মাঠে তখন অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি বললেও কম বলা হবে— অনবরত শিস, কটূক্তির সঙ্গে দর্শকাসন থেকে উড়ে আসছে নানান ধরনের সব জিনিস— জলের বোতল, পয়সা, মদের গ্লাস বাদ যাচ্ছে না কিছুই; লক্ষ্য একজনই। খানিকক্ষণ পরেই তিনি কর্নার নিতে যাওয়ার সময়ে ঘটল সেই ঘটনা। প্রথমে কেউ লক্ষ না করলেও পরে টিভি ক্যামেরায় ধরা পড়ল তাঁর দিকে উড়ে এসেছে এমনকী একটা মৃত শুয়োরের মাথাও! খবরের শিরোনামে আসার পরে স্তম্ভিত ফুটবলবিশ্ব! যাঁরা জানতেন না, তাঁরাও জানলেন, এল ক্লাসিকো ঠিক কী মাপের ডার্বি!
সময়টা ২০০০ সাল, কেরিয়ারের মধ্যগগনে থাকার সময়ে বার্সেলোনার তারকা-ফুটবলার লুই ফিগো হঠাৎ বার্সেলোনা ফুটবল ক্লাবের চিরশত্রু রিয়াল মাদ্রিদ ক্লাবে যোগ দিলেন। উপরের ঘটনাটা ২০০২ সালের, যখন মাদ্রিদের জার্সি পরে পুরনো ক্লাব বার্সেলোনার বিরুদ্ধে ক্যাম্প ন্যু-তে খেলতে এলেন লুই ফিগো। নতুন শতাব্দীর শুরুতে তখনও সোশ্যাল মিডিয়ার এত রমরমা ছিল না; ফলে স্টেডিয়ামে সমর্থকদের রাগের মাত্রাছাড়া বহিঃপ্রকাশ সোশ্যাল মিডিয়ার খাপ পঞ্চায়েতের বিচারের বাইরে। সব সমর্থক অবশ্য অত ডাকাবুকো হন না। যাঁরা হন, তাঁদের নিয়েই স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে গড়ে ওঠে কট্টরপন্থী সমর্থকদের দল। ম্যাচ চলাকালীন যাঁদের গানবাজনা, পাইরোটেকনিক, টিফো, শ্লোগান-লেখা পতাকায় জমজমাট থাকে চারপাশ। ফিফা, উয়েফা, বিভিন্ন দেশের লিগ নিয়ন্ত্রকদের কাছে এই ফুটবল-সমর্থকরা লাতিন আমেরিকায় বারা ব্রাভা বা তোর্সিদা অর্গানিজাদা, ইংল্যান্ডে ফার্ম, আর ইউরোপে আলট্রা নামে পরিচিত, যাঁরা মাঠে এক ধরনের বিশেষ ধ্বনির জন্মদাতা। এই আলট্রা শব্দবন্ধেই তাঁদের বিশ্বজোড়া খ্যাতি। সমর্থকরা ছাড়া ফুটবল অসম্পূর্ণ; আর আলট্রারা ফুটবলের সাব-কালচার, তাঁদের বাদ দিলে ইতিহাসের সময় ধরে ফুটবলের ওপর রাজনৈতিক বা সামাজিক বিবর্তনের প্রভাব এবং তার বিশ্লেষণ অসম্পূর্ণ থেকে যায়।
ফুটবল আর রাজনীতি যুগে-যুগে একে অপরের হাত ধরে হেঁটেছে। এই সংযোগকে আরও দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠা করতে হলে আমাদের একটু ইতিহাস ঘাঁটতে হবে, যেখানে তখনকার রাজনীতি ফুটবলকে প্রভাবিত করতে শুরু করেছিল। একটু পিছন ফিরে স্পেনের ইতিহাসের দিকে তাকালেই দেখতে পাব, স্পেনে গৃহযুদ্ধের শেষে জেনারেল ফ্রাঙ্কো ক্ষমতায় আসার পরে নিদান জারি করলেন যে, গোটা দেশজুড়ে একটাই ভাষা চালু হবে, সেটা রাজধানী মাদ্রিদের কাস্টেলানো স্প্যানিশ; অন্যান্য প্রদেশ যেমন কাতালুনিয়া বা বাস্ক, এই সব জায়গায় যে-ধরনে বা ডায়ালেক্টে স্প্যানিশ বলা হত সেগুলোর উপর জারি হল নিষেধাজ্ঞা। যুক্তি সেই একই— এক দেশ, এক ভাষা, আর সেই ভাষার চলনবলন ঠিক করবেন রাজধানীর মসনদে বসা একনায়ক। চেনা-চেনা লাগছে কি পরিস্থিতিটা? ইতিহাস হয়তো এ ভাবেই ফিরে-ফিরে আসে, সে প্রথম বিশ্ব হোক কি তৃতীয় বিশ্ব! সেই সময়ে সকলের সন্দেহ ছিল যে, রাজধানী মাদ্রিদের ক্লাব হওয়ার সুবাদে রাজপরিবার ও একনায়ক ফ্রাঙ্কোর স্নেহধন্য যেহেতু রিয়াল মাদ্রিদ, তাই রেফারির বহু সিদ্ধান্ত তাদের পক্ষে যায়। কাতালুনিয়ায় প্রতিবাদের ঝড় উঠল, রাজনৈতিক সেই প্রেক্ষাপটে প্রতিবাদের অন্যতম হাতিয়ার হয়ে উঠল ফুটবল। গণতন্ত্রের টুঁটি চেপে ধরার সেই ব্যাকড্রপে কাতালুনিয়ার ক্লাব বার্সেলোনা আর মাদ্রিদের রেষারেষি তুঙ্গে পৌঁছল মাঠে, মাঠের বাইরে সমর্থকদের মধ্যেও। এক সময়ের নয়নের মণি ফিগোর দিকে দলবদলু হওয়ার অভিযোগে মিসাইল হয়ে উড়ে আসা কাটা শুয়োরের মাথা তাই ফুটবল ফ্যানাটিকের কাছে স্বাভাবিক ঘটনা মনে হয়।
যত বড় ক্লাব, স্বাভাবিকভাবেই তাদের সদস্য-সমর্থকদের সংখ্যাও তত বেশি। একই অনুপাতে বেশি তাদের আলট্রাদের সংখ্যাও। বিভিন্ন দেশে ঘরোয়া ফুটবল লিগের প্রচলন শুরু হওয়ার পরে ঘরের মাঠ ছেড়ে অন্য এলাকার মাঠে অর্থাৎ হোম-অ্যাওয়ে ম্যাচের প্রচলন শুরু হল। দেখা যেত, যাদের ঘরের মাঠে খেলা অর্থাৎ হোম ম্যাচ, মাঠ তাদের সমর্থকেই ভর্তি; তাদের সম্মিলিত চিৎকারে বিপক্ষ দলের খেলোয়াড়, কোচ, এমনকী রেফারিরাও চাপ অনুভব করছেন। এমন পরিস্থিতিতে ‘ফেয়ার-প্লে’র ভাবনাচিন্তা অর্থহীন। ম্যাচে রেফারির অনেক সিদ্ধান্ত ভুল হত, কোনও ক্ষেত্রে বলা ভাল চক্ষুলজ্জার বালাই না রেখে যাদের ঘরের মাঠে খেলা হচ্ছে তাদের পক্ষেই যেত। অনেক ক্ষেত্রেই ম্যাচের পরে বিপক্ষ দলের খেলোয়াড়রা ঘরের মাঠের সমর্থকদের হাতে নিগৃহীতও হতেন। অতঃপর চাকা ঘোরানোর প্রয়োজন থেকেই বিপক্ষ দলের সঙ্গে আস্তে-আস্তে তাদের সমর্থকরাও বেপাড়ায় যেতে শুরু করল। ঘরের দলের গর্জনের একটা বিরোধী হুংকার জন্ম নিল, গ্যালারিতে সমর্থন-পাল্টা সমর্থনের সেই সূত্রপাত।
বিশ্বের জনপ্রিয়তম খেলার আবেদন আন্তর্জাতিক হলেও আদত চরিত্র কিন্তু প্রাদেশিক— বিভিন্ন ফুটবল ক্লাবগুলোর নিজস্ব এলাকা, শহরের বৈশিষ্ট্য, সাহিত্য-সংস্কৃতির ছাপ থাকে তাদের জার্সি থেকে শুরু করে সমর্থকদের বাঁধা গানে। ফুটবলের প্রাণভোমরা বছরভর ধরে চলা ক্লাব-ফুটবল; আর ক্লাব-ফুটবলের অন্তর্নিহিত প্রাদেশিক-মানসিকতাই খেলাটার বিশ্বজোড়া জনপ্রিয়তার রহস্যের মূলে। চার বছরের বিরতি শেষে Euro Cup 2024 শুরু হল জার্মানিতে। ফুটবলের আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে বিভিন্ন ক্লাবের আলট্রারাই তাদের দেশের হয়ে মাঠ মাতাবেন। প্রতিবারের মতোই নিরাপত্তার বজ্রআঁটুনি এড়িয়ে কিছু অপ্রীতিকর ঘটনা যে ঘটবেই, সেটার আশঙ্কাও থেকে যায়। ভোটরঙ্গ ভুলে বাকি বিশ্বের মতো এ-বঙ্গও মেতে উঠবে ফুটবলে। কেউ স্পেন, কেউ-বা জার্মানি, আবার কেউ ফ্রান্স-এর সমর্থনে গলা ফাটাবেন। ক্রিকেটসর্বস্ব দেশে ফুটবলের বাড়তে থাকা জনপ্রিয়তা দেখে আন্দাজ করাই যায় যে, ইউরো ফাইনাল ম্যাচের দিন এখানেও টেলিভিশন বা অনলাইন স্ট্রিমিং-এ দর্শকসংখ্যা নতুন রেকর্ড ছোঁবে ।
সমর্থকদের মধ্যে আলট্রা আন্দোলন প্রথম দানা বাঁধে ইতালিতে— পাঁচের দশকের শেষে, ছয় এবং সাতের দশকে তা আরও ভয়াবহ হয়ে ওঠে। ১৯৫৯ সালে ঘরোয়া লিগে নাপোলি বনাম বোলোনা ম্যাচে মাঠে অশান্তির জেরে বহু দর্শক আহত হন, সেই মর্মান্তিক ঘটনার নেপথ্যে তখনও পূর্ণ অবয়ব না পাওয়া আলট্রাদের অবদান ছিল। যত দিন গেল, সমর্থকদের নিজেদের উৎসাহে গড়ে তোলা আলট্রা সংগঠনগুলো ধীরে-ধীরে তাদের নিজেদের ক্লাবের পরোক্ষ অনুমোদন পেতে থাকল। যত দিন যায়, তাদের প্রভাব গ্যালারির গণ্ডি পেরিয়ে বাইরে গড়ায়; ক্লাবের বাকি সমর্থক, ক্লাব-কর্তৃপক্ষ, খেলার দিনে আইনশৃঙ্খলার দায়িত্বে থাকা পুলিশের মধ্যেও যোগসূত্র হয়ে ওঠে এই আলট্রারাই।
লাতিন আমেরিকার ছবিটাও ইতালির মতোই, আলো-আঁধারিতে ঢাকা; আলট্রা গ্রুপগুলো সেখানে যেন এক-একটা অপরাধের সিন্ডিকেট। বারা ব্রাভাদের রাজত্ব শুধু গ্যালারিতে সীমাবদ্ধ নয়; স্টেডিয়ামের বাইরে পার্কিং থেকে শুরু করে খেলার দিন খাবারের স্টল ঠিক করে দেয় তারা। মরশুমে বিক্রি হওয়া টিকিটের লভ্যাংশ থেকে খেলোয়াড়দের ট্রান্সফার ফি-এর কমিশনেরও দাবিদার তারা। ক্লাবের নির্বাচনের সময়ে তাদের হস্তক্ষেপ যেমন স্বাভাবিক ঘটনা, তেমনই বারা ব্রাভা-র সদস্যদের নাম জড়িয়ে থাকে অপহরণ, তোলা আদায়, মাদক চোরাচালান থেকে খুনের মতো অপরাধেও। বারা ব্রাভাদের দাপটেই বোকা জুনিয়র্স আর রিভারপ্লেট-এর সুপারক্লাসিকোর উত্তেজনা সেই মহাদেশের সীমানা ছাড়িয়ে নাড়া দেয় সুদূর এশিয়ায় বসে থাকা ফুটবলভক্তকেও।
কোভিড-পরবর্তী দুনিয়ায় বাড়তে থাকা বেকারত্ব, অর্থনৈতিক-সামাজিক বৈষম্যের বিষের সঙ্গে গোদের উপর ফোড়ার মতো এসেছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, ইজরায়েল-প্যালেস্টাইন সমস্যার পুনরাবৃত্তি। এই বীভৎসতা থেকে বাঁচতে আক্রান্ত দেশগুলির বহু পরিবার মূল ইউরোপে আশ্রয় নিচ্ছে। সেই শরণার্থীদের অনেকে প্রতিদিনই কোনও-না-কোনওভাবে বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। উদ্বাস্তুদের সঙ্গে গোটা বিশ্বেই যেরকম ব্যবহার করা হয় আর কি! ইউরোপের এই সামাজিক অস্থিরতার ছাপ পড়ছে খেলার মাঠে। সংকীর্ণ জাতীয়তাবোধ, বর্ণবৈষম্যের সমস্যার সঙ্গে কখনও লেজুড় হচ্ছে হোমোফোবিয়া, কখনও নব্য-নাৎসি ভাবাবেগ। গ্যালারিতে ফ্যাসিস্ট আবেগের বিস্ফোরণে কলঙ্কিত হয়েছে ফুটবল। ১৯০০ সালে প্রতিষ্ঠা পাওয়া লাজিও, ইতালির রাজধানী রোমের ক্লাব হওয়ার দরুন, একনায়ক বেনিতো মুসোলিনির আশীর্বাদধন্য ছিল; স্বাভাবিক ভাবেই লাজিও-র সমর্থকদের একটা বড় অংশ ফ্যাসিস্ট আদর্শের প্রতি এখনও সহানুভূতিশীল। পড়শি ক্লাব এ এস রোমার সঙ্গে ডার্বি হোক বা অন্য দেশে বিপক্ষ ম্যাচ, লাজিও-র গ্যালারিতে তাদের আলট্রা গোষ্ঠী ‘Irreducible’ (ইরেদুচিবলে) আউশভিৎজ বা অ্যান ফ্র্যাঙ্ক-এর স্মৃতিকে ব্যঙ্গ করে নাৎসি ব্যানার, স্বস্তিকা প্রদর্শন করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধাবোধ করে না।
অবশ্য ২০১৯-এ চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ম্যাচ খেলতে গ্লাসগো শহরে গিয়ে সেল্টিক সমর্থকদের থেকে যোগ্য জবাব পেয়েছিল লাজিওর অতি-দক্ষিণপন্থী আলট্রারা। সেই রাতে গ্যালারিতে আবারও ইতিহাসের পুনর্নির্মাণ— সেল্টিক সমর্থকরা মাঠে এনেছিলেন বিশালাকৃতি ব্যানার, স্কেচে মুসোলিনির মৃতদেহ; (দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষের দিকে, ১৯৪৫-এর এপ্রিলে মুসোলিনিকে হত্যা করার পরে জনসমক্ষে তাঁর মৃতদেহ উলটো করে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়— এটা মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য যে, ফ্যাসিস্টদের শেষের সেদিন ঠিক কেমন হবে!) নীচে লাজিও-র কট্টরপন্থী সমর্থকদের উদ্দেশে টিপ্পনী, ‘follow your leader’!
অবশ্য শুধু সমর্থকদের দোষ দিয়ে লাভ নেই, যখন তাদের নায়করাও নিজেরাই মাঠে অখেলোয়াড-সুলভ আচরণ করেন। ২০০৫-এর ডার্বিতে এ এস রোমার বিরুদ্ধে ম্যাচ জেতার পরে লাজিও-র ফুটবলার পাওলো ডি ক্যানিও আবেগে আত্মহারা হয়ে সমর্থকদের অভিনন্দন কুড়োতে গিয়ে সরাসরি রোমান স্যালুট করে বসেন; গোটা বিশ্বের কাছে যা নাৎসি স্যালুট বলেই পরিচিত। ক্যানিও পরে অবশ্য সাফাই দেন, হাতের যে-মুদ্রা তিনি ব্যবহার করেছিলেন তা রোমান সাহিত্য-সংস্কৃতিতে বহুব্যবহৃত, সেটার সঙ্গে নাৎসিদের কোনও যোগ নেই। এক ম্যাচ সাসপেনশন, ১০,০০০ ইউরো জরিমানা হয়েছিল ক্যানিওর। তাতেও তাঁকে দমায় কে! বিতর্ক তাঁর ছায়াসঙ্গী, কোনও রাখঢাক না রেখেই বলেছিলেন, ‘I am a fascist, not a racist.’
লাজিও কোনও বিচ্ছিন্ন দৃষ্টান্ত নয়। জেনিট সেন্ট পিটার্সবার্গ ক্লাবের দীক্ষিত সমর্থককুল ‘Landscrona’ (ল্যান্ডস্ক্রোনা) ক্লাবকে লেখা খোলা চিঠিতে অনুরোধ করেছিল কোনও কৃষ্ণাঙ্গ বা সমকামী ফুটবলারকে যেন ক্লাব কর্তৃপক্ষ সই না করায়। ইন্টার মিলান-এর ফরোয়ার্ড রোমেলু লুকাকু তাঁর নিজের দলেরই আলট্রা গোষ্ঠী ‘Curva Nord’ (কুর্ভা নর্দ) এর কাছে বর্ণবিদ্বেষের শিকার হয়েছেন; তাঁর দোষ এটুকুই যে তিনি কৃষ্ণাঙ্গ! তুরস্কের গালাতাসারে বনাম ফেনেরবাচে, ইতালিতে রোমান ডার্বি থেকে এসি মিলান বনাম ইন্টার, বা দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপের সার্বিয়ায় রেড স্টার বেলগ্রেড বনাম পার্টিজান বেলগ্রেড-এর রক্তক্ষয়ী লড়াই ফুটবলকে আর পাঁচটা খেলার থেকে আলাদা করেছে। গোটা বিশ্বে এমন একটা ফুটবল মরশুম পাওয়া কঠিন যেখানে সমর্থকদের মধ্যে মারামারিতে কেউ আহত হননি, বা প্রাণ হারাননি। এত আঁধারের বিপরীতে কিছু আলোও দেখা যায়: ইজরায়েল-এর ক্লাব হপিয়েল তেল আভিভ-এর মুখ শহরের শ্রমিকশ্রেণি, ক্লাবের প্রতীকও অবধারিতভাবেই কাস্তে-হাতুড়ি! তাদের সমর্থকরা মাঠে যে-নিশান ওড়ান, তাতে একই ফ্রেমে ধরা দেন মার্ক্স, গান্ধী ও চে গেভারা। জার্মানির সেন্ট পাওলি ক্লাবের সমর্থকরা গ্যালারিতে সাজানো ব্যানার আর সম্মিলিত আওয়াজে জানিয়ে দেন যে তাঁদের মাঠে কোনও ধরনের বৈষম্য তাঁরা সহ্য করবেন না। সেখানে ফুটবলের মাচো আবহে সমকামীরা যেমন স্বাগত, তেমনই স্বাগত উদ্বাস্তুরাও। ইউরোপের বাড়তে থাকা উদ্বাস্তু সমস্যা অন্তত তাঁদের কাছে কোনও সমস্যা নয়।
সাধারণ সমর্থককুলের পাশাপাশি বিউটিফুল গেম ভোট পেয়েছে বিখ্যাত ব্যক্তিত্বদেরও। মার্ক্সবাদী দার্শনিক আন্তোনিও গ্রামশি নিজে ফুটবলপাগল ছিলেন; কাগজে থিয়েটার সমালোচনার পাশাপাশি মাঝেমধ্যে ফুটবল ম্যাচের ম্যাচ-রিপোর্টও লিখতেন তিনি। তাঁর শহরে এ এস লিভর্নো-র সমর্থকদের সিংহভাগই যে বামপন্থার দিকে ঝুঁকে থাকবে তা আন্দাজ করতে অসুবিধে হয় না। আলব্যের কামু নিজে খেলতেন গোলকিপার পজিশনে। স্পষ্ট জানিয়েছিলেন তাঁর জীবনের ‘দুই বিশ্ববিদ্যালয়’ থিয়েটার আর ফুটবলের মাঠ। কামু সাহিত্যে নোবেল পাওয়ার পর তাঁর প্রথম সাক্ষাৎকার কোনও স্টুডিয়োতে নয়, হয়েছিল ৩৫,০০০ দর্শকের মাঝে পার্ক দে প্রিন্সেস স্টেডিয়ামে— সেখানে খেলা দেখছিলেন তিনি। সে-সময়ে মাঠে উপস্থিত সাধারণ সমর্থকদের সঙ্গে নোবেলজয়ীও মিলেমিশে একাকার; তখন তাঁর পরিচয় শুধুই এক ফুটবল সমর্থকের।
ফুটবল নিয়ে গ্রামশির পর্যবেক্ষণ ছিল— ‘It demands initiative, competition and conflict. But it is regulated by the unwritten rule of fair play.’ আবারও সেই বহুব্যবহৃত শব্দ— ফেয়ার প্লে! আজকের সমাজে দিন-আনি-দিন-খাই মানুষের দৈনন্দিনতায় সেটার দেখা পাওয়ার জন্য হয়তো দূরবিন লাগবে। কিন্তু মাঠের নব্বই মিনিট আমাদের জীবনের অ-প্রাপ্তিগুলো পিছনের সারিতে চলে যায়, তখন সমবেত আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিনিধিত্ব করেন ফুটবলাররা। সবুজ ঘাসের আধুনিক কলোসিয়ামে কোনও ভেদাভেদ, কোনও বৈষম্য স্থান পায় না। গ্যালারিতে উপস্থিত ‘টুয়েলভ্থ ম্যান’ সমর্থকদের ভরসাতেই লিগ টেবিলের তলানিতে থাকা ছোট দলও বড় ক্লাবের বিরুদ্ধে জোরদার ফাইট দেয়; তাদের সমর্থকরাও ফেয়ার প্লে-র উপর ভরসা রেখেই মাঠ ভরান, তাঁদের সমবেত অবদানেই বহু সময় ডেভিড গোলিয়াথকে মাটিতে আছড়ে ফেলে। এটুকুই আশা যে, সবুজ ঘাসের এই চালচিত্র হয়তো শিগগিরই বদলাবে না, ‘জনতার খেলা’ ফুটবল মাঠেই সাধারণ মানুষ ফেয়ার প্লে নিয়ে বেঁচে আছেন, আগামীতেও থাকবেন।
ছবি: সংগৃহীত