শ্যাম বেনেগাল না থাকলে হিন্দি সিনেমাও যে বলিউডি ফর্মুলার বাইরে গিয়ে তীব্রতা আর সত্যের আখ্যান হয়ে উঠতে পারে, তা আমরা, মানে দর্শকরা কখনও বুঝতাম না। বাংলায় এই ধারা চালু করেছিলেন সত্যজিৎ রায়। এবং প্রায় সমসাময়িক সময়ে আমরা পেয়ে গিয়েছিলাম ঋত্বিক ঘটক, মৃণাল সেন, তপন সিনহা, রাজেন তরফদারকে। কিন্তু হিন্দি সিনেমার সেই অন্যধারা বা প্যারালাল ফিল্ম যাকে বলা হয়, সেই গন্তব্যে পৌঁছতে সময় লেগেছিল আরও বছর পনেরো।
যদিও ১৯৬৯ সালে মণি কউল এবং সত্তরের গোড়ার দিকে কুমার সাহানি প্যারালাল সিনেমা তৈরি করতে শুরু করেন, কিন্তু তাঁদের ছবি খুব ভাল হলেও আমজনতার মনের ভিতর পৌঁছতে পারেনি। একটি নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে আটকে ছিল। ১৯৭৪ সালে শ্যাম বেনেগাল তৈরি করলেন ‘অঙ্কুর’ আর সঙ্গে-সঙ্গে একটা বিস্ফোরণ হল ভারতীয় সিনেমা জগতে। প্যারালাল ছবি কিন্তু বাণিজ্যিক ভাবে সফল। এই অমৃতযোগ তো আর সহজে হয় না! এবং এর পর থেকে শ্যাম বেনেগাল যেসব ছবি বানালেন, তাতে ধীরে-ধীরে দর্শকের মনন, দৃষ্টিভঙ্গি, সিনেমা সম্পর্কে উৎসাহের একটা নতুন ধারা তৈরি হল। এরপর তো স্বর্ণযুগ। শ্যাম বেনেগাল পর পর বানালেন ‘নিশান্ত’, ‘মন্থন’, ‘ভূমিকা’, ‘আরোহণ’, ‘মান্ডি’— প্রতিটাই মাইলফলক।
ভারতের প্রথম ক্রাউড ফান্ডিং সিনেমা হল ‘মন্থন’। আমূল-এর কাহিনি নিয়ে তৈরি হওয়া ছবির চিত্রনাট্য লিখেছিলেন বিখ্যাত নাট্যকার বিজয় তেণ্ডুলকর। আর হোয়াইট রেভোলিউশন-এর পাঁচ লক্ষ চাষি ২ টাকা করে দিয়েছিল সিনেমাটা তৈরি করার জন্য।
শ্যাম বেনেগালের আর একটা বড় অবদান, তিনি আমাদের এমন সব অভিনেতার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন যে এখন তাঁদের ছাড়া সিনেমাজগৎ ভাবতে অলীক লাগে। কে জানত আমরা ‘অঙ্কুর’-এর দৌলতে পেয়ে যাব শাবানা আজমির মতো এক শক্তিশালী অভিনেত্রীকে! শুধু কি তাই, দক্ষিণের অনন্ত নাগ, গিরিশ কারনাড কিংবা মরাঠি নিউজ রিডার স্মিতা পাতিলকেও একইভাবে পাব আমরা। ‘নিশান্ত’-এ আবিষ্কার করব নাসিরুদ্দিন শাহকে, ‘ভূমিকা’য় আবিষ্কার করব ওম পুরীকে। নামের ফিরিস্তি দিতে গেলে কত লম্বা হবে তার ঠিক নেই!
এই যে আমাদের চিন্তা-ভাবনার বাঁকবদলের শুরু, তার আদি গুরু শ্যাম বেনেগাল। তিনি ওইরকম ছবি হিন্দিতে না বানালে ভারতীয় সিনেমার জগতে অসাধারণ সব সিনেমা, পরিচালক আর অভিনেতারা আঞ্চলিক গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ থেকে যেতেন। তিনি তাঁর সমসাময়িক অনেক পরিচালক, যেমন কেতন মেহতা, কুন্দন শাহ এবং আরও অনেককে প্যারালাল সিনেমা করার সাহস জুগিয়েছেন। আমাদের প্রজন্ম তো বটেই, আমাদের পরের প্রজন্মের বহু পরিচালক তাঁর দ্বারা উদ্বুদ্ধ।
আরও একটা জরুরি ব্যাপার হল, শ্যাম বেনেগালের সিনেমা জনপ্রিয় হওয়ার পর কিন্তু ন্যাশনাল ফিল্মস ডিভিশন কর্পোরেশন (এনএফডিসি) অন্য ধারার ছবি তৈরি করতে সহায়তা করে। তার আগে ফিল্ম ডিভিশন কর্পোরেশন ছিল, কিন্তু তারা এত সক্রিয় ভাবে কাজ করতে শুরু করেনি। এই যে শ্যাম বেনেগাল তাঁর সিনেমার মধ্যে দিয়ে রাষ্ট্রকে একটা শিল্পের দায়বদ্ধতা নিতে উদ্বুদ্ধ করলেন, সেটা একটা ঐতিহাসিক মোড় বলা যেতে পারে। কারণ এনএফডিসি না থাকলে বহু ভাল-ভাল ছবি তৈরিই হত না। সব ভাল ছবি যে বাণিজ্যিকভাবে সফল হবে, তা তো নয়। সেই জায়গায় এনএফডিসি একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। এবং আমরা তো দেখতেই পাচ্ছি, এনএফডিসির সক্রিয় সহযোগিতা বন্ধ হওয়ার পর ‘পুষ্পা ২’-এর মতো ছবি বাজারে রমরম করে চলছে এবং চলবেও। শিল্পের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের সহযোগিতা খুব প্রয়োজন, রাষ্ট্রের নিষেধ নয়।
শ্যাম বেনেগালের চলে যাওয়টা একটা যুগ শেষ করে দিল। যে-যুগে আমরা পেয়েছিলাম নিজের শিল্প সৃষ্টি করার সাহস, টাকা না থাকলেও কী করে ক্রাউড ফান্ডিং করে সিনেমা বানাতে হয় তার রুলবুক, শক্তিশালী অভিনেতাদের সংস্রব (সে-পর্দায় হলেই বা ক্ষতি কী!) আর গভীর চিন্তায় ডুবে থাকার মতো একটা খনি।