মনখারাপের মশারি
এরকম অদ্ভুত দোটানার পুজো আর আসেনি। লোকে আনন্দ করছে বটে, কিন্তু কোনও প্রসন্নতাই ঝিকিয়ে উঠছে না। দরাদরির সময়ে লোকে একটা গ্লানি কোনওমতে রুমাল দিয়ে মুছে ফেলে, নিজের কাছ থেকে নিজে টুক করে লুকিয়ে পড়ছে। শপিং মল কোনওদিন পরিসংখ্যান দিচ্ছে, আগে যত লোক আসত তার অর্ধেক আসছে। কিংবা ভিড় হচ্ছে, কিন্তু যারা আসছে, তারা আগে যত সময় কাটাত, তার অর্ধেক কাটিয়ে বাড়ি ফিরে যাচ্ছে। এক ফুটপাথের হকার হয়তো মোটামুটি ব্যবসা করছে আর ভাবছে যাক তাহলে মানুষের ঢল নামল, কিন্তু অন্য ফুটের হকার দেখছে এমাথা-ওমাথা সুনসান।
আসলে যখন একটা গণআন্দোলন শুরু হয়, মানুষের মনে শাণিত আশা থাকে, খুব তাড়াতাড়ি একটা এসপার নয় ওসপার হবে। কিন্তু কোনও পারেই তরী ভিড়বে না, ভারত বা বাংলার নিখুঁত নিয়তি ও ঐকান্তিক ঐতিহ্য মেনে পুরো জিনিসটাই কে জানে কী করে ধেবড়ে কেতরে লেবড়েজুবড়ে পড়ে থাকবে, এটা মানুষ আন্দাজ করেনি। কোনও নির্দিষ্ট দিকে আঙুল না তুলে, শুধু এদিক-ওদিক কয়েকটা পায়ে-চলা-পথ দেখিয়ে দেওয়া হবে, যেগুলো অবিলম্বে আগাছায় ঢেকে যাবে, এই ঝাপসা-পনা জনগণকে বুড়বক বানিয়েছে। একটা প্রখর অন্যায় ঘটে গেছে, তারপর তার প্রবল প্রতিবাদ হয়েছে, লোকে ভেবেছিল, বড়-বড় তদন্তকারী সংস্থাগুলো হেস্তনেস্ত করবেই। সরকার হয়তো জনরোষ বুঝে একটুখানি সমাধানের দিকে ঝুঁকবে। অন্তত লজ্জায় জিভ কাটবে। সরকার তপ্ত হয়েছে বটে, অনুতপ্ত হয়নি।
সাধারণ লোকের ধারণা, সিবিআই বা পুলিশ শার্লকের বাবা, চাইলে সব রহস্যের সমাধান করে ফেলতে পারে। কিন্তু এখন এই পাক্কা মিরাকলের তকমা নড়নড় করছে। গ্রেফতার হওয়া দুটো-তিনটে পোড়-খাওয়া লোক মিলে তাদের ক্রমাগত নাস্তানাবুদ করছে, না কি তারা নিপুণ তদন্ত করতে পারছে না, না কি তাদের তদন্ত করতে দেওয়া হচ্ছে না— কিছুই স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে না। কিন্তু যে-লোকগুলো তাড়াতাড়ি অফিস সেরে মিছিল করেছে, রাত্তিরের আরাম ঘুম সিরিয়াল ওয়েবসিরিজ চুটকিভ্রমণ ছেড়ে পথে নেমে স্লোগান দিয়েছে, হাতের শ্লথতা কাটিয়ে মুষ্টি উপরে তুলেছে, পায়ের আলস্য কাটিয়ে মাইলটাক হেঁটেছে, মাসখানেক ধরে আক্রোশ লালন করেছে ও যথাযথভাবে ধারাবাহিক ফেটে পড়েছে, যারা সংখ্যায় ও নিবিড়তায় ইদানীং-বাংলার যে-কোনও আন্দোলনকে ছাপিয়ে এই বিক্ষোভকে প্রাণশক্তি জুগিয়েছে, তারা অবাক হয়ে দেখছে, তাদের সংহতি ও তীব্রতার ফল লবডঙ্কা, কলিকাতা আছে কলিকাতাতেই। একটা প্রাণপণ ঝাঁপ, বেলাগাম ধাওয়া, হু-হু উদ্যমী উড়ালে ঢাল বেয়ে ছুটতে-ছুটতে আচমকা যখন কেউ দ্যাখে সামনে অতলান্ত খাদ, হাঁ-করা শূন্য, তখন যে ঠক-ঠক-ঠকেছি প্রকাশিত হয়, গিলে ফেলা শক্ত। আসলে রাষ্ট্র এমন বেধড়ক বন্দোবস্ত করে রেখেছে, এমন গলি-গলতাময় সুড়ঙ্গ, যাতে বিচারের বাণী যুগ-যুগ ভুলভুলাইয়ায় তাকধাঁধা খেয়ে তেষ্টায় চোখ উলটে পড়ে থাকে, আর অন্য অন্যায়ের ঘটনা এসে তার ওপর পলি ফেলে দেয়। ক্ষমতাকেন্দ্র খুব ভাল জানে, লোকে খুব বেশিদিন ঝালায় বাজতে পারে না। সে তাই শুধু ধৈর্য ধরে কুচকাওয়াজটা নজর করে আর ঠেকনা দিয়ে যায়। স্রেফ ‘দেখছি’, ‘হচ্ছে’, ‘এই তো কমিটি গড়ছি’, ‘ওই তো তদন্ত শুরু হল’ আউড়ে সে একটা অনন্ত আঠালো থ্যাপ, একটা আউট-অফ-ফোকাস মহানেত্র, একটা সর্বংসহ খাস-পাঁচিল গড়ে তোলে। যেখানে মাথা ঠুকতে-ঠুকতে এক সময়ে ললাটে গজিয়ে ওঠা আলুটিকে রেঁধে হজম করে ফেলা ছাড়া হতাশ নাগরিকের আর করার কিছু থাকে না। রাষ্ট্রের সর্বাধিক অস্ত্র তার ফিরতি কামান নয়, পোষা ডালকুত্তাও নয়, তার সময়কে ব্যবহার করার চাল। সে এমন স্থাণু, গোঁজ হয়ে বসে থাকতে পারে, এমন গ্যাঁট ও জগদ্দল তার ঠাট, শুধু জাড্য দিয়েই সে উদ্যত বর্শাকে ভোঁতা করে ফ্যালে। এই বাধা অতিক্রম করে বছর-বছর ধরে জেদ বজায় রেখে যেতে পারে শুধু রাজনৈতিক দল, তাদের মহড়া আবার শাসকেরা মারধর ও পেটোর ব্যাকরণে সামলে নিতে অভ্যস্ত। শুধু আকাঙ্ক্ষা, প্রাণপণ আকাঙ্ক্ষাও, একটা ঘাগু লৌহবস্তাকে উলটে ফেলতে পারে না। লোকে ‘হেঁইয়ো’ স্বতঃস্ফূর্ত ও আশিরনখ প্রত্যয়ে মারছে বটে, কিন্তু ক্ষমতার গিঁট্টুমোহনেরা জানে, জনতার ধাক্কার প্রাথমিক তোড়টা যদি সামাল দিয়ে দিতে পারে, ‘ঢোঁড়া সাপ আজি এমন ছোবলাচ্ছে, অ্যাঁ’ বিস্ময়টা যদি গোড়াতেই তার হাঁটু না ভেঙে দেয়, তাহলে আজকের অনাচার কালকের লেবুর আচার দিয়ে ঠিক ম্যানেজ করে নেবে। সাধারণ লোকে বুঝতে অবধি পারবে না, প্রবল প্রতিপক্ষ কখন বাতলে দেবে, অপসারণ মানে একটা ঘর থেকে ঘুঁটিকে আরেক সুবিধেজনক ঘরে চেলে দেওয়া, আলোচনা মানে সব প্রশ্নের পাশ কাটিয়ে মন দিয়ে চায়ে চিনি গুলে চলা, বিবৃতি মানে অশালীন ট্রোলের কদর্য আক্রমণ।
পুজোয় প্রতিবাদ নিয্যস হবে, কিন্তু তার পরিকল্পনা করছে মূলত সমাজকর্মীরা, রাজনৈতিক দলের লোকেরা, কট্টর সমর্থকেরা। কোনও সন্দেহ নেই গুচ্ছ মিছিলের আয়োজনে এরাই প্রধান ভূমিকা পালন করেছে, কিন্তু আন্দোলনের প্রাণ যে সাধারণ মানুষ, যারা এসেছে বলেই প্রবল তরঙ্গ উঠেছে ও কিঞ্চিৎ কাঁপন ধরেছে, তাদের একটা দোলাচল চলবে, কারণ পুজোয় প্রতিরোধ গড়ে অন্যের আনন্দ আটকানো বাঙালির ভেতর-গঠনের বিরুদ্ধে যায়। ষষ্ঠীতে প্রতিবাদ করুন সপ্তমীতে আনন্দ করবেন’খন পন্থা যদি-বা কারও পছন্দ হয় (কারণ সত্যিই তো একদিন মিছিলে গেছি বলে পরেরদিন ঠাকুর দেখতে পারব না কেন, বন্ধুদের গেট-টুগেদারেই বা ফাঁকি পড়ব কোন যুক্তিতে), তখন সে ফেসবুক-প্রতিবেশীর কাছে ভণ্ড এবং ‘আজ ক্রোধী কাল আমোদী’ প্যাঁক খেয়ে যেতে পারে। তার চেয়ে বড় কথা, যতই আমরা কোটেশনে আওড়াই গন্তব্যটা আসল নয়, যাত্রাপথটাই আসল, যাত্রীর পক্ষে ক্রমাগত গন্তব্য আবছা হলে ও ধুম ধুলোর ঝড় উঠলে বুক বেঁধে পরের পদক্ষেপ খুব কঠিন। ‘হেরে যাব’ জানলে সাধারণ লোক তার চেষ্টা থামায়, তার ধক নিভে আসে। এ-লড়াই জেতা যাবে ভেবে প্রথমদিকে যেমন একটা প্লাবন উঠেছিল, এখন তা পিছিয়ে যাচ্ছে, মনে হচ্ছে সতেরোশো অবান্তর ফ্যাচাং-এ প্রকৃত সন্ধান ও দাবিকে ঘাগু ঘোল খাইয়ে দেওয়া গেল। পরিণামহীন কাহিনি সহ্য করা তবু সহজ, কিন্তু উপসংহারহীন বাস্তব?
বাঙালিরা ক্লাস ফাইভের রচনায় অবধি লিখেছে, পুজোর রোদ্দুর দেখলেই মন শনশন করে ওঠে। মহালয়া এসেছে শুনলেই চূড়ান্ত পাষাণেরও অজান্তে ওষ্ঠাধরে মুচকি খেলে যায়। এখন প্যান্ডেলের বাঁশ পড়ছে, মাইকের ডেসিবেলও চড়ছে, কিন্তু ওই প্রতিবর্ত ক্রিয়ায় হইহই আমোদ কই সিধে সত্তায় সেঁধিয়ে যাচ্ছে না তো? তার বদলে ছ্যাঁৎ ছ্যাঁৎ মনে পড়ে যাচ্ছে একটা লাশের চূড়ান্ত অপমান, আর সুবিচার চেয়ে অনেকের আথিবিথি আকুতিকে দুরন্ত উপেক্ষা। একটা পরাজয়ের তেলচিটে মশারি গোটা পুজোর আবহ ঘিরে ঝুলে আছে। তা নড়ছে ও কাঁপছেও, যখন-তখন এঁটে এসে গলা টিপে ধরতে পারে। অঞ্জলির সময়ে নিজ ফ্রিজ ও এসইউভি-র চাহিদার সঙ্গে একটা ন্যায়বিচারের প্রার্থনা অনেকে করবে বলেই মনে হয়। সে-মেলোড্রামা পেরিয়েও, এটুকু বলা যায়, এমন মনমরা পুজোর বুকের ওপর দিয়ে যত জয়ঢাক টেনে নিয়ে যাও ও আলোকসজ্জার খুঁটি পোতো, কালশিটে ঢাকা যাবে না। যে-লোকটা হয়তো একটা মিছিলেও যায়নি, কিন্তু আত্মকেন্দ্রিকতা ও নির্বেদের অপবাদ ভেঙে বেরিয়ে আসা মানুষগুলোকে টিভিতে দেখেছে, মনে মনে কুর্নিশ করেছে, সেও বিষাদের দলা ঢক করে গিলে ফেলে তবেই ফুচকায় মন দেবে। মা দুর্গার ত্রিনয়নের দৃষ্টিতে তা পড়বেই, তখন উনি কি ডবল ত্রিশূল অর্ডার দেবেন?