ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2025

 
 
  • মনডে ব্লুজ : পর্ব ৪

    জয়দীপ ঘোষ (February 3, 2025)
     

    রবি আলসেমির, সোম অ্যালার্মের

    সূর্য, চাঁদ আর খালি-চোখে-দেখা-যায়, এমন পাঁচখানা গ্রহের নাম তুলে নিয়ে তৈরি হয়ে উঠেছে আমাদের সপ্তাহের সাতটা দিনের নাম। কিন্তু এই সাতের মধ্যে উজ্জ্বলতম যে-দুটি জ্যোতিষ্ক— সূর্য আর চাঁদ— তাদের দখল পেয়েছে সপ্তাহের সবচেয়ে বিপরীতমুখী দুটো দিন, রবি আর সোম। রবি ছুটির, সোম কাজের। রবি ঘরের, সোম বাইরের। রবি আলসেমির, সোম অ্যালার্মের। এমনিতে মঙ্গল বা বুধের সঙ্গে সোমের তেমন কোনও তফাত নেই বটে, কিন্তু ওই-যে ছুটির দিনটার পরে প্রথম ও-ই হাত ধরে কাজের দিকে টান দিল, তাতেই সোমের কপাল পুড়ল। সে হয়ে উঠল খলনায়ক!

    কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে যাঁরা পড়ান, নিয়মানুসারে সপ্তাহে পাঁচদিন তাঁদের কর্মস্থলে যেতে হয়। রবিবার তো ছুটিই। সেই সঙ্গে আর একটি দিন ‘প্রিপারেটরি ডে’ হিসেবে তাঁদের বাড়িতে থাকার জন্য বরাদ্দ হয়। কোন দিন? না, এর কোনও নির্দিষ্ট দিন নেই। সংশ্লিষ্ট অধ্যাপক সোম থেকে শনির মধ্যে যে কোনও একটি দিনকে বেছে নিতে পারেন নিজের মতো করে। হাতের কাছে কোনও পরিসংখ্যান নেই, কিন্তু ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে জানি, কলেজে কলেজে যে-দিনটিকে ওই ঘিরে ওই ‘প্রিপারেটরি ডে’-র চাহিদা তুঙ্গে ওঠে, সে আর কোনওদিন নয়, সোমবার। কেন, ঠিক সোমবারই কেন? রবি-সোম পরপর দু’দিন একসঙ্গে পাওয়া গেল বলে? সে তো শনিবারকে বেছে নিলেও তাই-ই হত। কিন্তু সোমবারের মনস্তত্ত্বের সঙ্গে শনিবার পাল্লা দিতে পারবে কেন! ওই-যে সপ্তাহের ‘শুরু’-টা ছুটির পেটে ঢুকিয়ে দেওয়া গেল, এর এক গোপন আনন্দ আছে। চাকুরিজীবী হতভাগা ছাড়া এর তাৎপর্য সকলে বুঝবেন না। কিন্তু সপ্তাহের ‘শুরু’-টা মানে? সোমবারের বদলে যদি কারও সপ্তাহ মঙ্গলবার থেকে শুরু হয়, তাতেই-বা কী এল গেল? পাঁচদিন কাজে ফেরার হিসেব তো একই রইল, না?

    আরও পড়ুন: শনি-রবিবারই বেছে বেছে পড়ত মন্ত্রীদের প্রেস কনফারেন্স!
    পড়ুন জয়ন্ত ঘোষালের কলমে মনডে ব্লুজ পর্ব ৩…

    এ-প্রসঙ্গে একটা ‘জোক’ মনে পড়ে যায়। চাকুরিজীবী মহলে এই জোক জনপ্রিয়। এক মন্ত্রী ট্রেনে উঠেছেন, ট্রেনের শেষ কামরায় তাঁর জন্য বিশেষ ব্যবস্থা করা হয়েছে, সেখানেই তিনি আরাম করে সফর করছেন। কী-একটা স্টেশনে, হঠাৎ তিনি লক্ষ করলেন, তাঁর সেই শেষ কামরাটি প্ল্যাটফর্মের বাইরে রয়ে গেছে। প্ল্যাটফর্ম ছোট, পুরো ট্রেন তাতে ধরেনি। রেগে গেলেন মন্ত্রীমশাই। শহরে ফিরে তিনি কড়া ভাষায় রিপোর্ট দিলেন: এরপর থেকে কোনও ট্রেনে যেন শেষ কামরা বলে কিছু না-থাকে। আর যদি-বা শেষ কামরা থাকেও, তাকে যেন ট্রেনের মাঝামাঝি রাখা হয়!

    মন্ত্রীমশাইয়ের বোকামিতে হাসার আগে এ বঙ্গের সমস্ত চাকুরিজীবীকে জিজ্ঞাসা করে দেখুন, তাঁদেরও মনের কথা কতকটা এইরকম। সপ্তাহে যেন কোনও ‘সোমবার’ না থাকে। আর যদি-বা থাকে, তা হলে যেন তাকে সপ্তাহের মাঝামাঝি রাখা হয়!

    এ-আর আশ্চর্য কী যে, রবীন্দ্রনাথের একটা ছড়ার নামই হয়ে উঠবে ‘রবিবার’! আর সেই ছড়ায় সকলের ওপরে জেগে থাকবে একধরনের প্রতিপক্ষতা। সোম-মঙ্গল-বুধের সঙ্গে রবিবারের লড়াই। ‘সোম মঙ্গল বুধের যেন মুখগুলো সব হাঁড়ি’। অন্যদিকে ‘রবিবারের মুখে দেখি হাসিই আছে লেগে।’

    উপরের গপ্প এবং মন্তব্য কৌতুকের বটে, কিন্তু খুবই বিমর্ষ কৌতুক। এককালে দ্বারকানাথ ঠাকুর কিংবা প্রফুল্লচন্দ্র রায়রা বাঙালিকে স্বাধীন ব্যবসায়ী হওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন বারবার। কিন্তু পুঁজি, ব্যবসা আর মুনাফা— শব্দ তিনটেকে বাঙালি জাতি ধীরে ধীরে এমন ঘৃণা করতে শিখেছে, যেন ও তিনটে শব্দ হিটলার, মুসোলিনি আর তোজো-র সমার্থক। ফলে আজ বাংলা-জুড়ে ব্যবসা করেন গুজরাত, মহারাষ্ট্র, মায় উত্তরপ্রদেশ-বিহারের মানুষ। আপামর বাঙালি তাঁদের নিচে চাকরি করে বাংলারই মাটিতে। প্রতিদিন সকালবেলা মাইতি, ঘোষ বা চ্যাটার্জিদা-রা পড়ি-কী-মরি করে ট্রেন ধরেন দত্তপুকুর বা পায়রাডাঙা থেকে, ট্রেনে তাঁদের ফোন বেজে উঠলে তাঁরা জানেন, এইবার হিন্দি ভাষায় তাঁদের নির্দেশিকা অথবা গালি শুনতে হবে ওপরমহল-এর কাছ থেকে। তাঁদেরও জবাব দিতে হবে হিন্দি ভাষায়। রবিবার তাঁরা ঘরে-বাইরে বাঘ মারেন, সোমবার আত্মপরিচয়ের ঠেলা সামলানো শুরু হওয়ার দিন! সোমবারের ট্রেনে তাই সপ্তাহের বাকি দিনগুলোর থেকে ঠেলাঠেলি বেশি, ঝগড়া বেশি। সোমবার কোনও কারণে ট্রেন লেট হলে রেল কোম্পানি গালিও খায় বেশি বেশি। রবীন্দ্রনাথের নাটক ‘গোড়ায় গলদ’-এর বিনোদবিহারী আমাদের সকলের মনের কথা বলেছিলেন বটে, ‘বলো দেখি চন্দর, একে কি বেঁচে থাকা বলে! সোমবার থেকে শনিবার পর্যন্ত কেবল কালেজ যাচ্ছি, আইন পড়ছি, আর সেই পটলডাঙার বাসার মধ্যে পড়ে ট্রামের ঘরঘড় শুনছি। হপ্তার মধ্যে একটার বেশি রবিবার আসে না, তাও কীসে খরচ করব ভেবে পাওয়া যায় না!’

    রবীন্দ্রনাথের প্রসঙ্গে অন্য একটা কথা মনে পড়ে গেল। উনিশ শতকে বাংলায় বাচ্চাদের পড়াশোনা নিয়ে যাঁরা ভাবছিলেন, তাঁরা বেশ একটা পড়াশোনা-প্রবণ শিষ্ট শৈশবের কল্পনা করছিলেন। বাংলা ভাষায় শিশুদের জন্য লেখা-হওয়া প্রথম ছড়াযুগ্মকে মদনমোহন তর্কালঙ্কার পরামর্শ দিয়েছিলেন, ‘উঠো শিশু মুখ ধোও পড়ো নিজ বেশ।/ আপন পাঠেতে মন করহ নিবেশ।।’ কিংবা, ‘লেখাপড়া করে যেই।/ গাড়িঘোড়া চড়ে সেই।’ প্রাতঃস্মরণীয় বিদ্যাসাগরমশাইও তাঁর ‘বর্ণপরিচয়’-এ লেখাপড়া করা আর ‘সুবোধ’ বালক হওয়ার মধ্যে বেশ নিবিড় একটা সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। জানিয়েছিলেন, ‘সুবোধ বালক’-রা ‘কখনও আলস্যে কাল কাটায় না’। 

    সাধারণভাবে, উপনিবেশের কালে একটা জরুরি বলার কথা হিসেবে বিষয়টাকে বোঝা এক, কিন্তু শিশুপাঠ্য-গ্রন্থ কেবল এই ভাল-মন্দের নির্দেশিকায় ভরে রাখা— এইটা ঠিক পছন্দ করে উঠতে পারেননি রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং। ফলে, তাঁর ‘সহজ পাঠ’-এর দীনুরা পাখি পোষে, শীতকাতুরে গুপিরা শাল-মুড়ি দিয়ে শুয়েও থাকে, আর যখন বৃষ্টি নামে, দুই কূলে বনে বনে সাড়া পড়ে যায় তখন, ‘বর্ষার উৎসবে জেগে ওঠে পাড়া’। ফলে, এ-আর আশ্চর্য কী যে, রবীন্দ্রনাথের একটা ছড়ার নামই হয়ে উঠবে ‘রবিবার’! আর সেই ছড়ায় সকলের ওপরে জেগে থাকবে একধরনের প্রতিপক্ষতা। সোম-মঙ্গল-বুধের সঙ্গে রবিবারের লড়াই। ‘সোম মঙ্গল বুধের যেন মুখগুলো সব হাঁড়ি’। অন্যদিকে ‘রবিবারের মুখে দেখি হাসিই আছে লেগে।’

    সোমবার হল এই হাঁড়িমুখোদের সর্দার। উনিশ শতকের শিশুপাঠ্য বইগুলো ছিল যেন সোমবারের বই, রবীন্দ্রনাথের শিশুপাঠ্য বইগুলো হয়ে উঠল রবিবারের। 

    তবে কিনা, এর উল্টোদিকে একটা ছোট কথাও থাকতে পারে। সেইটা বলে আমার এই ছোট নটেগাছটি মুড়িয়ে আনি। সারাজীবন বর্ষার মাধুর্যময় বর্ণনা লিখে গেছেন রবীন্দ্রনাথ। বলা হয়, ‘গীতবিতান’ ভালভাবে নিংড়োতে পারলে প্রতিবারই বর্ষার ফোঁটা ফোঁটা জল পড়বে। এহেন কবিও অন্তত একবার তাঁর কবিতায় বর্ষাকের এক মর্মান্তিক উপমান তৈরি করেছিলেন। ‘বাঁশি’ কবিতাটা মনে আছে তো? সেই-যে ‘কিনু গোয়ালার গলি’? সেই কবিতায় ওই কেরানিটির স্যাঁতসেতে ঘরের আশেপাশে যখন বর্ষা নামে, তখন, কবি লিখলেন, ‘বাদলের কালো ছায়া/ স্যাঁৎসেঁতে ঘরটাতে ঢুকে/ কলে-পড়া জন্তুর মতন/ মূর্ছায় অসাড়।’

    বর্ষাকালকে রবীন্দ্রনাথ তুলনা করছেন, কলে-পড়া থেঁতলে যাওয়া ইঁদুরের সঙ্গে, এ যেন অভাবনীয়। কিন্তু আমরা বুঝি, জলে-ভাসা নোংরা দুর্গন্ধময় গলি, তার ঘুপচি ঘরে যাঁরা থাকেন, বর্ষাকাল তাঁদের কাছে তত রোম্যান্টিক হয়ে না-ও আসতে পারে। এ-কালের কবিয়ালও তাই গেয়েছিলেন, ‘সেই জলেতে বেদম ভিজে একটা লোক/ মেঘদূতের নাম রেখেছে আহাম্মক।’ সোমবারকে বিস্তর গাল দিতে গিয়েও কথাগুলো হঠাৎ মনে পড়ল। যে-ছেলেটি কলেজ পাস করে বসে আছে বহুদিন, অথচ কাজ নেই, যে-মেয়েটির ভাল ডিগ্রি, বাবা-মা বিয়ে করার জন্য চাপ দিচ্ছে, কিন্তু সে নিজের পায়ে দাঁড়াতে চায় আগে, তাদের জন্য তাড়াতাড়ি একটা করে সোমবার জুটুক। তাদের জীবনে বড্ড বেশি রবিবার।

    সকলের হাতে কাজ থাক। সকলের জীবনে গাল দেওয়ার মতো একটা সোমবার যেন জেগে থাকে।

     
      পূর্ববর্তী লেখা
     

     

     



 

Rate us on Google Rate us on FaceBook