আগাথা ক্রিস্টির মৃত্যু পঞ্চাশ বছর ছুঁল। জীবদ্দশাতেই বহু লেখক যেখানে ইররেলেভেন্ট হয়ে যান, সেখানে মৃত্যুর পঞ্চাশ বছর পরেও একজন লেখিকা সর্বকালের বেস্টসেলারদের মধ্যে পড়ছেন। তাঁর একটা বইও আউট অফ প্রিন্ট নয়।
মনে রাখতে হবে, ক্রিস্টি-র ৮৫ বছরের জীবদ্দশায় লেখকজীবন কমবেশি ৬০ বছরের। অজস্র লিখেছেন। পোয়ারো, মিস মার্পল, টমি অ্যান্ড টাপেন্স, স্ট্যান্ডঅ্যালোন রহস্য উপন্যাস, স্মৃতিকথা, অজস্র গল্প— এত রাশি রাশি বইয়ের সমস্তই এখনও ছাপা হয়ে চলেছে, এ প্রায় অবিশ্বাস্য ব্যাপার! সময় এত সদয় খুব কম লেখকের প্রতিই হয়েছে। বাইবেল, শেক্সপিয়র— আর নাম মনে পড়ছে না। এমনকী, কোনান ডয়েলেরও বেশ কিছু উপন্যাস আজকাল শুধু কিন্ডলেই মেলে, ছাপার অক্ষরে পাওয়া যায় না। এডগার অ্যালান পো-র রচনাবলি সহজলভ্য, কিন্তু আলাদা করে একমাত্র উপন্যাসটা? নামগুলো করছি, কারণ এঁদের প্রভাব ভবিষ্যতের জঁর সাহিত্যে সুদূরপ্রসারী ছিল।
আরও পড়ুন : রোবট থেকে ভিনগ্রহীদের নিত্য যাতায়াত ছিল আইজ্যাক অ্যাসিমভের লেখায়…
তা সত্ত্বেও আগাথা ক্রিস্টি এঁদের ছাড়িয়ে অন্তত বই বিক্রির ক্ষেত্রে লক্ষ যোজন এগিয়ে গেলেন। বলতে বাধা নেই, তা সাহিত্যগুণের কারণে নয়। পো, কোনান ডয়েল, এমনকী, শার্লি জ্যাকসনের মতো জঁর সাহিত্যের দিকপালদের সঙ্গে তুলনা করলে ক্রিস্টির লেখা যথেষ্ট কাঠ-কাঠ, প্লটসর্বস্ব অনেক জায়গাতেই। বহু ক্ষেত্রে চরিত্রগুলো একরৈখিক। তার পরেও আজকের পৃথিবীতে কী করে আগাথা ক্রিস্টি কোটি কোটি পাঠকের কমফর্ট রিড হয়ে উঠলেন? এমন এক পৃথিবীতে, যেখানে পোয়ারো বা মিস মার্পলের মতো চরিত্রের দেখা পাওয়া সম্ভব নয়, সেই লন্ডনও যথেষ্ট আর্কেইক একটা প্রতিরূপ, যাকে ‘অ্যাবসেন্ট কমিউনিটি’ হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। তাহলে পাঠক কোনওভাবেই এই লেখাগুলোর সঙ্গে একাত্ম হতে পারছেন না, এবং তার পরেও লেখাগুলো বেস্টসেলার। রহস্যটা কী ছিল?
অনেক ভেবেচিন্তে এই লেখার জন্য একটাই বড় কারণকে চিহ্নিত করা গেল। তাত্ত্বিক কচকচিতে ঢুকব না। এমনিতেই জঁর সাহিত্যকে বিদগ্ধ বাঙালি সমালোচকরা করুণার চোখে দেখেন। তাঁদের কাছে তাত্ত্বিক বৈধতা প্রমাণের দায়, অন্তত ক্রিস্টি-র নেই। সেগুলো সরিয়ে রেখে যদি দেখা যায়, তাহলে সম্ভবত সবথেকে বড় কারণ হিসেবে উঠে আসবে ক্রিস্টি-র এক্সপ্লোর করার ক্ষমতা। তাঁর আগে যে ডিটেকটিভ সাহিত্য জনপ্রিয় ছিল, তারা এক-একটা ট্রোপ তৈরি করেছিল। সেটা শুধুমাত্র কোনান ডয়েল নন। উইলকি কলিন্স, এমনকী, চার্লস ডিকেন্সও। একটা জনপ্রিয় ট্রোপ হল, অনেক সন্দেহভাজনের মধ্যে যাকে সবথেকে কম সন্দেহ করা হচ্ছে— সে আসলে অপরাধী। কারণ সহজ। পাঠককে চমকে দেওয়া যাবে। পাঠক এই লোকটাকে আবিষ্কার করে স্তম্ভিত হয়ে ভাববে, ‘আরে একে তো সন্দেহই করিনি।’
ক্রিস্টি তাঁর প্রথম ডিটেকটিভ উপন্যাসেই এই ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করে বসলেন। ‘মিস্টিরিয়াস অ্যাফেয়ার অ্যাট স্টাইলস’ দেখিয়ে দিল, যাকে সবথেকে বেশি সন্দেহ করা হচ্ছে, সে অপরাধী হতে পারে এবং তার পরেও পাঠককে স্তম্ভিত করা যায়। তার কয়েক বছর পরেই সেই যুগান্তকারী বই, ‘মার্ডার অফ রজার অ্যাক্রয়েড’, সম্ভবত ডিটেকটিভ উপন্যাসের ইতিহাসে চূড়ান্ত শৃঙ্গ ছুঁয়ে গেল, যাকে হজম করা বহু সমালোচকের সাধ্য ছিল না। কথক নিজেই খুনি এবং বই জুড়ে সে যা বলে যাচ্ছে— তাকে শেষ পর্যন্ত আনরিলায়েবল ন্যারেশনের খোপে ফেলতে হবে, এটা দর্শনগতভাবে ডিটেকটিভ সাহিত্যকে সম্ভবত সবথেকে বড় ধাক্কা।
আমেরিকান সমালোচক এডমন্ড উইলসন বইটাকে এত বেশি অপছন্দ করলেন যে, লিখে ফেললেন দীর্ঘ প্রবন্ধ, ‘হু কেয়ারস হু কিলড রজার অ্যাক্রয়েড?’ আবার ১৯৯৮ সালে সাহিত্যের দিকপাল তাত্ত্বিক পিয়েরে বায়ার্ড উপন্যাসটাকে ডিকনস্ট্রাক্ট করতে গিয়ে আরেকটা উপন্যাস লিখে ফেললেন, ‘হু কিলড রজার অ্যাক্রয়েড?’ সেখানে তিনি টেক্সটের ক্রিটিকাল অ্যানালিসিস করে দেখালেন যে, এর অন্য সমাধানও সম্ভব এবং আগাথা ক্রিস্টি নিজেও সেটা জানতেন। জঁর সাহিত্যে ড্রাকুলা-র পর এমন সুদূরপ্রসারী প্রভাব, তাও আবার দার্শনিক স্তরে, আর কোনও বই এনেছে কি না, জানা নেই।
ক্রিস্টির পরীক্ষা-নিরীক্ষা এখানেই শেষ হয়নি। প্রচলিত ট্রোপগুলোকে তিনি এমনভাবে এরপরে বাঁকিয়ে-চুরিয়ে দিলেন যে, সেগুলোই তারপর থেকে প্রথা হয়ে উঠল। যেমন, কোনান ডয়েল এবং অন্যান্য ক্রাইম-আখ্যানকার, যেমন চেস্টারটন বা পরের যুগের জন ডিকসন কারের মতো বৈপ্লবিক লেখকদের একটা প্রিয় সাবজেক্ট ছিল— হত্যা যখন হয়েছে বলে সবাই জানে, আসলে হত্যা হয়েছে তার আগে। মাঝখানের সময়টাকে খুনি ব্যবহার করেছে অন্যদের বিভ্রান্ত করার জন্য।
আগাথা ক্রিস্টি করলেন ঠিক উলটোটা। ‘ইভিল আন্ডার দ্য সান’-এ দেখালেন যে, হত্যা যখন হয়েছে বলে সবাই জানে, আসলে হত্যা হয়েছে তার পরে। এই প্রায় অসম্ভব একটা ধাঁধার সমাধান তিনি এমনভাবে করলেন যে, এটা একটা মডেল হয়ে গেল। ভবিষ্যতের বেশ কিছু গোয়েন্দা-কাহিনির লেখক, যেমন রুথ রেন্ডাল বা ইয়ান র্যানকিন এই ট্রোপ ব্যবহার করলেন নিজেদের গল্প-উপন্যাসে। আরেকটা প্রচলিত কাঠামো— হত্যা মানে তার হত্যাকারী থাকবে— সেটাকে ক্রিস্টি ধ্বংস করলেন ‘অ্যান্ড দেন দেয়ার ওয়ার নান’ উপন্যাসে। এই বইটা নিয়ে নতুন করে কিছু বলব না, কারণ কয়েকশো কোটি মানুষ এই কাহিনি জানেন। পরবর্তীকালের সংখ্যাহীন গল্প-সিনেমায় এই মডেল প্রয়োগ হয়েছে। আরেকটা প্রচলিত ট্রোপ হল, একটা হত্যা মানে তার অপরাধী এক বা দু’জন। ক্রিস্টি দেখালেন, অপরাধী সবাই হতে পারে। প্রত্যেকটা সন্দেহভাজন। এই বইটাও এত বিপুল জনপ্রিয় যে, নাম করার দরকার নেই, তাও ‘মার্ডার অন দ্য ওরিয়েন্ট এক্সপ্রেস’-এর নামটা রাখাই রইল। ইতিমধ্যেই ক্রিস্টিতে অদীক্ষিত পাঠকের জন্য যথেষ্ট স্পয়েলার দেওয়া হয়েছে।
এই যে, পরের পর জনপ্রিয় ধারণাগুলোকে চ্যালেঞ্জ করে গোয়েন্দা সাহিত্যকে প্রায় রেভলিউশনাইজ করা, সে লকড রুম হোক বা বডি ডাবল তত্ত্ব, এটা তাঁর পরে এত ধারাবাহিকভাবে আর কেউ করেননি। একই সঙ্গে আরেকটা জিনিস সফলভাবে করেছিলেন, যদিও এক্ষেত্রে তাঁকে পথপ্রদর্শক আখ্যা দেওয়া ঠিক হবে না। তা হল, সমাজে যা কিছু শাশ্বত, যা অপরিবর্তনীয়— তাকে ভ্যালিডেট করা। এটা পোয়ারো বা মিস মার্পলের উপন্যাসগুলোর প্রায় প্রতিটার ক্ষেত্রে সত্যি। নিস্তরঙ্গ রোমান্টিক জীবন, পোয়ারোর লন্ডন হোক বা মার্পলের ক্ষেত্রে প্রভিন্স, আর উচ্চবিত্ত রাজতন্ত্রী মূল্যবোধকে ন্যায্যতা দেওয়া। জারজ সন্তান অবশ্যই লজ্জাকর আর তাই অপরাধী (‘এরক্যুল পোয়ারো’স ক্রিসমাস’), বহুগামিতা বিপজ্জনক (‘লর্ড এজওয়ার ডায়েজ’), অথবা তীক্ষ্ণবুদ্ধির অল্পবয়সি মেয়েকে সন্দেহের কারণ থেকে যায় (‘আ পকেটফুল অফ রাই’)। এটা তাই আশ্চর্যের নয় যে, আগাথা ক্রিস্টি বলশেভিকদের সহ্য করতে পারতেন না, প্রচুর গালমন্দ করেছেন। অবশ্য লাল রঙে অ্যালার্জি তাঁর সময় ও শ্রেণির পক্ষে বেশ সাধারণ ব্যাপার ছিল।
তবে ডিটেকটিভ সাহিত্যে রক্ষণশীলতার ধ্বজা ক্রিস্টি প্রথম ওড়াননি। তাঁর বহু আগেই কোনান ডয়েল বা চেস্টারটনরা ছিলেন। তার কারণও ছিল। যা কিছু শাশ্বত আর যা কিছু ব্যক্তিগত (সম্পত্তি হোক বা ভালবাসার মানুষ), তার ওপর হস্তক্ষেপ ভয়াবহ অপরাধ, এটা তখনকার বুর্জোয়া দর্শনের ভিত্তি ছিল। আধুনিক গোয়েন্দাসাহিত্য সেই ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে। এগুলোকে বাদ দিয়ে ক্রিস্টি তাঁর মডেল বানাতেও পারতেন না।
অনেক বছর পেরিয়ে এসে, সুইস লেখক ফ্রিডরিশ ডুরেনম্যাট তাঁর রহস্য উপন্যাস ‘দ্য প্লেজ’ দিয়ে ক্রিস্টির নির্মাণ করা এই আদর্শ ডিটেকটিভ সাহিত্যের মডেলকে ভেঙে দেবেন। প্রায় অপ্রাসঙ্গিক করে দেবেন ডিটেকশন সম্পর্কিত প্রচলিত ধ্যানধারণা, আর সেটাই হয়তো উত্তরাধুনিক ক্রাইম কাহিনি-র সূচনা (ডুরেনম্যাট এরকম তকমা পেয়ে চটে যেতেন আমি নিশ্চিত)। ডুরেনম্যাটের সমসময়ে নর্ডিক নোয়া এসে আবার রহস্য উপন্যাসের গোড়া ধরে টান দেবে, যেখানে ডিটেকটিভ ঈশ্বরপ্রতিম কেউ নয়। কিন্তু সেগুলো বৈপ্লবিক কাজ হলেও ক্রিস্টি-র তুলনায় জনপ্রিয় হবে না। কারণ ক্রিস্টি তাঁর লেখার গুণে ততদিনে কমফর্ট জোনে পরিণত হয়েছেন। তাঁর বইগুলো মানুষকে ডিস্টার্ব করে না। বরং স্টেটাস কুয়ো-কে ভিন্ডিকেট করে। আগাথা ক্রিস্টি যেখানে যতটুকু ভাঙেন, সেটা রহস্য কাহিনির ট্রোপে। তার বাইরে তিনি কনভেনশনের ধ্বজাধারী। ভিক্টোরিয়ান অবশেষের রোমান্টিকতা তাঁর সম্বল (মনে রাখতে হবে, ক্রিস্টির সর্বক্ষণের সঙ্গী ছিল কিটস-এর রচনাবলি)। তাঁর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে আমেরিকান লেখকরা যখন হার্ড-বয়েল্ড ক্রাইম ফিকশন আনছেন, রেমন্ড শ্যান্ডলার বা ড্যাশিয়েল হ্যামেটের মতো কিংবদন্তিরা, আর সমালোচনায় ছারখার করছেন ক্রিস্টি-কে, কারণ তাঁর নির্মিত জগৎ নাকি অবাস্তব, সেগুলো তুমুল জনপ্রিয় হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু সর্বকালের সেরাদের মধ্যে জায়গা করে নেওয়া? ফ্রিডরিশ ডুরেনম্যাটের ‘দ্য প্লেজ’ অথবা ‘দ্য জাজ অ্যান্ড হিজ হ্যাংম্যান’, এগুলো যুগান্তকারী বৈপ্লবিক। তেমনই উমবের্তো একো।
কিন্তু যেটা বুঝতে হবে, বিপ্লব যুগে বাঁচে আর শাশ্বত বাঁচে কালে। নাস্তিক অনেকেই হয়, কিন্তু পূর্বপুরুষের ঠাকুরের সিংহাসনে নিত্যপুজোর শালগ্রাম শিলাকে ছুড়ে ফেলে দেওয়ার সাধ্য হয় ক’জনের? ক্রিস্টি আমাদের শালগ্রাম শিলা। তাঁর অনড়-অব্যয় জগৎ, সে যতই অনুপস্থিত ছায়া ফেলুক না কেন, তা আমাদের কল্পনাকে সুখ দেয়। কনজার্ভেটিভ সাহিত্যের সম্ভবত মহত্তম শৃঙ্গারোহণ এখানেই। এর নেপথ্যে দীর্ঘ সমাজতাত্বিক ব্যাখ্যা আছে— কেন কট্টর রাজতন্ত্রী বালজাক কার্ল মার্ক্সের প্রিয় লেখক ছিলেন, বা রেজিম পরিবর্তনের পরে সংস্কৃতি কি নিজেকে পাল্টে ফেলে না কি নতুন রেজিমকে প্রভাবিত করে— কিন্তু আগেই বলেছি সেসব তত্ত্বে ঢুকব না।
মৃত্যুর পঞ্চাশ হল। বই, সিনেমা, সিরিজ, ‘মাউসট্র্যাপ’ নাটকের হইহই— সবকিছু মিলিয়ে যা ভাবগতিক, একটা কথা চোখ বুজে বলা যায়। মৃত্যুর একশো বছর হবে যেদিন, নিশ্চিতভাবেই আমি তখন বাঁচব না এবং মানুষ আমাদের, মানে আমি-আপনি, ডাকবাংলা— সবাইকে ভুলে যাবে। কিন্তু তখনও নতুন কোনও কলমচি আমার মতোই মাথা চুলকোবে— ক্রিস্টির জনপ্রিয়তার নেপথ্যের রহস্যটা ঠিক কী? শার্লক হোমস বিষয়ে ভিনসেন্ট স্টারেট একবার বলেছিলেন, ‘হোমস কখনও ছিলেন না, আর তাই কখনও মরতেও পারেন না।’ ক্রিস্টি-র ব্যাপারে বক্তব্যটা একটু বদলে দেওয়া যায়, ‘ইতিহাস জুড়ে ছিলেন, তাই তাঁর মৃত্যু দিয়ে কারও কিছু আসে যায় না।’