সমবিধান ঔষধালয়
গড়িয়ায় আমাদের ছোট্ট পাড়ায় আমাদের বাড়ির দিক থেকে এসে সাহেব-বাড়ির মোড় থেকে রাস্তাটা যেখানে তিনদিকে ভাগ হয়ে যেত, সেখান থেকে বাঁয়ে হেঁটে গেলে মিনিটখানেকও নয়। ডান হাতে পড়বে ডাক্তারবাবুর চেম্বার এবং ডিসপেন্সারি। পুরো নাম তাঁর কমই শুনেছি তখন, ডাক্তার ভটচাজ নামেই তাঁর খ্যাতি। আর সে-খ্যাতি কেবল আমাদের এলাকাতেই নয়, বরং সে-অঞ্চল পেরিয়ে বহুদূর বিস্তৃত ছিল। দূর-দূর সব পাড়া থেকে অসুখ-করা মানুষজন ডাক্তারবাবুকে দেখাতে আসতেন। আর একবার আসা মানেই সারাজীবন আসা। তাঁর ওষুধে এমনই কাজ হত যে, হরেক রকম অসুখে তাঁরই কাছে আসতে বাধ্য হতেন সকলে। এই যেমন তাঁর এক অতি খুদে অথচ নিয়মিত রুগি, আমি।
ছোটবেলায় আমি দুর্দান্ত ভুগতাম। আমাদের স্কুলে ‘দিনলিপি’ নামক একখানা খাতা দেওয়া হত সব পড়ুয়াকেই, স্কুল কামাই হলে সেখানে তারিখ ও কারণ উল্লেখ করে অভিভাবকের সই-সহ নিয়ে যেতে হত। তা সেই দিনলিপি আমার শেষ হয়ে যেত সকলের আগে। এক-দুজন শিক্ষক তো বিরক্ত হয়ে বলেই ফেলতেন, ‘তুমি এত অসুস্থ হও কীভাবে বলো তো?’ কিন্তু, সত্যি বলতে কী, আমি খুব সৎভাবেই অসুস্থ হতাম। এবং প্রায় প্রতি মাসেই। হয়তো খেলতে গিয়ে বৃষ্টি ভিজে ফিরলাম, ধূম জ্বর এসে গেল। সে আর নামেই না। হয়তো ঝাল-ঝাল মটরদানা বেশ করে চিবিয়ে এলাম, পরদিন থেকে পেট-বাবাজি আর সঙ্গ দিল না। এইরকম সব লেগেই থাকত। আর যে-অসুখই লাগুক না কেন, ধন্বন্তরি ওই একজনই। ডাক্তার ভটচাজ।
দু’বেলাই তিনি নিয়ম করে চেম্বারে আসতেন, কেবল বেস্পতিবারটা ছাড়া। ওইদিন তাঁর ছুটি। একজন বাঁধাধরা রিক্সাচালক ছিলেন, যাঁর পঙ্খিরাজে সওয়ার হয়ে আমাদের পাড়ায় ঢুকতেন ডাক্তারবাবু। পাটভাঙা বুশ শার্ট আর পাতলুন, পালিশ করা জুতো, আর কোলের ওপর শোয়ানো থাকত কালো রঙের চৌকোনো একখানা ব্রিফকেস। ওর মধ্যেই ডাক্তারির যাবতীয় সরঞ্জাম লুকোনো। আরেকটি জিনিস অবশ্যই থাকত, সেটা হল ওঁর মুখজোড়া উজ্জ্বল আর তৃপ্তিময় একখানা হাসি। চপচপে তেল দিয়ে স্নান করার পর সিঁথি কেটে আঁচড়ানো কালো চুল, নাকের নীচে যত্নে জিইয়ে রাখা সরু গোঁফ, আর সদাশয় হাসি, এই ছিল ডাক্তারবাবুর চেনা চেহারা। রিক্সায় যাতায়াতের পথে পাড়ার লোকজনের সঙ্গে মোলাকাত হলে সহাস্য অভিবাদন তো স্বভাবসিদ্ধ ছিলই, না হলেও মুখে একখানা হাসি টাঙিয়ে রিক্সায় বসে থাকতেন তিনি। দেখলেই মন ভাল হয়ে যেত।
শরীরও নিঃসন্দেহে ভাল হত তাঁর চিকিৎসায়। এইখানে বলে রাখি, তিনি প্র্যাকটিস করতেন হোমিওপ্যাথি। সে-আমলে হোমিওপ্যাথ ডাক্তারদের দেদার রমরমা ছিল, এখনকার মতো সব কিছু একপেশে হয়ে যায়নি। আমারও গোটা ছোটবেলাটা কেটেছে এবং সেরেছে ওই হোমিওপ্যাথি চালিয়েই। নেহাত বাধ্য না হলে অ্যালোপ্যাথের ধার মাড়াতাম না কেউই। তা যা বলছিলাম, ছোটখাট অসুখবিসুখ করলে বাবার হাত ধরে হেঁটে তাঁর চেম্বারে যাওয়াটাই ছিল দস্তুর। একখানা মাঝারি ঘর, মলিন আর পলেস্তারা-খসা তার পুরনো দেয়াল, চারপাশে চারখানা বেঞ্চি পাতা, মাঝখানে একখানা টেবিল, তাতে কিছু পত্রপত্রিকা আর খবরের কাগজ। আর দেয়ালের একপাশ ঢেকে দাঁড়িয়ে থাকা একজন প্রাচীন কাচের আলমারি, যার মধ্যে সার বেঁধে বন্দি সব শিশিবোতল। এই ছিল তার চেম্বারের মোটের ওপর চেহারা।
ডাক্তারবাবুর কাজকম্মো সব সামলাতেন এক সদা-হাসিমুখ সাদাচুলের প্রৌঢ়, শঙ্করদা নামে যাঁকে ডাকতেন সকলে। আমার শঙ্করমামা অবশ্য। আমাকে দেখলেই, ‘কী রে, আবার কী হল?’ বলে একগাল হেসে একটু আদর করে দিতেন। অসুস্থ শরীরেও খানিক মন ওখানেই ভাল হয়ে যেত। মাঝখানের টেবিলে ছাপানো কিছু চৌকো কাগজ রাখা থাকত, তাতে রোগীর নাম, ঠিকানা আর অসুখের ধরন লিখে জমা দিতে হত। যার যেমন সময়ে কাগজ জমা পড়বে, তার তেমন সময়ে ডাক। অনেকেই এসে আগে থাকতে নাম লিখিয়ে যেতেন, যাতে আদত সময়ে অপেক্ষা বেশিক্ষণের না হয়। অবশ্য অপেক্ষা করতে ভালও বাসতেন অনেক রোগী। কেউ-কেউ হয়তো পাড়ারই মানুষ, ডাক্তারখানায় বসে দিব্যি দেশকাল বিষয়ে আড্ডা ও মন্তব্য চলত তাঁদের মধ্যে, কেউ-কেউ দিনের খবর ঝালিয়ে নিতেন ওখানেই। বিশেষ তাড়া কারওর থাকত না তেমন।
বাবার সঙ্গে ছিল তাঁর ভারি খাতির। একে সে-সময়ে সাংবাদিক হওয়াটা একখানা বেশ গ্রাম্ভারি ব্যাপার, তায় ডাক্তারবাবু নাকি ছিলেন লতায়পাতায় আমাদের জ্ঞাতি। ফলে কাগজ আমাদের জমা দিতে হত না, কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর হাতে একটু ফুরসত পেলেই ভেতরঘরে তলব পড়ত আমাদের। ছোট্ট একখানা চেম্বার যাকে বলে, একপাশে ডাক্তারবাবুর মস্ত চেয়ার, পিঠে তোয়ালে মোড়া, অন্যপাশে রোগীর বসবার ব্যবস্থা। একদিকে লম্বা আর সরু বিছানা, রোগীকে যদি শুইয়ে পরীক্ষা করতে হয়, সেজন্য। ডাক্তারবাবুর মাথার পেছনে জ্বলজ্বল করছে বাঁধাই করা দুই বিখ্যাত ব্যক্তির দু’খানা ছবি। হ্যানিম্যান আর রবীন্দ্রনাথ। এই কম্বিনেশনটা আর কোথাও কখনও দেখিনি। পাশের একখানা জানলা দিয়ে রোদ বা ল্যাম্পপোস্টের আলো, দুইই দিব্যি ঢুকে পড়ত।
আমাকে আগে ঝট করে দেখে নিতেন ডাক্তারবাবু। তারপর ওষুধ লিখে সে-কাগজ ধরিয়ে দিতেন শঙ্করমামার হাতে। এই ব্যাপারটা আমার দারুণ লাগত। ডাক্তারবাবুর দেওয়া বিধিমতো এ-বড়ির সঙ্গে সে-বড়ি মিলিয়ে মিশিয়ে তাতে স্বচ্ছ চনমনে গন্ধের তরল মিলিয়ে ভাল করে দু’হাতে ঝাঁকিয়ে তৈরি করা হত ওষুধ। আরেক রকমও হত, তাকে আমরা ডাকতাম ‘পুরিয়া’। রাগ নয়, রোগের পুরিয়া। সে-ওষুধ হত সাদা আর গুঁড়ো, মিল্ক পাউডারের মতো দেখতে অবিকল। খেতেও মিষ্টি। পরিমাণমতো কাগজে ঢেলে, সুন্দর চৌকোনো ভাঁজ করে পুরিয়া বানিয়ে তাদের চালান করা হতো খামের মধ্যে। উপরে ডোজ লিখে দেওয়া হত কালির কলমে, হাতের লেখায়।
তা এইসব যতক্ষণ চলত, ডক্তারবাবু আড্ডা জুড়তেন বাবার সঙ্গে। চারপাশের কী হালচাল, কোথায় কী হচ্ছে, কেননা সে-আমলে সাংবাদিকদের কাছে অনেক কিছু লুকোনো থাকত। তারই দু’চারটে জেনে নিতে পারলে কারই-বা রোমাঞ্চ না হয়! বাবাও গপ্পে মানুষ ছিলেন, দুজনে জমে যেত। ডাক্তারবাবুর একটাই নেশা ছিল, নস্যি। ওই আড্ডার সময়ে অবধারিত ভাবে পাশের টেবিল থেকে নস্যির ডিবেটা তুলে এনে আঙুল দিয়ে তার মাথায় বেশ কয়েকবার টোকা মারতেন, খোলার আগেই। এ হল গিয়ে নেশার প্রস্তুতি। তারপর কৌটো খুলে এক টিপ নস্যি দু’আঙুলের মাঝে তুলে নিয়ে নাকের সামনে ধরে চোঁওও টান। শেষমেশ রুমাল বার করে নাক মুছে নিয়ে আবার আড্ডায় ফেরা। এসব নেশাও, ওই হোমিওপ্যাথ চেম্বারের মতোই, বিরল হয়ে এসেছে এখন। যেমন বিরল হয়ে এসেছে আমার বৃষ্টি ভেজা।
তাঁর চেম্বারের নামটাই তো বলা হয়নি। ভারি চমৎকার একখানা নাম ছিল, যিনিই দিয়ে থাকুন। সমবিধান ঔষধালয়। মনে-মনে আউড়ে নিতে বেশ লাগত আমার। যদিও তখনও জানতাম না, সমবিধান আদতে এক ইউটোপিয়ার নাম, যা কোনওদিন কোথাও স্থায়ী হবার নয়। যেমন জানতাম না, ও-পাড়া থেকে অনেক দূরে উঠে আসব একদিন, দু’বেলা রিক্সায় বসে থাকা ডাক্তারবাবুর হাসিমুখ দেখতে পাব না নিয়মমাফিক। এখন অসুখ করলে যেসব জায়গায় যাই, সেখানে কেউ কাউকে চেনে না, কোনও পারস্পরিক কুশল বিনিময়, আড্ডা বা হাসিঠাট্টাহীন ঠান্ডা ঘরে সকলে বিমর্ষ, অপেক্ষায়। দূর-দূর অবধি কোনও রিক্সা নেই, পাড়া নেই, ল্যাম্পপোস্ট নেই, পাশাপাশি তাকিয়ে থাকা রবীন্দ্রনাথ আর হ্যানিম্যান নেই। আমার ছোটবেলাটাও নেই। যার অনেকখানি ওই ডাক্তারবাবুর সঙ্গেই রিক্সা চেপে কোথায় যেন হারিয়ে গেছে…
ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র