পবিত্র খুনি
যখন একটা ছবিতে সিরিয়াল-কিলার পর পর মেয়েদের খুন করে চলেছে, আর একজন মহিলা সাংবাদিক তার খোঁজ করে চলেছে, এবং অপদার্থ পুলিশ কিচ্ছুই কিনারা করতে পারছে না, তখন আমরা জানিই যে এক সময়ে মহিলার সঙ্গে খুনির দেখা হবে এবং মহিলাকে খুন করার চেষ্টা হবে। মহিলা জিততে পারবে কি না, এই হল সাসপেন্স। কিন্তু আলি আব্বাসি পরিচালিত ছবি ‘হোলি স্পাইডার’ (চিত্রনাট্য: আলি আব্বাসি, আফশিন কামরান বাহরামি, ২০২২) এটাকে ছবির শেষ হিসেবে ধরেই না, বরং একটা মধ্যবিন্দু হিসেবে ধরে। এই বিশেষত্বই এটাকে একটা আশ্চর্য ছবিতে রূপান্তরিত করেছে, থ্রিলারের বদলে এটা হয়ে উঠেছে এক দুরন্ত সামাজিক ছবি। গল্পটা তৈরি করা হয়েছে সত্যি ঘটনা অবলম্বনে, ২০০০ থেকে ২০০১ সালের মধ্যে ইরানের মাশাদ শহরে একটা লোক রাস্তা থেকে বেশ্যা তুলে নিয়ে গিয়ে খুন করত এবং এভাবে ১৬টা খুন করেছিল, তারপর ধরা পড়ে। এখানেও একজন খুনিকে দেখানো হয় যে তা-ই করছে, কিন্তু বহু কল্পিত ব্যাপারস্যাপারও জুড়ে দেওয়া হয়, যেমন একজন অন্য শহর থেকে আসা মহিলা সাংবাদিকের চরিত্র আমদানি করা হয়, যে এই ঘটনাটার প্রায় তদন্ত করতেই নেমে পড়েছে। লোকটা রাত্রে বাইকে চড়ে মাশাদ শহরের পবিত্র সমধির আশেপাশে দাঁড়িয়ে থাকা কোনও বেশ্যাকে বলে ‘চলো’, তারপর তাকে বাড়িতে নিয়ে গিয়ে গলায় ফাঁস দিয়ে খুন করে, তারপর তার দেহ কোথাও ফেলে দিয়ে, এক সাংবাদিককে ফোন করে বলে দেয় মৃতদেহটা কোথায় পাওয়া যাবে। মিডিয়া এই খুনির নাম দিয়েছে ‘স্পাইডার’। প্রথমে একটু গোপনে রাখলেও, একটু পর থেকেই ছবিতে তাকে দেখানো হয়, সে একজন সাধারণ গৃহস্থই, রাজমিস্ত্রি হিসেবে কাজ করে, তার বউ আছে সন্তান আছে, সে বাচ্চার সঙ্গে খ্যালে, আবার বন্ধুরাও (তার সঙ্গে এককালে যুদ্ধে গিয়েছিল) তাকে ভালবাসে। সাধারণ জীবন, সাধারণ ব্যবহার (যদিও ইদানীং একটু বেশি নার্ভাস আর রোগা হয়ে যাচ্ছে), শুধু বাড়ি ফাঁকা থাকলে সে একজন করে যৌনকর্মী মেয়ে এনে খুন করে, কিন্তু কোনও শারীরিক সঙ্গ করে না, প্রত্যেকবার বাইকে তোলার সময়ে সে মেয়েটাকে বলে ‘ঠিক করে বোসো’, যাতে কোনও অবাঞ্ছিত শারীরিক স্পর্শ সে না পায়। একবার এক বেশ্যা তাকে জড়িয়ে তার গাল চেটে দেওয়ার ফলে সে তাড়াতাড়ি বাথরুমে গিয়ে দাড়িটা সাবান দিয়ে ধোয় এবং বারে বারে ঈশ্বরের কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা করে, তারপর এসে মেয়েটাকে গলা টিপে খুন করে। সে খুন করে কেন? কারণ এভাবে সে দেশের পাপ দূর করতে চায়। যারা এত অপবিত্র যে, মেয়ে হয়ে বহু পুরুষের সঙ্গ করে, তাদের খুন করে সে শিক্ষা দিতে চায়। সে পুণ্যের কারবারি। ঈশ্বরের সহকারী। সংস্কারের কান্ডারি। এবং সত্যিই বহু লোক তাদের মেয়েদের বলে দিয়েছে, রাত হলে একেবারে বাইরে বেরোবি না। এতে কি সমাজের মঙ্গলই হচ্ছে না?
মেয়ে-সাংবাদিকটির নাম আছে খুব, দুর্নাম বললেও অত্যুক্তি হয় না। প্রথমত সে তার লেখায় সরকারের নিন্দে করে, তার ওপর এও বোঝা যায় সে ধর্মান্ধদের সমালোচনা করতে ভালবাসে। তাই পুলিশ থেকে সরকারি মাতব্বর, সকলেই তার সঙ্গে তেতো ও কর্কশ কথা বলে। ধর্মকর্তা তাকে বলে, সে যে বিশাল চাদরে নিজেকে ঢেকেঢুকে এখানে দেখা করতে এসেছে, তাতে সে কোনও ধাপ্পাই দিতে পারবে না। কিন্তু মেয়েটি দমে যাওয়ার পাত্রীই নয়, সে তেজি ও কাজসর্বস্ব। মুশকিল হল, সে সুন্দরীও বটে। ফলে পুলিশকর্তা একদিন তার সঙ্গে এমনিই দেখা করতে চায়, বলে, উর্দি পরে থাকলেও তার ভেতরটা খুব নরম। মেয়েটিকে তার কাগজের সম্পাদকও আলাদা করে ডেকে পাঠিয়েছিলেন, মেয়েটি কু-মতলব বুঝে যায়নি, তাই তাকে চাকরি থেকে ছাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল, সে-দুর্নামও মেয়েটির গায়েই এসে লেগেছে। সে সিগারেট অবধি খায়। তাই পুলিশকর্তা যখন হোটেলের ঘরে এসে তার সঙ্গে কথা বলার ও ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করে এবং সে যখন বলে ‘বেরিয়ে যান’, তখন পুলিশ কাছ ঘেঁষে এসে জানতে চায়, না গেলে কী করবি? পুলিশ ডাকবি? তারপর একেবারে গালে মুখ ঠেকিয়ে বলে, যে মেয়েছেলে অনেক পুরুষের সঙ্গে সিগারেট খায়, অনেক পুরুষের সঙ্গে মেশে, সেই সস্তা মেয়েদের সে ছুঁয়েও দ্যাখে না। মাশাদ শহরে এসে রিজার্ভ করে রাখা হোটেলের ঘরও সে পাচ্ছিল না, কারণ রিসেপশনের লোকেরা গুজগুজ করে ঠিক করেছিল, একজন অবিবাহিতা মেয়েকে একটা ঘর দেওয়া ঠিক নয়। পরে সাংবাদিকের কার্ড দেখে তারা রাজি হয়। একজন মৃতা বেশ্যার মায়ের সঙ্গে এই সাংবাদিক যখন দেখা করতে যায়, মা বলে, পুলিশের ওপর তার কোনও ভরসা নেই, কারণ পুলিশ তো এই খুনিকে সমর্থনই করবে, কারণ সে তো বেশ্যাদের মেরে সাফ করছে, সমাজের জঞ্জাল পরিষ্কার করছে। তখন সাংবাদিকটির চোখ একবার জ্বলে ওঠে, কারণ এই তীব্র নারীবিরোধী সমাজকে সেও কিছু কম চেনে না।
এই সাংবাদিক যে শেষে নিজেকে টোপ হিসেবে ব্যবহার করবে, রাতে বেশ্যা সেজে ওই অঞ্চলের আশেপাশে ঘোরাঘুরি করবে, এ তো আমরা আন্দাজ করেইছিলাম। এবং ঠিকই, এক রাত্রে খুনি এসে তাকে বাইকে তোলে। বাইকটাকে গাড়ি করে অনুসরণ করার কথা ছিল মেয়েটির সহকারী সাংবাদিকের, কিন্তু গলিঘুঁজির মধ্যে সেই লোকটা বাইকটাকে হারিয়ে ফ্যালে। শেষ খুনের পর লাশ বয়ে নিয়ে যাওয়ার সময়ে খুনি হাতে একটা চোট পেয়েছিল, সাংবাদিক-মেয়েটির গলা টিপে ধরার সময়ে তাই সে একটু কমজোরি, তার ওপর মেয়েটি সেই ব্যান্ডেজ-বাঁধা হাতে মরিয়া আঘাত করে, ফলে খুনি ধস্তাধস্তিতে হেরে যায়, মেয়েটি নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়, এবং তারপর চিৎকার শুরু করতেই খুনি কেমন গুটিয়ে যায়, বলে, চেঁচিও না চেঁচিও না, আমার একটা পরিবার আছে। মেয়েটি তার ছুরি বের করে লোকটিকে শাসায়, বলে নিজেকে বাথরুমে বন্ধ করো, তারপর পালায়। লোকটি তারপর ধরা পড়ে (মেয়েটি পোশাকের মধ্যে লুকিয়ে একটা টেপরেকর্ডারও এনেছিল)। ফলে মেয়ে-সাংবাদিকের জয় ও খুনির পরাজয়, শুভের জয় ও অশুভের পরাজয়, তদন্তের জয় ও অমীমাংসিত রহস্যের পরাজয় ঘোষিত হয়। কিন্তু ছবি মোটে শেষ হয় না। সত্যি বলতে, ছবি এবারেই শুরু হয়। খুনির ছেলে দোকানে জিনিসপত্র আনতে যেতে দোকানি তাকে বলে, যা খুশি নিয়ে যাও, তোমার মা’কে বোলো যখন ইচ্ছে এসে জিনিস নিয়ে যেতে, কারণ তোমার বাবা আমাদের জন্য যা করেছেন, তার তুলনা হয় না। খুনির বন্ধুরা বাড়ি বয়ে এসে-এসে গাদা-গাদা খাবার ও প্রয়োজনীয় জিনিস দিয়ে যায়, বলে, আমরা প্রাক্তন যোদ্ধা, আমাদের কথা সবাই শোনে, আমরা পিটিশন সই করা শুরু করেছি, ওর কিচ্ছু হবে না, ও ছাড়া পাবেই। সহ-কয়েদিরা খুনিকে বলে, আমরা তোমার জন্য গর্বিত। আদালতের সামনে বিরাট ভিড় জমে যায়, লোকজন একযোগে জোর স্লোগান দিতে থাকে, ও নির্দোষ, ওকে ছেড়ে দাও। অর্থাৎ, যে-লোকটা ১৬টা মেয়েকে খুন করেছে, তাকে অপরাধী নয়, অবমানব নয়, একজন ত্রাতা, একজন সংস্কারক, একজন সাহসী স্পর্ধিত মসিহা হিসেবে দেখা শুরু হতে থাকে। কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে সে যখন কথা বলে, আদালতে উপস্থিত লোকেরা তাতে বার বার সায় দেয়, তার হাসির কথায় হাসে। সে একজন নায়ক বনে যায়। তার উকিল যখন বলে, আমরা বলব তোমার মাথা একটু-আধটু খারাপ, সে আদালতে দাঁড়িয়ে সে-কথা মান্য করে না, বলে আমি পাগল বটে, কিন্তু ঈশ্বরের জন্য পাগল, তাঁর পুরোহিতের জন্য পাগল। বউকে সে বলে, আমি যদি নিজেকে পাগল বলি, আমার সমর্থকেরা কী ভাববে?
মহিলা-সাংবাদিক এই ঘটনা নিয়ে আরও অনেকের ইন্টারভিউ নিচ্ছিল, তার সহকারী ক্যামেরায় তা রেকর্ড করছিল। তারা যখন খুনির বউয়ের কাছে যায়, বউ বলে, যে-মেয়েরা অন্যের স্বামীকে ফুঁসলে নিচ্ছিল, আমার স্বামী তাদের মেরে সমাজের ময়লা সাফ করছিল। যে-মেয়েরা ছোট জ্যাকেট পরে, চুয়িংগাম চিবোয়, রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকে (কামনার পসরা নিয়ে), তারা স্বাভাবিক কাজ করে না। মহিলা-সাংবাদিক শেষে জেলখানায় গিয়ে খুনির মুখোমুখি বসে, খুনি বলে তার এ-কাজে কোনও ব্যক্তিগত আনন্দ হত না, সে শুধু সমাজ পরিষ্কার করার জন্যে এই কাণ্ড করত। কথাটা অবশ্য মিথ্যে, কারণ আমরা দেখেছি একটি মৃতদেহের শরীর ভোগ করার জন্য সে কেমন আকুল হয়ে উঠেছিল, আর একবার একটি বেশ্যার মৃতদেহ কার্পেটে জড়িয়ে যখন ঘরের কোণে রাখা আছে (কারণ তার বউ আচমকা এসে পড়েছে না বলেকয়ে বাপের বাড়ি থেকে), সেই দেহটির একটা পা বেরিয়ে আছে দেখে তার উত্তেজনা ফুঁসে ওঠে ও বউয়ের সঙ্গে সঙ্গমের গতি ও দাপট বাড়ে। মহিলা সাংবাদিককে সে এও বলে, তার কোনও অনুশোচনা নেই। আফশোস একটাই, সে তার কাজ সম্পূর্ণ করতে পারল না। সে প্রায় ২০০জন বেশ্যাকে দেখেছে ওখানে ঘোরাফেরা করতে (আর মারতে পেরেছে মাত্র ১৬জনকে)। যখন আদালতের রায় বেরোবে, সবাই দেখতে পাবে দৈব হস্তক্ষেপ। যদিও যে-ঈশ্বরের প্রতি তার এত নিবেদন ও ভরসা, তিনি শেষ অবধি তাকে বাঁচান না। এমনকী যে-কর্তৃপক্ষের পান্ডা এসে তাকে বলে যায়, যখন ফাঁসি দিতে নিয়ে যাওয়া হবে, একটা গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকবে, যাতে চড়ে সে পালিয়ে যেতে পারবে— সেও মিথ্যে কথাই বলে। এবং শেষে তাকে তড়পে মরতে হয় সেই টুঁটি-টিপে হত্যা করা বেশ্যাদের মতোই, ফাঁসির দড়ির চাপে ছটফটিয়ে দম বেরিয়ে। কিন্তু শহর ছেড়ে যাওয়ার সময়ে মহিলা-সাংবাদিক বাসের সিটে বসে নিজের ভিডিও ক্যামেরায় খুনির ছেলের সাক্ষাৎকার দেখতে থাকেন, যেখানে ছেলেটি গর্বিত ও সহাস্য মুখে বর্ণনা দিচ্ছে, কেমন করে তার বাবা খারাপ মেয়েদের বাড়িতে এনে তাদের গলা টিপে ধরত এবং তাদের নিকেশ করত, আর তারপর কার্পেটে জড়িয়ে তাদের দেহ পাচার করত অন্যত্র। আর সেই ডেমনস্ট্রেশনে সাহায্য করার জন্য ডেকে নিচ্ছে তার ছোটবোনকে, যে নিগৃহীতা মেয়ে সেজে খুশি হচ্ছে।
ছবিটায় পরিচালক বাজিমাত করেন স্রেফ এই ভাবনার দৌলতেই: একটা খুনিকে দেখাবার সমান গুরুত্বপূর্ণ— তার সমর্থক একটা সমাজকে দেখানো। বোঝানো: এতগুলো লোক নিশ্চিত, এই খুনি অবশ্যই একটা প্রয়োজনীয়, কল্যাণকর ও পবিত্র কাজ করেছে। ফলে ছবির ভিলেন এই খুনি শুধু নয়, সঙ্গে একটা গোটা নারীবিদ্বেষী সমাজ। যারা নারীকে পরাধীন রেখে, নিগ্রহ করে, ভোগ করে, অপমান করে আনন্দ পায়। যারা মনে করে তাদের মতানুযায়ী নারী না চললে, তার প্রতি হিংস্র আচরণ করা যায়, অশালীন ব্যবহার করা যায়, এমনকী গলায় থাবা বসিয়ে তার প্রাণও হরণ করা যায়। খুনির বউ এক সময়ে বলে, এই পরিবারে একজন শহিদ আছেন, তাছাড়া আমার স্বামী যুদ্ধে গেছে। মানে, এমন এক ঐতিহ্য থেকেই তো এক বেপরোয়া সংস্কারক তৈরি হয়। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে একটা সমাজের অধিকাংশ লোক যখন নারীকে শৃঙ্খলিত রাখায় বিশ্বাসী, যখন একজন হন্তারক মর্যাদা পায় পবিত্র জমাদারের, তখন সেই সমাজে একটা খুনি ফাঁসি গেলেও বহু অনুপ্রাণিত ও গর্বিত খুনি জন্মানোর সম্ভাবনা উর্বর থাকে। তার সন্তান লজ্জায় মাথা না নামিয়ে যখন অহংকার ও তৃপ্তির সঙ্গে নিজের বাবার হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা দেয়, তখন বোঝা যায়, মহিলা-সাংবাদিক এই নির্দিষ্ট ঘটনার ক্ষেত্রে জিতে গেলেও, বৃহত্তর সংগ্রামে গো-হারান হেরে বসে আছে। যে-খুনির অনুশোচনা নেই, যে-সন্তানের কুণ্ঠা নেই, যে-সমাজের আত্মসমীক্ষা নেই, সেখানে মাকড়সার জাল আপাতত ছিঁড়ে গেলেও, চোখের পলকে নতুন ও নিখুঁতভাবে নির্মিত হবে।