ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2025

 
 
  • স্বপ্নের আখ্যানকার

    রাহুল দাশগুপ্ত (March 6, 2025)
     

    বিশ শতকের লাতিন আমেরিকায় আখ্যানের যে গৌরববৃদ্ধি হয়, তার সঙ্গে একমাত্র তুলনীয় উনিশ শতকের ইউরোপ। গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসকে বুঝতে হলে, তিনি যে সমৃদ্ধশালী ঐতিহ্যের অংশ, সেটাকে আগে বোঝা দরকার। তিনি যে ধারায় আখ্যান রচনা করেছেন, সেই ধারায় তিনি একা নন, অনেকে মিলেই একটা ঐতিহ্য সৃষ্টি করে গেছেন। যদিও তাঁদের মধ্যে গার্সিয়া মার্কেসের নামই গোটা পৃথিবীতে উজ্জ্বলতম হরফে লেখা রয়েছে। অনেকের একজন হয়েও যেভাবে তিনি নিজের অদ্বিতীয় মৌলিকতাকে প্রতিষ্ঠা করে গেছেন, তা এক অননুকরণীয় দৃষ্টান্তই বটে!

    লাতিন আমেরিকার উপন্যাসকে এক স্বতন্ত্র রূপ দেওয়ার প্রয়াস শুরু হয় যাঁদের হাতে, তাঁদের মধ্যে চারজনকে পথিকৃতের মর্যাদা দেওয়া যায়। এঁরা হলেন, গুয়াতেমালার মিগুয়েল আনহেল আস্তুরিয়াস (১৮৯৯-১৯৭৪), আর্জেন্তিনার হোর্হে লুই বোর্হেস (১৮৯৯-১৯৮৬), কিউবার আলেহো কার্পেন্তিয়ের (১৯০৪-’৮০) এবং মেক্সিকোর হুয়ান রুলফো (১৯১৭-’৮৬)। এদের পাশাপাশি অসামান্য কৃতিত্ব দেখিয়েছেন মাসেদোনিও ফার্নান্দেজ (১৮৭৪-১৯৫২), লিওপোল্ডো মার্সেল (১৯০০-’৭০), ইকুয়েডরের দেমেত্রিও আগুইলেরা মালতা (১৯০৯-’৮১), উরুগুয়ের হুয়ান কার্লোস ওনেত্তি (১৯০৯-১৯৯৪), কিউবার হোসে লেজামা লিমা (১৯১০-’৭৬), পেরুর হোসে মারিয়া আরগেদাস (১৯১১-’৬৯), আর্জেন্তিনার আর্নেস্তো সাবাতো (১৯১১-২০১১), প্যারাগুয়ের আউগাস্তো রোয়া বাস্তোস (১৯১৭-২০০৫)। এরা সবাই স্প্যানিশ ভাষার লেখক। পর্তুগিজ ভাষার লেখকদের কথা এখানে অনুল্লেখিতই রইল। এরা সবাই এমন কিছু উপন্যাস লিখেছিলেন, যা বিশ্বসাহিত্যে চিরকাল থেকে যাওয়ার মতো ধ্রুপদী কাজ হিসেবে ইতিমধ্যেই স্বীকৃত।

    আরও পড়ুন : উল্টোদিকে হাঁটা ডন কিহোতে-কেই পৃথিবীর দরকার এখন! লিখছেন সুমন মুখোপাধ্যায়

    এই উপন্যাসগুলির মধ্যে রয়েছে, আস্তুরিয়াসের ‘দি প্রেসিডেন্ট’ (১৯৪৬) এবং ‘মেন অফ মেইজ’ (১৯৪৯), কার্পেন্তিয়েরের ‘দি কিংডম অফ দিস ওয়ার্ল্ড’ (১৯৪৯), ‘দি লস্ট স্টেপস’ (১৯৫৩), এবং ‘এক্সপ্লোশন ইন আ ক্যাথিড্রাল’ (১৯৬২), রুলফোর ‘পেদ্রো পারামো’ (১৯৫৫), ফার্নান্দেজের ‘দি মিউজিয়াম অফ ইটার্না’স নভেল’ (১৯৬৭), মার্সেলের, ‘আদান বুয়েনোসায়রেস’ (১৯৪৮), আগুইলেরা মালতার ‘সেভেন সারপেন্টস অ্যান্ড সেভেন মুনস’ (১৯৭০), কার্লোস ওনেত্তির ‘আ ব্রিফ লাইফ’ (১৯৫০) এবং ‘দি শিপইয়ার্ড’ (১৯৬১), লেজামা লিমার ‘প্যারাদিসো’ (১৯৬৬), মারিয়া আরগেদাসের ‘ডিপ রিভারস’ (১৯৫৮), সাবাতোর ‘অন হিরোজ অ্যান্ড টম্বস’ (১৯৬১), রোয়া বাস্তোসের ‘আই, দি সুপ্রিম’ (১৯৭৪)। অর্থাৎ, গার্সিয়া মার্কেস এবং ‘লাতিন আমেরিকান বুম’-এর বাকি লেখকদের স্বমহিমায় অবতীর্ণ হওয়ার ক্ষেত্র প্রস্তুতই ছিল।

    ‘লাতিন আমেরিকান বুম’ বলতে যে কয়েকজন দিকপাল লেখককে বোঝায়, তাঁদের মধ্যে গার্সিয়া মার্কেস ছাড়াও ছিলেন, হুলিও কোর্তাসার (১৯১৪-৮৪), হোসে দোনেসো (১৯২৪-৯৬), কার্লোস ফুয়েন্তেস (১৯২৮-২০১২), গুইলার্মো ক্যাব্রেরা ইনফান্তে (১৯২৯-২০০৫), ম্যানুয়েল পুইগ (১৯৩২-৯০) এবং মারিও ভার্গাস লোসা (১৯৩৬)। এঁরা প্রত্যেকেই উপন্যাস রচনায় অসামান্য কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। কোর্তাসারের ‘হপস্কচ’ (১৯৬৩), দোনেসোর ‘দি অবসিন বার্ড অফ নাইট’ (১৯৭০), ফুয়েন্তেসের ‘দি ডেথ অফ আর্তেমিও ক্রুজ’ (১৯৬২), ‘তেররা নোসট্রা’ (১৯৭৫) এবং ‘দি ওল্ড গ্রিঙ্গো’ (১৯৮৫), ক্যাব্রেরা ইনফান্তের ‘থ্রি ট্র্যাপড টাইগার্স’ (১৯৬৭), পুইগের ‘কিস অফ দ্য স্পাইডার উওম্যান’ (১৯৭৬) এবং লোসার ‘দি গ্রিন হাউস’ (১৯৬৫), ‘কনভারসেশন ইন দ্য ক্যাথিড্রাল’ (১৯৬৯) এবং ‘দি ওয়ার অফ দ্য এন্ড অফ দ্য ওয়ার্ল্ড’ (১৯৮১)। বিশ শতকের উপন্যাসে এক-একটি মাইলস্টোন হিসেবে স্বীকৃত। পরবর্তীকালে যদিও লিখতে এসেছেন, ইসাবেল আইয়েন্দে (১৯৪২), জুলিয়া আলভারেজ (১৯৫০) এবং বিশেষ করে রবার্তো বোলোনো (১৯৫৩-২০০৩)-র মতো লেখক, তবু বুম-পর্ব মোটামুটিভাবে ভার্গাস লোসায় এসে শেষ হয়ে গেছে বলেই ধরা যায়।

    লেখায় কোনও আপস বা সমঝোতা নেই

    এই বুম-পর্বের উজ্জ্বলতম লেখক গার্সিয়া মার্কেসের লেখায় বারবার বিষয় হিসেবে এসেছে, নিঃসঙ্গতা। লাতিন আমেরিকার অন্য বহু লেখকের মতোই, তিনিও একটি কাল্পনিক ভূখণ্ড সৃষ্টি করেছিলেন, যার নাম দিয়েছিলেন, মাকোন্দো। আলেহো কার্পেন্তিয়ের, মিগুয়েল আনহেল আস্তুরিয়াস ও হুয়ান রুলফোর হাতে যে ‘জাদুবাস্তবতা’-র সূত্রপাত, তাঁকে এক সার্থক রূপ দিয়েছিলেন যেসব লেখক, তাঁদের পুরোধা ছিলেন, গার্সিয়া মার্কেস। বাকিরা হলেন, হুলিও কোর্তাসার, কার্লোস ফুয়েন্তেস, মারিও ভার্গাস লোসা, হোসে দোনেসো এবং ম্যানুয়েল পুইগ। এই ঘটনাই ‘লাতিন আমেরিকান বুম’ নামে পরিচিত। এরই সার্থক প্রয়োগ দেখা যায় তাঁর বিশ্ববন্দিত ‘নিঃসঙ্গতার একশো বছর’ উপন্যাসে। মাকোন্দোর একশো বছরের ইতিবৃত্ত এই উপন্যাসে বিধৃত। পাবলো নেরুদা এই উপন্যাসটিকে মিগুয়েল দ্য সার্ভান্তিসের ‘দন কিহোতে’-র পর স্প্যানিশ গদ্যসাহিত্যের সবচেয়ে বড় ঘটনা বলে উল্লেখ করেছিলেন।

    প্রসঙ্গত, জাদুবাস্তবতা মানে আমাদের বাস্তবতার ভেতরের অলৌকিক আর আশ্চর্য। গদ্যশৈলীর এই বিশেষ ধারাটিকেই গোটা বিশ্বে অত্যন্ত জনপ্রিয় করে তোলেন গার্সিয়া মার্কেস। অর্ধেক স্বপ্ন আর অর্ধেক দুর্নীতির ভেতর লাতিন আমেরিকার যে জীবন-যাপন, স্বৈরাচারের ঘেরাটোপে ও সাম্রাজ্যবাদী শক্তির আগ্রাসনের মুখোমুখি যেখানে নিরন্তর উত্তরণের প্রয়াস, তারই আখ্যান গার্সিয়া মার্কেসের রচনাগুলি। তাই সেখানে পাওয়া যায় বাস্তবকে দেখার এক জাদুময়, অতি-প্রাকৃতিক দৃষ্টিভঙ্গি। ফ্রানৎস কাফকা আর উইলিয়ম ফকনারের জগৎ দারুণভাবে প্রভাবিত করেছে তাঁকে। আর তিনি অনেক কিছু শিখেছেন লাতিন আমেরিকার দুই মহৎ লেখক কার্পেন্তিয়ের আর রুলফোর কাছ থেকে।

    আগেই যে প্রশ্নটা তোলা হয়েছে, সেখানেই যদি ফেরা যায়, তাহলে দেখা যাবে, এক সমৃদ্ধ ঐতিহ্যের অংশীদার হয়েও জনপ্রিয়তায় গার্সিয়া মার্কেস সবাইকে ছাপিয়ে গেছেন কয়েকটি বিশেষ কারণে। তিনি রস ও কৌতুক মিশিয়ে অসম্ভব জমিয়ে গল্প বলতে জানেন। যদিও সেই গল্পগুলিতে আদ্যোপান্ত মিশে থাকে রাজনৈতিক ও দার্শনিক অভিজ্ঞতা ও উপলব্ধি। গল্পগুলি পাঠক পড়ে যান অপ্রতিরোধ্য গতিতে। কিন্তু এমন তার ভার, তার ওজন, ফলে পাঠ-অভিজ্ঞতার পর শিউরে উঠতে হয়, বিপন্ন হতে হয়। জীবন ও জগতের এক নিষ্ঠুর ছবি উঠে আসে, যেখানে প্রাতিষ্ঠানিক চাপে ব্যক্তিমানুষের স্বাধীনতা, স্বপ্ন, স্মৃতি বা যাপন বারবার আক্রান্ত হতে থাকে। এখানেই গার্সিয়া মার্কেস সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। তিনি কখনওই পাঠকের মনোরঞ্জনের জন্য লেখেন না। তাঁর লেখায় কোনও আপস বা সমঝোতা নেই। বরং সমস্ত চাপ, আগ্রাসন, অন্যায় ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে তিনি সর্বদাই সোচ্চার। পাঠক সেই জগতের ভেতর নিমজ্জিত হতে বাধ্য হয়, যদিও তার তাপ তাদের দগ্ধ করে না।

    গার্সিয়া মার্কেস যেন দেখাতে চান, প্রতিষ্ঠান নিজের স্বৈরাচার ও পাগলামিকে ঢাকা দেওয়ার জন্য যাবতীয় সুস্থতাকে পাগলামি বলে চালাতে চায়। কারণ, সুস্থতাকে স্বীকৃতি দিলে তার সাপেক্ষে তাদের নিজেদের অসংগতিগুলি প্রকাশ্য হয়ে যাবে। নিজেকে সুস্থ দেখাতে প্রতিষ্ঠান তাই প্রকৃত সুস্থতাকে বিকৃত করে। কারণ প্রকৃত সুস্থতা কোনও প্রতিষ্ঠানের অসুস্থতার পক্ষে সর্বদাই বিপজ্জনক। কুকুরে কামড়ানো এখানে নেহাতই এক উপলক্ষ মাত্র।

    ফ্রানৎস কাফকার মতোই গার্সিয়া মার্কেস প্রতিটি লেখাতেই একটি করে রূপকের জগৎ তৈরি করেন। রূপক সেই আবরণের কাজ করে, যা দ্রষ্টব্যের তীব্র আগুন থেকে দ্রষ্টাকে রক্ষা করে। ‘অফ লাভ অ্যান্ড আদার ডেমনস’ উপন্যাসটির কথাই ভাবা যাক। এই কাহিনির মধ্যমণি এক নারী, যার নাম, সিয়েরভা মারিয়া। গোড়াতেই তাকে একটি কুকুর কামড়ে দেয়। আর এই তুচ্ছ ঘটনাই হয়ে ওঠে একটি বিরাট সুযোগ। গোটা শহর এই মেয়েটিকে পাগল হিসাবে প্রতিপন্ন করতে চায়। চায়, কারণ গোটা শহরে এই মেয়েটিই একমাত্র সুস্থ। মেয়েটি নিষ্পাপ হৃদয়ে প্রেমে পড়ে আর সেই প্রেমকেও বিকৃত করা হয়, অসুস্থতা বলে দেখানোর চেষ্টা করা হয়। মেয়েটিকে পাগল হিসেবে প্রতিপন্ন করার জন্য গোটা শহরটাই যেন উন্মাদ হয়ে ওঠে। তাদের সেই পাগলামি যেন বড় বেশি করে চোখে পড়ে এই কাহিনিতে। মেয়েটিকে তারা যত বেশি করে পাগল হিসেবে দেখাতে চায়, তত বেশি তাদের নিজেদের পাগলামি যেন প্রকট হয়ে ওঠে। আর সেই ভয়াবহ পাগলামির প্রতাপে শেষ-পর্যন্ত আত্ম-বলিদান করতে হয় শহরের একমাত্র সুস্থ মেয়েটিকে।

    গার্সিয়া মার্কেস যেন দেখাতে চান, প্রতিষ্ঠান নিজের স্বৈরাচার ও পাগলামিকে ঢাকা দেওয়ার জন্য যাবতীয় সুস্থতাকে পাগলামি বলে চালাতে চায়। কারণ, সুস্থতাকে স্বীকৃতি দিলে তার সাপেক্ষে তাদের নিজেদের অসংগতিগুলি প্রকাশ্য হয়ে যাবে। নিজেকে সুস্থ দেখাতে প্রতিষ্ঠান তাই প্রকৃত সুস্থতাকে বিকৃত করে। কারণ প্রকৃত সুস্থতা কোনও প্রতিষ্ঠানের অসুস্থতার পক্ষে সর্বদাই বিপজ্জনক। কুকুরে কামড়ানো এখানে নেহাতই এক উপলক্ষ মাত্র। এটাই প্রতিষ্ঠানের কাছে হয়ে ওঠে হাতের পাঁচ। মেয়েটি পাগল হলে শহরটি সুস্থ। কিন্তু মেয়েটির সুস্থতাকে মেনে নিলে শহরটির অসুস্থতা ধরা পড়ে যাবে। তাই মেয়েটিকে ক্রমাগত পাগল বলে প্রতিপন্ন করতে চায় শহর। কারণ তাহলেই তারা নিজেরা যে সুস্থ ও স্বাভাবিক, সেটাই প্রতিপন্ন করা যাবে। কিন্তু শ্লেষ এখানেই যে, যত শহরটি তা চায়, তত তার পাগলামি আর অসুস্থতা আরও বেশি করে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এখানেই গার্সিয়া মার্কেস তাঁর আসল জাদু দেখিয়েছেন। নিজেকে ঢাকতে গিয়ে প্রতিষ্ঠান কীভাবে আরও বেশি করে উলঙ্গ হয়ে যায়, তা তিনি বেআব্রু করেছেন এই আখ্যানে।

    এরকমই একটি আশ্চর্য উপন্যাস, ‘ক্রনিকল অফ আ ডেথ ফোরটোল্ড’। এই কাহিনির গোড়া থেকেই সান্তিয়াগো নাসার জানে যে, তাকে কবে, কোন সময়ে, কোথায়, কীভাবে হত্যা করা হবে। সে ওই হত্যার থেকে পালাতে চায়। নিষ্কৃতি পেতে চায়। গোটা উপন্যাসে সে নানাভাবে ওই পূর্বঘোষিত মৃত্যুর হাত থেকে পালানোর পথ খোঁজে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পারে না। পূর্বঘোষণা অনুযায়ী, ঠিক যেভাবে, যে সময়ে, এবং যে স্থানে তার মৃত্যু হওয়ার কথা, সেভাবেই হত্যা করা হয় সান্তিয়াগোকে। প্রশ্ন হল, কেন ঠেকানো গেল না সান্তিয়াগোর মৃত্যুকে? সবাই জানত, কবে, কোথায়, কীভাবে সান্তিয়াগোকে হত্যা করা হবে, অথচ একটা নরহত্যাকে ঠেকানো গেল না? কেন গেল না?

    হিংসা ও স্বৈরাচারের আগ্রাসনের সামনে মানুষের অসহায়তা ও বিপন্নতার এমন রূপক বিশ্বসাহিত্যে আর ক’টা আছে বলা কঠিন। অবশ্যাম্ভাবী তুলনা হিসেবে আমাদের মনে পড়তে পারে, ফ্রানৎস কাফকার ‘দি ট্রায়াল’। সেখানেও যেমন কাফকা দেখাতে চেয়েছেন, এক হিংসাশ্রয়ী ও স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থায় মানুষ আমৃত্য দণ্ডপ্রাপ্ত। সে জানে না, তার অপরাধ কী। আমৃত্যু তাকে কাটাতে হয় ত্রাসে ও অপরাধবোধে। আর শেষ পর্যন্ত সে কী অপরাধ করেছে, তা না জেনেই তাকে চরম দণ্ড পেতে হয়।

    হিংসা, ক্ষমতা, স্বৈরাচার, সাম্রাজ্যবাদ ও ঔপনিবেশিকতার নানারকম প্রাতিষ্ঠানিক ছবি ও তার ভেতরে মানুষের বিপন্নতা ও দ্রোহের কথা গার্সিয়া মার্কেস লিখে গেছেন। ‘হানড্রেড ইয়ার্স অফ সলিটিউড’ উপন্যাসে তিনি লিখেছেন, বোয়েনদিয়া পরিবারের একশো বছরের ইতিহাসের কথা, আর সেই পারিবারিক ইতিহাস উপলক্ষ করে তিনি রচনা করতে চেয়েছেন প্রতিষ্ঠান ও স্বাধীনতার সংঘাতময় ঐতিহ্যের এক মহাকাব্যিক মানচিত্র। আর এই স্বাধীনতারই প্রকাশ ঘটেছে ওই পরিবারের প্রতিটি মানুষের আশ্চর্য সৃজনশীলতায়। যুদ্ধে হোক বা যৌনতায়, রাজনীতিতে হোক বা উৎসবে, তারা সর্বদাই যে যার নিজের মতো করে মৌলিক ও প্রবল উদ্ভাবনী ক্ষমতাসম্পন্ন। আর এখানেই ক্ষমতা ও প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তাদের নিত্য-বিরোধ। এত মৌলিক বলেই তারা প্রত্যেকে যে যার নিজের স্মৃতি ও খেয়াল, স্বপ্ন ও কল্পনার জগতে বন্দি। এই বন্দিত্ব থেকে তাদের মুক্তি নেই। এ তাদের পরাজয় নয়, এ তাদের উত্তরণও নয়, কিন্তু এটাই তাদের বাস্তবতা, জাদুবাস্তবতার সীমান্তে যার অবস্থান!

    ‘দি অটাম অফ দি প্যাট্রিয়ার্ক’ এবং ‘দি জেনারেল ইন হিজ ল্যাবিরিন্থ’ যেন একে-অপরের পরিপূরক। প্রথমটি এক স্বৈরাচারীর অন্তর্জগতের মানচিত্র, যেখানে স্বৈরাচারকে অতিরঞ্জিত করে তার ভেতরের যাবতীয় অসংগতি ও পাপকে এমন এক সীমাহীনতায় নিয়ে গেছেন গার্সিয়া মার্কেস, যা শেষ পর্যন্ত এক হাস্যকর অথচ শ্বাসরুদ্ধকর স্তরে পৌঁছে গেছে। দ্বিতীয়টিতেই আবার রয়েছে গোটা লাতিন আমেরিকার মুক্তিদাতা সিমন বলিভারের কাহিনি, স্বৈরাচারের বিরুদ্ধেই তাঁর চিরন্তন দ্রোহ, নিজেই যিনি একটি প্রতীক, যদিও সেই প্রতীকের আড়ালে বহমান এক ব্যক্তি-মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা, স্মৃতি-স্বপ্ন-কল্পনার সমান্তরাল জীবন।

    প্রসঙ্গত, লাতিন আমেরিকার তিন দিকপাল লেখক ঠিক করেন, তাঁরা প্রত্যেকে স্বৈরাচার নিয়ে একটি করে উপন্যাস লিখবেন। এই তিনজনের মধ্যে আউগাস্তো রোয়া বাস্তোস লেখেন, ‘আই, দি সুপ্রিম’, আলেহো কার্পেস্তিয়ের লেখেন, ‘রিজনস অফ স্টেট’ এবং গার্সিয়া মার্কেস লেখেন, ‘অটাম অফ দি প্যাট্রিয়ার্ক’। অবশ্য এর আগেই স্বৈরাচার নিয়ে মিগুয়েল আনহেল আস্তুরিয়াস লিখে ফেলেছেন, ‘দি প্রেসিডেন্ট।’

    গার্সিয়া মার্কেসের আরও একটা অসম্ভব গুরুত্বপূর্ণ লেখা, ‘লাভ ইন দ্য টাইম অফ কলেরা।’ প্রেম ও যৌনতা নিয়ে, তাদের অক্ষয়তা নিয়ে, এমন রচনা সাম্প্রতিক বিশ্বসাহিত্যে আর দ্বিতীয় কোনও আছে কি না, সন্দেহ! ফ্লোরেন্তিনো ভালবাসত ফারমিনোকে, কিন্তু ফারমিনোর বিয়ে হয়ে যায় ডাক্তার জুভেনাল উরবিনোর সঙ্গে। পঞ্চাশ বছরের সুখী দাম্পত্য জীবনের পর ডাক্তারের মৃত্যু হয়। কিন্তু যে প্রেম অক্ষয়, তার কাছে পঞ্চাশ বছর কী এমন সময়! তাই ফ্লোরেন্তিনো আর ফারমিনোর মিলন হয় পঞ্চাশ বছর পর, বার্ধক্যে পৌঁছে। প্রেম আর কলেরাকে এই উপন্যাসে মিলিয়ে দেওয়া হয়েছে বিভ্রান্তিল মাধ্যমে। ফারমিনোর প্রেমে পড়ার পর ফ্লোরেন্তিনোর মধ্যে কলেরার লক্ষ্মণ দেখা দেয়। আর ফারমিনোর কলেরা হলে, তা পরীক্ষা করতে এসেই ডাক্তার মেয়েটির প্রেমে পড়ে যায়, যদিও ফারমিনোর কলেরা হয়নি, সাধারণ অসুখই হয়েছিল।

    কিন্তু কলেরা যদি হয় মৃত্যু ও ধ্বংসের প্রতীক, তবে সেই ধ্বংসকে অতিক্রম করার মধ্যেই তো প্রেমের সার্থকতা। তাই উপন্যাসের শেষে দুই প্রেমিক-প্রেমিকা জাহাজে ভেসে চলে অনন্তকাল ধরে আর এভাবে ভাসবে বলে, তাদের প্রেম সময়-অতিক্রান্ত বলেই, তাদের জাহাজ কলেরার সংকেতকে বহন করে চলে। আর এভাবেই ধ্বংসের ইঙ্গিত বহন করে চলে যে জাহাজ, তা আসলে হয়ে ওঠে অনিঃশেষ প্রেমের রূপক। জীবনের দ্ব্যর্থবোধকতাকে এভাবেই শ্লেষে আর চমৎকারিত্বে ফুটিয়ে তুলেছেন গার্সিয়া মার্কেস।

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     



 

Rate us on Google Rate us on FaceBook