৯০০ বছরের গির্জা, ভূতুড়ে গলি
কিছু লোকের কপাল আছে না, শেষপর্যন্ত সব হবে, কিন্তু ঝামেলা পুইয়ে— আমার সেরকম। লন্ডনের মতো শহরে গিয়েও কি রেহাই আছে! হিথরো এয়ারপোর্টের বাইরে লেখা, ‘ওয়েলকাম টু দ্য ক্যাপিটাল অফ দ্য ওয়ার্ল্ড’। অনেক-অনেক বছর ধরেই। এই শ্লাঘার আলো অবশ্য কালক্রমে ‘কমে আসিতেছে’, বিশেষ করে আমজনতার মতে গত জমানায় মানে ঋষি সুনকের প্রধানমন্ত্রিত্বে নাকি অর্থনীতি একেবারে উচ্ছন্নে গেছে। জিনিসপত্রের দাম আকাশছোঁয়া, ট্যুরিস্ট হিসেবে এটুকু টের পেয়েছি। সে-বিতর্ক থাক, তবে লিভারপুল স্ট্রিটের মতো বিশাল স্টেশনেও ট্রেনে উঠতে গিয়ে বিপত্তি হল। যাব ঘণ্টা দেড়েক দূরে প্রাচীন শহর নরউইচে, দাদার বাড়িতে। বন্দে ভারত টাইপের ট্রেন, ভাড়া দুজনের ভারতীয় টাকায় তেরো হাজার টাকা। ব্রিটেনের শহরতলির ট্রেনে সময় অনুযায়ী ভাড়া বাড়ে-কমে। বেলা ন’টা পর্যন্ত আরও বেশি ছিল দেখে নিয়েছিলাম অনলাইনে। কাউন্টার থেকেই টিকিট কাটা ভাল বলে আমি আর মেয়ে ঠিক করলাম, কারণ হোটেল থেকে টিউব ধরে ঠিক সময়ে পৌঁছতে পারব স্টেশনে, এরকম কনফিডেন্স অর্জন করে উঠতে পারিনি।
সকাল ন’টা নাগাদ মারাত্মক ব্যস্ত লিভারপুল স্ট্রিট স্টেশনে পৌঁছে গেছি। আধঘণ্টা পরে একটা ট্রেন। কাউন্টারে এক মহিলা। ফোরেক্স কার্ড দিয়ে বললাম, ‘দুটো নরউইচ।’ মেশিনে কার্ড ঢুকিয়ে দেখা গেল, পেমেন্ট ডিক্লাইনড। ঠিক আছে, সেই মুহূর্তে সার্ভার ডাউন থাকতেই পারে। আবার সোয়াইপ করা হল। একই কথা। এদিকে আমার ফোনে মেসেজ ঢুকল, টাকা কাটা গেছে। কী সর্বনাশ! ভিনদেশে বিদেশী মুদ্রা অনলাইনের কোন জটিল বাঁকে আটকে গেছে, এই মুহূর্তে বোঝা সম্ভব নয়। কাউন্টার থেকেও বলা হল, অভিযোগের ফর্ম ভরে দিয়ে যান, আমরা দেখছি। কে দেখবে কে জানে! ন্যাশনাল রেল (যার পুরোটাই বেসরকারি হাতে), পেমেন্ট গেটওয়েতে থাকা কোনও ব্রিটিশ সংস্থা নাকি আমার দেশের যে-ব্যাঙ্ক থেকে ফোরেক্স কার্ড কিনেছি তারা? এসব প্রশ্নের উত্তর পেতে সাত থেকে পনেরোদিন লাগবে, কিন্তু আমাদের ফেরার টিকিট আটচল্লিশ ঘণ্টা পরেই। আপাতত মাথা ঘামিয়ে লাভ নেই। ওদিকে ফোন আসছে, নরউইচে আমার ব্রিটিশ বৌদি কিমা কারি থেকে রায়তা, এমনকী নান পর্যন্ত তৈরি শুরু করে দিয়েছে। কেক বেক করেছে গতকাল রাতেই।
অগত্যা ছুটলাম এটিএমে। কোনওমতে নগদ তুলে টিকিট কেটে ট্রেনে তো উঠতে হবে! উঠলাম এবং জানালার ধারে জমিয়ে বসলাম। ইংলিশ কান্ট্রি সাইড দেখতে-দেখতে যাব ভেবে মনটা কিছুটা হালকা হল। সত্যি, সবুজ প্রান্তরে বাদামি ভেড়ার দল চরে বেড়াচ্ছে, এই দৃশ্যটা যতবার দেখেছি, ততবার ভেবেছি, রাখাল বালকের দিন কি একেবারেই গিয়েছে? অবেলার এই ডাউন ট্রেনের কামরা প্রায় ফাঁকা, দু’চারজন বুড়োবুড়ি, ঢাউস সুটকেস নিয়ে একজন মহিলা আর গিটার কাঁধে মোবাইল-মগ্ন এক কিশোর। আমার মেয়ে স্কেচবুক বার করে কলকাতার স্কাইলাইন আঁকছে, দীর্ঘদিন প্রবাসী মামা-মামিকে দেবে।
ভারি ছিমছাম পুরনো চেহারার স্টেশন নরউইচ। বাইরে গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছে আশি ছুঁই-ছুঁই তরুণ দম্পতি হিমু আর জয়। টিপটিপ বৃষ্টিতে ঠান্ডার আমেজ। বহুদিন পর দেখা হওয়ার উচ্ছ্বাস পেরিয়ে গাড়িতে ওঠা গেল। শুধু আজকের দিনটার কয়েক ঘণ্টা সম্বল, তাই ঝটপট দেখে নেওয়া হবে এই ঐতিহাসিক শহরের যতটা সম্ভব। প্রথম গন্তব্য নরউইচ ক্যাথিড্রাল, যার বয়স প্রায় ন-শো বছর। কিন্তু কিছুক্ষণ পর ঢুকে গেলাম একটা বিশাল শপিং মলের পার্কিং-এ। কেন এখানে? গাড়ি রাখা যাবে অনেকক্ষণ। এই মলের ভেতর দিয়ে হেঁটেই পৌঁছে যাওয়া যাবে গির্জায়। অনেক হাঁটার পর এল সেই ক্যাথিড্রাল, ১১৪৫ সালে তৈরি। একে বলা হয় ‘শহরের ভেতর গ্রাম’। ঠিকই, ৪৪ একর জায়গা জুড়ে সবুজ মাঠে বিশাল গথিক স্থাপত্য। আর ভেতরে ঢুকলে তো মাথা ঘুরে যাবে! মধ্যযুগের রোমান ভাস্কর্যের ছড়াছড়ি। সূক্ষ্ম কারুকার্য ছেড়েই দিন, হাজারের ওপর ‘বস’ দেখেই তাক লেগে যাবে। বস কাকে বলে? অনেক প্রাচীন গির্জাতেই সিলিং-এ ‘বস’ ভাস্কর্য দেখা যায়। ফুল, লতাপাতা, পশুপাখি থেকে মানুষ, যিশুর জীবনের কাহিনি— যা-কিছু হতে পারে; বলা থাকতে পারে আস্ত লোককথাও। আশ্চর্য লাগে ভাবতে, কীভাবে শতাব্দীর পর শতাব্দী অটুট আছে এগুলো, নষ্ট হয়নি যুদ্ধবিগ্রহেও! আর দেখার মতো এই গির্জার অর্গানটি, দেশের মধ্যে সবচেয়ে বড়। আর একটা কারণে অনেকে দেখতে আসে এই গির্জা, এখানে শ্যুটিং হয়েছে হ্যারি পটার সিনেমার। মজার একটা ক্যাফে আছে নরউইচ ক্যাথিড্রালের ভেতর। দারুণ চা আর কেক পাওয়া যায়। চা বলতে মনে পড়ল, ব্রিটিশদের চা নিয়ে বেশ প্যাশন রয়েছে। হিমুদার বাড়িতে দেখলাম, চা পর্বটা রীতিমতো একটা অনুষ্ঠান। টি-পটে টিকোজি দিয়ে ঢেকে ঘড়ি ধরে চা ভিজিয়ে, সুন্দর পোর্সেলিনের কাপে সাজিয়ে-গুছিয়ে পরিবেশন এবং দুধ-চিনি সমেত, এটাই সাহেবদের টি কালচার। সঙ্গে এক টুকরো কেক থাকলে সোনায় সোহাগা। শুনেছি, বাকিংহাম প্রাসাদে নাকি রানি এলিজাবেথের আমল থেকেই আমাদের উত্তরবঙ্গের এক বিশেষ বাগানের বিশেষ চা যায়। রানির মৃত্যুর পরও সেই ট্র্যাডিশন চলছে, প্রিন্স চার্লস রোজ পান করেন সেই মহার্ঘ ইন্ডিয়ান টি।
ক্যাথিড্রালের পর আমরা হাঁটতে-হাঁটতে পৌঁছে গেলাম ‘ঘোস্ট ওয়াক’-এর রাস্তায়। বৌদি বলল, এই প্রাচীন পাথর-বাঁধানো পথের দু’ধারের বাড়িগুলোতে নাকি গিজগিজ করছে ভূত, আর মোড়ের ‘মেডস হেড’ হোটেলটা বিখ্যাত ‘হন্টেড’ বলে। ঘোস্ট ট্যুরিজমের দৌলতে ভালই ভিড় হয়। তেরো শতকের বাড়ি হলেও ভেতরটা আধুনিক। দুটো ভূতের গল্প চালু আছে এই হোটেলে। এক, ধূসর জামা পরা এক পরিচারিকা নাকি ঘুরে বেড়ায় নিঃশব্দে। চোখে দেখতে না পেলেও টের পাবেন তার ল্যাভেন্ডারের সৌরভে, দাবি হোটেল কর্তৃপক্ষের। দু’নম্বর ভূত একটু ভারিক্কি, এক সময়ে এই শহরের মেয়র ছিলেন। তিনি নাকি রাত হলেই ঘুরে বেড়ান উঠোনে আর ভয়ংকর মাথা ঝাঁকান। কী জানি, আমাদের এই রক্তমাংসের মানুষের মতো অশরীরিরও এত ক্ষোভ কেন!
হোটেলের সামনে পার্ক করা ভিন্টেজ কার বেন্টলে মার্ক সিক্স সেই ফেলে আসা দিনের স্মৃতি মেখে হাতছানি দেয় পর্যটকদের। ভাবলাম, এজন্যই বোধহয় নরউইচকে বলে ‘সিটি অফ স্টোরিজ’। ভর সন্ধেবেলা শুরু হয় ঘণ্টা দুয়েকের ‘অলৌকিক অভিযান’। নরউইচ ক্যাথিড্রাল, ক্যাসল, ওয়েনসাম নদীর ধার আর বিখ্যাত এই এলম স্ট্রিট ঘুরে ঘুরে দেখান পেশাদার ‘ঘোস্ট হান্টার’, এমন সব গল্প বলেন যে গায়ের লোম খাড়া হয়ে উঠবে। এই পথের প্রায় শেষে একটা গলিতে আচমকা ঢুকে গেল হিমুদা। ওর বন্ধুর অ্যান্টিকের দোকান দেখাবে আমাদের। সেই মধ্যযুগীয় স্যাঁতসেতে প্রায়ান্ধকার একতলা বাড়িটাতে ঢুকলে এমনিতেই গা ছমছম করে, তার ওপর ওইটুকু জায়গায় যা সব জিনিসপত্র সাজানো, বা বলা ভাল ছড়ানো চারপাশে, মড়ার খুলি থেকে মরক্কো চামড়ার কার্পেট, স্টাফড পশু থেকে বিচিত্র রঙের পাথরের মালা, মনে হবে দম বন্ধ হয়ে আসছে। দিনের আলোয়, হোক না মেঘলা, বেরিয়ে যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম।
পথেঘাটে বা হোটেলে ক’জন স্বচক্ষে ভূত দেখেছেন, তা আর জানা হয়নি, কিন্তু আমার দাদা-বৌদির বাড়িটি কম কিছু রহস্যময় নয়। নরউইচ শহরের বাইরে অ্যাপ্টন গ্রামে প্রাচীন বাড়ির নাম ‘মিলারস কটেজ’। ১৮৪৫ সালে তৈরি। বলা বাহুল্য, বেশ ক’টা হাত বদল হয়ে এসেছে গুপ্ত দম্পতির মালিকানায়। কিন্তু দুটো জিনিস এরা সংরক্ষণ করেছে সযত্নে। একটা হল লিভিং রুমের সাবেকি ইটের থাম, যার গায়ে খোদাই করে লেখা আছে ১৮৪৫ আর দ্বিতীয়টা এ-বাড়ির পুরনো নাম ‘মিলারস কটেজ’। মিলার কে ছিলেন, আমাদের মতো আগন্তুকেরা জিগ্যেস করেন বটে, কিন্তু অনেক তদন্ত করেও সেটা জানা যায়নি।
হাইওয়ে থেকে গ্রামের রাস্তা যেমন নেমে যায়, তেমনই গেছে মিলারস কটেজের দিকে। সেই পথের একধারে বিস্তীর্ণ গমের ক্ষেত। অন্যদিকে বাগানওয়ালা দোতলা বাড়ি। একতলায় লিভিং রুম, ডাইনিং আর কিচেন। কাঠের সরু সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠলে দুটো শোবার ঘর আর টয়লেট। উত্তর কলকাতার পুরনো বাড়ির মতো সিলিং-এ কড়িবরগা। সবচেয়ে মায়াময় লিভিং রুমের বাগানমুখো বিশাল কাচের দরজা। যার ওপাশে একফালি সবুজ, অ্যালিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ডের কথা মনে পড়ে যাবে, সেখানে ঝিরঝিরে বৃষ্টিতে অল্প-অল্প মাথা দোলাচ্ছে ম্যাগনোলিয়া আর চেস্টনাট গাছ। লাঞ্চের পর জমিয়ে আড্ডা শুরু হল। পুরনো ধাঁচের ফায়ারপ্লেসটাও এরা রেখে দিয়েছে, তবে এখন আগুন জ্বালানো হয় লোহার গ্রিল দিয়ে তৈরি কোল বক্সে।
বিকেলের দেরি আছে, ঠান্ডা বাড়ছে, বোধহয় গ্রামের দিক বলে। চারটে বাজতে-না-বাজতে চা আর কেক নিয়ে ফায়ারপ্লেসের সামনে আমরা, মাঝে মাঝেই হাত সেঁকে নিচ্ছি। আর জয় বলছে ভূতের গল্প। হিমুদা কিন্তু প্রথমেই বলেছে, ভূতের দেখা পাওয়াটাও নাকি একটা আর্ট, যেটা সবার জানা নেই; তবে জয় এ-ব্যাপারে স্পেশালাইজ করেছে। যখন-তখন এ-বাড়িতে অশরীরির উপস্থিতি টের পায়। জয় বলল, রাতে থেকে গেলে গ্যারান্টি দিচ্ছে, ভূত দেখাতে না পারুক, ফিল করাবেই। বিশ্বাস না করলেও, একে গ্লাভসের ভেতর হাতের পাতা জমে যাচ্ছে, তায় শিরদাঁড়া বেয়ে কেমন যেন শিরশিরে ভাব নেমে গেল। হঠাৎ জয় বলল, এমন কিছু বেলা হয়নি, লং ড্রাইভে গেলে কেমন হয়? হিমুদা খুব উৎসাহী হল। ভাবছিলাম, এই বয়সে কেমন চনমনে এরা, সকাল থেকে আমাদের নিয়ে ঘুরেও ক্লান্ত নয়। ব্যাক ক্যালকুলেশন করে দেখা গেল, রাত ন’টার ট্রেন যদি ধরি, তাহলে আমাদের ঘণ্টা চারেক সময়। তাহলে যাওয়া যাক আউলটন রড, সেখানে হিমুদাদের একটা ছুটি-বাড়ি আছে।
সে-গল্প নাহয় পরের পর্বে বলা যাবে। কিন্তু পাঠককে অনলাইনে আটকে থাকা টাকা নিয়ে টেনশনে রাখা ঠিক নয়। জানিয়ে রাখি, আমার টাকা খোয়া যায়নি। দেশে ফেরার পর একদিন মেসেজ পেলাম, পুরো টাকাটাই ফেরত এসেছে অ্যাকাউন্টে।
ছবি সৌজন্যে : লেখক