আমার বড় হওয়া বসিরহাট মফসসলে। ছোটবেলা থেকেই খেলাধুলোয় আগ্রহ ছিল। যোগাসন, জিমন্যাস্টিক থেকে জেলা বা সাব-ডিভিশন স্তরের খোখো-কবাডি খেলায় অংশ নিতাম সেই ছোটবেলাতেই। আমার বাড়ি ছিল একটু গ্রামের দিকে। বসিরহাট টাউনে যেতাম খোখো-র প্রশিক্ষণের জন্য। সেখানে, ‘শৈলারুণ শিক্ষা শিবির’-এ, প্রথম পরিচিত হই রক ক্লাইম্বিং কোর্সের সঙ্গে। বসিরহাটের ‘ট্রাভেলার্স গিল্ড’ আমার ‘মাদার ক্লাব’। তাদের উদ্যোগেই প্রথম পুরুলিয়ায় যাই রক ক্লাইম্বিং কোর্সের জন্য। বসিরহাট থেকে হাতে গোনা পাঁচ-ছ’জন মেয়ে ছিল সেই সফরে, ছেলেরা অনেকে ছিল। মেয়েদের মধ্যে আমি ছিলাম ছোট। তখন ক্লাস সেভেন-এইটে পড়ি। সেই যাওয়াটা খুব সহজ ছিল না। এমনিতে, স্পোর্টসের জন্য আমি রাতে থেকেছি বাইরে। কিন্তু পাহাড়ে উঠব শুনেই বাবা-মা পিছিয়ে গেল। কখনও কোনও কিছুতেই কিন্তু বাড়ি থেকে না বলত না। খুবই মনখারাপ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু আমার বড়দা তখন হাই স্কুলের শিক্ষক। কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ও উত্তরকাশী, গঙ্গোত্রী গিয়েছিল। ওর একটু অভিজ্ঞতা ছিল। ও আমাকে বলল, ‘তুই যাবি পুরুলিয়া?’ আমি জানালাম যে, যেতে চাই।
সেভাবেই আমার পুরুলিয়া যাওয়া, প্রথমবার। পুরুলিয়ায় রক ক্লাইম্বিং কোর্স করতে গিয়ে স্থানীয় অভিযাত্রীদের সঙ্গে পরিচিত হওয়া, শিক্ষকদের কাছে অভিযানের গল্প শোনা। এভাবেই পাহাড়ের প্রতি ভালবাসা জন্মায়। এটা তো অন্য খেলাধুলোর থেকে আলাদা। এখানে চ্যালেঞ্জটা নিজের সঙ্গে। কারও সঙ্গে প্রতিযোগিতা নেই। প্রথম হওয়ার তাগিদ নেই। এটা প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই।
আরও পড়ুন : মহিলারা কি কেবলই জোগাড়ে হয়ে থাকবেন, রাজমিস্ত্রি হবেন না? নারীশ্রমের সুলুকসন্ধান প্রহেলী ধর চৌধুরীর কলমে…
এরপর পড়াশোনা শেষ করে চাকরিতে যোগ দিলাম। সেসময় ‘হিমালয়ান ইনস্টিটিউট অফ মাউন্টেনেয়ারিং’ থেকে বেসিক মাউন্টেনেয়ারিং-এর কোর্স করেছিলাম। এভাবে পাহাড়ে অভিযানের সূত্রপাত। অ্যাডভান্সড কোর্স করি ‘সার্চ অ্যান্ড রেসকিউ’-র, উত্তরকাশী-র ‘নেহরু ইনস্টিটিউট অফ মাউন্টেনেয়ারিং’ থেকে। সেখানে আমার শিক্ষক ছিলেন রতন সিং চৌহান। তাঁর কাছেও গল্প শোনা এভারেস্ট অভিযানের। ১৯৯১-’৯২ সালে প্রথম পশ্চিমবঙ্গ থেকে এভারেস্ট অভিযান শুরু হয়। একটি সংবাদপত্রে রোববারের পাতায় সেই ঘটনা ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হত। সেগুলো আমি পড়তাম।
বিভিন্ন পর্বতারোহণের পরেও একটা স্বপ্ন ছিল এভারেস্ট অভিযানের। সেই সুযোগটা আসতে আমার অনেকটা দেরি হয়ে যায়। ইতিমধ্যে আমি বিয়ে করি, আমার সন্তান হয় ২০০৫ সালে। পাহাড়ের সঙ্গে কিছুদিন বিচ্ছিন্ন থাকি। তারপর আমাদের দপ্তর থেকে একটি লেডিজ এক্সপিডিশন হয়। আমার ছেলে তখন ক্লাস ওয়ানে পড়ে। আমার স্বামী সুদেবের মাউন্টেনেয়ারিং গিয়ারের ব্যবসা। আমি ওকে জানাই, আমি আবার পাহাড়ে যেতে চাই। ছেলেকেও জিজ্ঞেস করি, আমি পাহাড়ে গেলে ওর অসুবিধে হবে কি না। ও জানায়, ওর কোনও অসুবিধে নেই। ওই যে পাহাড়ের কাছে আবার ফিরে যাওয়া, সেই থেকেই আবার এভারেস্টের নেশা মাথা চাড়া দেওয়া শুরু।
২০১২ সালে আমি মণিরাং অভিযানে যাই। এইভাবে আস্তে আস্তে এভারেস্টের স্বপ্নটা আরও বড় হয়ে উঠি। আমাদের মতো নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের কাছে এভারেস্ট অভিযানের মতো ব্যায়বহুল একটি ঘটনা প্রায় স্বপ্নেরই মতো।
এখানে একটা কথা বলে রাখা উচিত, আমরা পাঁচ বোন, দুই ভাই। আমার বাবা-মা কোনওদিন আমাদের ছেলে-মেয়ের লিঙ্গবিভাজনের আদলে বড় করেননি। আমি যখন বিয়ের পর আবার পাহাড়ে উঠছি, তখন আমার বাড়ি থেকেও খুব সাহচর্য পেয়েছি। আমার স্বামী বলেছিল, দরকার হলে বাড়ি বিক্রি করে দেবে।
২০১৪ সালে আমার এভারেস্ট অভিযানে যাওয়া। সেই বছরেই, এভারেস্টের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় বিপর্যয় ঘটে। পৃথিবীর সবচেয়ে বিপজ্জনক আইসফল কুম্বু-তে সে-বছর সাংঘাতিক তুষারঝড় আসে। ১৬ জন শেরপা মারা যান। শেরপাদের সংগঠন সে-বছর এভারেস্ট অভিযানে আর যেতে চায় না, নেপাল সরকারের প্রচুর অনুরোধ সত্ত্বেও। ২০১৫ সালে আমরা আবার যাই। সেই বছর নেপালে ভয়ংকর ভূমিকম্প। কয়েক সেকেন্ডের ভূমিকম্পে আমাদের বেস ক্যাম্প ধ্বংস হয়ে যায়। হিমবাহ দুলছিল নৌকার মতো। আমরা দৌড়তে শুরু করি। সাড়ে ১৭,০০০ ফিটে কতটা আর দৌড়নো সম্ভব? আমি একজায়গায় এসে সমর্পণ করে দিই। থেমে যাই। আমার এক সহ-অভিযাত্রী, সে ছিল কোরীয়, সে আমাকে নাম ধরে ডাকতে থাকে। সেসময় আমি খোখো খেলার শিক্ষা মাথায় রেখে একটা ডাইভ দিই। একটি পাথরের পিছনে আশ্রয় নিই। নাক বন্ধ করে মুখ দিয়ে নিশ্বাস নিতে থাকি, যাতে মুখের নিঃশ্বাসের গরম ভাপে বরফের কণাগুলো গলে যেতে পারে।
এভাবে কতক্ষণ ছিলাম, খেয়াল নেই। আমি বেঁচে আছি না মরে গেছি, বুঝেই উঠতে পারছিলাম না। সেই অবস্থা থেকে ফিরে আসি।
এমন অভিযানে যাওয়ার আগে বাড়িতে রীতিমতো বলে যাই, কোন জিনিস কোথায় রাখা আছে। কারণ, প্রকৃতির সঙ্গে যুদ্ধে যাচ্ছি, সে যুদ্ধে জিতব কি না, কোনও নিশ্চয়তা নেই। এটা খুব অন্তরের কথা, আবেগের কথা হয়তো বলছি। যাই হোক, সেবার অভিযান থেকে ফিরে এসে মনে হয়েছিল, আর কোনওদিন পাহাড়ে যাব না। মৃত্যুকে সামনে থেকে দেখার সেই অভিজ্ঞতা কোনওদিন ভুলব না। আমার প্রতিদ্বন্দ্বীই তো প্রকৃতি, তার কাছে তো নতজানুই হতে হয়। এখানে হাততালি কুড়োনোর কোনও জায়গা নেই।
২০১৬ সালে আবার ওই অভিযানের রয়্যালটি মকুব করেছিল সরকার। সে-বছর আমার আবার যাওয়া। ২০১৫ সালে হয়তো কেউ কেউ গিয়েছিল বেস ক্যাম্প থেকে ক্যাম্প ওয়ানে, কিন্তু অনেকেই পারেনি। ২০১৬ সালে আমি যখন ক্যাম্প ওয়ান অ্যাক্লেমেটাইজ করে নেমে আসি, তখন সেটাই আমার কাছে একটা বড় অর্জন ছিল। বেস ক্যাম্পে এসে আবহাওয়ার সঙ্গে খাপ খাওয়ানো-সহ আরও কিছু প্রস্তুতি চলছিল।
ক্যাম্প ফোরে আমরা পৌঁছই। সেই কিন্তু ‘ডেথ জোন’-এ ঢুকে যাওয়া। আমার তখন পাঁচ বোতল অক্সিজেনের প্রয়োজন ছিল, আর আমার ব্যক্তিগত যে শেরপা, তার লাগবে তিন বোতল অক্সিজেন। ক্যাম্প ফোরে পৌঁছে দেখলাম, আটটার মধ্যে দুটো সিলিন্ডার নেই। খুব কম অক্সিজেন নিয়ে নিয়ে সেই হিসেবে ভারসাম্য আনি।
আমার সহ-অভিযাত্রীরা তিনজনেই ছিল পুরুষ। রাত সাড়ে সাতটায় আমরা ফাইনাল পুশ আপে বেরই। ভোরের মধ্যে ব্যালকনিতে পৌঁছেও যাই। বুঝতে পারি, একজন সহযাত্রী এগিয়ে গিয়েছে আগেই। এর ফাঁকে আমার ব্যক্তিগত শেরপা-ও এগিয়ে যায়। আমার ব্যক্তিগত ক্যামেরাও ছিল তাঁর কাছে। সামিটের ছবি তোলার জন্য নিয়ে এসেছিলাম। কিন্তু তার জন্য আর অপেক্ষা করি না। এগিয়ে যাই, সামিট সম্পন্ন করি। নামতে থাকি ব্যালকনির দিকে।
এদিকে কোনও অক্সিজেন নেই, অন্যদিকে আমাদের হাতে ফ্রস্টবাইট শুরু হয়। শেষে একজনকে পাই, যাঁর কাছে অসহায়ভাবে প্রার্থনা করি, ‘একটু অক্সিজেন দাও, আমার পরিবার আছে, আমি বাঁচতে চাই।’
ব্যালকনিতে এসে যখন পৌঁছেছি, তখন আমরা বিধ্বস্ত। আমার ব্যক্তিগত শেরপা তখন ফাঁকা সিলিন্ডারগুলো থেকে অক্সিজেন সংগ্রহ করছে, সেও তো মানুষ! আমাদের তখন অক্সিজেন নেই। এবং আমরা এতটাই ক্লান্ত, ওখানে আমরা প্রায় আধা-ঘুমন্ত অবস্থায় চলে যাই। শরীর আর দিচ্ছে না। শেরপাই তখন আমাদের হুঁশ ফেরায়। বলে, ‘এখানে মরবে নাকি!’ আমরা নামতে শুরু করি কোনওমতে। প্রথমে দাঁড়িয়ে, তারপর বসে, তারপর শুয়ে পড়ে। আমার সামনের অভিযাত্রী থেমে যাচ্ছিল বারবার, আমি তার আগেও এগতে পারব না, হুক, অ্যাঙ্কর— সব বদলাতে হবে। তার মধ্যেও অ্যাঙ্কর বদলাতে বদলাতে নামতে থাকি।
এদিকে কোনও অক্সিজেন নেই, অন্যদিকে আমাদের হাতে ফ্রস্টবাইট শুরু হয়। শেষে একজনকে পাই, যাঁর কাছে অসহায়ভাবে প্রার্থনা করি, ‘একটু অক্সিজেন দাও, আমার পরিবার আছে, আমি বাঁচতে চাই।’
তিনি আমাকে কীভাবে নামিয়ে আনেন, সে এক রোমহর্ষক কাহিনি। তিনি লেসলি জন বিনস। ব্রিটিশ ক্লাইম্বার, আগে সেনাবাহিনীতে ছিলেন। একটি চোখে দেখতে পান না। তিনি প্রায় দেবদূতের মতো ছিলেন সেখানে। পরের দিন তাঁর সামিট ছিল, সেসব উপেক্ষা করেই তিনি আমাকে নামিয়ে আনেন। লেসলির সূত্রেই আমার শেরপা, আমার সহযাত্রীদের খুঁজে পাই। এমন মানবিকতার পরিচয় ক’জন দিতে পারে!
এরপর ক্যাম্প থ্রি-তে নেমে আসি। সেটা ছিল প্রায় একার লড়াই। আমার শেরপা আমাকে আবারও ছেড়ে যায়। সে কাহিনি অন্য কোথাও বলব!
এর মাঝে, আমার বাড়িতে সরকারিভাবে খবর গিয়েছিল নেপাল সরকার থেকে, আমি মৃত। অতক্ষণ কোনও শেরপার সাহায্য ছাড়া, অক্সিজেন ছাড়া, খাবার ছাড়া কাটানো সম্ভব নয় জেনেই, সরকার এমনটা ধরে নিয়েছিল। কিন্তু জীবনের অমোঘ টান আমাকে লড়াই করার শক্তি জুগিয়ে গিয়েছিল টানা। বেস ক্যাম্পে নেমে আসি সেই শক্তির জোরেই।
আমার সহযাত্রীরা কেউ আর জীবিত নেই, একথা ভাবলে এখনও বিষণ্ণ লাগে। মনে আছে, মনের জোরে নেমে আসার পর, যখন হেলিকপ্টারে উঠেছি, তখন মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিলাম, আর নিজেকে ধরে রাখতে পারিনি।