বাক্সবদল, বাণিজ্য সম্মেলন, কিলিং ফিল্ডস
ছোট্ট একটা দেশ। তার এক প্রান্তে সিয়েম রিপ চিরকাল বিখ্যাত আঙ্করের জন্য আর অন্য প্রান্তে রাজধানী নম পেন কুখ্যাত কিলিং ফিল্ডসের জন্য। একেবারে ভিন্ন চরিত্রের দুটো শহর। সেখানে পরে ঢুকব। তার আগে একটা কেলেঙ্কারির কথা বলে নিই। প্রথম কম্বোডিয়া সফর ছিল নেহাতই হুজুগে, ট্রাভেল শোয়ের শ্যুটিং-এ। সিয়েম রিপ ঢুকেছিলাম সড়কপথে থাইল্যান্ড দিয়ে। দ্বিতীয়বারের সফর আনুষ্ঠানিক, ফেডারেশন অফ ইন্ডিয়ান চেম্বারস অফ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ফিকি) বাণিজ্য সম্মেলন। এবার কলকাতা থেকে প্লেনে ব্যাংকক, সেখান থেকে আবার ফ্লাইটে নম পেন। ডেলিগেশনের নেতৃত্বে ড. অমিত মিত্র, ফিকি-র সেক্রেটারি জেনারেল, তখনও রাজনীতিতে যোগ দেননি। পরে পশ্চিমবঙ্গের অর্থমন্ত্রী হন। ব্যাংকক এয়ারপোর্টে দুপুরে নেমে ঘণ্টা তিনেক অপেক্ষা করার পর নম পেনের বিমান। লাগেজ নিয়ে আবার চেক ইন। তাই তড়িঘড়ি সবাই ছুটলাম বেল্টের দিকে। বাক্সপ্যাঁটরা নিয়ে এক কাপ কফি আর স্যান্ডউইচ তো খেতে হবে! আমার ডাফল ব্যাগটা খুব কমন দেখতে। ওরকম অনেকের থাকে। খুব কনফিডেন্সের সঙ্গেই আমি ব্যাগটা সংগ্রহ করেছিলাম। তারপর ক্যাফেতে বসে আড্ডা দিতে-দিতে খেলামও। ফ্লাইটের ঘোষণা হতে ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে হাঁটা দিলাম গেটের দিকে। ঘণ্টা দেড়েকের উড়ান ব্যাংকক থেকে নম পেন। তখনও কি জানতাম, কী বিপদে পড়ব আর অচেনা একজনকে আরও বেশি বিপদে ফেলব!
ঝকঝকে শহর নম পেন। দীর্ঘ রাজনৈতিক অস্থিরতার কালো ছায়া সরিয়ে উন্নয়নের সড়কে পা রাখার মরিয়া চেষ্টা সর্বত্র। এই বাণিজ্য সম্মেলনের উদ্দেশ্যও সেটাই, কম্বোডিয়ায় বিনিয়োগ টানা। হোটেলে পৌঁছতে-পৌঁছতে বিকেল হয়ে গেল। লবিতে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন কয়েকজন, তখনই আলোচনায় বসতে হবে তাঁদের সঙ্গে। রাত পোহালেই এই হোটেলের ব্যাঙ্কোয়েটে ট্রেড ফেয়ার। এঁরাই সব আয়োজনের দায়িত্বে। এঁদের বোঝাতে হবে, ঠিক কীরকম প্যাভিলিয়ন-সজ্জা চাই আমরা। তাছাড়া একটু পরেই যেতে হবে ভারতীয় দূতাবাসের নৈশভোজে। সময় হাতে খুব কম। তাই ভাবলাম ঘরে ব্যাগ পাঠিয়ে আগে এঁদের সঙ্গে মিটিংটা সেরে নিই। কথা বলতে-বলতে এক সময়ে ঘড়ির দিকে চেয়ে আঁতকে উঠি। আটটায় ডিনার, সবাই তৈরি। তাড়াতাড়ি ঘরে গিয়ে ব্যাগ খুলতে গিয়ে সন্দেহ হল। আমারটাতে তো ছোট একটা তালা লাগানো ছিল। চেনটা খুলতেই, ও হরি! পুরুষদের পোশাক ভেতরে। বুঝলাম, যা সর্বনাশ হওয়ার হয়েছে। দোষটা আমার, আমি অন্য কারও ব্যাগ নিয়েছি। কিন্তু আগামী তিনদিন এই বাক্সবদল কেলেঙ্কারির সমাধান হওয়ার নয় কারণ ঘটনাস্থল ব্যাংকক আর আমি নম পেনে। আপাতত আর ভাবার সময় নেই, ডিনারে যাওয়ার পোশাক জোগাড় করতে হবে। টিম মেম্বারদের একজনকে বললাম সমস্যার কথা। বিদেশে অফিসিয়াল ডিনার থাকলে যার-যার জাতীয় পোশাক পরাটাই রীতি। পুরুষেরা অবশ্য অনেকেই স্যুট-টাই পরেন। আমিও এনেছিলাম ম্যাচিং শাড়ি-ব্লাউজ। সে আর কী করা যাবে! তোলপাড় করে জোগাড় হল একটি সালওয়ার স্যুট, মোটামুটি আমার গায়ের মাপে। কিন্তু সেই এথনিক পোশাকের সঙ্গে আমার স্নিকার্স এতই বেমানান যে, অন্য একজনের হাওয়াই চটি পায়ে গলালাম। আন্তর্জাতিক স্তরে হাওয়াই চটির এই প্রদর্শন সংবাদে বহু বাঙালিই গর্বিত হবেন বলে আমার ধারণা। রাতে হোটেলে ফিরে রীতিমতো একটা কনফারেন্স বসল আমার ঘরে, কী হবে ব্যাগ অভিযানের স্ট্র্যাটেজি?
ব্যাগের ভেতর পাওয়া গেল একটা ফাইল। তাতে পাসপোর্টের কপি আর আধার কার্ড দেখে পরিচয় জানা গেল। রায়পুরের বাসিন্দা এক যুবক। আর ছিল ট্রাভেল এজেন্টের কার্ড। একটা তো সূত্র মিলেছে। ফোন করতে সেই এজেন্ট হায়-হায় করতে করতে রায়পুরের ভদ্রলোকের নম্বর দিলেন। কিন্তু সেখানে ফোন করে আমার হায়-হায় দশা। একে আমার হিন্দি প্রায় জটায়ুর মতো, তায় ভদ্রলোকের স্ত্রী ফোন ধরে সাংঘাতিক চেঁচামেচি করলেন। তাঁর স্বামী ছাপোষা মানুষ, বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে শখ করে ব্যাংকক বেড়াতে গেছেন, ফোন নিয়ে যাননি, কীভাবে তিনি এক বস্ত্রে কাটাবেন তিনটে দিন? সত্যিই তো, আমি যারপরনাই লজ্জিত! সেটা তো ওই ভদ্রমহিলাকে দেখাতে পারছি না। ট্রাভেল এজেন্টের থেকে পাওয়া একটামাত্র তথ্য আমার ভরসা, একই ফ্লাইটে ফিরছেন ভদ্রলোক। কলকাতা হয়ে রায়পুর যাবেন। ফেরার পথে দেখলাম, উনি আমার মতো দায়িত্বজ্ঞানহীন নন, উনি কিন্তু সেদিন খালি হাতেই বেরিয়ে গেছিলেন ব্যাংকক এয়ারপোর্ট থেকে। আর আমার ব্যাগটা বেওয়ারিশ হিসেবে পড়ে ছিল লস্ট অ্যান্ড ফাউন্ড-এ। সেটা পেতে অবশ্য আমার কালঘাম ছুটে গেছিল। বেশ ক’টা ফর্ম ফিল আপ, তথ্যপ্রমাণ পেশ এবং উপরি পাওনা থাই এয়ারপোর্ট কর্মীদের তীর ভর্ৎসনা। তারপর যখন ভদ্রলোককে ডেকে ব্যাগ ফেরত দেওয়ার পালা এল, উনি আমার দিকে এমন ঘৃণার দৃষ্টিতে তাকিয়েছিলেন যে মনে হচ্ছিল, ধরণী, দ্বিধা হও। এই ট্র্যাজেডি অফ এররসের পর দলের দাদাস্থানীয় একজন গম্ভীর মুখে বললেন, ‘অনেক হয়েছে ড্রামা, এবার দেখ খুলে সন্দেশের বাক্সটা ঠিক আছে কি না।’ আসলে কম্বোডিয়ায় ভারতের রাষ্ট্রদূত আর দু’চারজন গণ্যমান্যের জন্য কলকাতা থেকে কড়াপাকের জলভরা সন্দেশ নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। রাখবি তো রাখ, আমার ব্যাগেই। এখন খুলে দেখা গেল, এয়ারপোর্টের এসিতে তারা তিনটে দিন বহাল তবিয়তে কাটিয়েছে এবং কলকাতার মান রেখেছে। এক নিমেষে হাতে-হাতে লুঠপাট হয়ে গেল বড়-বড় সাইজের জলভরা।
ভ্রান্তিবিলাসের শিকার হলেও সেবারের নম পেন ভ্রমণ কিন্তু মন্দ হয়নি। বাণিজ্য সম্মেলন দারুণ হল। আমার ডিজাইন করা ব্রোশিওরের প্রচ্ছদে আঙ্কর ভাটের মন্দির আর তার সামনের জলাশয়ে তাজমহলের ছায়া বেশ প্রশংসা পেল। এক জামা পরে কাটানো সত্ত্বেও (এক সন্ধেয় এক ঝলক শপিং-এ বেরিয়ে এমন কোনও জামা পাইনি যা আমার পরার যোগ্য, সবই ব্যাংকক থেকে আমদানি করা কিশোরীসুলভ!) বহু নামি লোক আমার কাছে এসে আঙ্করের হালহদিশ জানলেন, কারণ ওই সম্মেলনে সৌভাগ্যবশত আর কোনও ভারতীয় ছিলেন না যিনি সিয়েম রিপ গেছেন। সম্মেলনের পর আমাদের নম পেন ঘোরার মধ্যে এমন একটা দ্রষ্টব্য ছিল, যেখানে গিয়ে চোখের জল ধরে রাখা মুশকিল।
নামেই আতঙ্ক— কিলিং ফিল্ডস। ‘এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ নয়’ বলে পার পাননি আট থেকে আশি কম্বোডিয়ানরা। ১৯৭৫ থেকে ’৭৯— নরকের অন্য নাম ছিল নম পেন। সেই সময়ে কুখ্যাত পল পটের খেমর রুজ সরকার কম্যুনিজম প্রতিষ্ঠার নামে মানুষের ওপর চরম অত্যাচার করেছে, নির্বিচারে গণহত্যা চালিয়েছে, হিটলারের নাৎসি বাহিনীর মতো কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে আটকে রেখেছে। নম পেন থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরে এই বীভৎসতার সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে চুং এক। এক সময়ে ছিল চাইনিজ সমাধিক্ষেত্র, পরে হয়ে যায় গণকবর। এখন যেমন জার্মানি বেড়াতে গিয়ে ট্যুরিস্টরা আউশউইৎজ ক্যাম্প দেখতে যান, শিউরে ওঠেন ইতিহাসের বর্বর এক অধ্যায়ে ফিরে গিয়ে, তেমনই নম পেনের কিলিং ফিল্ডস। মাত্র তিন বছরে পল পট হত্যা করেছিল ২০,০০০ মানুষকে। এমনকী বুলেট বাঁচানোর জন্য তার সেনারা নাকি যুবকদের পিছমোড়া করে বেঁধে পা ধরে ঝুলিয়ে গাছের গায়ে আছড়ে মাথা ভাঙত। জেরার নামে যখন-তখন নারী-পুরুষ নির্বিশেষে তুলে এনে মারধর করে মেরে ফেলে দেওয়া হত গণকবরে। আর কোনওদিন তাদের হদিশ মিলত না। শিশুদের আট বছর বয়স হলেই বাড়ি থেকে নিয়ে এসে রাখা হত লেবার ক্যাম্পে, মগজ ধোলাই করা হত; বাবা-মা নয়, রাষ্ট্রই তোমাদের আসল অভিভাবক। শ্রেণিহীন সমাজের স্বপ্ন দেখিয়ে যৌথখামারে, কৃষিকাজে এমন খাটানো হত মানুষকে যে কম্বোডিয়ার জনসংখ্যার ২৫ শতাংশ সাফ হয়ে গেছিল ওই ক’টা বছরে।
রাতভর বৃষ্টি হয়েছিল। পরদিন সকালে আমরা যখন কিলিং ফিল্ডস দেখতে গেলাম, জমি ছিল ভেজা। অদ্ভুত ব্যাপার, এরা গণকবরের জায়গাটা আলাদা করে ঘিরে রাখেনি। এর আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের সামনে গণকবরের জমি দেখেছি রেলিং-ঘেরা, স্মৃতিফলকও রয়েছে। একাত্তরের ২৫ মার্চের অভিশপ্ত রাতে পাকবাহিনী সারা বাংলাদেশে ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নাম দিয়ে হত্যালীলা চালিয়েছিল। ছাত্রাবাসে ঢুকে গুলিতে ঝাঁঝরা করে দিয়েছিল তরতাজা তরুণদের। তারপর মৃত, অর্ধমৃতদের টেনে নিয়ে ফেলে দিয়েছিল গণকবরে। মাটি চাপা দিয়ে দিয়েছিল। সেখানে গেলেও গভীর কষ্ট হয় বুকের ভেতর, কিন্তু কিলিং ফিল্ডস যেন জীবন্ত, যেন সদ্যই অতীত হয়েছে সেইসব কালো দিন-রাত। হাঁটতে অস্বস্তি হচ্ছিল, বুঝতে পারছিলাম না ঠিক কোথায় মাটির নীচে চাপা পড়ে রয়েছে অসহায় মানুষের শরীর আর কোথায় নয়। আজ বললে কতজন বিশ্বাস করবেন জানি না, আমি কয়েকটা দাঁত পেয়েছিলাম বৃষ্টিভেজা মাটিতে। মানুষের দাঁত। হাতে করে নিয়ে গিয়ে দেখিয়েছিলাম ওদের অফিসে। বিশেষ পাত্তা দেয়নি। বলল, ওরকম দাঁত বা হাড়ের টুকরো নাকি বৃষ্টি হলে মাঝে মাঝেই উঠে আসে জমির ওপর।
কিলিং ফিল্ডস-এর লাগোয়া আর এক মন খারাপের ঠিকানা। টুওল স্লেং জেনোসাইড মিউজিয়াম। এক সময়ে নাকি ছিল নামকরা হাইস্কুল। পল পটের আমলে পড়াশোনা শিকেয় উঠেছিল। লেখাপড়া মানেই পশ্চিমি, বিশেষ করে আমেরিকার অপশিক্ষা, এই দোহাই দিয়ে রাষ্ট্র বন্ধ করে দিয়েছিল স্কুল-কলেজ। এই হাইস্কুলটি হয়ে উঠেছিল কঠোর নিরাপত্তায় মোড়া জেলখানা, যেখানে হাজার-হাজার মানুষকে বন্দি করে রাখা হত তথ্য সংগ্রহের জন্য, জিজ্ঞাসাবাদের অছিলায় করা হত অকথ্য অত্যাচার। বেধড়ক মারধর, ইলেকট্রিক শক, এমনকী নাকের ভেতর জল ঢেলেই চলা যতক্ষণ না স্বীকারোক্তি আদায় করা যাচ্ছে। বেশির ভাগ সময়ই মনগড়া অভিযোগ আমেরিকার দালাল কি না কিংবা থাইল্যান্ড-ভিয়েতনামের চর কি না, এসব। টুওল স্লেং কি কারও নাম? প্রশ্নের জবাবে গাইড জানালেন, মোটেও না। খেমর ভাষায় এর মানে বিষবৃক্ষের পাহাড়। এমন যথাযথ নাম যে কোনও জায়গার হতে পারে, দেখিনি আগে। পল পট নামক বিষবৃক্ষটি যে বছর চারেকের বেশি রাজ করতে পারেনি, কম্বোডিয়ানদের, থুড়ি, কাম্পুচিয়ানদের ভাগ্য। সে-আমলে কম্বোডিয়ার নাম বদলে করা হয়েছিল কাম্পুচিয়া। ভিয়েতনামের হাতে পতন হয়েছিল রেড খেমর রুজের। যাকে আমরা মিউজিয়াম বলি, এটা কি ঠিক সেরকম? এই যে ইটের দেওয়াল দেওয়া আধফুটের সেল, এ কি মানুষের থাকার যোগ্য? এখানেই নাকি দিনের পর দিন বন্দিজীবন কাটাত নিরীহ নাগরিকেরা। হাত-পা মেলা তো দূরের কথা, উবু হয়ে বসে থাকা ছাড়া আর কিছু সম্ভব বলে মনে হল না। জেনে অবাক হলাম, এরকম নাকি শ’দুয়েক টর্চার সেন্টার ছিল পল পটের। এটি সবচেয়ে কুখ্যাত।
দলের সবার মন এত ভারী হয়ে গেছিল যে, নম পেনে শেষ সন্ধ্যাটা আমরা কাটালাম চুপচাপ টোনলে স্যাপের ধারে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সবচেয়ে বড় মিষ্টিজলের হ্রদ। নিরিবিলি, বড় বড় গাছের ছায়াঢাকা হ্রদের ধারে বসে থাকতে ভাল লাগে। দিগন্তবিস্তৃত জলরাশির ওপর কেমন সন্ধে ঘনিয়ে আসে।
ছবি সৌজন্যে : লেখক