ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2025

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • সংবাদ মূলত কাব‍্য : পর্ব ১


    মৃদুল দাশগুপ্ত (January 12, 2025)
     

    সাংবাদিকতা বনাম কবিতা

    বড় দুর্ভাবনায় পড়েছিলাম আমি। দুশ্চিন্তায় ছটফট করছিল মন। তখন, সেই তখন, সেবার একটি শারদ সংখ‍্যায় বিষ্ণু দে-র একটি কবিতায় একবারে গোড়ার লাইনটি, ‘সংবাদ মূলত কাব‍্য’ এই অমোঘ বাক‍্যটি পড়ে লাফিয়ে উঠেছিল আমার সে-সময়ের তারুণ‍্য, ছুটে রাস্তায় বেরিয়ে নৃত‍্য করতে ইচ্ছে হয়েছিল, নেচেছিলামও হয়তো, এমনই ধাক্কা দিয়ে আমাকে চাঙ্গা করে দিয়েছিল বিষ্ণু দে-র ওই কাব‍্যপংক্তি, যেন মাঝসমুদ্রে হাবুডুবু খাওয়া আমার সামনে ভেসে উঠেছিল কাঠের টুকরোটি, বিষ্ণু দে-র ওই লাইন। এই বয়সে, ভেবে দেখেছি, সারাজীবন আমাকে জড়িয়ে রইল ‘সংবাদ মূলত কাব‍্য’ ‘সংবাদ মূলত কাব‍্য’ এই মহামন্ত্র। আর জপেছি নিজের লেখা একটি কবিতা বিষয়ক গদ‍্যের শিরোনামটুকু (পরে গ্রন্থের নামও)— ‘কবিতা সহায়’; বিপদে-আপদে পড়লে এই নাস্তিকের ওই লব্জ—  ‘কবিতা সহায়’।

    এবার টুক করে একটা কথা বলে নিই। এই যে বিষ্ণু দে-র কবিতা-পংক্তি আমার জীবনে জড়িয়ে রইল, সেই কবিকে আমি দেখিনি বা সাক্ষাৎ করিনি কেন? বিষ্ণু দে-কে দেখিনি, বুদ্ধদেব বসুকে দেখিনি। কবিতাপ্রয়াসী হিসেবে আমরা, যাদের সত্তর দশকীয় বলা হয়, আমরা ছিলাম অগ্রজদের এড়িয়ে যাওয়া তরুণ। প্রতিষ্ঠান ও প্রথাবিরোধিতাই এর কারণ মনে হয়। তাঁদের কবিতা পড়েছি, কেউ-কেউ ছিলেন প্রিয় কবিও, তবু আমি বুদ্ধদেব বসু, বিষ্ণু দে-কে দেখিনি। এই বয়সে আমার বড় আক্ষেপ হয়, অথচ তাঁরা আমাদের লেখালিখির সূচনাকালে জীবিত ছিলেন। তবে আমি প্রেমেন্দ্র মিত্রকে দেখেছি। কথাও হয়েছে। আর স্নেহ পেয়েছি অরুণ মিত্রের। তা বিষ্ণু দে-র ওই কবিতার অমোঘ পংক্তি ‘সংবাদ মূলত কাব‍্য’ আমার জীবনব‍্যাপী জড়িয়ে থাকল কেন?

    সে-কথা শুরু করতে আমার জীবন শুরু দিয়েই শুরু করতে হয়। আমার জন্ম দেশভাগ ও স্বাধীনতার আট বছর পর, ১৯৫৫ সালে এই শ্রীরামপুর শহরে। দেশভাগ আমি দেখিনি, কিন্তু দেশভাগের জের আমি দেখেছি আমাদের পরিবারে, পূর্ববঙ্গ থেকে ছিটকে আসা আমাদের মহাপরিবারে। আমার বালককালে, ১৯৬৬ সালে বসিরহাটে নুরুল ইসলাম যেদিন পুলিশের গুলিতে মারা গেল, তামাম বাংলায় আমরা ক্লাস সেভেনের ছাত্ররা পরদিন মিছিলে নেমে বড় হয়ে গেলাম। নুরুল ছিল সপ্তম শ্রেণির ছাত্র। তারপর? উপমহাদেশের এই পূর্বাঞ্চলে স্বাধীনতা-পরবর্তী মহাঘূর্ণি। ইতিহাসের গ্রন্থিসময়। সমাজবদলের স্বপ্নে সংসদীয়, অসংসদীয় সশস্ত্র পথেও। ওই বাংলায় পূর্ব-পাকিস্তানেও মোচড় দিয়ে উঠল স্বাধীনতা আকাঙ্ক্ষার মুক্তিযুদ্ধ। বিস্তারিত বলার দরকার নেই। বিষয়টি বহুচর্চিত। অশোক মিত্র একটি চমৎকার লেখায় বলেছিলেন, বাঙালি তরুণদের একটি ধারা গেল বিপ্লব বাসনায়, আর একটি ধারা গেল কবিতা রচনার প্রয়াসে। সময় তখন নাচছিল। আমি এখন এই বয়সে, ভেবে দেখেছি, জোর দিয়েই এখন বলছি, আমাদের কবিতা, অর্থাৎ যাকে সত্তর দশকীয় কবিতা বলা হয়, তা ওই নৃত‍্যরত সময় থেকে জাত। তাই আমরা, সত্ত‌র দশকের আমার সকল বন্ধু-কবিরা, সকলেই ছন্দসিক্ত। ছন্দে পারঙ্গম। সময়ের নৃত‍্য থেকেই আমাদের কবিতায় ছন্দ এসেছে।

    সদ‍্য-তরুণ বয়সে আমি পড়েছিলাম বুদ্ধদেব বসুর সতর্কবাণী— চাকরি আর বিবাহ কবিতার শত্রু। আর সাংবাদিকতাও কবিতার শত্রু। চিন্তায়-চিন্তায় একেবারে মুষড়ে পড়লাম আমি। ‘জলপাই কাঠের এসরাজ’-এর পর যা লিখি, মনঃপূত হচ্ছিল না আমার। ছটফট করছিলাম আমি। ওই তখন, তখন বিষ্ণু দে লিখলেন ‘সংবাদ মূলত কাব্য’। চাঙ্গা হয়ে গেলাম আমি। আলোয় ভরে গেল চারদিক।

    সপ্তম-অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময়ে ওই ১৯৬৬-’৬৭ সালে চিলেকোঠায় উঠে আমি ‘গীতাঞ্জলি’র কবিতাগুলি পড়তাম। আমার মা বিবাহে অনেকগুলি ‘গীতাঞ্জলি’ উপহার পেয়েছিল। একটি গীতাঞ্জলি আমি হস্তগত করেছিলাম, আর মায়ের পাওয়া জীবনানন্দ দাশের ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’ও নিয়ে নিয়েছিলাম আমার জিম্মায়। চিৎকার করে-করে আমি সেসব কবিতা পড়তাম। আর পড়তাম আমাদের পরিবারে সযত্নে রক্ষিত বিজয় গুপ্তের ‘মনসামঙ্গল’ কাব‍্যটি। মনে যা খুশি আসত, খাতায়, টুকরো কাগজে লিখে ফেলতাম আমি। আমার ঝুন্টু মাসি একদিন সে-খাতার পাতা উলটে দেখে বলল, ‘আরে, তুই তো আধুনিক কবিতা লিখিস!’ তখনকার দিনে জীবনানন্দ, শক্তি, সুনীল— সবার কবিতাকে আধুনিক কবিতা বলা হত। ঝুন্টুমাসি, তার ভাল নাম ছিল অর্চনা সেন, তখন এমএ পড়ত। ঝুন্টুমাসি আমাকে বলল, ‘কবি ও কবিতা’, ‘লা পয়েজি’, ‘উত্তরসূরি’ এসব কবিতার পত্রপত্রিকা পড়ার কথা। ঝুন্টুমাসি আমাকে এসব পত্রিকা দিত, বাবাও আমাকে পত্রিকা কিনে এনে দিত। এইরকম একদিন দুপুরে চিলেকোঠায় কবিতা পড়ার সময়ে সবিস্ময়ে আমি দেখলাম ‘কবি ও কবিতা’-য় শম্ভুনাথ চট্টোপাধ‍্যায়ের একগুচ্ছ সোনালি ফসলের কবিতা পড়তে গিয়ে আমার কণ্ঠস্বর খাদে নেমে এসেছে। ‘ঋতু নয়, আমি দেখি স্তব্ধ তিন প্রেমিকের মুখ’ পড়তে-পড়তে মনে হল, আমি একটি সবুজ মখমলে মোড়া পথ দিয়ে হেঁটে রামধনু সাতরঙের জগতে হাজির হয়েছি…। মনে হল, সকল কবিতা আমি বুঝতে পারছি, খুলে যাচ্ছে সব চারদিকে। অনেক পড়ে কলকাতায় এসে কলেজ স্ট্রিটের রাস্তায় হাঁটতে-হাঁটতে শামসুর রাহমান আমাকে বলেছিলেন, ‘মৃদুল, আমরাই পৃথিবীর প্রকৃত সংখ‍্যালঘু, আমরা কবিতার মর্ম বুঝি।’

    ওই ছয়ের দশকের শেষ কয়েকটি বছর থেকে গোটা সাতের দশক— ওইসব ‘আধুনিক কবিতা’ লিখতে-লিখতে আমার মনে হল, অনেক লেখা জমে গিয়েছে, এবার আমার প্রথম কাব‍্যগ্রন্থটি করা যেতে পারে। বাটার দুটি জুতোর বাক্সে খাতার পাতা আর টুকরো কাগজে আমি কবিতা জমিয়ে রাখতাম। দুই বন্ধু তা নেড়েচেড়ে বলল, বই হতে পারে। ওই ১৯৭৮ সালে তৈরি হয়ে গেল আমার ‘জলপাই কাঠের এসরাজ’ কাব‍্যগ্রন্থটির পাণ্ডুলিপি (বইটি বের হয়েছিল অবশ‍্য ১৯৮০-তে)।

    ওই ১৯৭৮ সালেই আমি প্রথম জীববিজ্ঞানের শিক্ষক হিসাবে চাক‍রি পাই যে-স্কুলের আমি ছাত্র ছিলাম, সেই শ্রীরামপুর ইউনিয়ন ইনিস্টিটিউশনে। সেখানে তিন মাস পড়িয়ে চলে আসি কলকাতায় ইত‍্যাদি প্রকাশনীর ‘পরিবর্তন’ সংবাদ-পত্রিকাটিতে। সাংবাদিক হিসেবে। পত্রিকাটি প্রথমে পাক্ষিক, পরে সাপ্তাহিক হয়। বিপুল জনপ্রিয় হয়েছিল সে-সময়ে পত্রিকাটি।

    ওই চাকরিতে ঢুকেই আমার মনে দুশ্চিন্তা ঘনাতে থাকে, কারণ সদ‍্য-তরুণ বয়সে আমি পড়েছিলাম বুদ্ধদেব বসুর সতর্কবাণী— চাকরি আর বিবাহ কবিতার শত্রু। আর সাংবাদিকতাও কবিতার শত্রু। চিন্তায়-চিন্তায় একেবারে মুষড়ে পড়লাম আমি। ‘জলপাই কাঠের এসরাজ’-এর পর যা লিখি, মনঃপূত হচ্ছিল না আমার। ছটফট করছিলাম আমি। ওই তখন, তখন বিষ্ণু দে লিখলেন ‘সংবাদ মূলত কাব্য’। চাঙ্গা হয়ে গেলাম আমি। আলোয় ভরে গেল চারদিক। বুকের ভেতরটায় হ‍্যাজাক জ্বলে উঠল যেন। একটি কালো ডায়রিতে আমি লিখতে লাগলাম ‘এভাবে কাঁদে না’-র কবিতাগুলি। সেটা আটের দশকের শুরু…

    (চলবে)

     
      পূর্ববর্তী লেখা
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook