ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • ডেটলাইন : পর্ব ৪


    তপশ্রী গুপ্ত (August 23, 2024)
     

    পর্ব ৩

    কলম্বো, জাল রত্ন, সোনার বিস্কুট

    ২০০৫-এর পর ২০০৮। তিন বছরে অনেক বদলে গেছে কলম্বো। তখনও কিন্তু প্রভাকরণবধ কাব্য লেখা হয়নি। অক্টোবর মাস। কে জানত, এলটিটিই-র কোমর ভাঙতে বাকি আর মাত্র কয়েক মাস! ২০০৯ সালের মে মাসেই সেনাবাহিনীর হাতে প্রাণ গেল দুনিয়া-কাঁপানো সন্ত্রাসী আর তার দলবলের অনেকের। ফলে সেই উত্তেজনাপূর্ণ আবহটা জারি আছে শ্রীলঙ্কাজুড়ে। সৈকতের কাছাকাছি গল রোডে সেই রণমুথু হোটেলেই ফের উঠেছি। তবে এবার আমার আর তত টেনশন নেই। কারণ এবারের অ্যাসাইনমেন্ট খবরের নয়, ভ্রমণের। একটা চ্যানেলের জন্য কমিশনড প্রোগ্রাম, প্রতিবেশী কয়েকটা দেশের পর্যটন নিয়ে অনেকগুলো এপিসোড হবে। নেপাল, ভুটান, বাংলাদেশ, থাইল্যান্ড, শ্রীলঙ্কা। তাই এবারে সঙ্গী ক্যামেরাম্যানও অন্য; খবরের জগতের নয়, ফিচার তুলতে অভ্যস্ত। একটু হালকা মেজাজে কলম্বো নামলাম। সফরসূচিতে গল, ক্যান্ডি, সিথাএলিয়া, পিন্নাভেলের মতো সুন্দর-সুন্দর জায়গা রয়েছে। আছে কলম্বোর শহরতলিতে ছবির মতো বিচ রিসর্ট মাউন্ট লাভানিয়া। এবার আর জাফনার দিকেই যাওয়া নেই। হোটেলে চেক ইন করে লাঞ্চ সেরেই চললাম সৈকতের দিকে। এ কী কান্ড! বিচে ঢোকার রাস্তাই বন্ধ! আগের বার কিন্তু এসব ছিল না। শুধু তাই না, পাথরের মতো মুখ করে গোধূলিবেলার ওই অপূর্ব নীলের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে সার-সার সেনা। অগত্যা এক বেয়নেটধারীকেই জিজ্ঞাসা করলাম, ‘সৈকতে যাব কীভাবে?’ সে একটুও ঘাড় না ঘুরিয়ে বলল, ‘এদিক দিয়ে ঢোকার রাস্তা বন্ধ। অনেকটা হেঁটে গিয়ে তাজ সমুদ্র হোটেলের সামনে খোলা আছে।’ সেই সঙ্গে সতর্ক করল, বিচে দাঁড়িয়ে যেন ক্যামেরা না খুলি। বুঝলাম, এদিকে প্রধানমন্ত্রীর বাড়ি, ভারতীয় হাই কমিশন-সহ বেশ কয়েকটি দেশের দূতাবাস থাকায় হাই সিকিউরিটি জোন। তাই এরকম কঠোর নিরাপত্তা। কিন্তু প্রশ্ন জাগল মনে, সে তো ২০০৫ সালেও এসব ছিল, তাহলে তখন কেন সৈকতের পথ খোলা ছিল? কথা বাড়িয়ে লাভ নেই, উলটে ফেঁসে যেতে পারি। হাঁটা লাগালাম অন্য প্রান্তের দিকে। তাজ সমুদ্র চেনে দেশি-বিদেশি সবাই। আন্তর্জাতিক ম্যাচের ক্রিকেট টিম সাধারণত এখানেই ওঠে। কিছুটা গিয়েই মনে হল, নির্জন সৈকতে পিছু-পিছু কেউ আসছে। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি চেনা মুখ। তিন বছরেও ভুলিনি। সে অবশ্য আমাকে চিনতে পারেনি। লোকটার চেহারাটাও বিচিত্র, চোয়াড়ে মার্কা, পাক্কা দালাল বোঝাই যায়। বিদেশিরাই ওর টার্গেট, তাই চোস্ত ইংরেজি বলে। আমি সোজাসুজি বললাম, ‘আপনাকে আমি চিনতে পেরেছি। পিছনে এসে লাভ হবে না। মণিমুক্তোর লোভ দেখিয়েছিলেন, মনে আছে আগেরবার? সব জাল রত্ন দিয়ে ঠকান ফরেনারদের।’ ক্যামেরাম্যান তো হাঁ। এই সুদূর কলম্বোতে দালাল চিনে রেখেছি আমি! আসলে আগেরবার সৈকতে এই লোকটা পাকড়েছিল আমাদের। শ্রীলঙ্কা যে জেমস বা রত্নের জন্য বিখ্যাত, জানে সবাই। তাই সহজেই পা দেয় ওর ফাঁদে। নানারকম রহস্য করে তথাকথিত গোপন ডেরায় নিয়ে গিয়ে একগাদা দাম দিয়ে রুবি, পান্না, বৈদুর্য্যমণি বলে যেগুলো গছায়, সেগুলো আসলে সেমি প্রেশাস স্টোন ছাড়া কিছু নয়। বলা বাহুল্য, আমরা ওর ক্রেতা হতে পারি না কস্মিনকালেও। আমাদের সেই পকেটের জোরই নেই। আগের বার আমরা ওর সঙ্গে গেছিলাম ছবি তোলার আগ্রহে। অটো করে নিয়ে গেছিল গলির গলি তস্য গলির মধ্যে একটা বাড়ির বেসমেন্টে। সত্যিই চোখ ধাঁধিয়ে গেছিল শো-কেসে সাজানো নানা রঙের মাণিক্য দেখে। ছবিও তুলতে দিয়েছিল। পরে কিনব না জেনে হতাশ হলেও তেমন রাগ প্রকাশ করেনি। ভেবেছিল হয়তো আমরা টিভিতে প্রচুর প্রচার করব এই রত্নভাণ্ডারের। আমাদের ঘোর কাটছিল না, কারণ তখনও জানি না এগুলো ভুয়ো। ক’দিন পরে কলম্বোপ্রবাসী এক বাঙালি পরিবারের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। ফ্লাওয়ার রোড বলে একটা রাস্তায় বহুতলের সাজানো ফ্ল্যাটে আমাদের নেমন্তন্ন করে খাইয়েছিলেন। সেই বাড়ির গৃহিণী জানিয়েছিলেন, নকল মণিপান্নার রমরমা ব্যবসার কথা, বিদেশিদের, বিশেষ করে সাদা চামড়াদের ঠকানোর কথা। এবার আমার কথা শুনে কিন্তু লোকটা একটুও রেগে গেল না। বরং দাঁত বার করে হেসে বলল, ‘তোমাকে জেনুইন রত্ন দেব।’ পাগল হয়েছি যে আবার ওর খপ্পরে পড়ব! সে-কথা শুনেও ভ্রূক্ষেপ নেই। ওর হাত থেকে নিস্তার পাওয়া গেল অনেক পরে, ও নিজেই চলে গেল তাজের সামনে বিদেশি ট্যুরিস্টের দল দেখে।

    এই প্রসঙ্গে একটা বাচ্চা ছেলের কথা না বললে খুব অন্যায় হবে। কলম্বো সৈকতেই হঠাৎ একটা বছর বারোর মলিন হাফপ্যান্ট পরা ছেলে এসে ধরেছিল, তার কাছ থেকে মুক্তো কিনতে হবে। এই সাগরবেলায় এমন একটি নয়, অনেক ঝিনুক নাকি তারা খুঁজে পায় যার বুকে মুক্তো লুকানো। আমি একটুও পাত্তা দিইনি প্রথমে, তবু ঘ্যানঘ্যান করেই চলল। শেষমেশ যখন মাত্র ১০০ শ্রীলঙ্কা রুপিতে (ভারতীয় টাকায় অনেক কম) দশটা মুক্তো দিতে চাইল, আমি নিস্তার পাওয়ার জন্য কিনেই ফেললাম। কতদিন একটা কাগজে মোড়ানো অবস্থায় পড়ে ছিল বাড়িতে কে জানে! কোনও একদিন লকেট বানাব বলে একটা মুক্তো কলকাতার নামি গয়নার দোকানে নিয়ে যেতে তাঁরা বেশ অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘এই মুক্তো আপনি কোথায় পেলেন? খুব রেয়ার। অনেক দামি নিশ্চয়ই?’ আমি কি আর বলি, ছেঁড়া হাফপ্যান্ট পরা বালক এর বিক্রেতা? শুধু বললাম, ‘কলম্বো।’

    এই নকল মণির থেকেও বেশি চোখধাঁধানো ছিল সিন্দুকভর্তি সোনার বার। কলম্বোর বিশ্ববিখ্যাত গঙ্গারামাইয়া মন্দিরে। টেম্পল বললেও আসলে বৌদ্ধ মঠ। উত্তর-পূর্ব ভারত বা সিকিমে যেমন দেখা যায়, তেমন এখানেও রয়েছে অনাথ আশ্রম, হাতের কাজ শেখানোর স্কুল, এমনকী বৃদ্ধাশ্রমও। ভেবেছিলাম, মন্দিরে ক্যামেরা নাও ঢুকতে দিতে পারে। কিন্তু দেখলাম এরা বেশ উদার, রীতিমতো খুশি হলেন সন্ন্যাসীরা আমাদের আগমনে। শুধু তাই না, এক যুবা সন্ন্যাসীকে আমরা পেলাম গাইড হিসেবে। ঢোকার পথে মন্দিরের বড় আকর্ষণ বিরাটকায় সুসজ্জিত ঐরাবতকে এক পাউন্ড পাঁউরুটির লোফ খাওয়ালাম। জানলাম, উনিশ শতকের এই মন্দির জাভার বরবুদুরের অনুকরণে তৈরি। ভেতরে দেওয়ালে, সিলিং-এ প্রচুর খোদাই করা শিল্প। পেন্টিং সবই ভগবান বুদ্ধের জীবনের নানা কাহিনি। মূল বুদ্ধমূর্তিটিও দেখার মতো। আর রয়েছে প্রাচীন পুথির সংগ্রহ। তবে সবচেয়ে তাক লাগানো গঙ্গারামাইয়ার মিউজিয়াম। এত রঙের, এত ভঙ্গিমার বুদ্ধমূর্তি আছে আমার জানা নেই। দাঁড়ানো, বসা, শোয়া, ধ্যানরত— কত রকম! আর আছে কাচের বাক্সে শ্রীলঙ্কা। ছোট বুদ্ধমূর্তি, দেখতে হয় ম্যাগনিফাইং গ্লাস দিয়ে। আর হ্যাঁ, এই শত-শত মূর্তির অনেকগুলোই খাঁটি সোনার, কতগুলি ব্রোঞ্জের, মহার্ঘ মণিরত্নখচিত। আমরা প্রাণভরে ছবি তুললাম। আর একটা ব্যাপার দেখার মতো, সেটা হল ভগবানকে নিবেদিত পার্থিব উপহারের সন্তার। রাডো, রোলেক্স ঘড়ি থেকে বাইরে গ্যারেজে রাখা মার্সিডিজ, রোলস রয়েস, ল্যাম্বরগিনি গাড়ি— কী নেই সেখানে! সংসারত্যাগী গৌতম বুদ্ধ, বোধিবৃক্ষের নীচে ধ্যানে বসা বুদ্ধদেবের জন্য এই আয়োজন দেখে অবাক হয়ে ভাবলাম, ‘আমায় নইলে ত্রিভুবনেশ্বর, তোমার প্রেম হত যে মিছে।’

    গঙ্গারামাইয়া মন্দির, কলম্বো

    এখনও বাকি আসল চমক। অধ্যক্ষের অনুমতি নিতে গেলেন আমাদের গাইড সন্ন্যাসী। বিশেষ ঘরটিতে আমাদের নিয়ে যাবেন কি না। কী আছে সেখানে? এটুকু বলতে পারি, সব অনুমান ছাপিয়ে গেল ঢোকার পর। সার-সার সিন্দুক, খোলামাত্র ঝলমল করে উঠল। থাকে-থাকে সোনার মোটা-মোটা বার। এসব নাকি যুগ-যুগ ধরে জমানো সম্পদ। অচেনা বিদেশির ক্যামেরার লেন্সে কেন যে ধরা পড়তে দিলেন ওঁরা এই বৈভব, আজও কারণ খুঁজে পাইনি। কান-মাথা ভোঁ-ভোঁ করছিল। বাইরে বেরিয়ে খোলা হাওয়ায় নিঃশ্বাস নিয়ে বাঁচলাম মনে হল। আসলে গঙ্গারামাইয়া মন্দিরের এলাকাটা ভারি সুন্দর। বেইরা লেকের ধারে ফুলের বাগানের মাঝখানে মন্দির। জলের ওপর ঝুলন্ত সেতু পেরিয়ে চলে যাওয়া যায় আর একটা মন্দিরে— সীমা মালাকায়া। গঙ্গারামাইয়ার মতো বিশাল না, তবে শান্ত পরিবেশে উপাসনা করার জন্য আদর্শ।  

    অপার শান্তির পর বারো ঘণ্টা কাটতে-না-কাটতে যে কী অশান্ত আবহাওয়া সৃষ্টি হবে কলম্বোয়, আঁচ করতে পারিনি। রাতে এত অদ্ভুত খাওয়া জুটেছিল যে, ভোরে ভেবেছিলাম নির্ঘাত পেট গরম হয়ে উলটোপালটা স্বপ্ন দেখছি। সৈকতে রঙিন টেন্টে একটা পাকিস্তানি রেস্তরাঁয় গনগনে আঁচে শিক কাবাব ঝুলছিল। দেখে ভাবলাম, তন্দুরি রুটি দিয়ে মন্দ লাগবে না। রাত আটটা নাগাদ নোনা হাওয়ায় বসে আরও জমবে। ভাগ্যিস একটাই প্লেট কাবাব অর্ডার করেছিলাম! মুখে ছুঁইয়ে অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছিলাম, এত ঝাল। ক্যামেরাম্যান বীরত্ব দেখিয়ে হুসহাস করে খেল যতটা পারল। আমি সোজা উপায় বাছলাম। ওই রাতে আর কোনও বিকল্প ছিল না অবশ্য। এক গ্লাস স্প্রাইটে একটা বড়সড় তন্দুরি রুটি চুবিয়ে ডিনার সারলাম। দোকানি আড়চোখে দেখছিল বার বার। মনে হয়, এটা একটা নতুন আইটেম হিসেবে চালাবে পরদিন থেকে! যা বলছিলাম, এরকম আজগুবি ভোজের পর ভোরে আঁধার ঘনিয়ে এলে, শোঁ শোঁ আওয়াজ উঠলে প্রথমে তো দুঃস্বপ্ন মনে হতেই পারে। ঘরের লাগোয়া বারান্দায় গিয়ে যে-দৃশ্য দেখলাম, তাকে ভয়ংকর সুন্দর ছাড়া আর কীই-বা বলা যায়? রণমুথু হোটেলটা আহামরি না হলেও এর দারুণ একটা ব্যাপার আছে। ঘরের ব্যালকনি থেকে সমুদ্র দেখা যায়। সেদিন মনে হল যেন বে অফ বেঙ্গল অনেকটা কাছে চলে এসেছে। সাইক্লোনে সাগরতীরে কাটানোর অভিজ্ঞতা যাদের আছে, তারা বুঝবেন, একইসঙ্গে চোখজুড়ানো আর বুক ধুকপুকানো কাকে বলে! বিশাল ঢেউ এই যেন ঢুকে পড়ল হোটেলের পাঁচিল টপকে, তিনতলার বারান্দাও যেন ছুঁয়ে ফেলতে পারে যে-কোনও মুহূর্তে। সাগরতীরের নারকেল গাছগুলো হাওয়ার বেগে একবার নতজানু হয়েই ফের উঠে দাঁড়াচ্ছে, জলের ছাঁটে বেশিক্ষণ দাঁড়ানো দায়। ক্যামেরাম্যান পাশের ব্যালকনি থেকে এই অতিজাগতিক দৃশ্য লেন্সে ধরে রাখছে দেখলাম। ঘণ্টাখানেক কি তারও বেশি চলেছিল সেই তাণ্ডব।

    প্রকৃতির তাণ্ডব তো দেখলাম। মানুষের তাণ্ডব তার থেকেও কত ভয়ংকর, টের পেয়েছিলাম ক’দিন পর, বাকি জায়গাগুলো ঘুরে ফেরার পথে একদিনের কলম্বো হল্টে। সাক্ষাৎ মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। সে-কাহিনি পরের এপিসোডে।

    ছবি সৌজন্যে : লেখক

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook