা কাজ তা পুরুষেই করুক, মেয়েদের ও সব কাজে হাত দেওয়ার দরকার কি বাপু?’ এমনকী, ‘নিজের সংসারের কথা ভুলে এমন ভাবে পরের কাজ নিয়ে হৈ হৈ করে’ বেড়ালে বাড়ির চাকর পর্যন্ত মনে মনে ক্ষুব্ধ হয় তার ওপর। কিন্তু ‘কুমারী রায় বাঙ্গালী মেয়েদের সামনে আদর্শস্থানীয়া হয়ে থাকুন’, সংবাদপত্রের এই দাবি থেকে বোঝা যায়, সমাজের এক অংশ নারীকে এবার দেখতে চাইছে নতুন রূপে।
ভিন্ন ভিন্ন চাহিদা জুড়ে বাঙালি সমাজের এই যে ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’ অবতার, কৃষ্ণা-শিখার নির্মাণে তাকেই তুষ্ট করার উপাদান পুরে দেওয়া আছে। সেকেলে বাংলার ‘ঘরপোষা নির্জীব মেয়ে’-র জায়গায় সবাক সপ্রতিভ সুন্দরীদের বসাচ্ছে বাংলা সাহিত্য, যাতে একই সঙ্গে পূর্ণতা পাবে পাঠকের রোম্যান্টিক ইচ্ছে, আবার সেই মেয়েদেরই সতীত্বরক্ষার আখ্যানে নিশ্চিন্ত হবে অভ্যস্ত পিতৃতান্ত্রিকতা। স্ত্রীশিক্ষার প্রথম যুগে প্রহসন-জাতীয় লেখায় শিক্ষিতা মেয়েদের কামতাড়িতা এক অস্বাভাবিক জীব বানিয়ে তোলা গিয়েছিল বটে। কিন্তু বিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে, ‘উইমেন্স লিব’-এর কানাকানির মধ্যে সেই একই ছকে আর নতুন যুগের বাজারকে ধরা যে সম্ভব হবে না, সে কথা বুঝেছিল গোয়েন্দাসাহিত্যও। ‘কলেজের মেয়েদের’ নতুন টার্গেট অডিয়েন্স হিসেবে চিহ্নিত করার পাশাপাশি তাই লেখাতেও তাদের জায়গা দেওয়ার প্রয়োজন ছিল।
কিন্তু কৃষ্ণা-শিখাদের মর্যাদা দেওয়ার ছলে নারীকে তার পিতৃতান্ত্রিক সংজ্ঞা মনে করিয়ে দেওয়ার যে রাজনীতি কাজ করে যাচ্ছিল, প্রভাবতী দেবীও কোথাও না কোথাও তারই ফুট সোলজার হয়ে যান। সময়ের চাহিদাকে মান্য করেই জনপ্রিয় হয়েছিলেন প্রভাবতী দেবী, আর সময়ের দাবি মেটাতে গিয়েই তাঁকে মাথা নোয়াতে হয়েছিল পিতৃতন্ত্রের কাছে। মেয়েদের সম্বন্ধে প্রচলিত দীর্ঘদিনের নির্বুদ্ধিতার মিথ ভাঙতে পারলেও, আরও প্রাচীন পিতৃতন্ত্রের শৃঙ্খল ভাঙা তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়নি।