তরঙ্গনাথ – তেরো
গান্ধীজির নেতৃত্বে উত্তাল হয়ে উঠল ভারতবর্ষ। জেল, হাজত, দ্বীপান্তর বা ফাঁসি— কোনও কিছুতেই আর ভয় পেল না সাধারণ মানুষ। একদিকে মেয়ে-পুরুষ নির্বিশেষে দলে-দলে পথে নেমে সত্যাগ্রহ, অনশন, মিটিং, মিছিল; আর অন্যদিকে চতুর ইংরেজদের সঙ্গে নেতাস্থানীয়দের দফায়-দফায় কনফারেন্স আর বিভিন্ন বিষয়ে দর-কষাকষি এবং মতের অমিলে ক্রমাগত দলবিভাজন; সে এক বিষম পরিস্থিতি। ‘Transfer of Power’, ‘Partition of India’, ‘Independence of India’, ‘Indian Electorate’ এবং ‘Constituent Assembly’— এমন সব নতুন-নতুন সংকেতে পুলিশ প্রশাসন একেবারে জেরবার। তরঙ্গনাথের জীবনেও এই অভিঘাত এল একেবারে অতর্কিতে। একাদিক্রমে পুরী, কটক, ভাগলপুর, রাঁচিতে বদলি হয়ে-হয়ে, প্রায় অবসরের মুখে আবার যখন কটকে পোস্টিং হল, তরঙ্গনাথ আদেশ পেলেন এক বিপ্লবীকে ধরে আনবার; বাঙালি ছেলে, হংসধব্জ ধাড়া। সারা জীবন এসব থেকে পাশ কাটিয়ে চললেও, চাকরিজীবনের এই শেষ প্রান্তে এসে, দেওয়ালে যেন পিঠ ঠেকে গেল তাঁর। এর আগে বুদ্ধি খাটিয়ে কত স্বদেশিদেরই পালিয়ে যেতে দিয়েছেন তিনি। আগেরবার বদলি হয়ে ‘গণেশ ঘাট’-এর কাছে সপরিবারে থেকে, যে-জীবন তিনি কাটিয়েছিলেন, তার থেকে একেবারেই ভিন্ন এই নতুন পাড়া। ১৯৩৬ সালে উড়িষ্যা পুলিশকে একেবারে ঢেলে সাজিয়েছে ইংরেজ প্রশাসন। নতুন অ্যাক্ট পাশ করে এর নাম হয়েছে, Orissa Military Police। কালাহান্ডির রাজার কাছ থেকে আদায় করা একটা মস্ত বাড়িই এখন তাঁর কোয়ার্টার। চারপাশে নদী। ‘মহানদী’, ‘কাটজুড়ি’, ‘কুয়াখাই’ এবং ‘বিরূপা’; এছাড়াও আছে কাটজুড়ির ডান এবং বাঁ-দিকে ‘দেবী’ আর ‘বিলুখাই’— দুটো শাখানদীও। নদী ঘিরে মানুষের যেমন জীবন এবং উৎসব, পুলিশের পক্ষে তেমনই সংকট। নদী যেমন বন্যার উপদ্রব নিয়ে আসে, তেমনই সুবিধে করে দেয়, ডাকাত এবং স্বদেশিদের পালাবারও। লালাবাগ অঞ্চলে যে-রাজভবন, সেটাও এখান থেকে খুব দূরে নয়। এই অভিজাত এলাকায় বাঙালি প্রায় নেই বললেই চলে। একেবারে উঁচুপদের রাজভক্ত সব ওড়িয়া আমলা। যাঁদের ঝোঁকই হল থেকে-থেকে ইংল্যান্ড-স্কটল্যান্ড পাড়ি জমানো।
‘৫২ বাজার-৫৩ গলি’র এই কটক তাঁর নখদর্পণে; তাই তিনি অনেকটাই সড়গড়। কিন্তু মন তো চায় না ওই স্বদেশিদের ধরে-ধরে, দ্বীপান্তরে পাঠাতে। খোকা এবং খুকি দুজনেই রাভেন’শ ইশকুলের ছেলে ও মেয়েদের বিভাগে পড়লেও, তাদের মধ্যেও মাথা চাড়া দিয়েছে স্বদেশি বোধ। বেশ কিছু ওড়িয়া পরিবারের ছেলেমেয়েরা তাদের বন্ধু হয়েছে, যারা স্বদেশি আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে গেছে সরাসরি। ফলে, খোকা-খুকি এবং তরুর আলাপচারিতা থেকে তরঙ্গনাথেরও কানে আসে এমন কিছু পরিবারের নাম, পুলিশের ভাষায় যেগুলি একেবারে ‘Primary Suspect’। একবারে চুপ করে থাকলেও, নিজের চোখ-কান খোলাই রাখেন তরঙ্গনাথ। তার ওপর পুরনো আমলের ‘বারাবাটি’ দুর্গের পাশেই খোলা মাঠে গড়ে উঠেছে ‘গান্ধী আশ্রম’। অহিংস-পথের স্বদেশিদের কাছে এ তো একেবারে তীর্থস্থান। গান্ধীর আসা-যাওয়াতেও কড়া নজর আছে পুলিশের। অন্যদিকে কটকের ‘ওড়িয়া বাজার’-এ ওই জানকী ভবনও তো পুলিশের ঘুম ছুটিয়ে দিয়েছিল। সুভাষ বোসের অন্তর্ধান হলেও, তার অনুগামীরা তো আবার গান্ধীর অহিংস নীতি মানে না। তরঙ্গনাথ বুঝতে পারেন যে, হংসধব্জ ধাড়াকে ধরা একটা ছুতোমাত্র। তাঁর কাজে তুষ্ট হয়ে সরকার বাহাদুর শিরোপা দিতে চায় তাঁকে; বশংবদ নেটিভদের মধ্যে কাড়াকাড়ি চলে ‘রায়বাহাদুর’ বা ‘রায়সাহেব’— এমন সব খেতাব পাবার জন্য। সেই দলবাজির মধ্যে না ঢুকেও, এমনি-এমনি একটা খেতাব পেয়ে যাওয়াটাকে মেনে নিতে পারছে না যে তাঁবেদার গোষ্ঠী, তারাই মাথা খাটিয়ে এমন একটা সংকটের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে তাঁকে। হয় চাকরিতে ইস্তফা, নয়তো আদেশ মেনে তাঁবেদারি। আর তা নাহলে এই নগণ্য স্বদেশি হংসধব্জকে ধরে দিয়ে কর্তব্যের প্রমাণ দাখিল। নগণ্য হলেও বোমাবাজি এবং দল জুটিয়ে সশস্ত্র অভিযানের পুলিশ কেস আছে তার নামে। উড়িষ্যার রাজধানী এবং বাণিজ্যনগরী এই কটকে এত জাতের মানুষ মিলেমিশে আছে যে, ভাষা বা ধর্মের চিহ্নে ঝপ করে কাউকে খুঁজে পাওয়া দায়। তার ওপর মিলেমিশে আছে, মাঝিমাল্লা, চাষা, রুপোর কারিগর এবং তাঁতিরাও। কে কোথায় কীভাবে সাহায্য পাচ্ছে তার হদিশ পাওয়া বড় সহজ কাজ নয়। তরঙ্গনাথ Intelligence Branch-এর সর্বময় কর্তা হলেও, পুলিশের যেমন ইনফর্মার আছে, তেমন ইনফর্মার আছে স্বদেশিদেরও। তাদের ধরপাকড়ের সঙ্গে-সঙ্গে, সমানেই খুন হয়ে চলেছে পুলিশের লোকেরাও। একটাই সুবিধে হল তরঙ্গনাথের অব্যর্থ আন্দাজ। কারণ তিনি জানেন যে, এই ছেলেটি কোথায় লুকিয়ে থাকতে পারে। আর এটাও জানেন যে, এই হংসধ্বজকে যে-কোনও পুলিশই ধরতে পারত; তার জন্য তরঙ্গনাথের মতো উচ্চপদের পুলিশকে টান মেরে, এত আয়োজনের বাজনা শোনানোর কোনও দরকারই ছিল না। আসলে বড়মাথাদের ঢোকালে, নগণ্য কাজেরও গুরুত্ব বাড়ে। তার থেকেও বড় কথা যে, ব্রিটিশ শাসনের ঘণ্টা বেজে গেছে; শুধু এ-দেশটাই নয়, পৃথিবী জোড়া সব ক’টা উপনিবেশ থেকেই সরে আসতে হবে তাদের।
২
ইন্টালিজেন্স ব্রাঞ্চ থেকে কাজ করবার নিয়মটাই হল, চূড়ান্ত গোপনীয়তা। খবর এমন গোপনে সংগ্রহ করতে হবে যে, একজন ইনফর্মার অন্যজনের কথা জানবে না। একই কাজে, কতজনকে যে, কোন-কোন স্তরে লাগিয়ে রাখা হবে, সে-হদিশও লেখা থাকবে না কোথাও কোনও নথিতে; অথচ কাজটা হাসিল হয়ে যাবে তলে-তলে। প্রাথমিকভাবে যাদের কাজে লাগিয়েছেন তরঙ্গনাথ, তারা হল জেল থকে ছাড়া পাওয়া কিছু পুরনো কয়েদি; আর আছে কিছু রাজসাক্ষী। পুলিশের অত্যাচারের ফলে, নিজের দলের হদিশ দিয়ে দিয়েছে। এদের জেরা করতে-করতেই একজনের কাছ থেকে তরঙ্গনাথ জেনেছেন যে, ওই হংসধব্জ ধাড়া নিশ্চিত ভাবে কটকেই আছে; ছেলেকে বাঁচাতে, তার মা কোনও এক সম্ভ্রান্ত বাঙালি পরিবারে পরিচারিকার কাজ নিয়ে, অন্য পরিচয়ে দিন কাটাচ্ছে। গৃহস্বামী কতটা কী জানেন বোঝা যায়নি। জানা গেছে যে, ওই বিশেষ পরিচারিকাটির ছেলে নাকি সবসময়ে তার মায়ের সঙ্গে এক বাড়িতে থাকে না। গঞ্জামে মজুরের কাজ করে। মা এত ভাল ওড়িয়া বলে যে, বাঙালি বলে চেনার উপায় নেই। গঞ্জাম শুনেই কান খাড়া করে বসেন তরঙ্গনাথ। ময়ূরভঞ্জ, গঞ্জাম এসব অঞ্চল নিয়ে তো জোর টানাটানি চলছে। একদল ইনফর্মার তরঙ্গনাথকে তল্লাশি চালাতে বলে, ‘বারাবটি’র গান্ধী-আশ্রম এলাকায়। নাম-কা-ওয়াস্তে হালকা তল্লাশি চালালেও তিনি নিশ্চিত জানতেন যে, ওখানে ‘সে’ নেই। তাঁর মন বলছিল যে, পুলিশের চোখে ধুলো দিতে, সে হয়তো আস্তানা গেড়েছে থানার কাছাকাছিই; কারণ তাতে সন্দেহের অবকাশ কম।
রাতের অন্ধকারে নয়; বেলা থাকতেই বেরিয়ে গেলেন তরঙ্গনাথ। পুলিশের জিপ বা নিজের Cadillacগাড়িটা না নিয়ে, একেবারে সাধারণ পোশাকে, রাস্তায় হাঁটতে লাগলেন। এসে বসলেন, বক্সিবাজারের কাছে ‘গড়গড়িয়া’ ঘাটের চাতালে। ফুটকি বিন্দু থেকে ক্রমশ বড় হয়ে আসা নৌকাটা এসে দাঁড়াতেই, ভেসে পড়লেন তিনি। এই মাল্লাটি জানে যে, রিং রোড ধরে গাড়িতে না গিয়ে, এভাবেই তিনি পৌঁছতে চান, ‘মারাঠা ব্যারাক’-এর কাছে ‘চাউলিয়া গঞ্জ’ এলাকায়। তাঁর সহযোগী পুলিশেরাও সাদা পোশাকে আসছে, অন্য গাড়িতে। ‘চাউলিয়া গঞ্জ’-এর অনেকটাই শহর হয়ে গেলেও, এখনও সবুজ দিগন্ত জাগিয়ে চাষ হয়। নুয়া-পাটনার ‘মাছুয়াবাজারে’র কাছেও অপেক্ষা করবে, পুলিশের আর একটা ইউনিট। তরঙ্গনাথের আন্দাজ যে, ইনফরমেশন যতই যা থাক, এ-দুটো জায়গার মধ্যে কোনওটাতেই পাখি নেই। তাঁর মাথায় যে-জায়গাটা আছে, সেখানেই তিনি আগে যাবেন। কারণ অন্য জায়গায় তল্লাশি চালাবার খবর হলেই, আসল জায়গাটাতেও নাড়াচাড়া পড়ে যাবে। যে-খাঁড়িটাতে তিনি নামলেন, সেখানেও মোতায়েন হয়ে আছে কোমরে লুকানো পিস্তল নিয়ে সাদা পোশাকের পুলিশ। ‘চাউলিয়া গঞ্জ’ বা ‘মাছুয়াবাজারে’র রাস্তা না ধরে তিনি ঢুকে পড়লেন, ‘তারাকাশি’ নামে এক ঘিঞ্জি এলাকায়; বছর কয়েক আগেও তরুকে নিয়ে, এসেছিলেন, ফিলিগ্রির গয়না কিনে দিতে। ঘরে-ঘরে স্যাকরারা রুপোর কাজ করে চলেছে; কম আলোয়, পিঠ বেঁকিয়ে; খানিকটা হেঁটেই কাকে যেন কী একটা ইশারা করলেন তরঙ্গনাথ; মিনিট দশেকের মধ্যেই পুলিশে ঘিরে ফেলল ওই এলাকাটা। বেশ খানিকটা মাথা নামিয়ে, খড়ের চাল দেওয়া একটা বাড়ির মধ্যে ঢুকে এলেন তিনি। পকেটে রাখা ফোটোগ্রাফটি বার করে, মিলিয়ে নিলেন, হাড়জিরজিরে রোগা ছেলেটির চেহারার সঙ্গে। নিঃসন্দেহ হবার জন্য, অন্য দুজন অফিসারদের কাছ থেকেও চেয়ে নিলেন ভিন্ন অ্যাঙ্গেল থেকে তোলা, তার আরও দুটি ফোটোগ্রাফ। আসামি খেতে বসেছিল; সঙ্গের সেপাইটি তাকে নড়া ধরে তুলে, হ্যান্ডকাপ পরিয়ে হেঁচড়াতে শুরু করলে, নিষেধ করলেন তরঙ্গনাথ; ভরসা পেয়ে আসামির মা কেঁদে উঠে, এক বর্ণ ওড়িয়া না-জানা পরিষ্কার বাংলায় বলতে লাগল, ‘আজ এক মাস পরে, ঘরে এসে দুটি খেতে বসেছিল; ওকে খেয়ে যেতে দাও তোমরা!’ তরঙ্গনাথের দ্বিতীয় ইশারায় গাড়িতে তোলা হল তাকে। তরঙ্গনাথ শুনতে পেলেন, অভিশাপ দিচ্ছে বিধবা মা, ‘দারোগা, এই পাপেই নির্বংশ হবে তুমি।’
তরঙ্গনাথের চোখে ভাসছে ওই মহিলার সিঁদুর পরা মুখখানা; ছেলেকে বাঁচাতে বিধবা হয়েও, এক মরিয়া-মা সধবার ছদ্মবেশ নিয়ে আছে! আসামীকে নিয়ে পুলিশ ভ্যান চলে গেলে, তরঙ্গনাথও উঠে পড়লেন আর একটা গাড়িতে। বেলা পড়ে এসেছে। আশ্বিন শেষ হয়ে কার্তিক পড়েছে। আজ পূর্ণিমা। ঘরে-ঘরে তোড়জোড় চলছে ‘বালিয়া-যাত্রার’ শুভ যোগে। এইদিন নাকি ব্যাবসা শেষে বাণিজ্যতরীগুলো ফিরে আসত বালি, জাভা, ইন্দোনেশিয়া ও সুমাত্রা থেকে; তরঙ্গনাথ যে আজ কী বাণিজ্য করলেন জানেন না। সাহেব-বাহাদুরের পুরস্কার, নাকি এক লড়াকু মায়ের অভিশাপ! গাড়িতে বসেই ভাবতে লাগলেন, বাড়ি ফিরে আজ কী বলবেন তরুকে! সারাদিন অভুক্ত তরঙ্গনাথের সামনে এসে, তরু যখন খাবার বেড়ে দেবে, তাঁর গলা দিয়ে নামবে তো ওই খাবার! পাশে বসা অফিসারটি আর চুপ করে থাকতে না পেরে, ইংরেজিতে জানতে চাইল, ‘কোনও ইনফরমেশন ছাড়াই, আপনি স্যার ‘তারাকাশি’ চলে গেলেন কেন!’
‘মনে হল তাই; ইন্টুইশান! পুলিশের কাছে, ইনফরমেশন না থাকাটাও তো ইনফরমেশন!’
‘কেন মনে হল স্যার যে ‘চাউলিয়াগঞ্জ’ আর ‘মাছুয়া বাজার’ গেলে ওকে পাওয়া যাবে না!’
খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে তরঙ্গনাথ বললেন যে, ‘চাউলিয়াগঞ্জে তল্লাশি চালাতে গেলে, আমাকেই গুমখুন করা হত। সেজন্যই ওই ইনফরমেশনটা দেওয়া হয়েছিল, যাতে আমি ফাঁদে পা-টা দিই।’
‘তল্লাশি করতে বলে যে অর্ডার স্যার, সেখানে তো আপনার নাম দেওয়া ছিল না! তাহলে লিক হবে কী করে! আসলে, এক তল্লাশিতেই কাজ সারব বলে, আমি তো প্রায় এক মাস ধরে জ্বাল বিছিয়েছি; ফলে গোপনেরও যে ফোকর থাকে অফিসার!’
‘সড়ক পথে সোজা না গিয়েই কাজ হাসিল হল স্যার।’
‘সড়কপথের থেকে গলিপথের দূরত্ব সবসময়তেই কম; তবে, চেনা থাকা চাই।’
‘গলিঘুঁজি এসব আপনার চেনা থাকাতে, কী আশ্চর্য কাজ হল স্যার!’
জুনিয়র কেন, কেউই জানে না যে, একটি গুলিও খরচ না করে, গলিপথে এগিয়েই কী ভাবে কী করে ফেললেন তরঙ্গনাথ; তাঁর আসল কেরামতি ছিল, নৌকো ধরে জলপথে এগিয়ে, গোপনে স্পটে পৌঁছনো। মাল্লা-বদ্রুনাথ তাঁর সঙ্গে বেইমানি করেনি। বদ্রুনাথ কবে যে, কীভাবে তাঁর কাছে কোন উপকার পেয়েছিল, তা আর মনে রাখেননি তিনি। কিন্তু বদ্রুনাথের দেওয়া খবরে পুরোপুরি ভরসা রেখেছিলেন তরঙ্গনাথ। কারণ, মাছ বিক্রির সুবাদে তার ছেলে মাছুয়া-পুরুষোত্তমের নিয়মিত যাতায়াত ছিল, হংসধব্জের মায়ের কাছে। তার মনেই সন্দেহ জেগেছিল, সধবা হয়েও ওই বাঙালি গিন্নির মাছ না খাওয়ায়; ছেলে বাড়ি এলে তবেই মাছ যেত। সরু সুতোর খুটখুটে গিঁট ছাড়াতে-ছাড়তেই তরঙ্গনাথ বুঝেছিলেন যে, বদ্রুনাথের সন্দেহ একেবারে সঠিক। গাড়িতে রিং রোড দিয়ে ফেরার পথে, তরঙ্গনাথ আর একবার এসে দাঁড়ালেন, চৈতন্যদেবের পায়ের ধুলো মাখা সেই ‘গড়গড়িয়া’ ঘাটে। কার্তিক পূর্ণিমার আলোর মায়ায়, আমোদে ভেসে যাচ্ছে নদীজল; তালপাতা দিয়ে তৈরি খেলনা-নৌকোর ভেতরে প্রদীপ জ্বালিয়ে সেগুলিই নদীতে ভাসাচ্ছে মেয়ে-বউরা। বদ্রুনাথ জানতেও পারল না যে, কেন তিনি আজ তার নৌকোতে উঠেছিলেন। তরঙ্গনাথের মনে পড়ল যে, দস্যু রত্নাকরের পাপের ভাগও তো কেউ নেয়নি; তাঁর প্রতি চিরকৃতজ্ঞ বদ্রুনাথও বোধহয় ক্ষমা করতে পারবে না তাঁকে। জেলহাজত হবে জানলে, সে-ও কি এমন সাগ্রহে এই হদিশ দিত?
৩
মাসখানেকের মধ্যেই সরকারি বুলেটিন থেকে জানা গেল যে, ‘রায়সাহেব’ পদবিতে ভূষিত হয়েছেন তরঙ্গনাথ। খোকা যেন কিছুতেই মেনে নিতে পারল না, তাঁর এই উপাধি পাওয়ার গৌরব। রাভেন’শ কলেজের যোগাযোগে, তার বন্ধু বিজু পট্টনায়েকের সূত্রেই কি কোনও খবর চাউর হয়ে গেল! বিজুর মা বাঙালি হওয়ায় তরুরও যাতায়াত আছে ওই পরিবারে; ‘গণেশঘাট’ এলাকায় তাঁরা এখন না থাকলেও, সেখানকার ‘বীণাপাণি ক্লাব’-এর সূত্রেও খোকার এমন অনেক বন্ধু আছে, যারা ইংরেজবিরোধী। এই প্রথম এমন এক গৌরবে তিনি ভূষিত হলেন যে, বাড়িতে কেউ তাঁকে স্বাগত জানাল না। রাতে শুতে এসে তরু শুধু বলল, ভাগ্যিস এর আগে তিনবার সুযোগ পেয়েও এই ছেলেটাকে বন্দি করোনি তুমি! তাহলে তো ‘রায়বাহাদুর’ খেতাব পাওয়া বরকে নিয়ে মুখ লুকোতে হতো গো আমাকে! বিস্মিত তরঙ্গনাথ উদাসীন ভঙ্গির আড়ালে, ভীষণ সতর্ক চোখে, শুধু তাকিয়ে রইলেন তরুর মুখের দিকে।
থমথমে ভাবটা বাড়িতে না কাটলেও, শিরোপা-প্রদান অনুষ্ঠানে অবশ্য তরু তাঁর সঙ্গেই গেল। ‘নুয়া পাটনা’ থেকে কেনা, ‘নবগুঞ্জারা’ নকশায় বোনা সেই ঘিয়ে রঙের লালপেড়ে ‘মানিয়া বান্দি’ সিল্ক শাড়িটাই তরু পরেছে; হিন্দু ধর্মের পাঁচ রকম পশু-পাখি মিলিয়ে সে এক বিচিত্র অথচ সুন্দর মোটিফ এই ‘গুঞ্জারা’; খোকাই তো দেখে-দেখে বেছে বার করেছিল; ওই শাড়ির সঙ্গে মিলিয়েই তরু পরেছে, ‘তারাকাশি’ থেকেই কেনা ফিলিগ্রির গয়না; তবে হাতের বটুয়াটি নিজের বোনা; লেসের। তরঙ্গনাথ কি একটু কেঁপে গেলেন, তরুর সাজে আজ ‘তারাকাশি’ আর ‘নুয়া-পাটনা’র আভরণ দেখে! অনেক বছর বাদে তরঙ্গনাথ পরেছেন খাকি ব্রিচেশ; পুলিশি কায়দায় মোজার ওপর জড়িয়েছেন শেওলা সবুজ পট্টিও। পায়ে ভারী বুট; বাঁধা পাগড়ির বদলে কালো সিল্ক দিয়ে তৈরি পাগড়ি-টুপি, যার কালো ঝালরখানা লুটিয়ে আছে পিঠে; বিশেষ সম্মানে, পুলিশের গাড়িতে করে দুজনেই এসে পৌঁছলেন গভর্নর Lord Hawthorne Lewis-এর Government’s House-এ। কাটজুড়ি নদীর পাড়ে লালবাগ প্যালেসটাই ১৯৪১ থেকে সাহেবদের দখলে। দরবার হলের সামনের খোলা চত্বরে শুরু হল অনুষ্ঠান। গভর্নরের হয়ে মানপত্রটি পড়ে দিলেন আর এক ভারপ্রাপ্ত সাহেব। তরঙ্গনাথ গভর্নরের কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই, সাহেব নিজে হাতে তাঁর গলায় পরিয়ে দিলেন রুপোর পদক। পদকের সামনের দিকে এমবস করা, রাজা ষষ্ঠ জর্জের ছবি; যার ঠিক ওপরেই ব্রিটিশ-ক্রাউনের লোগো; আর ওই পদকেরই উলটো পিঠে লেখা তরঙ্গনাথের নামের পাশে, সাল-সহ উচ্চপদটি।
ভাইসরয় Lord Wavell এর নামে জয়ধ্বনি শেষে অনুষ্ঠানপর্বের সমাপ্তি ঘোষণা করা হলে, তরুকে নিয়ে সকলের সঙ্গে ডিনারে যোগ দিলেও, তরঙ্গনাথের কানে যেন কাঁটার মতো বিঁধছে, সেই ঘোষণা— ‘Rai Sahib is a title of honour for Hindus, a decorative part of the British Rule. It is conferred by the Viceroy of India to individuals who has performed faithful service or acts of public welfare to the nation accompanied by a special Title Badge.’
কানে বিঁধছে প্রশস্তিপত্রের সেই পাঠও— ‘… Your work in the capacity has been distinguished by the conscientiousness, accuracy and the sound judgement which has throughout your service rendered you an officer of outstanding value to Government…’
বাড়ি ফিরে, শোবার ঘরে এসে তরঙ্গনাথের কাছ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে, তরু বলল, ‘কী, রায়সাহেব তরঙ্গনাথ মশায়!’
বিরক্ত তরঙ্গনাথ তার দিকে নিষ্প্রাণ তাকিয়ে, কঠিন স্বরে বললেন, ‘আর কখনও আমার কান টেনে কথা বলবে না, তুমি।’ বললেন, ‘মনে রেখো, শিরোপা ছাড়াই চিরকাল সম্মানের সঙ্গেই চাকরি করে এসেছি; সেভাবে শেষ করেই অবসরও নেব।’
দিন কয়েক পরে, তরুর হাত থেকে চিঠিখানি নিয়ে পড়বার আগেই অবাক হয়ে গেলেন তিনি। পরিচিতদের মধ্যে যে একজন তাঁকে শুভেচ্ছা জানিয়েছে, সে হল ভূতেশ। চিঠিখানি এসেছে দিল্লি থেকে। তরুর কাছে তরঙ্গনাথ এ-ও তো শুনেছিলেন যে, খোকার সঙ্গে তার বড় বা মেজো যে-কোনও এক মেয়ের বিয়ে দিতে আগ্রহী ভূতেশ। তরু বা খোকা কেউই বিশেষ গা করেনি। সংসার নিয়ে তাঁর আর বিশেষ কিছু ভাববার নেই। রাণীর মৃত্যুর আগেই তরঙ্গনাথের মায়ের ইচ্ছেতেই, তাঁর বড় মেয়ে বিমির বিয়ে হয়ে যায়। কিন্তু দু-মাসের মধ্যেই বিধবা হয়ে সে ফিরে আসে; মৃতদেহ অবশ্য কেউই দেখতে পায়নি অনেক চেষ্টা করেও আবার বিয়েতে রাজি করাতে পারেননি বিমিকে। লেখাপড়া করে বিমি এখন একটা রেসিডেন্সিয়াল ইশকুলে পড়ায়। মেজো মেয়ের বিয়েও দিয়ে গেছেন তরঙ্গনাথের বাবা; মন্দের ভাল হয়েছে সেই বিয়ে; ছোট মেয়ের দুটি সন্তান হলেও, চরম অসুখী হয়েছে তাঁদের ‘খুকি’ও। রাণীর মৃত্যুর জেরে, পাটনায় থাকাকালীন আগে চলে গেছেন তাঁর মা; আর বাবা গেছেন পরে, ভাগলপুরে থাকবার সময়ে। খোকার খুব ইচ্ছে ছিল, রবি ঠাকুরের বিশ্বভারতীতে ঢোকবার। তাঁর সরকারি চাকরির কারণেই অনুমতি দিতে পারেননি তিনি। কলকাতার সরকারি আর্ট কলেজে পড়লেও শেষ বছরের পরীক্ষা না দিয়েই সে চলে গেছে, মুম্বইয়ের ফিল্মিস্থান স্টুডিয়োর কাজ নিয়ে। গান্ধী হত্যার পরে-পরেই অবসর নিয়েছেন তরঙ্গনাথ। দেশভাগ এবং স্বাধীনতার ঠিক পরেই ওই ১৯৪৮ সালেই, তরু এবং একটি মাত্র পরিচারিকাকে নিয়ে, পেনশন সম্বল করে তিনি ফিরে এলেন সোদপুরের পৈতৃক বাড়িতে। পুরনো জামার মতোই ফেলে দিয়ে এলেন পদমর্যাদা, বৈভব এবং বন্ধু-পরিজনের এক মুগ্ধ পরিসর।
আমি তরঙ্গনাথ। বছর দেড়েক হল অবসর নিয়েছি। সময় কাটে, বাড়ির পাশের এক টুকরো জমিতেই ফুলের বাগান করে। শীতের ফুল দেখতে সকলে দাঁড়িয়ে পড়ে। পাশের পুকুর থেকে লোহার বালতিতে জল তুলে নিজেই বাগানে দিই। কয়েকদিন হল তরু গেছে, মেয়ের কাছে বর্ধমান। আজই তার ফেরার কথা। রেডিয়োতে বেলার খবরে শুনেছি যে, আজ ৩০ জানুয়ারি, গান্ধীর মৃত্যুর এক বছর পূর্তিতে নানা মিছিল বের হওয়ায় ভয়াবহ হট্টগোলও নাকি শুরু হয়েছে; বর্ধমান লাইনের ট্রেন বন্ধ। জানি না তরু কী করে বাড়ি ফিরবে!
উতলা লাগলেও, বিকেলের দিকে হাঁটতে–হাঁটতে, একটু গল্প করতে গেলাম, বাড়ির একেবারে হাতায়, সুবিমলবাবুদের বাড়ি। এক কাপ চা খাওয়ার পরেই বুকে ব্যথা উঠল। ধরাধরি করে শুইয়ে দিল আমাকে…।
কেমন একটা ঘোর… খোকার গলা পাচ্ছি… তরু? সে কি সেই রথের রশি ধরবে বলে ভিড়ে হারিয়ে গেল? রথের ওপর থেকে দেখতে না পেলে, মানুষের ভিড়ে তো পিষে মরে যেত তরু!
আজ কি কার্তিক পূর্ণিমা! বালিয়া যাত্রায় নৌকো ভাসাচ্ছে সবাই! হংসধব্জ কী বেঁচে আছে?
রায়সাহেব খেতাবটা দেখলে, মা কত কষ্ট পেতেন!
Studebaker গাড়িটা বিক্রি করে দিয়ে এলাম বলে, খোকার অভিমান কি এখনও যায়নি?
ভাগলপুরে থাকবার সময়, বনফুলের ভাই… লালু ডাক্তার, আমার গান শুনতে চাইতেন…
রবি ঠাকুর নেই… তাঁর গান আছে…
কাটজুড়ি নদীতে সূর্য ডুবছে… আজি কোন সুরে বাঁধিব… দিন অবসান বেলা রে!
বড় আচ্ছন্ন লাগছে! ঘুম পাচ্ছে খুব, এখানেই ঘুমিয়ে থাকি…
তরু এসে ঠিক ডেকে দেবে…
কাটিহার জঙ্গলের বনভূমিতে শুয়ে আছি… শেওলা সবুজ রঙের ওপর ঝরে পড়ছে রাঙা রঙের বিন্তি আর জিরুল ফুল…
তিনতলায়, খোকার নতুন ছবিতে, ক্যানভাস জুড়ে, ভিজে-ভিজে থকথকে হুকারস গ্রিন…
তরু, তরু, তরু…
ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র