ওঙ্কার ধাম যাত্রা, সাগরমন্থন, দেবদাসী
ব্যাংককে বসেই ঠিক করলাম কম্বোডিয়া যাব। ট্রাভেল শোয়ে আঙ্কর ভাট দারুণ জমবে। হাতে-হাতে ভিসা পাওয়া যায় ব্যাংককের কম্বোডিয়া দূতাবাস থেকেই। পশ্চিমবঙ্গে পেট্রাপোল সীমান্ত দিয়ে যেমন বাংলাদেশে ঢোকা যায় সড়কপথে, ঠিক তেমন ব্যাংকক থেকে সীমানা পেরিয়ে ঢুকে পড়া যায় কম্বোডিয়ার সিয়েম রিপে। সেখানেই ভুবনবিখ্যাত আঙ্কর ভাট আর আঙ্কর থম মন্দির। আমাদের কপালদোষে কি না জানি না, যে-বাসটাতে উঠলাম সেটা লঝঝড়ে আর রাস্তা তো পুরো ব্রেক-ডান্সের ফ্লোর। বাসের যাত্রী একদল মধ্যবয়স্ক সাহেব-মেম আর আমরা দুই ভারতীয়। মারাত্মক ঝাঁকুনি আর ভাষা-বিভ্রাটে ড্রাইভারের থেকে এহেন পরিস্থিতির কারণ জানার ব্যাকুল প্রচেষ্টা ব্যর্থ হওয়া, এই দুইয়ের ধাক্কায় বিপর্যস্ত শরীর-মন। তার ওপর কোনও এক অজ্ঞাত কারণে এসি চলছে না। আধখোলা জানালা দিয়ে হু-হু করে লালচে ধুলো ঢুকছে। বিদেশিরা বার বার বলতে লাগল, ‘ট্রাভেল এজেন্ট বলেছিল একদম গোড়া থেকে ওরিয়েন্টাল ফ্লেভার পেতে গেলে হুশ করে প্লেনে উঠে সিয়েম রিপ পৌঁছে গেলে চলবে না। রাস্তা দিয়ে যেতে হবে। তখন যদি জানতাম, হাড়গোড় টুকরো হতে পারে, কে আসত!’ কোনওমতে যা জানা গেল ড্রাইভার ও হেল্পারের থেকে, তা হল, এরকম মোটেই থাকে না এই পথ। কম্বোডিয়া ট্যুরিজম-নির্ভর দেশ, তাই সম্মানিত পর্যটকদের এই দুর্দশায় অত্যন্ত দুঃখিত তারা। এখন রাস্তা সারাই হচ্ছে, উপায় কী! সম্মানিত পর্যটকেরা নাগরদোলায় চেপে প্রায়ই সমস্বরে চেঁচিয়ে উঠছেন, ‘ওহ মাই গড!’ এক-দু’ঘণ্টা নয়, আট-ন’ঘণ্টার পথের অনেকটাই এভাবে কেটেছিল। এর মধ্যে সামান্য রিলিফ ছিল আমাদের শ্যুটিং। বাসের ঝাঁকুনিতে কালোয়াতি গানের মতো কাঁপা গলার বর্ণনা ক্যামেরার সামনে এই যাত্রাপথের আর চার-পাঁচজনের সাক্ষাৎকার, কেমন লাগছে এই অ্যাডভেঞ্চার!
বিকেল নেমে আসছে। আকাশের মুছে যাওয়া আলো মেখে নীচে পড়ে আছে ধানখেত আর ছোট-ছোট গ্রাম। বাংলার সঙ্গে তফাত নেই। একটা কুঁড়েঘর টাইপের দোকানের সামনে বাস দাঁড়াল। পাশে ডোবা। খাবার আর টয়লেটের দরকার তখন সবার। ভেতরটা মন্দ না। ইলেকট্রিক হ্যারিকেন জ্বালিয়ে বেশ একটা রেস্তরাঁর ভাব এনেছে। ছোট-ছোট বেতের টেবিল-চেয়ার। প্রথমেই হাত বাড়ালাম মিনারেল ওয়াটারের বোতলের দিকে। বিদেশে দাম জেনে কেনা ভাল। আমেরিকায় দেখেছি, কোকের দাম নব্বই সেন্ট আর মিনারেল ওয়াটার তিন ডলার। বিলেত-আমেরিকায় সবাই কলের জল ধরে খায়। বোতলের জল তাই এমন দামি। এখানে দাম জিজ্ঞেস করতেই পিলে চমকে গেল। এক হাজার রিয়েল। হাজার শুনে বুকে ধাক্কা লাগবে না? পরমুহূর্তেই মনে পড়ল, কম্বোডিয়ান মুদ্রা রিয়েলের দাম ডলারের তুলনায় খুব কম। হাজার রিয়েল মানে এখন ভারতীয় মুদ্রায় কুড়ি টাকা; তখন বোধহয় দশ-বারো টাকা ছিল। আমরা মার্কিন ডলার ভাঙিয়ে প্রচুর রিয়েল পেয়েছি। আমার এক বিশ্বঘোরা স্পোর্টস রিপোর্টার বন্ধু বলেছিল, ‘কম্বোডিয়ায় বস্তা নিয়ে যাস টাকা রাখার জন্য!’ অজানা জায়গায় খাদ্য হিসেবে সবচেয়ে নিরাপদ আর পকেটসই হল ম্যাগি; পাওয়া যায় পৃথিবীর সব প্রান্তে। সেটাই নিলাম।
সিয়েম রিপ পৌঁছতে রাত হয়ে গেল। আমাদের দেশের মতোই ম্যালেরিয়ার ভয় এখানে। ২০০৮ সালে ভাগ্যিস ডেঙ্গির তেমন প্রাদুর্ভাব ঘটেনি। আমাদের হোটেলের সামনেই দেখলাম সরকারি হোর্ডিং— ম্যালেরিয়া থেকে সাবধান। আগেই শুনেছি, কম্বোডিয়া ট্যুরিস্ট-প্রিয় জায়গা হলেও চুরি-ছিনতাইয়ের জন্য নামডাক আছে। বিশেষ করে পাসপোর্ট আর ডলার সামলে রাখতে হয়। তাই অতিরিক্ত সতর্কতা হিসেবে লক করা ঘরেও মাথার কাছে নিয়ে শুলাম ব্যাগটা। পরদিন সকালে আমাদের আঙ্কর অভিযান। ঘুম ভেঙে উঠে মনটা আনন্দে ভরে গেল। রাতে কম আলোয় দেখতে পাইনি, আমাদের হোটেলটা মধ্যবিত্ত, কিন্তু বেশ সাজানো-গোছানো। সামনে লন, সেখানে ছোট-ছোট খড়ের চালা দেওয়া বসার জায়গা। হরেক রকম বুদ্ধমূর্তি রাখা। সকাল-সকাল টুকটুক (দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অনেক দেশে অটোকে এই নামেই ডাকে) করে পৌঁছে গেলাম আঙ্করের টিকিট কাউন্টারে। জানলাম, হয় ডলারে নয়তো রিয়েলে কাটতে হবে টিকিট। ডলার তোলা থাক জরুরি প্রয়োজনের জন্য, আপাতত দরকার রিয়েল। অতএব টুকটুক নিয়ে এটিএম। ভাষা থেকে কারেন্সি, বহু কিছু অদলবদল করে ঘেমে-নেয়ে বেরোল একগাদা রিয়েল। ঠিকই বলেছিল আমার সাংবাদিক বন্ধু, এই গোছা কি হাতব্যাগে ঢোকে? আবার ছুটলাম টিকিট কাউন্টারে। আঙ্কর-চত্বরে ঢুকেই দেখি, বোর্ডে নোটিশ, ‘এটি ইউনেস্কো ঘোষিত হেরিটেজ সাইট। এখানে ১০০ সিসি হ্যান্ডিক্যামের উপরে কোনও পেশাদার ভিডিও ক্যামেরা ব্যবহারের জন্য আগে থেকে ইউনেস্কোকে মেল করে অনুমতি নিতে হবে।’ সে কী! আমরা তো এতসব জানতাম না। তাহলে কি এতদূর এসে খালি হাতে ফিরতে হবে? বেপরোয়া বাঙালির যা স্বভাব, যা হয় পরে দেখা যাবে মনোভাব নিয়ে এগোলাম আমরা মনের সুখে ছবি তুলতে-তুলতে। চারদিকে অনেক রক্ষী, কিন্তু কেউ কিছু বলল না। ভাবলাম, হয়তো শখের আর পেশাদারি ক্যামেরার তফাত বোঝে না। এই ভাবনার চরম মাশুল কীভাবে গুনতে হয়েছিল, সে-গল্প পরে বলছি।
সেই কোন ছেলেবেলায় স্কুলের বইতে পড়েছিলাম সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের কবিতা, ‘শ্যাম কম্বোজে ওঙ্কার ধাম মোদেরই প্রাচীন কীর্তি।’ পুরাণ আর ইতিহাসের সীমানা বেশির ভাগ সময়েই ধোঁয়াশায় ঢাকা থাকে। প্রাচীনকালে ভারতীয় ভূখণ্ড কম্বোজ কম্বু মুনির নাম থেকে এসেছে নাকি ১৮৬৩ সালে ফরাসিরা উপনিবেশ তৈরির পর কাম্পুচিয়াকে কম্বোজ উচ্চারণ করত বলে এই নাম, সেটা তর্কের বিষয়। যাই হোক, বাঙালি হিসেবে আমরা কৃতিত্ব নিতেই পারি এই চোখধাঁধানো মন্দিরের, কবি যাকে বলেছেন ওঙ্কার ধাম আর পৃথিবী যাকে চেনে আঙ্কর ভাট নামে। রাজা দ্বিতীয় সূর্যবর্মণের কীর্তি আঙ্কর ভাট মন্দির-শহর। আস্ত শহরই বটে, ৪০২ একর। গিনেস বুকে জায়গা পেয়েছে বিশ্বের বৃহত্তম ধর্মীয় নির্মাণ হিসেবে। আরও একটা কারণে কম্বোডিয়ার নাম উঠেছে গিনেস বুকে, পৃথিবীতে আর একটাও দেশ নেই যার পতাকায় রয়েছে মন্দিরের ছবি। দ্বাদশ শতাব্দীতে এই জায়গাটার নাম ছিল যশোধরপুরা, খেমর সাম্রাজ্যের রাজধানী। মেরু পর্বত, যেখানে দেবতাদের বাস বলে কিংবদন্তী, তার আদলেই নাকি আঙ্কর তৈরি করেছিলেন রাজা। প্রথমে ছিল হিন্দু মন্দির, পরে হয়ে যায় বৌদ্ধ। এখনও অবশ্য বিশাল আট হাতের বিষ্ণুমূর্তি রয়েছে মন্দিরে ঢোকার মুখেই। খারাপ লাগে দেখে, পাথর ক্ষয়ে নষ্ট হয়ে গেছে বহু ভাস্কর্য, শ্যাওলায় ঢাকা পড়েছে কত সূক্ষ্ম কারুকাজ। আসলে রাজনৈতিক অশান্তিতে দীর্ঘ অবহেলার শিকার এই অমূল্য স্থাপত্য। এক সময়ে ফরাসি সরকার, ভারতের আর্কিওলজিকাল সার্ভে চেষ্টা করেছিল সংস্কারের। অনেক সমালোচনাও হয়েছিল সে-সময়ে যে, অদক্ষ হাতে পড়ে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে আঙ্কর। অনেক পরে ইউনেস্কো হাতে নেয় সংরক্ষণের কাজ। আমরাও দেখলাম লোহার ফ্রেমে অনেকটাই ঢাকা পড়ে গেছে মন্দিরের গা, ছবি তুলতে রীতিমতো অসুবিধা হচ্ছে। পরেও বহু বছর ছবি দেখেছি, সংরক্ষণের কাজ চলছে তো চলছেই।
মন্দিরের সামনে বিশাল দিঘি। তাতে ছায়া পড়ে ওই অসাধারণ স্থাপত্যের। খুব মায়াময় সেই প্রাচীনত্ব। মনে হয় যেন অন্য কোনও জন্মে আমি ছিলাম পৃথিবীর এই প্রান্তে, এদেরই একজন হয়ে। ‘হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে’। আমাদের দেশের তাজমহলের, আমাদের শহরের ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের সামনেও জলাশয়ে এমন প্রতিবিম্ব ধরা পড়ে।
আঙ্করের বেশ কয়েকটা প্রবেশপথ রয়েছে। তার একটা অবশ্য দ্রষ্টব্যের মধ্যে পড়ে। ওইরকম বিশাল সাগরমন্থনের দৃশ্য গড়া কীভাবে সম্ভব? ৯২টি অসুর বনাম ৮৮জন দেবতা, বাসুকী সাপকে নিয়ে টাগ অফ ওয়ারে মরিয়া গরল সেঁচে অমৃত দখলের খেলায়। ‘রামায়ণ’, ‘মহাভারত’-এর হাজার চরিত্র আর হিন্দু পুরাণের তেত্রিশ কোটি দেবদেবীর ছড়াছড়ি চারপাশে। সঙ্গে গৌতম বুদ্ধ। হিন্দু আর বৌদ্ধধর্মের এমন মিশেল কম দেখা যায়। আর রয়েছে হাজার-হাজার অপ্সরা, থামের গায়ে, দেওয়ালের গায়ে। দেবলোকের নর্তকীরা নাকি অখণ্ড সৌভাগ্যের প্রতীক। লম্বা করিডরে দেখা হল বর-কনের সঙ্গে। বিয়ে সারতে এসেছে মন্দিরে। কী জমকালো সাজ! থাইল্যান্ডে রাম-সীতার মূর্তি কিনতে পাওয়া যায় জরির কাপড় পরা, মাথায় চুড়োর মতো সোনালি মুকুট, অবিকল সেরকম সাজ। কনেকে তো অসাধারণ দেখতে, মাখনের মতো গায়ের রং। তারা খুব খুশি হল বিদেশি টিভির ক্যামেরায় বিয়ে শ্যুট হওয়াতে। আমাদের নেমন্তন্ন করল সন্ধের পার্টিতে। ইচ্ছে থাকলেও সেখানে যাওয়া হয়নি আমাদের, কারণ খুব বড় ঝামেলায় ফেঁসেছিলাম। সে-গল্পে আসছি।
দেখা হল এক দেবদাসীর সঙ্গে। শুনেছি, দক্ষিণ ভারতের দু-একটি প্রত্যন্ত মন্দিরে নাকি আজও দেখা পাওয়া যায় সুন্দরী দেবদাসীর। ঈশ্বরে নিবেদিতপ্রাণ সেই সংসার-বঞ্চিত নারীর একটাই লক্ষ্য, নাচে-গানে আরাধ্যকে তুষ্ট করা। মন্দিরের সেই অসামান্য নৃত্যকলা থেকেই ভারতীয় শাস্ত্রীয় নৃত্যধারার জন্ম। আঙ্কর ভাটের দেবদাসী অবশ্য আদৌ সুন্দরী নন, এই সকালেই বেশ নেশাগ্রস্ত এবং তাঁর শরীরের আন্দোলনকে আর যাই বলা যাক, নাচ বলা ঠিক নয়। চারপাশে শ্বেতাঙ্গ ট্যুরিস্টদের ‘ওয়াও’ শুনে, অসংখ্য ক্যামেরার ক্লিক-ক্লিক শব্দে আরও উৎসাহ পেয়ে গেলেন মাঝবয়সি মহিলা। খোলা চুল সামনে এনে এমন উদ্দাম নৃত্য শুরু করলেন, যেন তান্ত্রিকমতে পুজো হচ্ছে। সেটা অবশ্য ভুল কিছু নয়, কারণ বৌদ্ধধর্মের বজ্রযান ধারায় রয়েছে তন্ত্রসাধনা। মহিলা নিজেই ক্যামেরার সামনে ভাঙা ইংরেজিতে নিজের পরিচয় দিলেন দেবদাসী বলে। ‘সিগারেট মুখে নিয়ে দেবতার সামনে নাচছেন কেন?’ থাকতে না পেরে অন ক্যামেরা প্রশ্নটা করেই ফেললাম। আসলে তখন জানতাম না দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বহু দেশেই ভগবান বুদ্ধকে কোল্ড ড্রিঙ্ক-মদ-সিগারেট, এমনকী গাঁজাও উৎসর্গ করা হয় প্রসাদ হিসেবে। ব্যাংককে আমরা নিজেরাও ওরকম পুজোর ডালা নিয়ে মন্দিরে ঢুকেছি যাতে ফলমূলের পাশেই সাজানো সিগারেট আর ভাঙের গুলি। দেবদাসী জানালেন, ‘এরকমই নিয়ম। নেশাদ্রব্য না দিলে দেবতা সন্তুষ্ট হন না।’ ভাবলাম, ঠিকই তো, সুরলোকে সুরাপান করতে পারেন দেবতারা আর মর্ত্যে করলেই দোষ?
এতক্ষণ ভালই চলছিল শ্যুটিং। এবার বাইরে ঝকঝকে রোদে মন্দিরের আর আশেপাশের ছবি তোলা যাবে জমিয়ে, এই ভেবে একটা থামের ধারে কাঁধের ব্যাগটা নামিয়ে একটু সরে গিয়ে সবে ক্যামেরার সামনে বলতে শুরু করেছি আঙ্কর-বৃত্তান্ত, চোখের কোণ দিয়ে স্পষ্ট দেখলাম, দুটো লোক আমার ব্যাগটা তুলে নিয়ে হাঁটা লাগাল। কী সর্বনাশ! ওর মধ্যে যে আমার প্রাণভোমরা, পাসপোর্ট…
ছবি সৌজন্যে : লেখক