এমার্জেন্সিতে পুনর্মিলন
দিনকয়েক আগে এক বাংলা সংবাদপত্রে খবর বেরিয়েছে যে, কুম্ভমেলায় গিয়ে মা-কে ফেলে উধাও হয়েছে তাঁর উচ্চশিক্ষিত উচ্চপদস্থ ছেলে/ছেলেরা। কুম্ভমেলায় গিয়ে আত্মজনকে এভাবে ছেড়ে ফেলে পালিয়ে আসার উপাখ্যান কৈশোরে শুনেছিলাম কালকূট-এর কাছে, ওঁর অসাধারণ নিজস্ব বয়ানে। সে-বয়সে এতে বিস্মিত ও হতবাক হলেও, এখন নানা অভিজ্ঞতায় আর ততটা অবাক হই না। এমনকী, ট্রেনের টিকিট কেটে বৃদ্ধা মা-কে এলাহাবাদের প্রয়াগ পর্যন্ত পুণ্যের লোভ দেখিয়ে নিয়ে যাওয়ার কষ্টটাও না করে কীভাবে তাঁকে ফেলে চলে যাওয়া যায়, এমন ঘটনা খুব একটা কম নয়। ‘বৃদ্ধাশ্রম’ গান জনপ্রিয় হওয়ার ঢের আগেই আমাদের মানসিকতায় এই বিচ্ছিন্নতার ঘুণপোকা বাসা বেঁধেছে।
একদিন দিনের বেলায়, মেডিক্যাল কলেজের মেডিসিন বিভাগের আউটডোর, অর্থাৎ যাকে ইংরেজিতে বহির্বিভাগ বলে, শেষ হওয়ার পরে এমার্জেন্সিতে এসেছি। সেদিন আমাদের ইউনিটের অ্যাডমিশন ডে, যাকে কায়দা করে আমরা অ্যাড ডে বলতাম, অর্থাৎ যে-রোগী সেদিন থেকে চব্বিশ ঘণ্টায় মেডিক্যাল কলেজের এমার্জেন্সিতে আসবেন ও তাঁদের মধ্যে যাঁদের ভর্তি করা হবে, তাঁরা সকলেই আমাদের ইউনিটে ভর্তি হবেন। এটা সপ্তাহের সব দিনেই প্রযোজ্য, এক-একদিন এক-একটা ইউনিট, মেডিসিন সার্জারি, গাইনিকোলজি, অর্থোপেডিক চেস্ট— সব বিভাগের একই দস্তুর।
আরও পড়ুন: ‘এক বৃদ্ধা রোগী আমার হাত ধরে অঝোর ধারায় কাঁদছেন, আমাকে নাতি বলে ডাকছেন, অথচ, বাড়ির লোককে চিনতে পারছেন না!’ রামাদিত্য রায়ের কলমে মেডিসিনারি-র সপ্তম পর্ব…
তখন দুপুর ঢলে গেছে, এমার্জেন্সি ওয়ার্ডের ভেতরে সেভাবে টের না পাওয়া গেলেও, দেওয়ালে টাঙানো ঘড়ি জানান দিচ্ছে, হঠাৎই ট্রলিতে নিয়ে আসা হল এক বয়স্কা মহিলাকে। ওয়ার্ড বয় রোগীকে ও রোগী ভর্তির কাগজপত্তর এমার্জেন্সি ওয়ার্ডের সিস্টার দিদিমণির হাতে ধরিয়ে দিয়ে চলে গেলেন। আমি আমার সঙ্গী ইন্টার্ন জুনিয়র ডাক্তারকে নিয়ে ছুটে গেলাম। চটজলদি প্রাথমিক শারীরিক পরীক্ষার পরে, স্বাভাবিকভাবেই ডাক দেওয়া হল রোগীর বাড়ির লোককে। বারকয়েক ডেকে সাড়া না মেলায় আমার সঙ্গী ইন্টার্ন বাইরে গিয়ে খুঁজে এসে জানাল, বাড়ির লোক নেই… ভর্তি করে দিয়ে ভ্যানিশ হয়ে গেছে!
ভাবা হল, বোধহয় প্রাকৃতিক প্রয়োজনে আশপাশে কোথাও গেছে, অথবা অন্য কোনও দরকারে— একটু পরেই চলে আসবে। আপাতত প্রাথমিক পরিষেবার কাজকর্ম শুরু করা যাক। সেই ভেবেই রোগনির্ণয় ও চিকিৎসার দিকে মনোনিবেশ করা গেল। সেই আমলে রোগী ভর্তি হলেই মেডিক্যাল কলেজের এমার্জেন্সিতে ক্লিনিক্যাল, অর্থাৎ দেখে-ছুঁয়ে যন্ত্রপাতি দিয়ে পরীক্ষা করে পরীক্ষার জন্য রক্ত টেনে পাঠানো হত, আমরা বলতাম ‘এসইউসি’ (হ্যাঁ, তখনও এই রাজনৈতিক দলের গায়ে আরেকটা সি সাঁটানো হয়নি) ওরফে ‘সুগার ইউরিয়া ক্রিয়েটিনিন’। সঙ্গে ‘ইসিজি’ ও প্রয়োজনমতো ‘এক্সরে’। এসব করা হয়ে গেছে, যেহেতু রোগী আচ্ছন্ন অবস্থায় আছেন, ডাকলেও সেভাবে সাড়া দিচ্ছেন না, অথচ আমাদের গ্লুকোমিটারে রক্তের শর্করার মাত্রা কম নেই, রোগীর নাকে (খাওয়ানোর জন্য) নল পরিয়ে দেওয়াও হয়েছে, কিন্তু বাড়ির লোকের পাত্তা নেই!
সন্ধ্যায় আমাদের ইউনিটের ভিজিটিং চিকিৎসক, অর্থাৎ আমার স্যার এলেন, উনি দুপুরে আউটডোরের পরে যদি হাসপাতালের বাইরে যেতেন, ঠিক সন্ধে সাড়ে সাতটা থেকে আটটার মধ্যে বেলঘরিয়া (ওঁর বাড়ি) থেকে চলে আসতেন, সেদিন ভর্তি হওয়া রোগীদের দেখতে ও আমাদের পরামর্শ দিতে। এবং অবশ্যই সেই রাতে আমাদের খাওয়ানোর ব্যবস্থা করে তারপরে স্যার ফিরতেন।
তো আমাকে নিয়ে রোগীদের দেখতে-দেখতে, যাকে বলা হয় রাউন্ড দেওয়া, স্যার এলেন ওই প্রবীণার পাশে। দেখলেন, সমস্ত বৃত্তান্ত শুনলেন, তারপরে বললেন, দেখো আমাদের তো ওই বাড়ির লোকের কথা ভেবে লাভ নেই আপাতত, আমরা একটা ডায়াগনসিস ভেবে এগোতে থাকি, তারপরে দেখা যাবে।
আমি বিকেলের দিকে ওই এমার্জেন্সিতে সেদিনের জন্য রাউন্ড দিতে গেছি। হঠাৎই দেখি, মহিলাদের ওই ওয়ার্ডের দরজায় পর্দা সরিয়ে এক মাঝবয়সি লোক ওই মহিলার শয্যার দিকে তাকিয়ে উঁকিঝুঁকি মারছে। আমি ওই লোকের চোখের দৃষ্টি সম্পর্কে নিশ্চিত হতে না-হতেই দেখি লোকটি গায়েব।
অতএব, স্যারের পরামর্শ অনুসারে আমরা কাজ এগিয়ে নিয়ে চললাম। রোগীর সুষুম্না কাণ্ডের ভেতরের রস নিয়ে পরীক্ষার কথা ভাবা হলেও, অর্থাৎ যাকে পরিভাষায় ‘লাম্বার পাংচার’ বলে, শেষ পর্যন্ত করে ওঠা গেল না শুধুমাত্র বাড়ির লোকের অভাবে। এভাবেই স্যারের অভিজ্ঞতা ও প্রজ্ঞা, যাকে বাংলায় ‘ক্লিনিক্যাল অ্যাকিউমেন’ ও ‘ক্লিনিক্যাল এক্সপেরিয়েন্স’ বলে, তার ওপরে ভরসা করে আমি লেগে রইলাম ওই পরিবার-পরিত্যক্ত রোগীর জন্য।
আস্তে-আস্তে প্রায় নব্বই ঘণ্টা পেরিয়ে রোগীর চেতনার উন্নতি হতে শুরু করল। রোগী ড্যাবড্যাব করে চোখ মেলে চাইলেন, এবং কিছুটা আস্তে-আস্তে, সামান্য জড়িয়ে হলেও অস্ফুটে কথা বলতে শুরু করলেন। কিন্তু বাড়ির ঠিকানা মনে করতে না পারলেও ছেলের ডাকনাম বলতে পেরেছেন। এবং আমিও এই সুযোগে ওঁর অপোগণ্ড ছেলের নামে বেশ নিন্দেমন্দ করেছি, কাঁচা গালি বাদ দিয়ে যতটা বলা যায়, ততটাই বলেছি। উনি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে শুনেছেন, ও একবার শিশুর মতোই ভ্যাঁ করে কেঁদে উঠেছেন।
এভাবেই আরও একটা দিন গেল।
আমাদের ইউনিটে রোগী ভর্তির বার ছিল বুধবার। সপ্তাহ ঘুরে সোমবার এল। আমি বিকেলের দিকে ওই এমার্জেন্সিতে সেদিনের জন্য রাউন্ড দিতে গেছি। হঠাৎই দেখি, মহিলাদের ওই ওয়ার্ডের দরজায় পর্দা সরিয়ে এক মাঝবয়সি লোক ওই মহিলার শয্যার দিকে তাকিয়ে উঁকিঝুঁকি মারছে। আমি ওই লোকের চোখের দৃষ্টি সম্পর্কে নিশ্চিত হতে না-হতেই দেখি লোকটি গায়েব। প্রায় দৌড়ে গিয়ে গেটের কাছে পৌঁছেও ওই বিকেলের ভিজিটিং আওয়ার্সের ভিড়ে একঝলক দেখা লোকটিকে আর খুঁজে পেলাম না।
সেদিনের মতো ব্যর্থ হলেও হতোদ্যম হইনি। পরের দিন স্যারকে সকালে পুরো বিষয়টা জানিয়ে, আমার ইচ্ছে ও স্যারের পরামর্শমতো মঙ্গলবার বিকেলেও স্রেফ ওই লোকটিকে পাকড়াও করতে আবার এমার্জেন্সিতে গিয়ে অপেক্ষায় রইলাম। ইতোমধ্যে সিস্টারদের কাছে জানতে পেরেছি যে, কেউই কিন্তু ওয়ার্ডের ভেতরে এসে ওঁর সঙ্গে দেখা করেনি বা খোঁজখবর নেয়নি। অতএব নজর রাখতে হবে দরজার দিকে।
শেষ পর্যন্ত দেখা গেল। আবার সেই উঁকিঝুঁকি, এবং সেই দৃষ্টির অভিমুখ ওই শয্যার দিকেই। রীতিমতো অপেশাদার গোয়েন্দার মতো দ্রুত পায়ে এগিয়ে গিয়ে পেছন থেকে প্রায় খপাৎ করে ধরে ফেলে ওয়ার্ডের ভেতরে ঠেলে ঢোকালাম লোকটিকে। এবং আগে থেকে তৈরি থাকা সিস্টার দিদিরাও এসে ঘিরে ফেলেছেন ওই ছেলেকে। মা তো ছেলেকে দেখে আকুল নয়নে কাঁদছেন। আর আমরা ফেলুদা কিংবা ব্যোমকেশের কাহিনির শেষ দৃশ্যের মতো শেষ পর্বের জেরা করে চলছি।
ছেলের বিচিত্র বক্তব্য শুনে সবাই তাজ্জব! তার ধারণা হয়েছিল, মা বোধহয় মরেই গেছেন, অথবা কিছুক্ষণ বাদেই মারা যাবেন। কিন্তু পারিবারিক ঝামেলায় ভাগের মা গঙ্গা না-ও পেতে পারেন, অর্থাৎ, অর্থ ও দায়িত্ব নেওয়ার ক্ষেত্রে দুই ছেলেমেয়ের একই মনোবৃত্তি। সেই কারণেই ভর্তির পরে প্রতিদিনই একবার করে হলেও উঁকি দিয়ে যেত এই মক্কেল। যতদিন মা অচেতন অবস্থায় ছিলেন, ততদিন শুধুমাত্র উঁকি দিয়েই কেটে পড়েছে। জ্ঞান এসেছে, মা উঠে বসছেন দেখে উঁকি দেওয়ার সময়টা বেড়েছে, ও কিছুটা হলেও আগ্রহ বেড়েছে।
প্রয়াগে নদীর মিলন হয়, মানুষের বিচ্ছেদের কাহিনিও কম নয়। তবে আমার স্যারের অভিজ্ঞতা, আন্তরিক প্রচেষ্টা ও পেশাদারি দক্ষতায় ছেলের সঙ্গে মায়ের পুনর্মিলন ঘটল মেডিক্যাল কলেজের এমার্জেন্সিতে।
পুনশ্চ: হ্যাঁ, ছুটি হয়ে যাওয়ার পরেও মাসতিনেক ওই ছেলে তার মা-কে নিয়ে আমাদের আউটডোরে দেখাতে এসেছিল।