একচিলতে। একটু। সামান্য। ভয় নেই। কিচ্ছু হয়নি। এটুকুতে ঘাবড়ে গেলে চলবে? এমন কত হয়! এখন তো জীবন সবে শুরু! এরপর তো আরও কত কাটাছেঁড়া হবে। তখন কি আর আমরা থাকব? সেসব তো নিজেকেই সামলাতে হবে!
অনেকগুলো মুখ। আবছা। আশ্বাস। নিরাপত্তা। ওম। কী আরাম! কী যে শান্তি! পাখির ডানার মতো ছায়া। বটগাছের শীতল ছোঁয়াচ। ক্রমশ আরও আবছা হয়ে আসছে।
ঠিক পরমুহূর্তেই ম্যাচকাট। মাথার কোণ থেকে গড়িয়ে পড়ছে। ঠোঁটের কোণা ভিজে। চোখের একটা পাতা বোধ করি আধবোজা, ঠিক কতটা লাল হয়ে ফুলে উঠেছে শিরাগুলো, বোঝাই যাচ্ছে না। মুখের ভেতর ভসভসিয়ে উঠছে, ফেনার মতো। হাত-পায়ের নখ উপড়ে গেছে। চাপ চাপ। হাত দিয়ে ঘাম মুছতে গেলে হাত লাল হয়ে উঠছে নিমেষেই। দগদগে শরীরটা আর টেনে বহন করাই যাচ্ছে না।
‘এরপর তো আরও কত কাটাছেঁড়া হবে। তখন কি আর আমরা থাকব? সেসব তো নিজেকেই সামলাতে হবে!’
ক্রমশ ন্যুব্জ, নুইয়ে পড়া দেহটা মাথা তোলে, কুঠারের ঘা খাওয়া মাথা নোয়ানো গাছের মাথা যেমন ঝড়ে খানিক এতোলবেতোল হয়।
আরও পড়ুন : কীভাবে গোলাপ হয়ে উঠল রক্তগোলাপ? দোলের বিশেষ সংখ্যা ‘এবড়োখেবড়ো রং’-এ লিখলেন দোয়েলপাখি দাশগুপ্ত…
২
এর পরের দৃশ্য হয়তো কোনও চিত্রনাট্যে থাকবে। নখ কামড়ে দেখবে দর্শক, এরপর কী ঘটে। হয়তো বা সেঁধিয়ে যাবে কোনও স্বপ্নের মধ্যে। ঘামে জবজবে শরীর মাঝরাতে বা ভোরে উঠে বসবে ধড়ফড়িয়ে। সত্যি সত্যি অতটা লাল আমরা দেখেছি না কি? সেই লাল তো আর লাল থাকবে না, ক্রমশ কালো হয়ে উঠবে। শুকিয়ে শুকিয়ে আরও কষাটে। আরও সয়ে যাওয়া, মেনে নেওয়া। হঠাৎ সিনেমা দেখতে দেখতে, বা ঘুম ভেঙে উঠে কান্না পাবে সেই ছোটবেলার সামান্য ছড়ে যাওয়া আর সকলের ঘিরে ধরে প্রলেপ দেওয়ার মুহূর্তটা ভেবে। ওইটুকু, ওই একচিলতে-তেই তখন কী ভয়টাই না করেছে! কিন্তু সামান্য বল ক্যাচ করতে গিয়ে পিচরাস্তায় ঘষে যাওয়া হাঁটু, ফ্রিকিক মারতে গিয়ে ছালচামড়া উঠে যাওয়া গোড়ালি, বাড়ি ফিরে কেঁদে ওঠা আর বকুনি বা সান্ত্বনার নিশ্চয়তা— আর অন্যদিকে গণমারে, ছেঁড়া চামড়া, প্রতিরক্ষাবিহীন প্রতিটা ক্ষতচিহ্ন হজম করে জেগে ওঠা এমন কোনও রাস্তায়, যা চট করে বাড়ি ফেরে না; দুইয়ের মধ্যে, দেখা যাবে, একটু রঙের ফারাক হয়ে গেছে। লাল ওষুধের চেনা গন্ধ আর নেই, মুখে রয়েছে তেতো স্বাদ, কখনও কখনও মুরগির হাড়ের শেষাশেষি যে স্বাদ পেকে ওঠে আচমকা।
আমরা ভয় পাই ওই লালটাকে। রিনরিনে আতঙ্ক চেপে ধরে আমাদের। ছোট থেকে যার ইঞ্জেকশনে ভয় নেই, সেও কি চাইবে অমনটা?
কিন্তু না চাইতেও তো এই রংয়ের সঙ্গে সংলাপে যেতে হয় অনেককেই। এক-একটা সময় লাল না কালো বোঝা যায় না যেমন! যেভাবে আন্দ্রেই তারকভস্কির দ্বিতীয় ছবি ‘আন্দ্রেই রুবলেভ’-এর শেষে চার্চের গায়ে আঁকা ছবি, যুদ্ধবিধ্বস্ত ছিন্নভিন্ন দেহ, পোড়া কাঠ পেরিয়ে লাল হয়ে ধরা দেয় সাদা-কালো ফ্রেমের আবরণ ছিঁড়ে। সেই লাল রং কিন্তু ছবিতে বারবার ফিরে আসতে পারত। ছুরিতে অন্ধ হয়ে যাওয়া ক্ষতবিক্ষত চোখ, ছেঁড়া দেহের দৃশ্য পেরিয়ে যখন ডুরোচকাকে বাঁচাতে গিয়ে আন্দ্রেই রুবলেভ কুঠারের ঘায়ে মুখ রক্তাক্ত করে দেয় এক তাতার সেনার— তখন তো সব রক্তছিটে কালো! তাই দেওয়ালে আঁকা লাল রঙের ছিটেও কালো হয়ে আসে আমাদের কাছে, ডুরোচকা যাকে রক্তেরই দাগ ভেবে উত্তাল হয়ে ওঠে কান্নায়।
কালো, শুকিয়ে যাওয়া রক্তদাগ তাই আমাদের কাছে আসল ক্ষত। যে লাল টমেটো কেচাপের, তা যে রক্তের লাল নয়, রক্তে ভেজা প্রতিটি মানুষ তার হয়ে সাক্ষ্য দিতে পারে।
৩
অনুরাগ কাশ্যপের প্রথম ছবি ‘পাঁচ’, যা এ-বছর পুনর্মুক্তির দোরগোড়ায়, সেই ছবিতে শুরু থেকেই ধুমধাড়াক্কা রক্তস্নান আছে। কিন্তু সেই ছবির রং, সামগ্রিকভাবেই, বেশ খানিকটা চাপা। তাই রক্ত যখন আসে এই ছবিতে, তা টাটকা হয়ে ওঠে না কিছুতেই, বরং খানিক কালচে ভাব নিয়েই আসে। তার পরের ছবি ‘ব্ল্যাক ফ্রাইডে’-তেও, বিস্ফোরণ, সংঘাতে এপ্রান্ত-ওপ্রান্ত ছিটকে যাওয়া মানুষের শরীরের রক্তে কালোই বেশি দগদগে হয়ে ওঠে।
এই অনুরাগই আবার যখন বহু পরে ওয়াসিপুরের রক্তলেখা লেন্সে তুলে রাখছেন, তখন সেখানে রক্তের বিবিধ বর্ণচ্ছটা। ফয়জল যখন তার বহুদিনের বন্ধু ফজলুর বিশ্বাসঘাতকতার শাস্তি দেয় গলার নলিতে পরের পর ছুরি বসিয়ে, একটু দূর থেকে সিল্যুয়েটে তাদের ধরে রাখে ক্যামেরা, তখন যে রক্ত ছিটকে বেরয়, আরও দূরের হ্যালোজেনে তাতে লালের আভাস একবার পাওয়া গেলেও তা মিলিয়ে যায় মুহূর্তেই। বা এই মহাকাব্যিক ছবির প্রথম পর্বের শেষ দৃশ্যে যখন গুলিবিদ্ধ, প্রায় নিহত সর্দার খান নেমে আসে গাড়ি থেকে, তখন কাচের গুড়োতে ভরা দেহে রক্তের যে স্রোত বয়ে যায়, তার মধ্যে লাল যেমন আছে, তেমন কালচে ছোপও রগরগে হয়ে ফুটে আছে। গুলি প্রথম যখন গিয়ে বেঁধে শাহিদ খানের দেহে, তখন লাল রক্তের মধ্যিখানে যে গর্ত, যে কোটর তৈরি হয় তার দেহে, তাও, ঘন পাঁকের মতো কালো। এমনকী, ডেফিনিটের গুলি খেয়ে ফয়জলের ঠোঁটের গোড়া থেকে যে রক্ত গড়ায়, তাও লাল-কালোর সংমিশ্রণে। আবার এক ধর্ষক গুন্ডার দেহ কেটে কসাইখানায় ফেলে আসার আগে যখন আসগর কাটে তাদের দেহ, বা সরকারি আধিকারিককে খুন করে তলোয়ারে রক্ত লাগিয়ে সেই আধিকারিকেরই ছেলের কপালে টিকা লাগাতে যখন এগিয়ে যায় রামাধীর, সেখানে রক্তের রং লাল-ই। সরাসরি ট্র্যাজেডি বা সরাসরি প্রতিশোধে লাল-কালো মিশে থাকে, অন্যত্র সেই মিশেল অতটা থাকে না। কিন্তু এই বিচ্যুতিটা তৈরি হয় মূল ক্লাইম্যাক্সে। রামাধীরকে যখন পরের পর গুলি ছুড়ে চলে ফয়জল, তখন রামাধীরের দেহ টকটকে লাল হয়ে যায়। এই দৃশ্যের অভিঘাত আরও তাজা করতেই যেন রামাধীরকে সাদা ধুতি-পাঞ্জাবি পরিয়ে দেওয়া হয়। এই দৃশ্য বাস্তবরহিত হয়ে যেন, একপ্রকারের কমিক ভায়োলেন্সকে দৃশ্যামান করে তোলে। তাই চল্লিশ বছরের বহু-প্রতীক্ষিত প্রতিশোধ এখানে সসের মতো লাল রঙের ক্যানভাস হয়ে ওঠে লহমায়। যেন এ এক পাল্প স্বপ্নদৃশ্য। তাই এই দৃশ্যের সমান্তরালে বাকি যে রক্ত ঝরে, যতগুলো লাশ পড়ে, তা এভাবে লালে লাল হয়ে ওঠে না। সেই জন্যই বোধহয় এই দৃশ্যের ধাক্কায় ফয়জল প্রায়-বোবা হয়ে যায়।
অনুরাগ কাশ্যপের প্রথম ছবি ‘পাঁচ’, যা এ-বছর পুনর্মুক্তির দোরগোড়ায়, সেই ছবিতে শুরু থেকেই ধুমধাড়াক্কা রক্তস্নান আছে। কিন্তু সেই ছবির রং, সামগ্রিকভাবেই, বেশ খানিকটা চাপা। তাই রক্ত যখন আসে এই ছবিতে, তা টাটকা হয়ে ওঠে না কিছুতেই, বরং খানিক কালচে ভাব নিয়েই আসে।
একটু খেয়াল করলে দেখা যাবে, এমনকী, ঝকঝকে, খোলতাই রঙের হলিউডের ছবিতেও, মাথার পাশ থেকে প্রথম যে রক্তটা চলকে পড়ে, তার প্রাথমিক রং যেন, খানিকটা ঘন কালোই। হয়তো তা নয়, হয়তো বর্ণান্ধর মতো, সেই লালও আদতে কালো বলেই ঠেকে। এখানে একটি ছবির কথা অবধারিতভাবেই উঠে আসে, কোয়েন্তিন তারান্তিনোর ‘জ্যাঙ্গো আনচেইনড’। সেখানে ডিনার সিকোয়েন্স থেকে যে রক্তপাত শুরু হয়, বর্ণবৈষম্যের শোষণনীতি, কৃষ্ণাঙ্গদের নিষ্পেষণের বিপুল মার্কিন ইতিহাসের প্রেক্ষিতে, তা মাত্রাতিরিক্তভাবেই লাল। সেই রক্তের রংকে আরও সুস্পষ্ট করে তোলা হয় যেন রঙের রাজনীতি দিয়েই। এক প্রাচীন কৃষ্ণাঙ্গ ব্যক্তির খুলি বসানো থাকে টেবিলের ওপর, আর শ্বেতাঙ্গ ক্যান্ডির হাতে মাখানো রক্ত হয়ে থাকে টুকটুকে লাল, যা আবার কৃষ্ণাঙ্গ ব্রুমহিলডার মুখে লেপে দেয় সে। ফ্রানজ ফানোঁর লেখায় কালো মানুষের যাপিত অভিজ্ঞতার যে দ্বান্দ্বিকতা ধরা ছিল, তার পটভূমিকায় চিনলে ওই রক্ত কষাটে লাল-ই লাগে। এর প্রত্যুত্তরের আরও লাল রক্তপাত যেন ওয়াল্টার বেঞ্জামিনের ‘ডিভাইন ভায়োলেন্স’-কে সংজ্ঞায়িত করে।
৪
রক্তর অভ্যেস ছোটবেলা থেকে যাদের তৈরি হয়, তারা জানে, সিনেমার মতো লাল রং সবসময় দেখা যায় না মোটেও। যে দাঙ্গা দেখেছে চোখের সামনে, ঘষটে যাওয়া রক্তের দাগ অনুসরণ করেও খুঁজে পায়নি হারিয়ে যাওয়া মানুষ, যে দেশের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করতে গিয়ে, অধিকার ছিনিয়ে নেওয়ার সশস্ত্র অভ্যুত্থানে মেতে, দেখেছে সহযোদ্ধার রক্তে ভেজা লাশ— দোলের দিন জলে গুলে যাওয়া লালচে রং যদি সে মিশে যেতে দেখে নালায়, তার শরীরের প্রতিটি রন্ধ্র নিস্পৃহই থাকবে।
যে সুপারি কিলারের খুন করতে হাত কাঁপেনি প্রথমবারেও, সেই ঘাতক যে রক্ত চেনে, আর পেটের তাগিদে পাঁঠা-মুরগি-গরু-মোষ যে কসাইখানায় কাটছে রোজ, তার চেনা রক্তের রং, সেই রঙের অভিজ্ঞতা বদলে যাবেই।
শুধু যা বদলায় না কখনও, তা রক্তের স্বাদ। যে একবার পেয়েছে সেই স্বাদ, সে কখনও ভাষায় ব্যাখ্যা করেনি তা। জঙ্গলে যে পশু কামড়ে ধরছে শিকারের টুঁটি, সে খাদ্যের তাগিদে যে স্বাদ চিনছে, আর ক্ষমতা ধরে রাখা হত্যাকারী, শোষক যে লিকলিকে স্বাদ চিনছে, দুইয়ে নৈতিকতার তফাত হয়তো আছে। কিন্তু যাদের রক্ত ঝরে, তারা জানবে না সেই স্বাদ, কোনওদিনও।
শিকার এমনই। জীবনানন্দ লিখেছিলেন, আকাশ তখন হয়ে ওঠে ‘মচকাফুলের রংয়ের মতো লাল’। আকাশ লাল হয়ে ওঠে মাটির রক্তের অনুভবে কেবল। রক্তের স্বাদ আকাশ পায়নি কোনওদিন, পাবেও না কখনও।