সাহেবদের, ব্রিটিশদের উচ্চারণে, ‘বিয়েনালে’। দু-বছর অন্তর একবার। দুনিয়ার প্রথমটি হয়েছিল ১৮৯৫ সালে। ভেনিসে। বিবিধ শিল্পকলার প্রদর্শনী, অতীত থেকে শুরু করে সমকালীন পরিস্থিতি, মানুষের ক্রম-পরিবর্তনশীল জীবননির্ভর চিত্রবোধ, যা সব শিল্পসৃষ্টির আঁতুড়, তার প্রেক্ষিতে উৎসব। সঙ্গে আলোচনা। শহরের বিভিন্ন শিল্পকেন্দ্রে, ছড়িয়ে-ছিটিয়ে।
ভারতের প্রথমটি শুরু হয়েছিল কোচিতে। এই মুহূর্তে এমনই এক শিল্পমেলা চলছে বাংলায়- বেঙ্গল বিয়েনালে। এর প্রথম পর্ব সদ্য শেষ হয়েছে শান্তিনিকেতনে। এখন এসেছে কলকাতায়। ২০২৫ সালের জানুয়ারি মাসের ৫ তারিখ পর্যন্ত চলবে। অতএব, প্রায় একমাস সময়। যথেষ্টই। শীতের রোদ মেখে শহরের একপ্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে দৌড়ে বেড়ানো, প্রদর্শনী দেখার অসামান্য অভিজ্ঞতার সুযোগ হাতের মধ্যে। একেবারে ফ্রি। তবে কোনও কোনও জায়গায় প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব টিকিট রয়েছে। যেমন ইন্ডিয়ান মিউজিয়াম এবং ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল। প্রথম বেঙ্গল বিয়েনালে-তে ঠিক কী কী রয়েছে, তার আভাস এই প্রতিবেদনে। আইকনিক, জনপ্রিয়, ক্লাসিক শিল্পীদের আর-একবার ফিরিয়ে আনার পাশাপাশি আমজনতার কাছে কম পরিচিত কন্টেম্পোরারিদের কাজও রাখা হয়েছে গুরুত্ব দিয়ে। পক্ককেশ অভিজ্ঞরা এই সম্পদের সঙ্গে পরিচিত হলেও সদ্য স্কুল পেরনো আর্ট-প্রেমী নবীনদের জন্য এই উৎসব আরও জরুরি।
বঙ্গশিল্পের ঝলমলে পরম্পরাটি সবার সামনে সাজিয়ে দিয়েছেন উদ্যোক্তারা। বলে রাখা ভাল, শুধুমাত্র শিল্পকর্ম নয়, তার প্রদর্শনের জায়গা ও যত্নবান সম্পাদনা নতুন মাত্রা যোগ করেছে বেঙ্গল বিয়েনালে-তে। জানিয়ে রাখি, এটি শুধুমাত্র বাংলার কাজ, এমন নয়। আমরা সিদ্ধার্থ শিবকুমার মহাশয়ের কাছে কৃতজ্ঞ। বিনামূল্যে প্রাপ্ত পুস্তিকায় ওঁর কিউরেটরিয়াল নোটসে জানা গেল কেন এই সামগ্রিক প্রেজেন্টেশনের নাম ‘আঁকা বাঁকা’, থ্রু ক্রস কারেন্টস- ব্যাপারটা কী! প্রত্যেক ভেন্যুতে শিল্পী ও শিল্পকর্মের বিষয়ে বলা আছে। একটু শক্ত ইংরেজি, তবে অসুবিধে হবে না। এক-একটি লোকেশন ধরে আমরা এগব।
দক্ষিণ কলকাতায়, কালীঘাটের কাছে সদানন্দ রোডে ‘দ্য রেড হাউজ’ দিয়ে শুরু করি। মূলত একটি ক্যাফে। হেরিটেজ বাড়িটির সামনে দাঁড়ালেই সম্ভ্রম জাগে। মালিকরা প্রপার্টিটিকে ফ্ল্যাটবাক্স না বানিয়ে অথেন্টিক আদি চেহারায় ফিরিয়ে দিয়েছেন। লন্ডন, রোম শুধু নয়, কলকাতাতেও এসব হচ্ছে। তৈরি হচ্ছে চেনা গ্যালারি ছাড়িয়ে অজস্র নতুন শিল্পপ্রাঙ্গণ। সুখের কথা, বাড়ছে কলকাতার শিল্পচর্চার পরিসর। সামনে দাঁড়ালে প্রাচীন এই আবাসটি কেন গ্ল্যামারাস, এমন প্রদর্শনীর জন্য যথাযথ, সেটি বুঝতে অসুবিধে হয় না। জয় হোক ওঁদের।
চমৎকার কফির সুগন্ধে মাতোয়ারা এক সাবেকি সিঁড়ি দর্শকদের তুলে নিয়ে গেছে
তিনতলায়। সেখানেই যাবতীয় শিল্পসম্ভার। ঢুকলেই মালুম হয়, আমরা হস্তশিল্প মেলায় ঢুকে পড়িনি। তিনজন শিল্পী। আলাদা চরিত্রের আর্ট এক্সপ্রেশন। শরীর নয়, সবটাই হৃদয়ের অভিব্যক্তি। একান্তই ব্যক্তিগত, আর্ট বাজারের ঊর্ধ্বে অবস্থিত।
অধীপ দত্তর ‘আর্কিওলজি অফ দ্য প্রেজেন্ট’ প্রত্নতত্ত্ব ও এই সময়ের বিচিত্র সহবাস ও অনুভবের চিত্ররূপ। চিত্র বলতে তুলি দিয়ে রং দৃশ্যের দায়সারা বর্ণনা নয়। প্রচুর রেখা, বিন্দুর মাধ্যমে সিন্ধুর স্বাদ। মাইক্রোফাইন এক অনুসন্ধান। মিড্ল টোন থাকলেও, শেষ পর্যন্ত রেশ থেকে যায় অবধারিত সূক্ষ্ম এক কনট্রাস্টের। সবই ফ্রেমে বাঁধানো আধা ভাস্কর্য। যার বিচিত্র টেক্সচার বহু প্রাচীন একসময়, সভ্যতাকে নির্লিপ্ত বিস্ময়ে মিলিয়ে দিয়েছে আজকের আইডিওলজিতে। একটি সিরিজ আছে, প্যানেল বলা যেতে পারে, সেখানে ফ্রেম টু ফ্রেম ছবির ত্বক এমন অনেক গল্প শুনিয়ে গেছে যা মনকে নাড়া দেয় অমোঘ তেজস্বিতায়। ইন্ক্ অন পেপার। রয়েছে একটি দেরাজে সাজানো বিচিত্র কিছু ইন্টারেস্টিং দ্রব্য। ফাইবারগ্লাস। নাম, ‘বোরিং ইনস্ট্রুমেন্টস।’ ব্যাক টু দ্য ফিউচার।
পাশের ঘরে সমীরেন্দ্রনাথ মজুমদারের ‘বার্ন্ড ইন্টু বিয়িং।’ এখানে কিছু নস্টালজিয়ার ভগ্নাংশকে জুড়ে সৃষ্ট নিসর্গরাজি। পরিবর্তিত দুনিয়ায় চিরন্তন জীবনানন্দীয় অনুভূতির প্রকাশ। পাইরোগ্রাফি, অর্থাৎ কাঠের শরীরে সূক্ষ্ম অগ্নি স্পর্শে ফুটিয়ে তোলা ছবি।টেক্সচারধর্মী মোহময় চেহারা।
উত্তাপকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করার কারণগুলি সহজেই অনুমেয়। সুখের, ফুর্তির সেলিব্রেশন নয়। বিষিয়ে যাওয়া পরিবেশ, পরিবর্তিত আবহাওয়ার ফলাফল, পরিত্যক্ত হয়ে যেতে বাধ্য হওয়া মানুষের সাইলেন্ট আক্ষেপ প্রত্যেক ফ্রেমে। ঠিক সোমনাথ হোরের মতো, ক্ষতচিহ্নের সুষমা। একরঙা, একবগ্গা, একান্ত আক্ষেপের কাজ। ইতিহাস স্রেফ অতীতের সম্পত্তি নয়। শিল্পীর দৃষ্টিতে তা বর্তমানের অনেক গভীরে প্রোথিত এক গভীর বোধ।
শান্তিনিকেতন নিবাসী নীলাঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাব্যময় ভাষা ও রেখায় ফার ইস্ট
এশিয়া-র আমেজ। বাংলার চেনা ঋতুচক্র জাপানি স্টাইলে দেদার জল, কালি ও অপলক দৃষ্টিসুখের শান্তিময় মিশ্রণ। প্রকৃতির খামখেয়ালি উথালপাথাল, অথবা সমে এসে থামতে চাওয়ার অভিজ্ঞতাকে তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করার অভিব্যক্তি। রেখার সঙ্গে অননুকরণীয় ক্ষুদ্র কিছু কবিতা। সবই সাদার ওপর জবরদস্ত কালোতে। নীলাঞ্জনের অ্যাপ্রোচ নির্বিকার হলেও দর্শক সহজে এক ছবি থেকে অন্য ছবিতে চলে যেতে পারবেন না।
সাদার্ন অ্যাভেনিউয়ের বিড়লা অ্যাকাডেমির পাঁচতলায় টি কে পদ্মিনীর ‘আ সিম্ফনি ইন্টারাপ্টেড।’ কেরলের মানুষ। সমকালীন ভারতীয় শিল্পকলার অঙ্গনে মহিলা শিল্পী হিসেবে এঁর স্থান অমৃতা শেরগিলের পাশাপাশি। কে সি এস পানিকরের ছাত্রী। পাঁচ-ছয়ের দশকের কেরলের গ্রামীণ আবহ, বোধ, জীবনচিত্র নিয়ে ওঁর দশ বছরের স্বশিক্ষিত চিত্রজীবন। বোর্ডের ওপর তেল রং। ছবিতে নাম-সই, টাইটেল চোখে পড়ে না। ছোট করে এইটুকু বলা যেতে পারে। কেরলের সঙ্গে বাংলার সবুজ, সবীজ আবহের মিল আছে। মানসিকতা ও দৈনন্দিন জীবনেরও। টি কে পদ্মিনীর প্রায় সব ছবিতে মানুষকে কাছ থেকে দেখা, সরাসরি বর্ণনা করা। ত্রিমাত্রিকতার মুনশিয়ানা, মলিন ও উজ্জ্বল রঙের মেদুরতা দর্শককে স্তব্ধ করবে অকারণে। প্রদর্শনী কক্ষের মধ্যেই একটি উপকক্ষে কিউরেটর আর শিবকুমারের ভিডিও কথোপকথনটি জরুরি। শিল্পীকে অনেকটা আপন করে নিতে সাহায্য করে।
আলিপুর সেট্রাল জেল বদলে গেছে বেশ কিছুদিন আগে। সেটি আর অপরাধী ভবন নয়। কলকাতার অন্যতম শ্রেষ্ঠ সরকারি শিল্প প্রদর্শনশালা। কারাগার, ব্রিটিশ আমল, স্বাধীনতা উত্তর ভারত, জেলকেন্দ্রিক সংস্কৃতি দর্শনের এক অবিশ্বাস্য সংগ্রহশালা। বেঙ্গল বিয়েনালে স্বেচ্ছায় ঢুকে পড়েছে এই কারাগারে। জাঁকিয়ে বসেছে কিছুদিনের জন্য। অপরাধের স্মারকের পরিবর্তে শিল্প। বাঙালির সার্বিক মানসিক অবনমন, সরকারি ঔদাসীন্যের সত্য-মিথ্যার ঊর্ধ্বে এটি এক বিরল, নবকলেবরে সজ্জিত বিচিত্র বিচরণভূমি। রক্ষীরা আছেন বইকি। নজর রাখছেন দুর্মূল্য আর্ট ও অত্যুৎসাহী দর্শকদের ভিড়ের প্রতি।
প্রথমেই শান্তিনিকেতনের অর্পণ মুখোপাধ্যায়ের ‘আই আর ছত্তিরিশ’। প্রায়ান্ধকার ঘরে ব্যাকলিট সারি সারি ছবি। অবশ্যই সাদা-কালো। সবই বোলপুর, বীরভূমের জমিতে তোলা। আলোকচিত্রের আদিতম পর্যায়ের টেকনিককে নতুন করে আবিষ্কার করা একটা যাত্রা। অ্যামব্রটাইপ। ওয়েট কোলোডিওন প্রসেস। কাগজ নয়, ছবি ফুটেছে কাচের ওপর। তাই ব্যাকলিট। শিল্পীর স্মৃতিনির্ভর কাজের পরিচয়ে বলা আছে পরিযানের কথা। রয়েছে আপন দেশ, জমি, আবাসের সংজ্ঞা বদলে যাওয়ার আভাস। আজকের ডিজিটাল ছবির আবহে এই সময়ের দৃশ্যাবলি ধরে রাখতে প্রাচীন পদ্ধতির আশ্রয় কেন নেওয়া হল? সূত্র হল, স্মৃতিমেদুরতা-জনিত অনুভব চিত্রায়িত করার জন্য পুরাতনী অপটিক্স, কেমিস্ট্রিই যথার্থ। কঠিন কাজ। সময়সাপেক্ষ। অভিজ্ঞ শিল্পী অসামান্য মুনশিয়ানায় ধরে রেখেছেন রেট্রো সুরটি।
এরপর কালী। ‘রেভারেন্স এন্ড রেবেলিয়ন।’ ধর্ম নয়, আর্টের উন্মাদনায় ভাসতে চাইলে দিল্লি আর্ট গ্যালারির আহরিত দুর্দান্ত কালী সংগ্রহের আকর্ষণ অনতিদূরে অবস্থিত কালীঘাটের চেয়েও বেশি। রিপ্রোগ্রাফি, মধ্যযুগীয় এচিং, লিথোগ্রাফি, চেনা পটচিত্র, জলরং, তেলরং তো আছেই। আছে মকবুল ফিদা হুসেনের, সতীশ গুজরালের কালীও। কোম্পানি আমল, সাহেব সুবোদের কালী, নেটিভদের ছবি, ভাস্কর্য, কী নেই! কলকাতার ওল্ড কারেন্সি বিল্ডিঙে এর কিছু ছিল, এখন আর নেই, ফিরে গেছে দিল্লিতে। তাই আর একবার দেখার সুযোগ ছেড়ে দেওয়ার কোনও মানে হয় না। কালীর রূপ, রাগকে সম্ভ্রম না করে উপায় নেই। আর্ট নিশ্চিন্তে রাঙিয়ে দেয় ভয়ংকর, মিথিক্যাল এই দেবীকে। সাজিয়ে দেয় খাঁটি সোনার জলে ভেজা তুলি দিয়ে।
শীলা গৌড়ার ‘ইন্টারোগেশন রুম’ এক মেগা ইন্স্টলেশন, ৫ নম্বর সেল, একটি বড় ঘরের মধ্যে আয়োজিত। নামকরণ থেকে যে আন্দাজ পাওয়া যায়, তার স্বাধীন ইন্টারপ্রিটেশন। খোদ জেল কক্ষে। গা ছমছমে ব্যাপার। বাপ্পাদিত্য বিশ্বাসের ‘লিবারেশন’ বস্ত্রশিল্পের স্বাধীনতার, মুক্তির পরিচয়। পর পর তাঁতযন্ত্র, অবিন্যস্তভাবে ছড়িয়ে থাকা, বিছিয়ে দেওয়া সুতোর নকশার রোমান্স। স্রেফ কাপড়, টেক্সটাইলের গপ্প নয়, অবশ্যই। কলোনিয়াল যুগে এই লম্বা, আধা খোলা এই জায়গাটিতে তাঁতিদের কাজ করত বন্দিরা। নীল চাষ, অত্যাচার, এর সঙ্গে উদ্ভূত এক শৈল্পিক আবহ, ছুঁয়ে দেখার সুযোগ এখানে। ‘গরদ’, ‘জামদানি’ চেনা শব্দগুলির অন্যধারার ব্যাখ্যা দিয়েছেন শিল্পী, অত্যন্ত আধুনিক ও আকর্ষণীয় স্টাইলে। আবার সেই স্মৃতিতে ফিরে যাওয়া, যার সাক্ষী আমরা নই। ২০২৫ সালে দাঁড়িয়ে বয়ন আর্ট নতুন চেহারায় হাজির দেদার মুক্ত বায়ু চলাচল করা জেল প্রাঙ্গনে।
অত্যন্ত সুচিন্তিত, সুপরিকল্পিতভাবে আয়োজিত হয়েছে কলকাতার ‘বেঙ্গল বিয়েনালে ২০২৫’। শহরটির শিল্প-সংস্কৃতিকেন্দ্রিক আধুনিক দুরন্তপনার পরিচয় সর্বত্র।
ছবি সৌজন্য- লেখক