মশলার সাতসমুদ্র

গুজরাট ও সিন্ধুর উপকূলবর্তী এলাকায় সমুদ্রের ধারে এক পাহাড়ের উপর ছিল হরসিদ্ধি মাতা নামে এক দেবীর বাসস্থান। সমুদ্রে চলমান যত জাহাজ, তাঁর দৃষ্টিগোচর হত। সেই জাহাজের নাবিকদের মধ্যে কেউ কেউ তাঁর মন্দিরটি দেখতে পেয়েও প্রণাম না জানালে, ভয়ানক কুদৃষ্টি হেনে তিনি তাদের জাহাজ দিতেন ডুবিয়ে। অতঃপর তাঁর অসীম ক্ষমতার কথা জানতে পেরে, নাবিকেরা মন্দিরে গিয়ে তাঁর কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা করে আসেন। দেবীর নাম ওঁরা রাখে বহনাবতী মাতা— যাঁর কৃপায় জাহাজ চলতে সক্ষম হয়। 

এই নাবিকেরা প্রচুর অর্ঘ্য দান করে দেবীর কাছে প্রার্থনা জানায়, তাঁর মন্দিরটি যেন পাহাড়ের উপর থেকে নীচের মাটিতে নামিয়ে আনা হয়। যাতে তাঁর রোষে আর জাহাজডুবি না হয়, সে জন্যেই এই ব্যবস্থা। রাজি হয়ে গেলেন দেবী, তবে একটি শর্তে: পাহাড় থেকে সমতলে মন্দিরটি নামিয়ে আনার রাস্তায়, প্রত্যেক পদক্ষেপে তাঁর নামে বলি দিতে হবে মোষ। নাবিকেরা এই দাবি মেনে নেয়। দেবী এভাবেই নেমে আসেন সমুদ্রের ধারে পাহাড়টির চূড়া থেকে নীচের জমির মন্দিরে।

আজও দেবীর নামে উৎসর্গ করা হয় ছাগল— আরব সাগরের নাবিক-সমাজের সঙ্গে তাঁর সেই প্রাচীন সম্পর্কের স্মারক হিসেবে। আরব এবং আফ্রিকার বণিকদের সাথে এই নাবিকেরা মশলার ব্যবসা করতেন। ‘সিকোতর মাতা’ নামে এই দেবীকে কখনও কখনও ভূষিত করা হয়, সেই নামের মূলে হয়তো আছে বিপজ্জনক তটভূমির জন্যে কুখ্যাত ইয়েমেন দেশের সোকোত্রা দ্বীপ। আবার ‘সিকোতর’ শব্দটি ‘সুখধরা’ (অর্থাৎ ‘সুখ দেয় যা’) থেকেও আসতে পারে।

‘এরিথ্রিয়ান সাগরের পেরিপ্লুস’ নামে একটি দু’হাজার বছরের পুরনো গ্রিক পুঁথি থেকে জানা যায়, সে সময়ে ভারতবর্ষের উপকূলবর্তী অঞ্চলে ছিল ব্যবসা-বাণিজ্যের রমরমা। লোহিত সাগর থেকে হর্ন অফ আফ্রিকা হয়ে আরব এবং ভারতের পশ্চিম উপকূল পর্যন্ত বাণিজ্যের খবর আছে এই পুঁথিতে, আছে চের ও পাণ্ড্য রাজ্যশাসিত ভারুচ অঞ্চলের সঙ্গে বাণিজ্যের কথা। কিন্তু প্রত্নতাত্ত্বিকেরা বলেন, তারও আগে, অন্তত চার হাজার বছর আগে, হরপ্পার শহরগুলো থেকে উপকূল ধরে পারস্য উপসাগর দিয়ে সুমেরীয় সভ্যতা (আধুনিক ইরাক) পর্যন্ত বাণিজ্যে যেত খাগড়ার (reed) জাহাজ। আক্কাডিয়ান সাম্রাজ্যের বাসিন্দাদের কাছে সিন্ধু নদীর পারের দেশটি বিখ্যাত ছিল পুঁতি, তিলের তেল, মুরগি, কুকুর এবং মোষের জন্য। অবশ্য তাঁরা এ দেশটিকে চিনতেন মেলুহা নামে। হরপ্পা সভ্যতার পতনের পরেও এই বাণিজ্য অব্যাহত থেকেছে। মিশরের তিন হাজার বছরের পুরনো মমিতে পাওয়া গেছে কেরলের গোলমরিচ।

কোঙ্কন উপকূলের শিলহর এবং কাদম্ব রাজাদের শিলালিপিতে পাওয়া যায়, প্রায় হাজার বছর আগেকার ভারতীয় জাহাজের খবর। মুম্বই শহরের বোরিভলিতে একসর শিলায় রয়েছে নৌযুদ্ধের প্রতিকৃতি। কিন্তু এই সময়ের পর থেকেই শুরু হল সমুদ্রভ্রমণে ‘জাত যাওয়া’র ব্রাহ্মণ্যবাদী ফতোয়ার বাড়বাড়ন্ত। ধর্মশাস্ত্রে প্রথম এই ভয়ানক ‘কালাপানি’ নিয়মের উল্লেখ পাওয়া যায়। এ ফতোয়ার ফলে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হলেন সেইসব বণিক, যাঁরা জলপথে বাণিজ্য করতেন, বিশেষ করে বৌদ্ধ বণিকেরা, যাঁদের টাকায় কোঙ্কন উপকূলে বহু বৌদ্ধ গুহামন্দির তৈরি হয়েছে। উনবিংশ শতাব্দীতে এই নিয়মের কড়াকড়ি শেষ পর্যন্ত খানিকটা কমে, কারণ তখন ভারতের বহু মানুষ বিদেশ যেতে শুরু করেন। প্রথমদিকে ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জে চুক্তিবদ্ধ মজুর হিসেবে, পরে লন্ডনে ব্যারিস্টারি পড়তে পরিযায়ী হন ভারতের মানুষ। আরও পরে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের হয়ে নানা আন্তর্জাতিক যুদ্ধে লড়ার জন্য ভারতীয় সেনাদের সমুদ্র পার করে বিভিন্ন দেশে নিয়ে যাওয়াটাও দরকারি হয়ে পড়ে। 

ভারতের সামুদ্রিক ইতিহাস নিয়ে আমরা খুব বেশি জানতে পারি না, কারণ বিগত হাজার বছর ভারতে সামুদ্রিক বাণিজ্যের কাজটা আসলে সম্পন্ন করেছেন ভিনদেশি জাতিরা। এ বিষয়ে প্রথমদিকে দাপট ছিল আরবদের; পালে মৌসুমী বায়ুর সাহায্য নিয়ে তাঁরা ভারতে এসে মশলার ব্যবসা করেছেন। ভারতীয় উপকূলে এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় এই আরবদের হাত ধরেই ইসলাম ধর্মের প্রচার। মুসলমান জগতে আরবেরাই বাণিজ্যের জোরে নিয়ে আসেন জগতের ধনসম্পদ, ৭০০ থেকে ১৭০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বিশ্ব-রাজনীতিতে তাঁদেরই ছিল আধিপত্য।

ইসলামিক জগতের এই সম্পদের মূলে যে রয়েছে মশলার ব্যবসা, তা টের পান ইউরোপীয়রা। যেহেতু রেশম পথের (silk route) কর্তৃত্ব ছিল মুসলমানদের হাতে, এই সম্পদ থেকে ইউরোপীয়রা ছিলেন বঞ্চিত। খানিকটা এই কারণেই পঞ্চদশ শতাব্দীতে স্পেনীয় এবং পর্তুগিজেরা রেশম-পথকে এড়িয়ে বাণিজ্য করার তাগিদে নতুন সামুদ্রিক পথ খুঁজতে শুরু করেন। আফ্রিকার ‘কেপ অফ গুড হোপ’-এর ধার দিয়ে এই নতুন পথের হদিশ তাঁরা পান, আর পশ্চিম আফ্রিকায় তাঁদের আয়ত্তে আসে মৌসুমী বায়ুর খবর, যার সাহায্যে তাঁরা পৌঁছে যান কালিকট বন্দর।

এই অভিযানের তাগিদটা পুরোপুরি অর্থনৈতিক ছিল না, পর্তুগালের রাজারা তখন মরিয়া হয়ে সন্ধান করছেন প্রাচ্যে নতুন খ্রিস্টান রাজত্বের। ক্রুসেডের (Crusades) যুদ্ধে তাঁদের কানে এসেছিল প্রেস্টার জনের নেতৃত্বে ভারতে এক বিরাট খ্রিস্টান সাম্রাজ্যের কিংবদন্তি। তাঁরা আশা করেছিলেন, এই সাম্রাজ্যের সাহায্যে খ্রিস্টানেরা পূর্ব এবং পশ্চিম দিক থেকে সম্মিলিত ভাবে মুসলমানদের আক্রমণ করে তাঁদের হাত থেকে কেড়ে নেবেন ইজরায়েলের পবিত্র ভূমি। বলা বাহুল্য, এ আশা সত্যি হয় নি, কিন্তু রাজনীতি আর অর্থনীতির মতোই রূপকথাও যে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রসারের পিছনে কারণ হয়ে উঠতে পারে, প্রেস্টার জনের কিংবদন্তি আমাদের সেই শিক্ষা দেয়। 

Read in English