ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2025

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • সুরা-রোপিত


    সার্থক রায়চৌধুরী (January 8, 2025)
     

    যিশু জন্মাবে-জন্মাবে করছেন। চারদিকে প্রবল বাঁশি, ভেঁপু, সিটি, বড়-বড় বক্স বাজিয়ে ‘শিলা কি জওয়ানি’ আর ‘টুম্পা সোনা’র সঙ্গে উদ্দাম নাচে মেতে উঠেছে সরকারি আলোয় ঝলমল করতে থাকা নিম্নমধ্যবিত্ত পাড়া। রাস্তার দু’ধারে বসেছে হরেক খাবারের অস্থায়ী স্টল, সবাই এলাকার মানুষ—ক্রেতা, বিক্রেতা, দর্শক। ভিড় জমেছে সালামি-সসেজ আর কেকের দোকানগুলোয়। বড়রা প্রকাশ্যে আর যুব-তরুণ ও কিশোর-প্রজন্ম একটু আবছায়ায় গিয়ে দু’ঢোক মেরে কেক খেয়ে চার্জ করে চলেছে সন্ধে থেকে। চারদিকে একটা তেরি-মেরি কহানি টাইপ মেরি-মেরি ভাব।

    সকলেই হাসছে, গল্প করছে, আনন্দ করছে। ঠিক এইরকমই একটা সময় বেধে গেল হইহই কাণ্ড। শোরগোলটা যেদিক থেকে ভেসে আসছে, সেই দিকেই এগোতে থাকলাম সকলে। অকুস্থল মাধবের মেক-শিফ্‌ট মিষ্টির দোকান, আসামি পিন্টুদা। ঘটনাটা অভূতপূর্ব! মাধবের মিষ্টির দোকান, পুরনো দোকানঘর ছেড়ে তিনটে বাড়ি পরে নতুন ওঠা ফ্ল্যাটে নিচে উঠে এসেছে। স্থানান্তর প্রক্রিয়া কমপ্লিট হলেও আগের দোকানঘর এখনও বিক্রি বা ভাড়ায় যায়নি বলে হাফ-তোলা শাটারের উপরে বড়-বড় করে ‘To Let’ লিখে সেটিকে ভাঁড়ার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছিল। আধো-অন্ধকারে নেশায় বুঁদ পিন্টুদা সেটিকে পাড়ায় জনকল্যাণমূলক কাজের নতুন স্থাপনা— একটি নির্মীয়মাণ ‘Toilet’ ভেবে ভিতরে প্রবেশ করে এবং নিজেকে ভারমুক্ত করে। শুধু তাই নয়, যে-পাত্রটিকে তিনি মূত্রাধার ভেবে ভাসিয়েছেন,সেটি ছিল টুলের উপরে রাথা পান্ঠুয়ার গোলাপি গামলা। উপরন্তু হাতেনাতে, (মানে কট কি হ্যান্ডেড বলব জানি না), হওয়ার পরও, মাধবের কোনও স্পেলিং-সেন্স নেই, একটা ভাওয়লের অভাব যে কোনো সুইট ইস্যুকে প্রায় হিসুতে বদলে দিতে পারে, এবং তার জন্য মাধব এবং মাধবের চোদ্দগুষ্টির অশিক্ষাই যে আসলে দায়ী, ইত্যকার প্রতিবাদ নিয়ে সোচ্চার পিন্টুদা। উত্তেজিত জনতা, হাওয়া-বাতাস, তাছাড়া পিন্টুদা বার বার বলে চলেছে, ‘আরে! আমি তো বাবলু আর তারও আগে গৌরবকে ওখানে বাথরুম করতে দেখে ওটাকে বাথরুম ভেবেছি, বাবলুই তো বলল যে “ভেতরে একটা টাব করে রেখেছে আপাতত, এখানেই করিস, নোংরা করিস না।”’ পাশে পিয়ারিবাবুর গলিতে তখন একাধারে ওয়াক ও বমির শব্দ। দেওয়াল ধরে বিপলাই, মানু, তোতন ভাসিয়ে চলেছে। পাশে দাঁড়ানো বিধানদাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আউট?’ বিধানদা সামনেক বাওয়ালের দিকে তাকিয়ে নির্বিকার উত্তর দিল, ‘ক্রিসমাসের ভমিটগুচ্ছ। মানে য়ারা পান্তুয়া ঝেড়ে খেয়েছিল।’

    আরও পড়ুন : পঁচাত্তর বছরের বুড়ো ভাইরাস এইচএমপিভি হঠাৎ এখন কেন ভাইরাল?

    ডিসেম্বর শেষের উৎসবক্লান্ত আলোর মালা খোলা হচ্ছে নতুন বছরে। সেলুনের আয়নায় নিজের পুরনো মুখ দেখতে-দেখতে দু’কলি বিষণ্ন কবিতা সবে দানা বাঁধতে শুরু করেছে, সুবোধদা চুলে কলপ লাগিয়ে একটা সিগারেট ধরাতে যাবে, ‘শালারা! এক সপ্তাহে প্রায় দেড়শো কোটি টাকার মদ খেয়ে ফেলেছে, দেখেছিস!’

    সেলুনের সামনে পাতা বেঞ্চে বসে শৈলেনজেঠু। হাতে খোলা খবরের কাগজ। সাল-সোয়েটার-মাঙ্কি ক্যাপ পরেও ঠকঠক করে কাঁপছেন। শীতে নয়, সম্ভবত রাগে-উত্তেজনায়। বছরের প্রথম রবিবার, পাড়ার ব্যস্ত সেলুন আর সক্কাল-সক্কাল এইরকম একটি টপিকের টপকে পড়া সদাস-তর্ক বাঙালির কাছে টোটাল টুর্নামেন্ট।

    ‘হবে না! পাড়ায়-পাড়ায় মদের দোকান খুলে, অ্যাকাউন্টে-অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠিয়ে, চাকরিবাকরি তুলে দিয়ে ছেলেপিলেগুলোকে বেকার করে রাখলে তো এটাই হবে শৈলেনদা!’, সুবোধদা তাচ্ছিল্যভরে বলে সিগারেটটা ধরিয়ে ফেললেন।

    ছবি: পৃথ্বী বসু

    ‘ঠিক বলেছিস সুবোধ, আমরা যখন কালেভদ্রে, ন’মাসে-ছ’মাসে একটু-আধটু খেতুম, তখন হয় গড়িয়া নয়তো ট্রামডিপো, এক বোতলের পয়সা জোগাড় করতেই একবেলা কাবার। তখন এত ফুর্তিও ছিল না, এত সময়ও নয়। এখন তো ফোন থেকে বোতাম টিপলেই ঘরে এসে মদ দিয়ে যাচ্ছে।’ হাফের একটু বেশি দাড়ি কামানো অবস্থাতেই আসরে নেমে পড়েছে তপনকাকু। হাতে রেজর আর কাঁধে তোয়ালে নিয়ে এবার মদনের পালা।

    দীর্ঘদিন ধরে এই সেলুনে বহু মানুষের চুল-দাড়ি কাটতে-কাটতে, সাদা চুল-গোঁফ কালো করতে-করতে, তাদের বিভিন্ন কথা ও বার্তা শুনতে-শুনতে মদন একটু দার্শনিক-গোছের হয়ে উঠেছে— ‘শোনো, আগে মদ-গাঁজা এসব ছিল নিষিদ্ধ জিনিস, আর এখন হয়ে গেছে ট্যাটাস সিম্বল। বর-বউ একসাথে খাচ্ছে। ছেলেমেয়ে বাপ-মা’র সামনেই মাল খাচ্ছে, বিড়ি টানছে। আগে যে-ফ্যামিলিতে একটা লোক মাল খেত, এখন সেই ফ্যামিলির চারজন খাচ্ছে। এবার হিসেব করো শীতের সময়, বছরশেষের ছুটির বাজার, সব মিলে যাবে।’

    ‘হারবার্ট’ ছবির দৃশ্যে শুভাশিস মুখোপাধ্যায়

    বাইরে থেকে সেলুনে ঢুকে সবার দিকে একটা করুণাঘন ঘৃণার দৃষ্টি হেনে শুরু হল বুলবুলের (আমাদের কাউন্সিলর) ভাষণ, ‘তাহলে দোষটা সরকারের, তাই তো? সেটাই তো বলবে! তোমাদের চিন্তাভাবনাগুলো ব্যাঙ্কের লকারে রেখে এসো শৈলেনজেঠু। কী সুবোধ কাকা, পাড়ায়-পাড়ায় তো অনেক খাবারের দোকান, মিষ্টির দোকান, জিমও হয়েছে! তা মানুষ কি খাবার আর মিষ্টি খেয়ে ডায়াবিটিস বাধিয়ে ফেলছে? না বীভৎস লেভেলে জিম করে সব ঋত্বিক আর শিল্পা হয়ে যাচ্ছে? আর পাঁচটা জিনিসের মতো মদও একটা আইটেম। তার দোকান খুললেই দোষ? সরকারের কত আয় হয় এর থেকে কোনও আইডিয়া আছে? কত লোকের কর্মসংস্থান হচ্ছে এর থেকে জানো? সুইগি, জোমাটো, কত ছোট-ছোট স্ন্যাক্সের দোকান হয়েছে দ্যাখো না? মানুষ শান্তিতে আছে, আনন্দে আছে, ফেস্টিভাল টাইমে একটু বেশি খেয়ে নিয়েছে। বাম জমানার চৌত্রিশ বছরে এটা হয়েছে?’

    ‘বাইশে শ্রাবণ’-এর একটি দৃশ্যে প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়

    সেলুনের পাশেই পদ্মদির চায়ের দোকান। উনুন ধরিয়ে ধুনো দিতে-দিতে এবার পদ্মদি দরজার পাশ থেকে মুখ বাড়িয়ে বলতে থাকল, ‘শোন বুলবুল, ওসব পার্টি-ফার্টি বাদ দে। তোদের জন্য আমাদের মতো কত গরিব মানুষের সর্বনাশ হচ্ছে জানিস? বাড়ি জোয়ান ছেলেগুলো ওই বিষ গিলে-গিলে সব শয়তান তৈরি হচ্ছে। শুধু টাকা দাও, টাকা দাও। এক পয়সার রোজগার তো চার পয়সার মদ! লিভার পচে যাচ্ছে। মরে যাচ্ছে, তবু বাপ-মায়ের ওপর অত্যাচার কমছে না। সে-খবর রাখিস?’

    কান্নাভেজা কথাগুলো ঘুরতে থাকে সেলুনের বন্ধ, ঝুল-পড়া পাখার উপর। একটা সাময়িক স্তব্ধতা নেমে আসে। ফের শুরু করে মদন, ‘হিসেবটা কিন্তু বুঝতে হবে। দ্যাখো চোলাই বন্ধ হয়ে গেছে, ইংলিশের দোকানেই বাংলা বিক্রি হচ্ছে; তাহলে যারা চোলাই খেত, তারাও এখন ইংলিশের দোকান থেকেই বাংলা কিনছে। আবার বাংলার দাম এখন যা হয়েছে, তার থেকে একটু বেশি দিলেই ইংলিশ। লোকদের পকেটে কাঁচা পয়সার অভাব নেই, কত রকমের কাজ বেরিয়েছে বলো তো? আঁশ বিক্রি, চুল বিক্রি, মাসাজ করা, টোটো চালানো, সারানো… বিশ্বাস করবে না, মালির কাজ, ড্রাইভারির কাজ আর মাইনে যেরকম বেড়েছে সেরকম কাজও। এই তো আমার ডাইনো দেশে বাঁদর তাড়িয়ে মাসে হাজার-দেড় হাজার কামাচ্ছে। তাহলে শীতের সময়ে মাল বিক্কিরি তো বাড়বেই!’

    শৈলেনজেঠু বাইরে থেকে উঠে এসে কাগজটা রেখে চাপা একটা আক্ষেপের স্বরে বলে উঠল, ‘এখন তো মেয়েরাও প্রচণ্ড মদ খাচ্ছে, সেটাও একটা ফ্যাক্টর।’

    আমি এই প্রথম বলতে বাধ্য হলাম, ‘না, সেটা ফ্যাক্টরও না। ডিসকাশনের ব্যাপারও না। ছেলেরা একা মদ খাওয়ার থেকে ছেলেমেয়ে মিলেমিশে মদ খেলে ভাগে কম খাওয়া হয়, ওসব তোমরা বুঝবে না।’

    ‘তোর ডাইনো মাল খায়? যা বুঝিস না, তা নিয়ে লেকচার দিস না। খবরটা কোথায় বেরিয়েছে দেখেছ সবাই? ওটা ইচ্ছে করে রাজ্য সরকারকে নিয়ে কুৎসা করার জন্য করা হয়েছে।’

    বুলবুল ওর লাইনে গোটা ঘটনাটাকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা সবে শুরু করেছে, তপনকাকু (দাড়ি কাটা কমপ্লিট) বুলবুলের দিকে ঘুরে একটু শ্লেষাত্মক সুরে বলে উঠল, ‘সে কী রে! আমি তো শুনলাম এবার পার্ক স্ট্রিটে কম লোক হয়েছে বলে তোদের দলই এই খবর করতে পয়সা দিয়েছে, যাতে দেখানো যায় মানুষ সব প্রতিবাদ, প্রতিরোধ ভুলে এখন আবার প্রাণ খুলে আনন্দ করছে!’

    ‘তোমাদের তো বিলুপ্ত হলেও ডায়লগ থামবে না কোনওদিন, ওই ধনশক্তি-গণশক্তি ছেড়ে একটু চারপাশটা ঘুরে দেখো।’ বলে বুলবুল বেরিয়ে গেল।

    শৈলেনজেঠু বাইরে থেকে উঠে এসে কাগজটা রেখে চাপা একটা আক্ষেপের স্বরে বলে উঠল, ‘এখন তো মেয়েরাও প্রচণ্ড মদ খাচ্ছে, সেটাও একটা ফ্যাক্টর।’

    আমি এই প্রথম বলতে বাধ্য হলাম, ‘না, সেটা ফ্যাক্টরও না। ডিসকাশনের ব্যাপারও না। ছেলেরা একা মদ খাওয়ার থেকে ছেলেমেয়ে মিলেমিশে মদ খেলে ভাগে কম খাওয়া হয়, ওসব তোমরা বুঝবে না।’

    কিছুক্ষণ আবার সবাই চুপ। সুবোধদা চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়— ‘ওয়ার্ডভিত্তিক একটা ডেটা পাওয়া গেলে বোঝা যাবে, কনসাম্পশনের এপিসেন্টারটা কোথায়।’

    মদন বাটি আর বুরুশ ধুতে-ধুতে বলে, ‘টিভির ওই ঝগড়াগুলো দেখে-দেখে তোমার মাথাটা গেছে, ওগুলো কম দ্যাখো। আরে, আরও একটা মেন কারণ হল বাংলাদেশে হাসিনার পতন। ওখানে মদ যা ছিল সব উড়ে গেছে, তাই এখান থেকে নতুন স্টক গেছে।’

    ব্যাপারটা আন্তর্জাতিক স্তরে ছড়িয়ে পড়ার আগেই বেরিয়ে পড়ি রাস্তায়, সামনেই ঝন্টাদা নিজের রিক্সার সিটে বসে বিড়ি টানছে আর মিটিমিটি হাসছে। ‘কী ব্যাপার ঝন্টাদা!’

    জিজ্ঞেস করতেই ঠোঁটের কোণে একটা হালকা হাসি ঝুলিয়ে উদাসীন আক্ষেপে সে বলে ওঠে, ‘আর নিয়ম! আমাদের জামানায় নিয়ম ছিল, বুঝলি! নিয়ম। ন-টা বাজবে, দোকান বন্ধ। এখন করে দিল সাড়ে দশটা। ড্রাই ডে তুলে দিল। ওই একটা ড্রাই ডে আর বাকি দিন রাত ন-টা থেকে রাত দুটো অবধি যা পরিশ্রম করেছি! ব্ল্যাকে মাল বেচে এক রাতে যা কামিয়েছি, এখন এক সপ্তাহেও হয় না। আমাদের কথা কেউ ভাববে বল? নিয়মটা যদি ফিরে আসে না, হাজার-হাজার ছেলেমেয়ের ইনকাম হবে। বাংলার সোনার দিন ফিরে আসবে। বুলবুলকে বলিস, আমি বলেছি ওর দিদিকে বলতে।’

    একশো সাঁইত্রিশ কোটি টাকার মদ খেয়েছে কলকাতার লোক। এই শীতে। শীতকাল আবার কবে আসবে সুপর্ণা?

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook