ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • ‘ম্যাটার-অফ-ফ্যাক্ট’ ব্যক্তিত্ব


    জয়ন্ত ঘোষাল (December 28, 2024)
     

    এখন গণতন্ত্র মানেই চিৎকার। চিৎকার করে জানাতে হয়, আমি জননায়ক। তবু এই বিরাট গর্জনের গণতন্ত্রে বিরল কিছু মানুষ থাকেন, যাদের জন্যই বলা চলে, ব্যতিক্রমই সত্য। এমনই একজন ব্যক্তিত্ব ছিলেন, ভারতের দু-দফায় দশ বছরের প্রধানমন্ত্রী, মনমোহন সিং। রাজ্যসভার সাংসদ হিসেবে ৩৩ বছর। এরপর গত এপ্রিলে তিনি সক্রিয় রাজনীতি থেকে অবসর নেন। আর গান্ধী পরিবারের বাইরে একমাত্র কংগ্রেস নেতা তিনিই, যিনি টানা দু-দফায় প্রধানমন্ত্রীর আসনে ছিলেন। 

    ১৯৩২ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর মনমোহন সিং জন্মেছিলেন এখনকার পাকিস্তানে। সেটা ছিল পাঞ্জাবের গাহ্ নামক গ্রামে। বাবা সীমান্তের একটা গ্রামে শাকসবজি বিক্রি করতেন।‌ সেই শাকসবজি বিক্রির জন্য একটি ঠেলাগাড়ি ছিল।‌ মনমোহন সিং কিছুদিন বাবার সঙ্গে থেকেছেন। কিন্তু দেশভাগের সময় এ-পাড়ে এসে হলদোয়ানি এবং পরে অমৃতসরে থাকেন। অমৃতসর হিন্দু কলেজে অনেক কষ্ট করে অর্থনীতির স্নাতক হন।

    তার পরের ইতিহাস তো আমাদের সকলের জানা। এখন আপনি যদি রাজনীতিতে আসার আগে খুবই নিম্নবর্গের ইতিহাস থেকে উঠে আসেন, আপনার শিকড় যদি বিস্তৃত থাকে কোনও রেলস্টেশনের চায়ের দোকানে অথবা কোনও কারখানায় শ্রমিকের ভিড়ে, তাহলে রাজসিংহাসন অলংকৃত করার পর আপনাকে নিজের ঢাক নিজেকে পেটাতে হবে। বলতে হবে, আমি প্রধানমন্ত্রীর কুর্সিতে বসেছি বটে, কিন্তু আসলে আমি তোমাদেরই লোক। 

    দিল্লিতে সাংবাদিকতা করার সূত্রে মনমোহন সিং-কে কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে। যেমনটা সাংবাদিকদের হয় আর কি! কখনও এই চিৎকার জিনিসটা তাঁর মধ্যে দেখিনি।‌ মনমোহন সিংয়ের সঙ্গে বহুবার বিদেশ গেছি। বিদেশে যাওয়ার সময়ও তিনি খুব কম কথা বলতেন। বিদেশে গিয়েও হইহুল্লোড়ের মধ্যে কম থাকতেন। মনমোহন সিংকে বরাবর দেখেছি, খুব ‘ম্যাটার-অফ-ফ্যাক্ট’ ব্যক্তিত্ব। ইংরেজিতে আরেকটা শব্দ আছে— ‘আন্ডারস্টেটেড’।‌ মনমোহন সিং সেরকম ছিলেন।

    মনমোহন সিং প্রথম প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর তাঁর প্রথম বিদেশ সফর ছিল ব্যাংকক। সেখানে বিমসটেকের সম্মেলন ছিল। প্রধানমন্ত্রীর মিডিয়া উপদেষ্টা সঞ্জয় বারু আমাকে ফোন করলেন‌। বললেন, ব্যাংকক যাবে? কেননা, বাংলা কাগজের জন্য খুব জরুরি। উনি ব্যাংকক দিয়ে দিয়ে শুরু করছেন, কেননা ব্যাংকক মানে হচ্ছে ‘লুক ইস্ট’ পলিটিক্স। অর্থাৎ ভারতবর্ষ থেকে আজকের ভারত অবধি আমরা কিন্তু পুবের দিকে তাকাচ্ছি। ভারতের পূর্বাঞ্চল পৃথিবীর এই দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিস্তৃত অঞ্চলের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে। উত্তর পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোর সঙ্গে সড়কপথে এশিয়ার সংযোগ স্থাপন হচ্ছে। মনমোহন সিং তাই ব্যবসা-বাণিজ্য, আমদানি-রপ্তানি এসব ক্ষেত্রে বিমসটেক সম্মেলনকে খুব গুরুত্ব দিচ্ছেন। সেই সফরে গিয়ে দেখলাম মনমোহন সিংকে, কত মনোযোগ দিয়ে তিনি প্রতিটি বৈঠক করেন!

    মনমোহন সিং তো শুধু অর্থনীতিবিদ ছিলেন না। তিনি রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার কাণ্ডারি ছিলেন। তিনি প্রশাসক ছিলেন, আমলা ছিলেন। তাই তাঁর কাজকর্মের মধ্যে ‌রাজনৈতিক নেতাদের যে কথা বলার সিনড্রোম, সেটা ছিল কম। কথা শোনার অভ্যেস ছিল বেশি।

    মনে আছে, মরিশাসে মনমোহন সিং গেছেন। সেখানে আমরা বেশ কয়েকদিন ছিলাম। সমুদ্রের তটে একটা অসাধারণ শহর। সবুজ শ্যামলিমা। এদিকে সুনীল আকাশ। আমরা যে-হোটেলটাতে ছিলাম, সেই হোটেলের ঘরগুলো একতলা। আর একতলার ঘরের পিছনের যে জানলা, সেই জানলা-সংলগ্ন দরজা খুলে সামনের বিচে চলে যাওয়া যায়। সব সাংবাদিকরা, প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ের অফিসাররা, মিডিয়া উপদেষ্টা সঞ্জয় বারু— সকলে মিলে আগুন জ্বালিয়ে বনফায়ার করলাম। অনেক রাত পর্যন্ত আমরা ওখানে আনন্দোৎসব করলাম। গানবাজনা হল।‌ হইচই হল। সারাদিন কাজ করার পর আমাদের ও প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ের সব কর্তাদের নিজেদের মধ্যেও অনেক আলাপ-পরিচয় হত। মনমোহন সিং কিন্তু এলেন না। সন্ধের পর যদি কোনও সরকারি কাজ‌ না থাকত, তাহলে দেখতাম, বিদেশে গিয়ে উনি ঘরে ঢুকে পড়তেন। সাধারণত, উনি স্ত্রী, মেয়ে, জামাই এদের খুব বেশি নিয়ে আসতে চাইতেন না। কখনও-সখনও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রধানমন্ত্রীর স্ত্রী গুলশন কউর হয়তো আসতেন। আমেরিকায় ওঁর এক মেয়ে থাকতেন। কিন্তু যে দুই মেয়ে দিল্লিতে থাকত, তাঁদের মধ্যে একজন দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপিকা।‌ তাঁরা কিন্তু খুব একটা বাবার সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর সফরের আনন্দ নেওয়ার জন্য ঘুরে ঘুরে বেড়াতেন, এমনটা দেখিনি। এক জামাই তো গোয়েন্দা অফিসারই ছিলেন দিল্লিতে। তাঁকে তো দেখাই যেত না। উড়িষ্যার লোক।

    মনমোহন সিংকে মরিশাসে গিয়ে আমাদের আনন্দোৎসবে না দেখতে পেয়ে ফেরার সময়ে প্লেনে উঠে আমি ওঁকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম যে, আপনি তিনদিন ঘর থেকে বের হলেন না। শুধু মরিশাসের বৈঠক করলেন। এই তিনদিন কী করলেন? উনি বললেন, আমি মরিশাসের ইতিহাসের ওপর একটা বই নিয়ে এসেছিলাম। সেই বইটা দিল্লিতে পড়ার সময় পেতাম না।‌ এখানে এসে তিনদিন সময় পেয়ে গেলাম, তাই আমি তিনদিনে মরিশাসের ইতিহাসটা পড়ে ফেললাম। তারপর তিনি কীভাবে বিহারিরা মরিশাসে এসেছিল, তারা এখানে কীভাবে বসবাস শুরু করে, বিহারিদের মরিশাসে গ্রাম আছে, কীভাবে মরিশাসে আখের চাষ শুরু হল ও সাফল্য পেল ইত্যাদি নানা গল্প তিনি আমাদের শোনালেন। আমরা মরিশাসের ওই বিহারিদের গ্রাম দেখতেও গিয়েছিলাম। ভারতীয় বংশোদ্ভুত মানুষরা কীভাবে সেখানে গিয়ে জীবনযাপন শুরু করেছে, দেখেছিলাম। তারা আর বিহারে ফিরে যেতে চায় না। মরিশাসেই থাকতে চায়। সেসব সাক্ষাৎকার-টাক্ষাৎকারও আমরা নিয়েছিলাম। কিন্তু মরিশাসের ইতিহাসের বই মরিশাসে গিয়ে কিন্তু আমরা পড়িনি। সেই পড়ার কাজটা কিন্তু করেছিলেন ড. মনমোহন সিং।

    এহেন মনমোহন সিংয়ের ক্ষেত্রে দেখেছি, সরকারি নীতি বা সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে যখনই কঠোরতা প্রদর্শনের প্রয়োজন হয়েছে, দ্বিধা করেননি। তা না-হলে আমেরিকার সঙ্গে পরমাণু চুক্তি করা তো খুব সহজ কাজ ছিল না। পরমাণু চুক্তি নিয়ে তখন প্রকাশ কারাতের নেতৃত্বে সিপিএম কিছুতেই রাজি ছিল না।‌ প্রণব মুখোপাধ্যায় তখন অর্থমন্ত্রী। তাঁর সঙ্গে প্রতিদিন রাত্রিবেলায় সীতারাম ইয়েচুরির বৈঠক হচ্ছে। প্রকাশ কারাতও একদিন-দু’দিন এসেছিলেন সেই বৈঠকে। তাঁরা বলেই দিয়েছিলেন, কোনওভাবেই আমরা পরমাণু চুক্তি হতে দেব না। প্রণববাবুও মনমোহন সিংকে বলেছিলেন, পরমাণু চুক্তি করতে গেলে হয়তো সরকার পড়ে যাবে। সেখানে মনমোহন সিং কমিউনিস্টদের বিরোধিতার তোয়াক্কা না করে, মুলায়ম সিং যাদবের সমাজবাদী পার্টির সমর্থন আদায় করে একটা বৈপ্লবিক কাণ্ড করে ফেলেছিলেন। এবং পরমাণু চুক্তি সম্পন্ন করেছিলেন বুশের সঙ্গে। দেশ জুড়ে তিনি এই প্রচারেও সক্ষম হয়েছিলেন, এই পরমাণু চুক্তি দেশের স্বার্থের বিরুদ্ধে নয়।‌ এই পরমাণু চুক্তির ফলে গ্রামে-গঞ্জে গরিব মানুষদের কাছে অনেক বেশি বিদ্যুৎ পৌঁছতে পারে। সেই ভোটের পর আমরা কিন্তু দেখলাম, মনমোহন সিং দ্বিতীয়বারের জন্য প্রধানমন্ত্রী হতে সক্ষম হলেন। বিজেপি কিন্তু সেবার পরাস্ত করতে পারল না। এসব আজ ইতিহাস।

    মনমোহন সিংকে মরিশাসে গিয়ে আমাদের আনন্দোৎসবে না দেখতে পেয়ে ফেরার সময়ে প্লেনে উঠে আমি ওঁকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম যে, আপনি তিনদিন ঘর থেকে বের হলেন না। শুধু মরিশাসের বৈঠক করলেন। এই তিনদিন কী করলেন? উনি বললেন, আমি মরিশাসের ইতিহাসের ওপর একটা বই নিয়ে এসেছিলাম। সেই বইটা দিল্লিতে পড়ার সময় পেতাম না।‌ এখানে এসে তিনদিন সময় পেয়ে গেলাম, তাই আমি তিনদিনে মরিশাসের ইতিহাসটা পড়ে ফেললাম। 

    ২০১৪ সালে, মনমোহন সিং তাঁর প্রধানমন্ত্রিত্বের শেষ বেলায় এসে, শেষ সাংবাদিক সম্মেলনে বলেছিলেন— ‘আমি চুপচাপ থাকতাম বটে। কিন্তু সাংবাদিক সম্মেলন করতে কখনও ভয় পাইনি।’ আসলে এই কথাটির মধ্য দিয়ে কোন‌ও নাম না বলে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে একটু খোঁচা দিয়েছেন বটে। ভেবে দেখলে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ২০১৪ থেকে আজ পর্যন্ত এত কথা বললেও, সেগুলি সবই কিন্তু একমুখী। হয় সেটা এক্স হ্যান্ডেলের মাধ্যমে, নয় সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে, নয়তো ভিডিও ফুটেজ। সাংবাদিকদের সঙ্গে গেট টুগেদারও করছেন।‌ কিন্তু সাংবাদিকদের স্বতঃস্ফূর্ত প্রশ্নের মুখোমুখি হননি।   

    মৃত্যুর পর আমাদের দেশে একটু বেশি, অন্য দেশেও একই প্রথা— সমালোচনা ভুলে গিয়ে প্রয়াত ব্যক্তির প্রশংসা করতে শুরু করা। মনমোহন সিংয়ের মৃত্যুর পরে নরেন্দ্র মোদি থেকে শুরু করে অনুপম খের— সকলেই ধন্য-ধন্য করছেন মনমোহন সিংকে নিয়ে। কিন্তু কীভাবে মনমোহন সিংকে সমালোচনা করে, ব্যঙ্গবিদ্রূপ করে, তাঁর ক্যারিকেচার করে, তাঁর চলনবলন নিয়ে তামাশা করে অনুপম খের একটি ছবিতে অভিনয় করেছিলেন, সেকথা মনে হচ্ছে অনুপম খের নিজেই আজ ভুলে গেছেন। আজ তিনিই বিবৃতি দিচ্ছেন, তিনি প্রধানমন্ত্রীকে বোঝার চেষ্টা করেছিলেন। তাঁকে অনুসরণ করার চেষ্টা করেছিলেন‌।

    কাজেই কেউ চলে যাওয়ার পর, অবিচুয়ারি লেখার সময়ে আমরা সেই রক্তমাংসের মানুষকে মহান করে তুলি। তবে মনমোহন সিংকে যদি মনে করতে হয়, তবে ভারতের মানুষ তাঁকে মনে রাখবে তাঁর অর্থনীতির সংস্কারের জন্য। এবং মনমোহন সিংয়ের আর্থিক উদারবাদ, কার্যত ১৯৪৭-এর স্বাধীনতার পর দ্বিতীয় ‘স্বাধীনতা সংগ্রাম’– একথা বলেছিলেন নরেন্দ্র মোদির অধুনা আর্থিক উপদেষ্টা, বাঙালি অর্থনীতিবিদ সঞ্জীব স্যানাল। তিনি মনমোহনকে নিয়ে একটা বই পর্যন্ত লিখে ফেলেছিলেন।

    মনমোহন সিং প্রথম থেকেই রাজনৈতিক নেতা ছিলেন না, আমলা থেকে ক্রমশ রূপান্তরিত হন। তাঁর পরেও কিছু বৈশিষ্ট্য এমন ছিল, যা সাধারণত আজকের রাজনীতির সঙ্গে মিলত না। যেমন ‘তু-তু ম্যা-ম্যা’ সংস্কৃতি থেকে তিনি সহস্র যোজন দূরে ছিলেন। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে পচ্ছন্দ করতেন, প্রকাশ্য সংসদে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, এত ভাল মুখ্যমন্ত্রী হয় না। যা ওঁর মনে হয়েছিল, সাফ-সাফ বলে দিয়েছিলেন। একবার প্রণব মুখোপাধ্যায়কে অনুরোধ করলেন, আমি বুদ্ধদেববাবুকে বাড়িতে নৈশভোজে আমন্ত্রণ জানাতে চাই। প্রণব মুখোপাধ্যায় আয়োজন করলেন। তখনও মনমোহন সিং মাছ খেতেন। পরবর্তীকালে স্বাস্থ্যের কারণে হার্টের ব্যামো হওয়ায় তিনি মাছ-মাংস একেবারেই ছেড়ে দেন। আমার বেশ মনে আছে, তখন সাত নম্বর রেস কোর্স রোডে দুই বঙ্গসন্তান, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ও প্রণব মুখোপাধ্যায়, মনমোহন সিংয়ের অতিথি হলেন। রীতিমতো ইলিশ মাছ-টাছ রান্না হল।

    মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কেও খুব পছন্দ করতেন মনমোহন সিং। অনেক অর্থনৈতিক ব্যাপারে তাঁর সঙ্গে মনমোহন সিংয়ের মতান্তরও হয়েছে। কিন্তু সবসময়ে তাঁকে ডেকে, স্নেহ সহকারে প্রতিটি বিষয় বোঝানোর চেষ্টা করতেন। মমতার সেই সময়ে যে রাজনৈতিক উষ্ণতা, রাজনৈতিক আন্দোলনমুখিনতা, সিপিএম বিরোধিতা— সেসবের সমর্থক ছিলেন মনমোহন। যখন নরসিমা রাও প্রধানমন্ত্রী, তখন তো মমতা কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হয়েছেন, আর মনমোহন সিং অর্থমন্ত্রী। সুতরাং, একই ক্যাবিনেটে মনমোহন ও মমতা ছিলেন।

    মনমোহন সিংকে একবার দেখেছি লালুপ্রসাদের ব্যাপারে তিনি একটা কড়া বিবৃতি দিয়ে খুব বিতর্ক সৃষ্টি করেছিলেন বিদেশে গিয়ে। সেই সফরে আমিও ছিলাম। লালুপ্রসাদ যাদবকে রেলমন্ত্রী করা হয়েছিল, অথচ তাঁর নাম চার্জশিটে ছিল। এটা তিনি মেনে নিতে পারেননি। কিন্তু রাজনৈতিক চাপে সেটা তাঁকে মেনে নিতে হয়। কারণ সেটা দলীয় চাপ ছিল। সেটা তিনি প্রকাশ্যে বলে দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন চার্জশিটে নাম আছে, এমন কোনও ব্যক্তির মন্ত্রী হওয়া উচিত নয়। সেই নিয়ে শোরগোল পড়ে গিয়েছিল। রাহুল গান্ধী আবার তার বিরোধিতাও করেছিলেন। সব মিলিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছিল। এটা বেশ ব্যতিক্রমী ঘটনা। মনমোহন নিজে সততার প্রশ্নে‌, দুর্নীতির প্রশ্নে একটা কড়া মনোভাব নিয়েছিলেন। যদিও দেখছি, লালুপ্রসাদ যাদবও কিন্তু মনমোহন সিংয়ের ব্যাপারে এখন খুব গদগদ ভক্তি প্রদর্শন করছেন।

    তবে মানুষকে কী করে সম্মান দিতে হয়, তাও কিন্তু ওঁর কাছ থেকে শেখা। ইন্দিরা গান্ধীর সময় যখন প্রণব মুখোপাধ্যায় অর্থমন্ত্রী ছিলেন, তখন মনমোহন সিং ছিলেন রিজার্ভ ব্যাঙ্কের প্রধান। ফলে সেই সময় প্রণব মুখোপাধ্যায়কে ‘স্যর’ বলতেন। ২০০৪ সালে মনমোহন সিং হয়ে গেলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী, আর প্রণব মুখোপাধ্যায় হয়ে গেলেন‌ তাঁর অধীনে অর্থমন্ত্রী। মনমোহন সিং কিন্তু সারাজীবন প্রণব মুখোপাধ্যায়কে ‘স্যর’ বলে গেছেন। প্রণব মুখোপাধ্যায় তাঁকে বলতেন ‘ডক্টরসাব’। একটা অদ্ভুত পারস্পরিক, অম্লমধুর সম্পর্ক ছিল। মতান্তর-মনান্তর হলেও, পারস্পরিক সম্মান কী করে দিতে হয়, সেই ওল্ড স্কুল পলিটিক্স কিন্তু মনমোহন সিং ও প্রণব মুখোপাধ্যায়ের ক্ষেত্রে দেখেছিলাম। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরেও কিন্তু মনমোহন সিং সবসময়ে প্রণববাবুর কাছেই চলে আসতেন পরামর্শর জন্য। আবার নরসিমা রাওয়ের সময়ে, যখন তিনি অর্থমন্ত্রী হন, প্রণববাবু তখন যোজনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান। প্রণববাবুর ঘরে অর্থমন্ত্রী মনমোহন সিং দেখা করতে চলে আসতেন, যা সাধারণত হয় না। এই শিষ্টাচার কিন্তু ভারতের রাজনীতিতে একটা বিরল ঘটনা।

    শেষ করি একটা মজার ঘটনা দিয়ে। ২০০৪ সালে, লোকসভা নির্বাচনের আগে সোনিয়া গান্ধী আমাদের জন্য একটা নৈশভোজের আয়োজন করেছেন। তিনি তখন দশ নম্বর জনপথ থেকে চব্বিশ নম্বর আকবর রোডের লনে এসে সেই আয়োজনের দেখাশোনা করতে ব্যস্ত। সেখানে প্রণববাবুও আছেন, মনমোহন সিংও আছেন। প্রণববাবু তখন নানারকম স্ট্র্যাটেজি তৈরি করছেন। বিভিন্ন দলীয় সংগঠনের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক হচ্ছে। বিভিন্ন রাজ্যে ঘুরছেন।‌ সেই সময়ে মনমোহন সিং শারীরিক কারণে একটু কম সক্রিয়। কিন্তু ওঁর খুব খারাপ লাগছে, তিনি ভোটের সময়ে কিছু কাজ করছেন না বলে। তিনি সোনিয়া গান্ধীকে বললেন, ‘আমি তো অসুস্থ। কিছু কাজ করতে পারছি না। ম্যাডাম আপনি যদি বলেন আমি কিছু জনসভায় ভাষণ দিতে পারি বা যেতে পারি। কিছু রাজ্য, যেমন পাঞ্জাব-হরিয়ানায় কিছু জনসভা-টনসভা করতে পারি।’ সোনিয়া গান্ধী একটু মুচকি হেসে বলেছিলেন, ‘ডক্টরসাব আপনাকে এসব কিছুই করতে হবে না। আপনি বরং একটা কাজ করুন, দিল্লিতেই একটা-দুটো সাংবাদিক বৈঠক করুন। আমাদের আর্থিক নীতি ভোটের আগে একটু বোঝান। আর ইস্তেহার তো প্রকাশ হবে, তার ওপরেও আপনি কিছু বক্তব্য রাখতে পারেন।

    সেদিনই বুঝতে পেরেছিলাম, সোনিয়া ওঁকে সম্মান করেন, কিন্তু সাংগঠনিক ক্ষেত্রে, ভোটের প্রচারের জন্য যে তাঁর খুব বেশি প্রয়োজন নেই- সেটাও তিনি বুঝিয়ে দেন।

    ২০০৪ সালে ইউপিএ জোট জেতার পর অনেকেই ভেবেছিলেন, প্রণববাবুকে প্রধানমন্ত্রী করা হবে। কিন্তু সোনিয়া গান্ধী যাঁকে জনসভার পরিবর্তে প্রেস কনফারেন্স করার পরামর্শ দিয়েছিলেন, তাঁকেই করলেন দেশের প্রধানমন্ত্রী।

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook