জঙ্গলের মধ্যে এক ‘নেকড়ের গুহা’ বানিয়েছেন রাজাবাবু। যেমন-তেমন গুহা নয়, একেবারে ত্রিস্তরীয় নিরাপত্তা বলয়ে মোড়া, ২৫০ হেক্টর জায়গার ওপরে বানানো এক সমর-দুর্গ। রাজাবাবুর ইচ্ছে, যুদ্ধের সময়টা তিনি এখানেই থাকবেন, এখানে বসেই উদযাপন করবেন পূর্ব রণাঙ্গনের কাঙ্ক্ষিত বিজয়-মুহূর্ত। তবে হাজার হলেও মানুষ তো বটে, ভয়ভীতি কি তাঁরও নেই! কড়া হুকুম ছিল, রণাঙ্গনের কাছাকাছি তিনি থাকবেন, অথচ শত্রুপক্ষের গোলাগুলি যেন তাঁর গায়ে আঁচড়টিও না কেটে যায়। রাজার হুকুম, অতএব, লোকলস্কর মিলে বেছে নিল পূর্ব প্রুশিয়ার মাসুরিয়া অঞ্চলের এই জঙ্গলটাকে; গাছপালা পরিষ্কার করে সেখানে বানিয়ে ফেলা হল ছোটখাট একটা রাজধানী। রাজাবাবুর নিজস্ব বাংকার তৈরি হল, সঙ্গে তাঁর একগুচ্ছ পারিষদবর্গের জন্য আলাদা-আলাদা থাকার জায়গা। বানানো হল সভাকক্ষ, বিভিন্ন গ্রেডের নিরাপত্তারক্ষীদের অফিস, গণ্ডাখানেক ব্যারাক, বসানো হল রেডিয়ো আর টেলেক্স অফিস, ছাপাখানা, জেনারেটর। সন্ধেয় ছবি দেখতে-দেখতে আরাম করবেন রাজাবাবু, তাই একখানা খুদে সিনেমাহলও বানিয়ে ফেলা গেল। পুব সীমানার জাতশত্রুদের দিকে যেদিন রওনা দিল তাঁর বাহিনি, তার দু’দিন পরেই এই ‘ব্র্যান্ড নিউ’ হেডকোয়ার্টারে এসে থাকা শুরু করলেন তিনি। সোভিয়েতকে ছারখার করে ফিরছে তাঁর লোকজন, এই খবরটা শোনার জন্য আজ কত বছরের অপেক্ষা তাঁর!
নিরাপত্তার ব্যবস্থাটি জোরদার। কমপ্লেক্সের একদম কেন্দ্রে রয়েছে কর্তাদের এগারোখানা বাংকার, তা বানাতে ব্যবহার করা হয়েছে ২ মিটার চওড়া ফেরোকংক্রিট। পেরিমিটার ফেন্সিং ঘিরে পাহারা বসিয়েছে প্যারামিলিটারি বাহিনী এসএস-এর (শ্যুৎজস্তাফেল) দুটি ইউনিট, তাদের টপকে মাছি গলারও উপায় নেই। এর বাইরে আছে আরেকটি নিরাপত্তাবলয়, সেখানে মন্ত্রীদের থাকার জায়গা। এছাড়াও, কয়েক হাজার কর্মী, মিলিটারি ব্যারাক। আর, গোটা কমপ্লেক্সকে ঘিরে রয়েছে তিন নম্বর নিরাপত্তাবলয়। সাঁজোয়া বাহিনী ওয়েহ্রম্যাখটের একটা বিশেষ বাহিনী সে-পাহারার দায়িত্বে। সেখানে মজুত আছে সাঁজোয়া ট্যাঙ্ক, অ্যান্টি-এয়ারক্রাফট গান। একশো কিলোমিটারের মধ্যে যে-কোনও বিমানই ধরা পড়ে যাবে রাডারে। গোটা এলাকাজুড়ে পোঁতা হয়েছে ল্যান্ডমাইন, বসানো হয়েছে অজস্র গার্ডহাউস, ওয়াচ টাওয়ার, চেকপয়েন্ট। এমনকী, কিছু বাড়তি সেনাবাহিনী রাখা হয়েছে ৭৫ কিলোমিটার দূরেও। সামরিক নিরাপত্তা ছাড়াও ব্যবহার করা হয়েছে আধুনিক মানের ক্যামোফ্লেজ পদ্ধতি। বাড়ির চালে বিশেষ পদ্ধতিতে পোঁতা হয়েছে গাছ, বাড়ি তৈরির সিমেন্টের সঙ্গে মেশানো হয়েছে সমুদ্রঘাস ও সবুজ ডাইয়ের একটি মিশ্রণ, কিছু-কিছু জায়গায় লাগানো হয়েছে প্লাস্টিকের নেট, দেখতে অবিকল গাছের পাতার মতো। প্লেন থেকে দেখলে প্রাকৃতিক জঙ্গলের সঙ্গে তফাত করার জো নেই।
সাধারণে সেখানে যেতে পারে না। তাও দু-একজন করে লোক সর্বদাই থাকে, যাদের কৌতূহল খানিক বেশিই হয়, সেসব ঝামেলা এড়াতে রাজাবাবুর লোকজন দায়িত্ব নিয়ে ঘোষণা করে দিয়েছে, এখানে বড়সড় একটা রাসায়নিকের কারখানা গড়ে তোলা হচ্ছে, অতএব, কেউ যেন ভুলেও না আসে। কাছাকাছির মধ্যে নেই কোনও রাস্তা বা শহর। থাকার মধ্যে আছে কেবল একখানা রেলস্টেশন আর পুঁচকে একখানা এয়ারস্ট্রিপ। ওই দিয়েই রোজ সকালে গুচ্ছ-গুচ্ছ চিঠি আর তার এসে পৌঁছয় রাজাবাবুর জন্য। রাজাবাবুর অবশ্য সকাল হয় বেলা দশটার খানিক আগে, তারপর পুষ্যি জার্মান শেফার্ডটিকে নিয়ে হাঁটতে বেরোন। সারা দেশে কেবল এই চারপেয়ে জীবটিকেই বোধহয় সম্পূর্ণ বিশ্বাস করেন তিনি। আধঘণ্টা হাঁটার পর সেসব চিঠিপত্র দেখতে বসেন।
দেশের রাজা তিনি, তার উপর ওদিকে যুদ্ধ চলছে। এ-যুদ্ধে তিনিই জিতছেন, ওপরওয়ালার তেমনই ইচ্ছা, এ-বিশ্বাস তাঁর দৃঢ়। সে যতই ফ্রন্ট থেকে খারাপ খবর আসুক-না, ওসব তিনি পাত্তাই দেন না। তাঁর সাফ কথা, যুদ্ধ জিততে হবে। কোথায় কতজন মরল, এসব নিয়ে মাথা ঘামানো তাঁর বিলকুল না-পসন্দ। কোনও ফ্রন্ট থেকে সেনা সরিয়ে নেওয়ার কথা শুনলেই ব্রহ্মতালু জ্বলে ওঠে! কোথায় উলটে আরও সেনা পাঠানো যায় কি না, সেসব বলবেন জেনারেলরা, তা নয়, শুধু এসব অলক্ষুণে কথা! তাঁর কি আর কোনও কাজ নেই? চিঠিপত্র দেখা শেষ হলে দু’ঘণ্টা ধরে চলে মিলিটারি ব্রিফিং। কর্নেল জেনারেল আলফ্রেড জড্ল বা ফিল্ড মার্শাল উইলহেল্ম কেইটেলের ঘরে বসে সভা। তারপর দুটোয় ডাইনিং হলে মধ্যাহ্নভোজন। রাজাবাবুর দয়ার শরীর, মাছ-মাংস-ডিম কিছুই খান না, তবে শত্রুদের তো আর দয়ামায়া নেই, খাবারে বিষ মিশিয়ে দিতে কতক্ষণ! রাজাবাবু তাই জনা পনেরো তরুণীকে নিয়োগ করেছেন, খাবার চেখে দেখার জন্য। রোজ তাঁরা ভয়ে-ভয়ে খাবারের টেবিলে আসেন, তাঁদের সামনে ধরা হয় প্লেট, যুদ্ধের বাজারেও সেখানে সাজানো থাকে রাশি-রাশি সবজি, সস, নুডলের নানা পদ আর সুস্বাদু ফল। মুখে তোলার সময়ে রোজই মনে হয়, এই বুঝি শেষ খাওয়া।
মধ্যাহ্নভোজন শেষ হলে মন্ত্রীদের সঙ্গে চলে অ-সামরিক কথাবার্তা। বিকেল পাঁচটায় কফি আসে। কফিপানের পর আবার একপ্রস্থ মিলিটারি ব্রিফিং। তারপর, সাড়ে সাতটায় রাতের খাবার, সে-পর্ব চলে পরবর্তী দু’ঘণ্টা ধরে। খাওয়া শেষ হলে সিনেমা দেখার শখ জাগে রাজাবাবুর। সিনেমা শেষ হলে আর তিনি বাইরে থাকেন না, কয়েকজন মোসাহেবকে নিয়ে চলে যান নিজের ঘরে, শেষরাত অবধি চলে তাঁর বক্তব্য। তিনি একাই বলেন, বাকিরা সবাই শোনে। মাঝেমধ্যে রাজাবাবুর মুড ভাল থাকলে গ্রামোফোন প্লেয়ারটায় বেজে ওঠে বেঠোফেনের সিম্ফনি বা ওয়্যাগনারের কোনও কম্পোজিশন। কিন্তু, এত কিছুর পরেও রাজাবাবু খুব শান্তিতে নেই। তরুণী সেক্রেটারিটির কাছে নাকি প্রায়শই তিনি বলে ফেলছেন, ‘ওরা সব কিছু জেনে গিয়েছে। যে-কোনও দিন বম্বার দিয়ে সব গুঁড়িয়ে দিতে পারে।’
কর্তার ভয় হয়েছে, সে নিশ্চয়ই অমূলক নয়! এত বড় একখানা দেশ চালাচ্ছেন, এমন ঝামেলা বাধিয়েছেন যে ৫০-এরও বেশি দেশ এখন লড়ালড়ি করছে, কম কথা নাকি! কর্তা অবশ্য মাঝে মাঝে পাহাড়ে ছুটি কাটাতে যান, কয়েক মাস বিশুদ্ধ হাওয়া সেবন করে আসেন। ১৯৪২ থেকে ১৯৪৪-এর মধ্যে তেমন বেশ কয়েকবার ব্যাভেরিয়ান আল্পসে তাঁর প্রিয় ‘বার্গহফ’ বাড়িটিতে সময় কাটিয়ে এলেন। যুদ্ধ নিয়ে চিন্তার শেষ নেই, একটু মানসিক শান্তিরও তো দরকার! তিনি গেলে সবসময়েই সঙ্গে থাকে এক ঝাঁক পারিষদবর্গ। ১৯৪৪-এর জুলাই মাসে পাহাড় থেকে ছুটি কাটিয়ে ফিরে এলেন তাঁর মোসাহেবরা। কর্তা অবশ্য কিছু আগেই ফিরে এসেছেন। তখনই পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী, বিমানহানা আটকাতে ছোটো বাংকারগুলো সরিয়ে ফেরোকংক্রিটের নতুন কিছু বড় বাংকার তৈরি করা হল। পুরো কাজটা হল ‘টট অর্গানাইজেশন’-এর তত্ত্বাবধানে, খরচ হল মোট সাড়ে তিন কোটি রাইখস মার্ক।
আঁটোসাঁটো নিরাপত্তায় আরও বজ্রআঁটুনি পড়ল। রাজাবাবু কি নিশ্চিন্ত হলেন? সে-বিষয়ে সঠিক খবর মেলে না। তবে খবর একটা হয়েছিল ঠিকই। একেবারে খবরের মতো খবর। ওই যে-মাসে অত কোটি খরচ করে বাংকার বানানো হল, সেই মাসেই রাজাবাবুর সভাকক্ষে, সেখানে তখন তিনি নিজেও উপস্থিত, সেখানে ঘটল এক ভয়ংকর বোমা বিস্ফোরণ। রাজাবাবু প্রাণে বাঁচলেন ঠিকই, তবে তাঁর গর্বের বেলুনকে ছ্যাঁদা করে দিয়ে গেল এই ঘটনা। আর, নেপথ্যে, শত্রুপক্ষ মিত্রশক্তির কেউ নয়, বরং রাজাবাবুরই অত সাধের সেনাবাহিনীর কয়েকজন উচ্চপদস্থ আধিকারিক…
১৯৪৪ সালের মাঝামাঝি। যুদ্ধের গতিপ্রকৃতি তখন সম্পূর্ণ ঘুরে গিয়েছে। পূর্ব রণাঙ্গনে সোভিয়েত রাশিয়া একের পর এক আক্রমণ হানছে, সফলও হচ্ছে অনায়াসে। ১৯৪৩-এর শুরুতেই (২ ফেব্রুয়ারি) স্ট্যালিনগ্রাদের যুদ্ধ শেষ হয়েছে। সংখ্যার দিক দিয়ে অনেক বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে সোভিয়েতের, কিন্তু শেষ হাসি হেসেছে লালফৌজই। আর, ঠিক এক বছরের মাথায়, ১৯৪৪-এর ২৭ জানুয়ারি, প্রায় আড়াই বছরের মরণপণ লড়াইয়ের পর লেনিনগ্রাদকে জার্মান দখলমুক্ত করেছে সেনা ও সাধারণের যৌথ শক্তি। এমতাবস্থায় পশ্চিম রণাঙ্গনে একটি বড়সড় ছাপ না রাখতে পারলে বিশ্বের কাছে যে মান যায় উইনস্টন চার্চিল আর ফ্র্যাঙ্কলিন রুজভেল্টের!
৬ জুন। উত্তর ফ্রান্সের নরম্যান্ডি উপকূলে প্রায় অতর্কিতে হানা দিল বিশাল মিত্রবাহিনী। ক্ষয়ক্ষতি এবারও মিত্রশক্তির পক্ষে বেশি, কিন্তু, পশ্চিম ইউরোপে জার্মানির তুলনায় বিমান ও নৌবহরের শক্তিতে প্রায় কয়েকশো গুণ এগিয়ে ছিল মিত্রশক্তি। ফলে, নরম্যান্ডি অবতরণ করার পর ফ্রান্সের দখল নেওয়া খুব কঠিন হয়নি।
জার্মানির অভ্যন্তরেও ততদিনে অসন্তোষ বাড়ছে। তিনের দশকের শেষে জার্মানি যখন তদানীন্তন সুদেতেনল্যান্ড (পরবর্তীকালে, চেকোস্লোভাকিয়া) দখল করছে, আরও এক মহাযুদ্ধের সিঁদুরে মেঘ ঘনিয়ে আসছে, তখনই সামরিক বিভাগ জার্মানির নিয়তির কথা ভেবে ভয় পেয়েছিল। কর্নেল জেনারেল লুডউইগ বেক, জেনারেল এরিক হোয়েপনার ও কার্ল-হেইনরিখ ফন স্টুয়েল্পন্যাগেল, অ্যাডমিরাল উইলহেল্ম ক্যানারিস এবং লেফটেন্যান্ট কর্নেল হ্যান্স অস্টার মিলে অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা করেছিলেন, কিন্তু সাংগঠনিক ব্যর্থতায় তখন তা বাস্তবায়িত হয়নি। যুদ্ধ চলাকালে পরিস্থিতি আরও ঘোরালো হল। নাৎসি-বিরোধী কমিউনিস্ট বা সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটরা তো বটেই, হিটলারি নির্যাতনের বিরুদ্ধে ধীরে-ধীরে গলা চড়াচ্ছেন এক সময়ে ন্যাশনাল সোশ্যালিস্ট পার্টিতেই যোগ দেওয়া হাজার-হাজার মানুষ। ১৯৪২ থেকে ’৪৩ সাল অবধি সক্রিয় অহিংস আন্দোলন চালিয়েছিল কয়েকজন কলেজপড়ুয়া ও অধ্যাপকদের সংগঠন ‘হোয়াইট রোজ’, গোটা জার্মানি জুড়ে তাঁরা ছড়িয়ে দিতেন নাৎসি-বিরোধী লিফলেট। পরে সকলেই ধরা পড়েন, কারও শিরশ্ছেদ হয়, কারও-বা ফাঁসি, কিন্তু লিফলেটের খবর চাপা থাকেনি।
এই অবস্থায় নতুন এক পরিকল্পনা নেওয়া শুরু করলেন কয়েকজন সেনাপ্রধান। অভিজ্ঞ তাঁরা ততদিনে বুঝে গিয়েছেন, যুদ্ধে জার্মানির পতন অনিবার্য এবং ঝাল মেটাতে দেশটাকে ধ্বংস করে দিয়ে যাবে মিত্রপক্ষ। এমন দুর্যোগ ঠেকাতে এবং সমস্ত সমস্যার সমাধান একটাই— ওই টুথব্রাশ গোঁফধারী শয়তানটিকে খতম করা। ১৯৪২ সাল থেকেই বিরোধীদের সংগঠিত করা শুরু করলেন জেনারেল হেনিং ফন ট্রেসকাউ ও হ্যান্স অস্টার। ১৯৪৩ সালের ১১ মার্চ হিটলার গিয়েছিলেন পূর্ব রণাঙ্গনের স্মলেন্সকে ফিল্ড মার্শাল গুয়েন্টার ফন ক্লুজের সদর কার্যালয় পরিদর্শনে; তাঁর প্লেনে একটি টাইমবোমা লুকিয়ে রেখেছিলেন হেনিং এবং অফিসার ফ্যাবিয়ান ফন শ্ল্যাবেনডর্ফ। কোনও কারণে বোমাটি ফাটেনি, পরে ফ্যাবিয়ান বোমাটি অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করে নিয়ে আসেন। এরপর আরও কয়েকবার হত্যার চেষ্টা হল। ওই প্লেনে বোমা রাখারই আটদিন পর হিটলার বার্লিনে সোভিয়েত সেনাদের কাছ থেকে পাওয়া অস্ত্রশস্ত্র পরিদর্শনে এলে জেনারেল মেজর রুডলফ গার্সডর্ফ মানববোমা ব্যবহার করে হত্যার চেষ্টা করলেন, নভেম্বর মাসে ও ১৯৪৪-এর ফেব্রুয়ারি মাসে ওই নেকড়ের গুহাতেই সামরিক পোশাক-মহড়াকে কাজে লাগিয়ে মানববোমা ব্যবহারের পরিকল্পনা করেছিলেন যথাক্রমে দুই তরুণ, মেজর অ্যাক্সেল ফন ডেম বুশ এবং ওয়েহ্রম্যাখট অফিসার এওয়াল্ড ফন ক্লেইস্ট। কিন্তু, কোনওটাই সফল হল না। একের পর এক দুঃসংবাদ আসে রণাঙ্গন থেকে, সর্বদা উৎকণ্ঠিত হিটলার তাই মিনিটে-মিনিটে মত বদল করেন; তবে, এতসব বিক্ষিপ্ত ব্যর্থতা যখন ঘটছে, তলে-তলে কিন্তু চলছে আরও সুসংগঠিত এক পরিকল্পনা।
১৯৪৩ সালেই লুডউইগ বেকের নেতৃত্বাধীন প্রতিরোধগোষ্ঠীতে এসে যোগ দিয়েছেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল ক্লাউস ফন স্তফেনবার্গ। পুরো নাম অবশ্য গালভরা, ক্লাউস ফিলিপ মারিয়া জাস্টিনিয়ান শেঙ্ক গ্রাফ ফন স্তফেনবার্গ। জার্মানির সোয়াবিয়া অঞ্চলের শতাব্দীপ্রাচীন অভিজাত শেঙ্ক ফন স্তফেনবার্গ পরিবারের ছেলে তিনি, পিতৃভূমির প্রতি আকণ্ঠ প্রেম, উত্তর আফ্রিকার যুদ্ধে গুরুতর আহত হয়ে দেশে ফিরতে হয়। সেরে ওঠেন যখন, তখন বাঁ-চোখ সম্পূর্ণ নষ্ট হয়েছে, ডান হাতের পাতা বাদ দিতে হয়েছে, বাদ পড়েছে বাঁ-হাতের অনামিকা ও কনিষ্ঠা আঙুলদুটিও। ইতিমধ্যে পূর্ব রণাঙ্গনে জার্মান সেনাদের হাতে ইহুদি, রুশ যুদ্ধবন্দি ও সাধারণ নাগরিকদের নির্বিচার হত্যা দেখে বীতশ্রদ্ধা জন্মেছিল, তাঁর মনে হয়েছিল, এ-ঘটনা দেশের গৌরবে কালি লাগিয়েছে। অতএব, হাসপাতাল থেকে স্বাভাবিক জীবনে ফেরার পর মানসিক শক্তির জোরেই তিনি আবারও কাজে ফিরলেন, চিঠি লিখলেন জেনারেল ফ্রেডরিখ অলব্রিক্টকে, যিনি ছিলেন মধ্য বার্লিন-স্থিত সামরিক সদর দফতর ‘বেন্ডলারব্লক’-এর প্রধান। ফ্রেডরিখ ততদিনে হাত মিলিয়েছেন হেনিং ট্রেসকাউ এবং হ্যান্স অস্টারের সঙ্গে। ছিলেন আরও অনেকে— ফিল্ড মার্শাল আরউইন ফন ভিৎজলেবেন, হিটলারের ব্যক্তিগত স্টাফের প্রধান সিগন্যাল জেনারেল এরিখ ফেলজিয়েবেল, আর্টিলারি জেনারেল এডুয়ার্ড ওয়্যাগনার, জেনারেল এরিখ হোয়েপনার, কার্ল-হেইনরিখ ফন স্টুয়েল্পন্যাগেল, বার্লিনের পুলিশ সভাপতি উলফ-হেইনরিখ ফন হেলডর্ফ, বার্লিনের গ্যারিসন অধ্যক্ষ লেফটেন্যান্ট জেনারেল পল ফন হ্যাসে।
চক্রান্তকারীদের তরফে বানানো হল ‘অপারেশন ভ্যালকাইরি’-র খসড়া। ফ্যুয়েরারকে নিকেশ করে এবং অনুগত মন্ত্রী-সান্ত্রীদের গ্রেপ্তার করে নিজেদের সরকার গঠনই একমাত্র উদ্দেশ্য, কিন্তু অনুমোদনের জন্য দিব্যি বলা হল, জার্মানিতে যদি কোনও বিদ্রোহ-টিদ্রোহ ঘটে বা দুম করে শত্রুপক্ষের বিমান এসে পড়ে, তেমন জরুরি অবস্থায় ‘অপারেশন ভ্যালকাইরি’ অনুসারে যে-দেশগুলো জার্মানির দখলে আছে, সেসব দেশে প্রশাসনিক দপ্তরগুলো যত দ্রুত সম্ভব দখল করে নেওয়া হবে। অনুমোদন এসেও গেল। পরিবর্তিত খসড়াতে স্বাক্ষর করলেন রিজার্ভ আর্মির বর্ষীয়ান কম্যান্ডার, জেনারেল ফ্রেডরিখ ফ্রম, ক্ষমতার শ্রেণিবৈষম্যে হিটলার ছাড়া এ-অপারেশনের অনুমতি দিতে পারেন একমাত্র তিনিই। চক্রান্তকারীরা তাঁকেও দলে ভেড়াতে চেয়েছিলেন, কিন্তু এ-লোকটি গভীর জলের মাছ। নথিতে সই দিয়েছেন বটে, কিন্তু শেষ অবধি তাঁর মতি কোনদিকে ঘুরবে, সে-বিষয়ে আশঙ্কা থেকেই গেল।
সময়ের চাকা ঘুরছিল। নাৎসি সেনাকর্মী ছাড়া আরও অন্যান্য মতাবলম্বীরা এসে যোগ দিলেন এই চক্রে। এলেন লিবারাল ডেমোক্র্যাটরা, এলেন কনজারভেটিভরা, যাঁদের অন্যতম ছিলেন লাইপজিগের মেয়র এবং হলোকস্টের প্রবল বিরোধী কার্ল ফ্রেডরিখ গোয়েরদেলার, চক্রান্ত সফল হলে যাঁকে চ্যান্সেলর নিযুক্ত করার পরিকল্পনা হয়েছে; এছাড়াও, যোগ দিলেন, নাৎসিবাদীদের চরম শত্রু কয়েকজন সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট ও কমিউনিস্ট কর্মীও। ক্লাউস স্তফেনবার্গ র্যাডিক্যালপন্থী ছিলেন, চক্রান্তে যোগ দেওয়া সোশ্যালিস্ট জুলিয়াস লেবের, অ্যাডলফ রাইখভিন, উইলহেল্ম লিউখনার এবং কমিউনিস্ট পার্টির আন্ডারগ্রাউন্ড নেতাদের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ গড়ে উঠল।
৬ জুন নরম্যান্ডি অবতরণের পর পরিস্থিতি গেল আরও পালটে। হিটলারকে শেষ করলেও মিত্রশক্তির সঙ্গে আপসরফা আদৌ করা যাবে কি না, সে-বিষয়ে সন্দিহান হয়ে উঠলেন চক্রান্তকারীরা।
দ্বিধা কেটে গেল ক্লাউস স্তফেনবার্গকে পাঠানো জেনারেল হেনিং ট্রেসকাউয়ের একটা টেলিগ্রামে, পরিষ্কার লেখা আছে নির্দেশ— ‘হিটলারকে হত্যার পরিকল্পনা থেকে কোনওভাবেই পিছিয়ে এলে হবে না। হত্যা-প্রচেষ্টা যদি ব্যর্থও হয়, তাও বার্লিনে ক্ষমতা দখলের অভিযান চালাতে হবে।’ সঙ্গে, আবেগতাড়িত সংযোজন— ‘পৃথিবীর কাছে এবং আগামীর উত্তরসূরিদের কাছে আমাদের প্রমাণ করতেই হবে, আমরা সকলেই তার মতো ছিলাম না, জীবন বিপন্ন করেও একটা চূড়ান্ত চেষ্টা আমরা করেছিলাম।’
এই প্রসঙ্গে এ-কথা মনে করিয়ে দেওয়া ভাল, যে-কয়েকজন এই ‘২০ জুলাই চক্র’র মূল পাণ্ডা ছিলেন, তাঁদের মধ্যে এরিখ হোয়েপনার, কার্ল স্টুয়েল্পন্যাগেল থেকে শুরু করে এমন আবেগ-গদগদ তারবার্তা পাঠানো হেনিং ট্রেসকাউ, এডুয়ার্ড ওয়্যাগনার, এমন অনেকেই ইহুদি-নিধন বা অন্যান্য নানা গণহত্যায় সরাসরি অংশ নিয়েছিলেন। ষড়যন্ত্রের অঘোষিত নায়ক ক্লাউস স্তফেনবার্গের ক্যাথলিক বিশ্বাস তাঁকে এই নিধনযজ্ঞকে ঘৃণা করতে শেখায়, নানা ঐতিহাসিক সূত্র থেকে তাঁকে র্যাডিক্যালপন্থী মনে হওয়াও অস্বাভাবিক নয়, কিন্তু রাজনৈতিক শাসনের প্রশ্নে তিনি সংসদীয় গণতন্ত্রের চেয়ে স্বৈরাচারী শাসনকেই শ্রেয় বলে মনে করলেন।
জুলাই মাসের প্রথমদিনেই এল সুসংবাদ। ক্লাউস স্তফেনবার্গের পদোন্নতি ঘটেছে। ফ্রেডরিখ ফ্রম তাঁকে চিফ অফ স্টাফ হিসেবে নিয়োগ করেছেন। স্টাফ কনফারেন্সে যোগ দেওয়া এই পদের অন্যতম দায়িত্ব। অতএব, হিটলার এবার তাঁর নাগালের মধ্যে। এবার অপেক্ষা কেবল সুযোগের। শুধু হিটলার নয়, হিমলার, গোয়েরিং-সহ শীর্ষ স্থানীয় সব ক’টি শয়তানকে একসঙ্গে উড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা ছকে ফেললেন ‘প্রতিবন্ধী’ ক্লাউস।
কিন্তু, আবারও বাধা। কীভাবে যেন ষড়যন্ত্রের আঁচ টের পাচ্ছে গেস্টাপো। ৫ জুলাই। কমিউনিস্ট পার্টি অফ জার্মানির পূর্বতন সম্পাদক আন্তন সায়েফকাওয়ের গুপ্ত বিপ্লবী দলের এক ইনফর্মারের বিশ্বাসঘাতকতার সৌজন্যে গেস্টাপোর হাতে ধরা পড়ে গেলেন ক্লাউস-ঘনিষ্ঠ দুই সোশ্যালিস্ট, জুলিয়াস লেবের ও অ্যাডলফ রাইখভিন। পরে আন্তন সায়েফকাও নিজেও ধরা পড়বেন। ১৭ জুলাই গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হল কার্ল গোয়েরদেলারের উপর। ১১ জুলাই ও ১৫ জুলাই, চারদিনের ব্যবধানে দু’দুবার টাইমবোমা বিস্ফোরণের পরিকল্পনা করেও শেষ অবধি তাকে বাস্তবায়িত করতে পারলেন না ক্লাউস।
ওদিকে, যুদ্ধের ময়দানেও রশি এখন সম্পূর্ণভাবে মিত্রশক্তির হাতে। ছ’সপ্তাহ যুদ্ধের শেষে ১৯ জুলাই পূর্ব ফ্রান্সের শেন দখল করল ব্রিটিশ ও কানাডার যৌথ বাহিনী, পূর্ব রণাঙ্গনে পূর্ব পোল্যান্ড ও সোভিয়েতের মধ্যেকার প্রস্তাবিত কার্জন লাইন পার করে এগিয়ে এল লালফৌজ, জার্মানদের হাত থেকে পোলিশ রাজধানী ওয়ারশ দখল কেবল সময়ের অপেক্ষা, ইতালির লেগহর্ন ও অ্যাঙ্কোনাও মিত্রশক্তির হাতে, কিছুদিনের মধ্যেই তাদের দখলে আসবে ফ্লোরেন্স। ওদিকে, সেদিনই জাপানে তোজোর মন্ত্রীসভা পদত্যাগ করল। ২০ জুলাই আরও কয়েকটা খবর। খোদ পূর্ব প্রুশিয়ার সীমান্ত থেকে রুশবাহিনী আর মাত্র আট মাইল দূরে। জার্মানির তৈলশিল্প, বিমানশিল্প ধ্বংস করতে সাড়ে আট হাজার যুদ্ধবিমান নামাচ্ছে ব্রিটেন।
সেদিন হিটলারের অরণ্য-দপ্তরে আসার কথা বেনিতো মুসোলিনির। তাই স্টাফ কনফারেন্সের সময় এগিয়ে এল সাড়ে বারোটায়। প্রচণ্ড গরম থাকায় কংক্রিটের বাংকারে না হয়ে সভা বসল একটা কাঠের ঘরে। ছোট ঘর, গরমের জন্য সব ক’টা জানলাই খোলা। ঘরের মাঝখানে ওক কাঠের বড় টেবিল। টেবিলের চারধারে মোট চব্বিশজন হোমরা-চোমরা ব্যক্তি। যদিও, হিমলার বা গোয়েরিং, সেদিনও নেই। কিন্তু, ক্লাউসের আর অপেক্ষা করা চলে না। হাতের ব্রিফকেসটি সুবিধামতো জায়গায় রেখে একটি ফোন আসার ছুতো করে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন, বেরোবার আগে পাশে দাঁড়ানো কর্নেল ব্রান্টকে জানিয়ে গেলেন, বেরিয়ে যাওয়ার কারণ।
১২টা বেজে ৪২ মিনিট। টেবিলের ওপরে মানচিত্র ফেলে পূর্ব রণাঙ্গনের পরিস্থিতি বোঝাচ্ছেন জেনারেল অ্যাডলফ হিউসিঙ্গার— ‘If our army group around Lake Peipus is not immediately drawn, a catastrophe…’ বিপর্যয়ের মাত্রাটা আর বলার সুযোগ পেলেন না তিনি, প্রচণ্ড শব্দে ব্রিফকেসে রাখা বোমাটা ফেটে পড়ল। ক্লাউস ওই মুহূর্তে ৮৮ নম্বর বাংকারের কাছে ছিলেন। ঘরের অবস্থা দেখে নিশ্চিন্ত মনে সেখান থেকে পালিয়ে যান। এমনকী, যে-ত্রিস্তরীয় নিরাপত্তাবলয়ে মোড়া থাকত হিটলারের সাধের ‘উল্ফ’স লেয়ার’ সেখানকার নিরাপত্তারক্ষীরাও তখন বোমা বিস্ফোরণের হট্টগোলে দিগ্ভ্রান্ত।
ঘটনায় মারা গিয়েছিলেন সরকারি স্টেনোগ্রাফার বার্জার, জেনারেল অফ দ্য ইনফ্যান্ট্রি রুডলফ স্মান্ট, জার্মান বিমানবাহিনি লুফৎওয়াফার চিফ অফ জেনারেল স্টাফ গুয়েন্টার কোর্টেন, এবং ক্লাউস যাঁকে ফোন এসেছে বলে বেরিয়ে যান, সেই জেনারেল হেইনজ ব্রান্ট। ম্যাপটি ভাল করে দেখতে পাচ্ছিলেন না, রেখে যাওয়া ব্রিফকেসটি তাই পা দিয়ে কিছুটা দূরে সরিয়ে দিয়েছিলেন শেষোক্ত ব্যক্তিটি, ফলে তিনি মরলেও বাঁচলেন হিটলার। মরণোত্তর মেজর জেনারেল সম্মান দেওয়া হল তাঁকে।
ওদিকে হেইনকেল হি ১১১ বিমানে চেপে বার্লিনে বিকেল ৪টের সময়ে যখন নেমে আসছেন ক্লাউস স্তফেনবার্গ, সাফল্যের আনন্দে, বেন্ডলারব্লককে এরিখ ফেলজিয়েবেল জানালেন, হিটলার জীবিত। এদিকে, তার কিছুক্ষণের মধ্যেই ক্লাউস ফোন করে জানালেন সম্পূর্ণ উলটো খবর। এমন ধোঁয়াশার মধ্যেই অলব্রিক্ট নির্দেশ দিয়ে দিলেন, অপারেশন ভ্যালকাইরি চালু করে দেওয়ার। রিজার্ভ আর্মির প্রধান ফ্রেডরিখ ফ্রম ওদিকে উল্ফ’স লেয়ারে উইলহেল্ম কেইটেলকে ফোন করে জানতে পারলেন, ফ্যুয়েরার অক্ষত, এবং, সন্দেহ পুরোপুরি ক্লাউস স্তফেনবার্গের দিকেই। পিঠ বাঁচাতে ভ্যালকাইরির দলিলে স্বাক্ষর করা ফ্রম এবার দলবদল করলেন।
অভ্যুত্থান যে পুরোপুরি ব্যর্থ, তা নিশ্চিত।
২০ জুলাই বিকেলের দিকেই মুসোলিনিকে অভ্যর্থনা জানাতে হিটলার রেলস্টেশনে যান। মুসোলিনি ঘরের অবস্থা দেখে বলেছিলেন, ‘আপনি যে বাঁচলেন, এটা আসলে স্বর্গ থেকে পরম পিতার নির্দেশেরই লক্ষণ।’ সেদিন রাতেই হিটলার বেতারে যে-ভাষণ দেন, তার শেষ লাইনটি ছিল, ‘They see in this, however, again the pointing finger of Providence that I must, and will, carry on with my work.’
এমন ‘ঈশ্বর-প্রেরিত দূত’-মার্কা আফিম গেলানোর পরের কয়েক মাস ধরে চলবে ধরপাকড়, বিচার-প্রহসন ও মৃত্যুদণ্ডের অপ্রতিরোধ্য ধারাবাহিকতা। ফ্রমের নির্দেশে ২১ জুলাই মাঝরাতেই বেন্ডলারব্লকে ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে দাঁড় করানো হয় ক্লাউস স্তফেনবার্গ, তাঁর সহকারী ফার্স্ট লেফটেন্যান্ট ওয়ার্নার ফন হেফটেন, জেনারেল অলব্রিক্ট এবং কর্নেল আলব্রেক্ট মেরৎজ ফন কুইর্নহেইমকে। ফ্রম নিজেও অবশ্য বাঁচেননি, পরদিনই গ্রেপ্তার হন; যুদ্ধে চূড়ান্ত পরাজয়ের মাস দেড়েক আগে তিনিও হয়ে যান ফায়ারিং স্কোয়াডের লক্ষ্য। কাউকে ফাঁসিতে লটকানো হয়, কেউ-বা আত্মহত্যা করেন। কুখ্যাত বিচারপতি রোল্যান্ড ফ্রেইসলারের গণ-আদালত, যেখানে বিচারের নামে বর্বর ধ্যাষ্টামো হত, যেখানে হোয়াইট রোজের প্রধান তিন সংগঠক, হ্যান্স, সোফি শল এবং ক্রিস্টফ প্রবস্টকে শিরশ্ছেদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। সেই আদালতেই বসে অভিযুক্তদের ‘বিচার’। মোট ৭০০০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়, যাঁদের মধ্যে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয় ৪৯৮০ জনের।
সময়ের ফেরে, ওই রোল্যান্ড নিহতও হন ষড়যন্ত্রে অভিযুক্ত ফ্যাবিয়ান ফন শ্ল্যাব্রেনডর্ফের মামলা চলাকালে, মিত্রবাহিনীর বিমান হামলায়, ৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৫। ফ্যাবিয়ানকে পরে আর দোষী প্রমাণিত করা যায়নি।
২০ জুলাই ষড়যন্ত্রকারীরা পরে ফেডেরাল ডেমোক্র্যাসির যুগে নায়কের সম্মান পেয়েছেন। হলিউডি অভিনেতা টম ক্রুজকে ক্লাউস স্তফেনবার্গ বানিয়ে তৈরি হয়েছে ছবি, Valkyrie, তাঁর বাস্তবসম্মত অভিনয় সে মহিমা-কীর্তনে ইন্ধন জুগিয়েছে, প্রতিবাদী নাৎসিদের খানিক আড়ালেই চলে গিয়েছেন জড়িত সোশ্যালিস্ট বা কমিউনিস্টরা, কিংবা অন্যান্য প্রতিরোধী আন্দোলনের কর্মীরা।
এদিকে ঘটনার আশি বছর পূর্তির মাত্র এক সপ্তাহ আগে, দুনিয়া জুড়ে নব্য দক্ষিণপন্থার উত্থান ও প্রতিরোধের মাঝেই, গুলি চলছে প্রাক্তন মার্কিন প্রেসিডেন্টের দিকে, পুলিশের গুলিতে মৃত আততায়ীর সম্পর্কে জানা যাচ্ছে, সে প্রেসিডেন্টের দলেরই সমর্থক। উদারবাদী বিশ্বের সর্বত্র ঝড় উঠছে নিন্দার, এমনকী সমালোচনা করছে বামপন্থী সংবাদমাধ্যম ‘জ্যাকোবিন’ও।
দুনিয়াজুড়ে বদলেছে রাজনীতির বয়ান, একুশ শতকীয় পৃথিবীতে বদলে যাচ্ছে প্রতিরোধের ধরনও। মহাশক্তিধর রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামের চেয়ে শান্তিপূর্ণ গণ-আন্দোলনেই পথ খুঁজছে বিশ্বব্যাপী প্রগতিবাদীরা। তবু, ফ্যাসিস্ট শাসকের নিজস্ব বুদবুদেই যখন গড়ে ওঠে প্রতিরোধ— সে-প্রতিরোধ শান্তিপূর্ণ হোক কি সশস্ত্র— তিক্ততা ভুলে একজোট হয় অনেকগুলো হাত, যে-হাতগুলোরও কয়েকটাতে হয়তো লেগে রয়েছে শাসকের প্রতি প্রশ্নহীন আনুগত্যের অতীত-রক্তচিহ্ন। তখনই একাকার হয়ে যায় ভূত-ভবিষ্যৎ, লেখা হয়ে যায় নতুন কোনও অধ্যায়।
ছবি সৌজন্যে : লেখক