লস অ্যাঞ্জেলেসের আগুন
ক্যালিফোর্নিয়ার আগুন বুঝিয়ে দিল, বিপদের এপিঠ-ওপিঠ বলে বাকি কিছু নেই আর। আমরা যারা এই উত্তর গোলার্ধে বাস করে, উন্নততর পরিষেবা পেয়ে এতকাল আমেরিকান ড্রিমের মতান্তরে নাইটমেয়ারের আদরে-আবডালে বেঁচে আছি— বা আমাদেরই কেউ কেউ, গাজা, ইউক্রেনে বোমা পড়বে বলে আশ্রয় ছেড়ে লুকিয়ে আছি, আমরা আসলে কেউ টেরই পাইনি, কখন সবাই একটাই নৌকায় উঠে বসে আছি। তাতে বিল গেটস-সহ, আদানি-আম্বানি এবং অথবা ইলন মাস্ককেও উঠতে হয়েছে। আর এটা ডুবে যাবে না ভাসবে— তা এখন আর শুধু প্রথম বা দ্বিতীয় অর্থনীতি ব্যবস্থায় আটকে নেই। ডুবলে সবাই একসঙ্গে ডুববে— রাজা আর টুনির আজ সমান বিপদ। টুনটুনি যদি বলে, এ দায় রাজার। আমার নয়। সেই শোষণ করে এ-বিপদ এনেছে— অতএব, আমি ডুবতে চাই না। তাতেও তরী তাকে রাজর সঙ্গেই এক তরীতে নিয়ে ডুবিয়ে ছাড়বে। এই আমাদের একমাত্র সরল ভবিতব্য। অ্যানথ্রোপোসিন আর ভবিষ্যতের পৃথিবী নয়। কেউ সুস্বাগতম বলে ফিতে না কেটে ডাকলেও আমরা আসলে পুঁজিবাদের হাত ধরে সেই আনেথ্রোপোসিনে সটান ঢুকে পড়েছি!
তবে কি সে দারুণ ভয়ের? কোথাও কোনও আশা নেই আর? ক্যামেরুনিয়ান দার্শনিক আচিল মেম্বে তাঁর প্রভাবশালী প্রবন্ধ নেক্রো-পলিটিক্সে, মৃত্যুর রাজনীতি সম্পর্কে এক বিস্তর আলোচনা করেন, তারপর বলেন যে, ধনীরা এবং ধনী দেশগুলোর তৈরি ব্যবস্থা নির্ধারণ করে কে বাঁচবে এবং কে মরবে। ভাতে গরিবের মরাই বেশি সুবিধাজনক বলে তিনি বাতলাচ্ছেন। গরিবের প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে ক্ষতি বেশি হয়। বড়লোকরা প্রকৃতির বিরুদ্ধে বেশ বেঁচে-বর্তে থাকে। শেষে তিনি আমাদের শান্তির বারির মতো এক সংহতির শক্তির কথাও মনে করিয়ে দেন অবশ্যই। যা চিরাচরিত মানুষ জাতির চিরচেনা, কিন্তু অধরা একটি সম্মিলিত প্রচেষ্টা, যা লাভ ও অনিশ্চয়তার বাইরের এক পৃথিবীকে এই টেকনোক্রেটিক শর্টহ্যান্ডের হাত থেকে পুনর্নির্মাণ করে ফেলতে পারে। তাই আশা নেই, একথা নেহাত না-মুমকিন, তা বলা যায় না। যেহেতু মানুষ জাতির ওপর থেকে বিশ্বাস হারানো যায় না, যেহেতু আমেরিকা আবার গ্রেট হবে— তাই।
আরও পড়ুন : আজও মেয়েদের ঘিরে থাকা মিথ ভাঙতে প্রাসঙ্গিক বোভোয়া! লিখছেন অমৃতা সরকার…
কিন্তু, এই অ্যানথ্রোপোসিন যুগে বসে মনে হচ্ছে, আবার প্লেট হয়েও বিশেষ সুবিধে হবে না। কারন লস অ্যাঞ্জেলেসের আগুন দেখিয়ে দিয়েছে, বড়লোকদেরও বাড়ি গরিবের মতো সমানে পোড়ে। সুপারস্টারের বাড়িও পুড়ে ছাই হয়ে যায়। আর সে অগ্নি-সংযোজক হিসেবে ধরে নিতে পারি— অ্যানথ্রোপোসিন।
কিন্তু কী সেই অ্যানথ্রোপোসিন?
পল কার্জন বলে এক লোক, আদিতে রসায়নবিদ, ২০০০ সাল নাগাদ এই কথাটা আমদানি করে ফেলেন। কিন্তু বাংলা লিখতে গিয়ে আমরা তাকে কী নামে ডাকব, তা নিয়ে ভেবে বেশি সময় বরবাদ না করে আমি ‘প্রভাবিত যুগ’— এই ডাকে লেখাটিতে বেশিরভাগ আলোচনা করব। অ্যানথ্রোপোসিন বা প্রভাবিত যুগ বলতে বোঝায় সেই সময়কে, যখন মানুষের ক্রিয়াকলাপ, বিশেষত শিল্পায়ন, নগরায়ন, বন উজাড় এবং দূষণ— পৃথিবীর প্রাকৃতিক ব্যবস্থাগুলিকে এতটাই প্রভাবিত করে ফেলেছে যে এগুলি ততদিনে ভূগর্ভস্থ স্তরেও দৃশ্যমান হতে শুরু করেছে। যার চোখে-আঙুল-ফল হল— গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি, বিপুল সংখ্যক প্রজাতির বিলুপ্তি (জীববৈচিত্রের ক্ষতি), বন উজাড় এবং ভূমির ব্যবহারে ব্যাপক পরিবর্তন। প্লাস্টিক এবং পারমাণবিক বর্জ্য ভূতাত্ত্বিক স্তরে জমা হওয়া ইত্যাদি।
পুঁজিবাদ, অ্যানথ্রোপোসিন এবং পরিবেশ রাজনীতির হা হা সিমফনি
এ-লেখা যখন লিখছি, তখন লস অ্যাঞ্জেলেসে প্রায় আশি ভাগ আগুনই নির্বাপিত হয়েছে। কিন্তু সাইবার পৃথিবীতে তার ডিজিটাল শিখা এখনও এক অযাচিত দ্বন্দ্বে মেতে রয়েছে দেখে মনে হয়, এটি যেন মানুষের প্রভাবিত যুগের প্রথম দৃশ্যায়িত নির্মম মেট্রোনোম। নেটময় আগুন শিখার লোলনৃত্য। শুকনো পাহাড়ের ওপর লাফিয়ে উঠে সে বাড়িঘর ও প্রকৃতি একসঙ্গে গ্রাস করে নিচ্ছে। যেন ‘অ্যাপোক্যালিপস’ ছবির শেষ দৃশ্য। কেউ কেউ বলছেন, ইনফারনো। দান্তের নরক। কেউ বা প্রকৃতিকে দুষছেন হাওয়া-বাতাসের দোষ দিয়ে। আর বিজ্ঞানী, পরিবেশ-যোদ্ধারা দশক দশক সমস্বরে বলে আসছেন অন্য কথা। বলছেন, এই শহরের দাবানল কেবলমাত্র প্রাকৃতিক দুর্যোগ নয়; এটিকে নির্মাণ করা হয়েছে। যার সার হল, লাগামহীন পুঁজিবাদ এবং নীতি-নির্ধারকদের অসচেতন উদাসীনতায় পরিচালিত এই সিমফনি। শুধু প্রাকৃতিক বিপর্যয় বলে আর ঘুমনো যাবে না। এমনকী, বছর বছর কতটা দাবানল হতে পারে বা পরিবেশের সংকটের কারনে জলস্তর বাড়ায় হাওয়া কত বেগে দৌড়বে, এসবও তারা নিক্তি মেপে কষে দিচ্ছেন। তাও ফি-বছর এই আগুন, যা বাড়তে বাড়তে ২০২৫-এ সর্বোচ্চ রূপ নিয়েছে। আর ইতিমধ্যেই ২৫ জন মানুষের প্রাণ গেছে।
আমরা যারা এই দেশটার পশ্চিমে থাকি, অর্থাৎ কিনা ক্যালিফোর্নিয়ার দিকে, তাদের কাছে ফি-বছর এই আগুন এক বাৎসরিক রুটিনে দাঁড়িয়ে গেছে। রোটেশনের মতো। এদেশে এসে থেকেই জানি, সামারে পাতা শুকনো হয়ে যাবে আর কিছু মানুষের কপাল পুড়বে। পুড়ে যাবে বন, দীর্ঘ ওক গাছের সারি ও মাটির জলবাহী জরুরি সব গুল্ম আর একর-একর বনানী। হাজার মাইল দূর থেকেও আমাদের নাকে ধোঁয়া এসে লাগবে। আর মিডিয়া ‘প্রাকৃতিক দুর্যোগ’ বলে দেগে কয়েকমাস ধরে বিবৃতি দেবে। কেউ জলাভাব, খরা, কেউ দমকলের ব্যর্থতা ও ফায়ার পলিসি, কেউ দমকলের বাজেট চুম্বকীকরণ থেকে শুরু করে নানারকম কারণ দর্শাতে থাকবেন। আর তারপরও প্রতি বছর জাটিঙ্গার পাখির মতো ক্যালিফোর্নিয়া, এই কোন এক অদৃশ্য পরাজয়ের মতো এই দাবানলে ঝাঁপ দেবে।
এই ছিল জনমানুষকে গিলিয়ে রাখা মেইনস্ট্রিম বয়ান। কিন্তু ক্যালিফোর্নিয়ার এই আগুন সেই বয়ানে ছাই ফেলে সহজ ছাপোষা মার্কিনদের মনেও প্রশ্ন এবার তুলে দিয়েছে, ‘এই ভরা শীতে এমন আগুন কেন? তাহলে কি পরিবেশ সংকটই এই দুর্যোগ তৈরি করল?’
মনে রাখতে হবে, অর্ধেক আমেরিকান কিন্তু এই রক্ষণশীল বয়ানে গুলিসুতো খাওয়া মাছ, যারা বিশ্বাসই করে না পরিবেশ সংকট বলে সত্যিই কিছু বিরাজ করছে এই গ্রহে। এরপরও, প্রশ্ন কিন্তু উঠে গেছে।
এমনিতে, যে-কোনও বিপর্যয়েরই তিনটি অভিমুখ থাকে। বলা হয়, যে-কোনও বিপর্যয় আসলে তিনটি জিনিসের ওপর নির্ভর করে: কত মানুষ আর বাড়িঘর এর মুখোমুখি হচ্ছে, তারা কতটা প্রস্তুত বা কতটা অসুরক্ষিত, আর সেই বিপদটা নিজেই— এক্ষেত্রে যা দাবানল। এখানে এই তিনটিরই সমন্বয়ে একেবারে পারফেক্ট ‘আগুন ঝড়’ তৈরি হয়েছে। তাছাড়া এলএ খুব ঘনবসতিপূর্ণ আর আগুন লাগার ঝুঁকি-পূর্ণ একটা এলাকা। সাধারণত, জানুয়ারি মাস দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়ায় দাবানলের মৌসুম না হলেও, লস অ্যাঞ্জেলেস কাউন্টিতে গত মে মাস থেকে মাত্র ০.১৬ ইফি (প্রায় ০.৪ সেমি) বৃষ্টি হয়েছে, তাও আবার গরম একটা গ্রীষ্মের পর। এর সঙ্গে কম আর্দ্রতা আর ২০১১ সালের পর সবচেয়ে জোরালো সান্তা আনা বাতাস মিলে এমন একটা আগুন ছড়ানোর পরিবেশ তৈরি করেছে, যা আগে কখনও দেখা যায়নি।
এই হল মোটের ওপর বিপর্যয়ের আখ্যান। তা এতই মজবুত মার্কিনিদের মনে যে, তারা জলবায়ু সংকটের বয়ান চট করে গিলবে না। কিন্তু এবার তারাও নড়েচড়ে বসেছে। এই যে এতদিন এই বলেই ক্ষান্ত দেওয়া যেতেই পারত। কিন্তু তা আর সহজ হচ্ছে না।
এই আগুনে-মোট প্রায় চল্লিশ হাজার একরেরও বেশি জমি পুড়ে গেছে। বড় বড় তারকাদের প্রাসাদও ধূলিসাৎ। বারো হাজারেরও বেশি বাসগৃহ ও পাবলিক সম্পত্তির ক্ষতি হয়েছে। মোট পঞ্চাশ হাজারেরও বেশি মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়েছেন।
LAFD Alert-KNOCKDOWN San Pedro Structure Fire 1152 W 37th St MAP: https://t.co/HLE4lYweGX FS101; DETAILS: https://t.co/gIYENxKKGv
— LAFD 🔥 (@LAFD) January 18, 2025
আর তার পাশাপাশি বাজারে চাষ হচ্ছে নানাবিধ ষড়যন্ত্রের থিওরি। ভাইরাল হচ্ছে ভিডিওর পর ভিডিও। এমনই এক ভাইরাল ভিডিওতে আজ সারাদিন এক দম্পতিকে শাপশাপান্ত করে নেটময় নেটিজেনদের ঘোরাঘুরি করতে দেখা গেল। সেটি হল— স্টুয়ার্ট আর লিন্ডা রেসনিক নামের এক দম্পতিকে নিয়ে, যাঁরা সারা ক্যালিফোর্নিয়ার মোট জলসম্পদের ৮০ শতাংশের একাই মালিক। যেখানে সারা ক্যালিফোর্নিয়া গত দু’দশক ধরে খরায় ভুগছে। উত্তর আমেরিকার বাড়ির সামনে-পিছনে অবশ্যকর্তব্য লন তৈরির যে অনায়াস অভ্যেস, তাতে ভাঙন ধরেছে। ক্যালিফোর্নিয়া জুড়ে জলের সতর্কতা ও জল ব্যবহারের ওপর চরম নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়েছে। সেখানে এই পরিবার তাদের পেস্তাক্ষেতের চাষের জন্য এই জলের মালিকানা কিনে নিয়ে শুধু পেস্তা উৎপাদন করে মুনাফা করে গেছেন। বড়লোকের শখের এই স্ন্যাক্স, যা অর্ধেক পৃথিবীর জনমানুষের কাছে কোনও অপরিহার্য খাদাই না। যা না খেলেও সভ্যতা ও তার সমগ্র বুদ্ধিবৃত্তি ও স্বাস্থ্যের কোনও হ্রাস হয় না, দিব্য চলে— তার উৎপাদন করতে গিয়ে এই মালিকানা।
আরও দু’টি ভিডিও আলোচনায় যাবো।
দ্বিতীয় একটি ভিডিওর কথা বলি। আগুন-পরবর্তী সময়ে দেখা যাচ্ছে, বাড়িওয়ালারা বাড়িয়ে দিলেন বাড়িভাড়া আর বিমা কোম্পানিরা বাছাই অঞ্চলে টাকা দিতে অস্বীকার করলেন।
এইবার, তৃতীয় আরেকটি ভিডিও।
তাতে দেখছি, নানারূপ পরিবেশ কনফারেন্সের ছবি। কনফারেন্স তেল কোম্পানির লবির লোকে ভর্তি।
কী দাঁড়াল? তিন এক্কে তিন নয়। এ হল, তিন এক্কে ছয়।
তো আসা যাক ভিডিও আলোচনায়, কী কী প্রশ্ন তুলে দিল তা? মানুষ জানতে পারলেন— বিমা সংস্থা বাছাই অঞ্চলগুলিতে (পড়ুন নিম্নবিত্ত ও বিপদঘন অঞ্চল) বিমা দিতে অস্বীকার করছে। আর বাড়ি ভাড়া বেড়েছে।
এই মডেলটিকে এবার বড় করে নিন। করলেই দেখতে পাবেন, বিশ্ব জুড়ে প্রাকৃতিক সম্পদের মালিকানা। যা কুক্ষিগত করে আমেরিকা অনেক সম্পদ করেছে। আর এক্ষেত্রে তা জল হলেও যা পরিস্কার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল, তা হল, আরেক প্রাকৃতিক শোষণ। কী সে আর-এক? অবশ্যই তেল ও জীবাশ্মনির্ভর। গাড়ির জন্য তেল। তেলের জন্য কূপ। কূপের জন্য খনন। খননের জন্য মাটি খারাপ হয়ে যাওয়া ইত্যাদি ইত্যাদি। অন্যদিকে, গাড়ির জন্য কার্বন নিঃসরণ বৃদ্ধি পাওয়া ইত্যাদি ইত্যাদি। এবং কার্বনের জন্য পুনরায় পরিবেশের ভাপমাত্রা বৃদ্ধি ও ইত্যাদি ইত্যাদি। অর্থাৎ, জীবাশ্ম, পুঁজির লড়াই, তার হাত ধরে পরিবেশ খারাপ, অতএব ধীরে কিন্তু পরিকল্পিতভাবে এই ‘প্রভাবিত যুগ’। আর, ক্যালিফোর্নিয়ার প্রকৃত সমস্যার মূলেও রয়েছে এই শাহেনশাহ ত্রিশক্তি— পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদ-অ্যানথ্রোপোসিন সংযোগ।
আর সাধারণ মানুষ যা ভাবতে শুরু করেছেন, একে তো এরা জলকে দখল করে অন্যকে বঞ্চিত করলেন। দুই, জল একজনের ব্যক্তিগত মালিকানায় থাকার ফলে, দমকলকর্মীরা, এদেশে আমরা ‘আগুনযোদ্ধা’ বলি, জলাভাবে পড়লেন। আগুন নেভানোর কাজও এমারজেন্সির তৎপরতায় করা গেল না। আর যাদের বাড়ি বাঁচানো গেল না, যারা গরিব মহল্লার, তাদের বিমার আওতা থেকে বের করে দিলেন বিমাকর্তারা। বাড়ির বিমা-বাবদ এখানে আমাদের মোটা টাকা ভরপাই করতে হয়। অতএব তবে, বাড়ি গেল, অস্থাবর গেল, পুনরায় বাড়ি বানানোর বিমার আওতা গেল, মনে করা হচ্ছে, এবদরের আগুনে ক্ষয়ক্ষতি বাদে প্রায় লক্ষাধিক মানুষ গৃহহীন হবেন। বিমা সংস্থা বাছাই অঞ্চলগুলিতে বিমা দিতে অস্বীকার করছে। তাও জীবাশ্ম জ্বালানি ও তেল ও গাড়ির গাঁটছড়ার কথা স্পষ্ট করে আলোচনায় আসছে না। যেখানে সারা ক্যালিফোর্নিয়া একাই দেশের সাত শতাংশ কার্বন নিঃসরণ করে, টেক্সাস তেরো।
এখানেই ঠিক চলে আসছে তৃতীয় ভিডিওটি। তেল লবির স্যুট-বুট পরা মানুষের ছবি পরিবেশ কনফারেন্সে কী করছে?
ভবিষ্যৎদ্রষ্টা প্রয়াত পণ্ডিত মাইক ডেভিস, তাঁর একটি রচনার কথা বলতে লোভ হচ্ছে। তাঁর প্রফেটসম এক বই, যা ১৯৯৮ সালে লিখিত ‘Ecology of Fear’, সেখানে লস অ্যাঞ্জেলেসকে এমন একটি শহর হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন, যার নামকরণ তিনি করেছিলেন— একটি শহর, যা সম্পদ না, ‘বিপর্যয় তৈরি করে’। তিন দশক আগেই ডেভিস এখানে দেখান, কীভাবে লস অ্যাঞ্জেলেসের বনাঞ্চল এবং প্রাকৃতিক এলাকা নগর সম্প্রসারণের জন্য ধ্বংস করা হয়েছে, যার ফলে দাবানলের ঝুঁকি বেড়েছে।
বর্তমান বিশ্বব্যবস্থা এখন জীবাশ্ম জ্বালানির অতিরিক্ত ব্যবহারের সীমা ছাড়িয়ে গেছে। বলার আর বাকি নেই যে, এটি লস অ্যাঞ্জেলেসকে ধ্বংস করছে এবং শীঘ্রই পুরো পৃথিবীকেও ধ্বংস করবে। একথা আজ স্কুলের বাচ্চাও জানে, যে, জীবাশ্ম পোড়ানো কার্বন ডাইঅক্সাইড সৃষ্টি করে, যা বায়ুমণ্ডলে গ্লোবাল ওয়ার্মিং সৃষ্টি করে! এই জীবাশ্ম জ্বালানি-নির্ভর পুঁজিবাদের কয়েক দশকের ফল। জীবাশ্ম জ্বালানিনির্ভর পুঁজিবাদ স্বল্পমেয়াদি লাভকে পরিবেশগত স্বামিত্রের চেয়ে অগ্রাধিকার দিয়েছে, উচ্চ-কার্বন অবকাঠামো-তেল খনন, গাড়ি-নির্ভরতাকে। আমেরিকার সারা দেশের গাড়ি-নির্ভরতা আর লস অ্যাঞ্জেলেসের গাড়ি নির্ভরতার ধারে-কাছে আসে না। এত গাড়ি রাস্তাময়, যে আট-লেন করেও কোনও লাভ হয় না। আর বিখ্যাত এলএ ট্রাফিকের কথা না-ই বা বললাম। সে একবার লাগলে ছাড়তে দিনদুয়েকের ব্যাপার। মাঝারি শহর থেকে গাড়ি চালিয়ে প্রখম যখন ক্যালিফোর্নিয়া যাই, তার আট-লেনের হাইওয়েতে গাড়ি ভুলে আমার রুদ্ধশ্বাস অবস্থা। পরে যা বহুবার যাতায়াতে অভ্যেস হয়ে গেলেও একবার পড়েছিলাম বিখ্যাত ওই জ্যামে। খোদ গোদারের ‘উইকেন্ড’ ছবির দৃশ্য। মনে হচ্ছে, আমি তার কলাকুশলী, আর আমার পিছনেই লং টেক নিয়ে চলেছেন স্বয়ং রাউল কুত্তার।
বৈষম্যের অনল কাব্য
কথা হল এই জীবাশ্ম জ্বালানির ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের থেকে ক্যালিফোর্নিয়াকে বাঁচাবে কে? তার নিওলিবারাল নীতি? যেহেতু ক্যালিফোর্নিয়াকে আমরা লিব্যারাল বলে জানি, আরও জানি, সে নিজেকে জলবায়ু-কর্মে একটি বৈশ্বিক নেতা হিসেবে দেখায়, তবে আমরা এ-কথা জানি না যে, তার নীতিগুলো কেন তবে রাজনৈতিক আপসে আটকে থাকে? যেমন আগুন প্রতিরোধের বাজেট দমকল খরচের তুলনায় নগণ্য, যেন আমরা অনন্ত বিপর্যয়ের কাছে আত্মসমর্পণ করেছি। অতএব কথা উঠবেই, কীসের নীতি?
গ্লোবাল রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, অর্থাৎ পুঁজিবাদ, নিয়ে কথা বলতে গেলে আমরা দুর্যোগগুলোর উৎপত্তি, গঠন এবং রাজনীতিকে ‘ক্যাপিটালোসিন’ ধারণার মধ্যে বসাই। দুর্যোগ এবং এগুলোর পিছনে থাকা শারীরিক প্রক্রিয়াগুলো প্রকৃতিগত নয়, একথা তো আগেই আলোচনা করেছি, এবার বলা দরকার বৈষম্যের আখ্যানও। এগুলো ক্যাপিটালিস্ট ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে অসমভাবে তৈরি হয় এবং সেই প্রক্রিয়াগুলোই এগুলোকে পুনরায় খারাপ করে তোলে। অতএব দাঁড়াল শুধু বিপর্যয় নির্মাণেই বৈষম্য নয়, বৈষম্য তার ফলেও। ফলে প্রভাবও হয় অসমভাবে।
আর কারণ, সব পোড়া নয় সমান। আগুন, অন্যান্য সকল দুর্যোগের মতো, সমানভাবে পোড়ায় না। ধনী ব্যক্তিরা হয়তো একটি বাড়ি হারায়, কিন্তু তারা আরেকটি পায়; তারা হয়তো পালায়, কিন্তু ফিরে আসে বিমা চেক এবং ব্যক্তিগত দমকল কর্মী নিয়ে। তাদের বিমার লেভেলই আলাদা। অন্যদিকে, শ্রমজীবী মানুষ, যারা প্রায়ই অভিবাসী এবং বর্ণগত সংখ্যালঘু, সবকিছু হারায়। ঠিক যেভাবে ধোঁয়া এমন মানুষের ফুসফুসে ঢুকে পড়ে, যারা এয়ার পিউরিফায়ার কেনার সামর্থ রাখে না বা দূষণমুক্ত স্থানে পালানোর ক্ষমতা রাখে না।
একেই পরিবেশ-বিজ্ঞানীরা বলছেন দুর্যোগ পুঁজিবাদ। যার মূল বৈষম্যে। যার ফলও বৈষম্য। দুর্যোগ মোকাবিলার জন্য যে প্রযুক্তি এবং ব্যবস্থাপনার পদ্মা নেওয়া হচ্ছে, তাও মূলত নিওলিবারাল রাষ্ট্র এবং বহুপক্ষীয় শাসনব্যবস্থার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। এই পড়াগুলো পরিবেশগত পরিবর্তনের কারণ এবং পুঁজিবাদের অধীনে ‘দুর্যোগের নতুন স্বাভাবিক’ পরিস্থিতি সমাধানের ক্ষেত্রে একধরনের টানাপোড়েন সৃষ্টি করেই চলেছে।
এবারে তবে তেলের লবির কথা এসে পড়বে। বললে কী পরিষ্কার হবে? তা হল— লস অ্যাঞ্জেলেসের জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরশীলতা এখানকার তেল কোম্পানিগুলি বহু বছর ধরে রাজনৈতিক শক্তিকে নিজেদের সুবিধের জন্য ব্যবহার করেছে, পরিবেশ-বান্ধব নীতিগুলোকে রুখে দিয়েছে। তেল কোম্পানি বা ফসিল ফুয়েল তাদের লবি-টাকাপয়সার প্রভাব খাটিয়ে ও মামলা-মোকদ্দমার মাধ্যমে এইসব সংস্কারকে বাধা দেয়। অপরদিকে, সংস্কার না হওয়ায় কার্বন আটকাতে পারে এমন বনানী পুড়ে যাওয়া ও ক্রমে খরা হওয়া। খরা হওয়াতে জল কম অতএব সবুজ কমে যাওয়া। কী দেখছেন? এমন এক তরবারি যার দুইদিকে ধার। দুইদিকে কাটতে কাটতে সে আমাদের সবার জীবন আর গ্রহটিকে জেরবার করে দিয়েছে।
অর্থাৎ, হাতে রইল সেই দু-খানি পেন্সিল— এক, গরিব যেমন আরও গরিব হবে, এই অ্যানথ্রোপোসিনে তার সঙ্গে তাল রেখে পরিবেশও আরও খারাপ হবে। তাই চালাকি বা নিওলিবারাল ক্যাপিটালিজমের বকোয়াসবাজিরও শেষ এল বলে। আর অন্য দেশ থেকে তেলই তুলুন কি নিজের বাড়ির কুয়ো থেকে— আগুন কিন্তু লেগে গিয়েছে।
তাই বলছিলাম টুনির কথা। গরিব নয় আরও গরিব হয়ে মরবে, কিন্তু এবার তবে বিল গেটসেরও পার নেই। তবে ইলন মাস্ক মঙ্গলে পালালে সে অন্য কথা।
ফলে সুরাহা হবে কীসে, করবে কে, কী তার পলিসি, সেসবে পৌঁছনোর আগে অন্তত গ্লোবাল পরিবেশ-রাজনীতির এই মুখটিকে স্পষ্ট করে চিনে নেওয়া দরকার।
যখন এ-লেখা ডাকবাংলা-র বাক্সে পাঠাচ্ছি, তখনই খবর এল, গাজায় সিজফায়ার হয়েছে আর কিউবা আজ থেকে মুক্ত দেশের স্বচ্ছ লিস্টিতে। অবশ্যই সবই মহান সৃষ্টিকর্তা ও যুক্তরাষ্ট্রের ইচ্ছে ও নির্দেশে।
সালাম! উই উইল মেক আমেরিকা গ্রেট এগেইন!