ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2025

 
 
  • মশগুল : পর্ব ৮

    দেবাশিস মুখোপাধ্যায় (March 8, 2025)
     

    ‘আজকাল’-এর আড্ডা

    ‘আজকাল’-এর অফিস ছিল আর্মহার্স্ট স্ট্রিটের লাহাবাড়িতে। ঠিকানা ছিল, ৯৬ রাজা রামমোহন সরণি। জনান্তিকে অনেকে বলতেন, ‘নয়-ছয়ের আজকাল’। মাঝখানে সরোবরের মতো উঠোন, আর তার চারধারে অফিস ঘর। আসলে বনেদিবাড়ির ঠাকুরদালানটিকে ঢেকে ঘরগুলি তৈরি হয়েছিল। প্রতিমা রাখার জায়গাটি ছিল স্পোর্টস ডিপার্টমেন্ট। চার ধাপ শ্বেতপাথরের সিঁড়ি দিয়ে উঠেই স্পোর্টস ডিপার্টমেন্ট। তার পিছনে কম্পোজ করার ঘর। সন্ধের পর ওই সিঁড়িতে বসে চা পান ছিল আমাদের অনেকটা সান্ধ্য আরামের মতো। আর সেই সঙ্গে ছিল আড্ডার শীতল দখিনা বাতাস।

    মফসসল শহর থেকে এসে প্রথম যখন ‘আজকাল’-এ ঢুকি, একটু নার্ভাস ছিলাম। দু’একজন ছাড়া কাউকেই চিনি না। অফিসে এসে আমার নিজস্ব কাজের ঘর, লাইব্রেরিতে ঢুকে পড়তাম। দু’একবার প্রয়োজনে সম্পাদক গৌরকিশোর ঘোষ, সংস্কৃতি-সম্পাদক রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় বা সহকারী সম্পাদক মিহির সিংহর ডাকে তাঁদের ঘরে যেতাম। অফিসের সবাইকে প্রথম একসঙ্গে দেখলাম ১৫ আগস্ট। তার কয়েকদিন আগেই গৌরদা ম্যাগসাইসাই পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছেন। ডেস্কের সবাই ধরল, খাওয়াতে হবে। ঠিক হল ১৫ আগস্ট অফিস ছুটি, সেদিনই আয়োজন করা হবে। কারওরই ধারণা ছিল না, গৌরদা কী  খাওয়াবেন। গৌরদার মত অনুসারেই মেনু ঠিক হয়েছিল। খিচুড়ি-আলুর দম। সঙ্গে চাটনি, পাঁপড় আর মিষ্টি। আড্ডা, খাওয়াদাওয়া, আবার আড্ডা। তবে তার মধ্যেই গৌরদা এসে বললেন, ‘তোমরা এক-এক করে বলো, এই ক’দিনে তোমাদের কাজের অভিজ্ঞতা।’

    গৌরকিশোর ঘোষ

    ‘আজকাল’ শুরু হয়েছিল ১৯৮১-র ২৫ মার্চ। আর তার কয়েক মাস পরেই হয়েছিল এই খাওয়াদাওয়ার পর্ব। সেদিন সবার সঙ্গে আলাপ হওয়ার পরেই একটু সহজ হয়েছিলাম। সেই আড্ডার কথা এখনও মনে আছে।

    আরও পড়ুন : অমৃতায়ণ-এর আড্ডাতেই রমানাথ রায় অ্যান্টি-গল্প ম্যানিফেস্টো তৈরি করেন! প্রণবেশ মাইতি-র কলমে ‘মশগুল’-এর সপ্তম পর্ব…

    প্রথমদিকে সুযোগ পেতাম রঞ্জনদার টেবিলের সামনে বসে আড্ডা দেওয়ার। বেশিক্ষণ বসা যেত না। প্রায়ই সংস্কৃতির পাতার লেখকেরা এসে ভিড় জমাতেন। একদিন অফিসে এলেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়। তাঁকে ঘিরে সেই সিঁড়িতে তুমুল আড্ডা। শৌনক লাহিড়ী, বাপি সমাদ্দার, সূর্য ঘোষ—  সবাই ঘিরে ধরেছে। আমরাও দাঁড়িয়ে। কাজকর্ম প্রায় লাটে উঠেছে। গৌরদা এসে নিদান দিলেন, ‘এই শক্তি,তুমি একদম সন্ধের পর অফিসে ঢুকবে না। কালকে কাগজ বের করতে হবে তো!’ শুধু বলা নয়, গেটের দারোয়ানকেও বলে দেওয়া হল। কয়েকদিন পর হঠাৎ সম্মিলিত হাসির আওয়াজ শুনে ঘর থেকে বেরিয়ে এসে দেখি, শক্তি চট্টোপাধ্যায় উঠোনে গোল হয়ে দৌড়চ্ছেন আর তাঁর পিছনে দারোয়ান। শক্তিদাকে ঢুকতে বাধা দিয়েছিলেন দারোয়ান। উনি দারোয়ানের হাতের নিচে দিয়ে দৌড়ে ঢুকে পড়েছেন। সবাই ঘর থেকে বেরিয়ে ওই বিচিত্র ঘটনা দেখে হাসিতে ফেটে পড়েছে। শক্তিদার কোনও ভ্রুক্ষেপ নেই। ‘ধরতে পারে না  ধরতে পারে না!’ বলে ঘুরপাক দিচ্ছেন। এমনকী, চুরুট মুখে গৌরদাও ‘এই কী হচ্ছে, এই কী হচ্ছে!’ বলে দাঁড়িয়ে মজা দেখছেন। সত্যি ‘আজকাল’-এর অফিসটা ছিল এমনই স্নিগ্ধ বাতাস ঘেরা মরুদ্যান।

    শক্তি চট্টোপাধ্যায়

    ‘আজকাল’-এর আড্ডা ছিল মূলত রঞ্জনদা আর সমীর দত্তর টেবিল ঘিরে। সমীর দত্ত ছিলেন রবিবাসর-এর দায়িত্বে। তাঁর সামনেই প্রথমে দেখি কমল চক্রবর্তী, বিকাশ মুখোপাধ্যায়, জগন্নাথ ঘোষ, সূর্য ঘোষকে। তবে আড্ডা বলতে যা বোঝায়, তেমনটি নয়। কাজের কথাই বেশি হত। জমাটি আড্ডা বলতে যা বুঝি, তা দেখেছি, যখন  বিমল কর রবিবাসরীয় ক্রোড়পত্রর দায়িত্ব নিয়ে এলেন। প্রায় প্রতি সন্ধেয় তাঁকে ঘিরে বসতেন শেখর বসু, অতিন্দ্রীয় পাঠক, রমানাথ রায়, অনীশ দেব, তুলসী মুখোপাধ্যায়-সহ আরও কয়েকজন। সেই আড্ডায় আমাদের বসার তেমন সুযোগই ছিল না। আসলে এঁরা ছিলেন বিমল করের নিজস্ব গোষ্ঠী। যদিও পরে সবার সঙ্গেই চমৎকার আলাপ হয়ে যায়।

    কয়েকদিন পর হঠাৎ সম্মিলিত হাসির আওয়াজ শুনে ঘর থেকে বেরিয়ে এসে দেখি, শক্তি চট্টোপাধ্যায় উঠোনে গোল হয়ে দৌড়চ্ছেন আর তাঁর পিছনে দারোয়ান। শক্তিদাকে ঢুকতে বাধা দিয়েছিলেন দারোয়ান। উনি দারোয়ানের হাতের নিচে দিয়ে দৌড়ে ঢুকে পড়েছেন। সবাই ঘর থেকে বেরিয়ে ওই বিচিত্র ঘটনা দেখে হাসিতে ফেটে পড়েছে। শক্তিদার কোনও ভ্রুক্ষেপ নেই। ‘ধরতে পারে না  ধরতে পারে না!’ বলে
    ঘুরপাক দিচ্ছেন।

    রঞ্জনদা চলে যাওয়ার পর সংস্কৃতির পাতার দায়িত্বে আসে অনিরুদ্ধ ধর। কাজের পর আমাদেরই বয়সি অনিরুদ্ধের টেবিলে অনেকেই আসতেন। একবার লাহাবাড়ির ছবি তুলতে এসে বিখ্যাত  রঘুবীর সিং এলেন ‘আজকাল’ দপ্তরে। মনে আছে, সেদিন তাঁর ছবি তোলার নানান অভিজ্ঞতা শুনতে অনেকেই তাঁকে ঘিরে ধরেছিলেন। সেভাবে ‘আজকাল’-এর আড্ডা বলতে আমাদের ছিল  দেবব্রত ঘোষের ঘরে। শৌনক লাহিড়ী, অমিত ধর, শীর্ষ বন্দ্যোপাধ্যায়, অলোকপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, প্রচেত গুপ্ত— অনেকেই জমা হত। চেয়ার তো মাত্র দু’টি। আমাদের আড্ডা হত দাঁড়িয়েই। আর হত, যখন সংস্কৃতির দপ্তর উঠে এল আলাদা ঘরে। তখন দায়িত্বে পূষণ গুপ্ত। একই সঙ্গে সদ্য প্রকাশিত মাসিক টেলিভিশনের দায়িত্ব। একটু রাত হলেই আমরা জমা হতাম সংস্কৃতি দপ্তরে। পরে সেই দায়িত্বে আসে শৌনক।  সেই ঘরের এককোণে একটি টেবিল-চেয়ারে বসে আপন মনে কাজ করতেন সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়। তাঁর বুদ্ধিদীপ্ত টিপ্পনির ভক্ত ছিলাম আমরা সবাই। কাজের মধ্যেই দু-একজন এসে বসতেন তাঁর সামনের চেয়ারে। বিনা কাজেই। আমরা ছিলাম সন্দীপনদার ভক্ত। সেভাবে আড্ডার আসর না বসলেও সন্দীপনদার কথা উপভোগ করতেন ঘরের সবাই। একবার এক বিখ্যাত রবীন্দ্রসংগীত গায়ক এসেছেন সংস্কৃতি দপ্তরে। তখন দায়িত্বে শৌনক। কাজের কথার পর শৌনক আলাপ করিয়ে দিতে চাইলেন সন্দীপনদার সঙ্গে। একটু উঁচু গলায় শৌনক হাঁক পাড়ল, ‘এঁকে চেনেন সন্দীপনদা! দারুণ রবীন্দ্রসংগীত গাইছেন। খুবই নাম করেছেন। মাইক নয়, মঞ্চে গলায় ল্যাপেল আটকে গাইতে ওঠেন। চিনতে পারছেন?’

    সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়

    সন্দীপনদা কয়েক সেকেন্ডের জন্য একবার মাথাটি তুলে, ‘আরেকটু লাগবে ভাই।’ বলে মাথাটি নামিয়ে স্বগতোক্তির মতো করে জানালেন, ‘তবে শৌনক, আমাদের সময় একজন রবীন্দ্রসংগীত গাইতেন। তাঁকে চিনতাম। কণ্ঠটি ভালই ছিল। আমাদের পছন্দসই। তিনি সন্ধেবেলায় কখনও কাগজের অফিসে এসে বসে থাকতেন বলে শুনিনি। তার নাম হেমন্ত মুখোপাধ্যায়।’ বলে আবার নিজের কাজে ডুবে গেলেন।

    সমীর রায় আর ক্ষীতীশ সরকার যখন রবিবাসরে এলেন, তাঁদের আগের কাজের ক্ষেত্রেও তুমুল অভিজ্ঞতা শুনতে মৌমাছির চাকের মতো তাঁদের ঘিরে ধরতাম। সমীরদা বলতেন, ‘ট্রাম ছাড়া আমি সবই চালিয়েছি।’ পরে সমীরদা চাকরি ছেড়ে ট্যুরিস্টদের বিদেশ ভ্রমণের ব্যবসা ধরেন। আর ক্ষীতীশবাবু ছিলেন একসময়ের বিখ্যাত ‘জলসা’, ‘প্রসাদ’ প্রভৃতি সিনেমা পত্রিকার কর্মাধ্যক্ষ। শুনেছি, সকালে বোম্বাই গিয়ে কাজ সেরে আবার রাতের বিমানে কলকাতায় ফিরে আসতেন। এসব ঘটনা ছয়-সাতের দশকের কথা। তেমনই  ছিল তার অভিজ্ঞতার ঝুলি। কাগজের অফিসে আড্ডা জমে সাধারণত সাপ্তাহিক বা মাসিক পত্রিকার দপ্তরে। যেখানে দৈনিক কাজের দায়িত্ব অনেকটা কম থাকত। মাঝে মাঝে লাইব্রেরিতেও আড্ডার আসর জমে যেত। যখন কয়েকজন বিখ্যাত লেখক নিজেদের লেখার  প্রুফ দেখতে লাইব্রেরিতে আসতেন। মনোজ মিত্র, সুধীর চক্রবর্তী, আবুল বাশার মাঝে মাঝেই আসতেন। কাজ শেষে তাঁদের ঘিরে আড্ডাগুলো জাস্ট জমে যেত।

    স্পোর্টস ডিপার্টমেন্টে অনেক নামীদামি খেলোয়াররা আসতেন বটে, তবে বিভাগীয় লোকজন ছাড়া সেখানে ঢোকা নিষেধ ছিল। তবে একবার অফিসে এলেন গাভাসকার আর তাঁর বন্ধু  ভিভ রিচার্ডস— একসঙ্গে। সম্পাদক অশোক দাশগুপ্তের সঙ্গে কথাবার্তা বলার পর বেরিয়ে এলেন আমাদের সঙ্গে আলাপ করতে। তাঁদের ঘিরে আমরা সবাই। নানা কথায় স্বর্ণোজ্জ্বল হয়ে উঠল দিনটি। মনে আছে, নানা কথাবার্তার মধ্যে ভিভকে হঠাৎ বলে ফেলেছিলাম, ‘আপনার হাঁটাচলা বা ব্যাট করার শক্তি দেখে যতটা শক্ত-সমর্থ মনে হয়, সামনে থেকে কিন্তু  তেমন মনে হয় না।’

    ‘ওহ্‌,ইজ ইট!’ বলে মুহূর্তে হাতটা ভাঁজ করে বাইসেপ  দেখিয়ে বলে ওঠেন, ‘জাস্ট ফিল ইট।’ দু-হাত দিয়ে বাইসেপ পরীক্ষা করেই চমকে উঠি। সত্যিই জটায়ুর মতো বলতে হয়েছিল, ‘নাঃ, নিজে থেকে পরীক্ষা না করলে বুঝতেই পারতাম না, ভিভই হচ্ছেন একালের লোহার ভীম!’ সেই উঠোনে মঞ্চ বেঁধে তাঁদের সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছিল।

    আজকাল বড় হল, গোটা উঠোনটাতে উঠে গেল দোতলা বাড়ি। মরুদ্যান শুকিয়ে গেল।

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     



 

Rate us on Google Rate us on FaceBook